মু জ না ই
অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩০
সম্পাদকের কথা
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের যুগ পার করে আমরা যে গ্লোবাল বয়েলিংয়ের সময়ে পা রেখেছি তার স্পষ্ট প্রমাণ এবারের অগ্রহায়ণ। আবহাওয়া দপ্তরের কথা অনুযায়ী, এই বছর উষ্ণতম অগ্রহায়ণ চলছে। শীতের সেই হিমেল পরশ একেবারেই অনুপস্থিত। পরিবর্তে এখনও কোথাও কোথাও বৈদ্যুতিক পাখা চালাতে হচ্ছে। রাতের দিকে তাপমাত্রার সামান্য পতন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই সময়ে আরও বেশি ঠাণ্ডা প্রত্যাশিত। আসলে এই সবই সভ্যতার অভিশাপ। প্রকৃতি প্রত্যাঘাত শুরু করেছে। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে চিরচেনা সেই আবহাওয়া। তবু আমাদের শিক্ষা নেই। উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক ঘটনাও প্রমাণ করল তথাকথিত উন্নয়নের সুড়ঙ্গ আদতে বিপদের পথকেই প্রশস্ত করছে। কুর্নিশ সেই সব খননকারীদের, যাঁদের হাত ধরে রক্ষা পেলেন আমার আপনার প্রিয়জনেরা। কুর্নিশ এই বিশ্বের তাবড় নেতাদেরও যাঁরা প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েল নিয়ে মুখ বন্ধ করে তামাশা দেখছেন। শিশু নিধন দেখেও যাঁরা কথা বলতে পারেন না, তাঁদের আর কী বলা! সব কিছু মিলেই এক অদ্ভুত আঁধার। পুরোনো বছরের শেষ মাস তাই করছে হতাশ!
মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩০
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
প্রকাশক- রীনা সাহা
প্রচ্ছদ ছবি - বাবুল মল্লিক
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩০
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
ত্রিদিবেশ রায়, উমেশ শর্মা, বেলা দে, দীপায়ন ভট্টাচার্য,
অমলকৃষ্ণ রায়, গৌতমেন্দু নন্দী, ইন্দ্রানী বন্দোপাধ্যায়,
আবদুস সালাম, চিত্র পাল, স্বপন দত্ত,
বাসব বন্দোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেন, উৎপলেন্দু পাল,
দেবর্ষি সরকার, লীনা রায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়,
শ্রাবণী সেনগুপ্ত, রীনা মজুমদার, দেবদত্তা লাহিড়ী,
অভিজিৎ সরকার, প্রতিভা পাল, মজনু মিয়া,
অলকানন্দা দে, সুমন্ত সরকার, বিনয় বর্মন,
অর্পিতা মুখার্জি চক্রবর্তী, মিঠু অধিকারী, সঞ্জয় এস সাহা,
জয়িতা সরকার, মনোমিতা চক্রবর্তী, বটু কৃষ্ণ হালদার,
নিতাই দে, চৈতন্য দাস, সোম শুভ্র চক্রবর্তী
টিপ্পনি
কেন মানবাধিকার আন্দোলন
ত্রিদিবেশ রায়
মানুষের বেঁচে থাকার ও সুরক্ষিত হবার অধিকারকে মানবাধিকার বলা যায়। মানবাধিকার বলতে নৈতিক নীতি ও নিয়ম যা মানব আচরণের নির্দিষ্ট মানকে বোঝায় এবং স্বাভাবিক আইনি অধিকার হিসাবে সুরক্ষিত থাকে।
ভারতের সংবিধান রচয়িতারা প্রথম থেকেই ভারতের নাগরিকদের অধিকার তথা মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তবুও ভারতের নাগরিকদের মানবাধিকারগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ভারতীয় সংসদ জাতীয় ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং মানবাধিকার আদালত গঠনের জন্য আইন পাস করে।
একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, স্বাভাবিক অধিকারের তত্ব অনুযায়ী মানবজাতি জন্মসুত্রেই কয়েকটি অধিকার লাভ করে যেগুলি থেকে তাকে বঞ্চিত করা যায় না। বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে সেখানেই ভারতের প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা গেছে এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও ভারতে মানবিক অধিকারকে স্বীকৃতি ও সুরক্ষা দিতে দেখা গেছে। কিন্তু তার সংখ্যা খুব বেশি নয়।
সুতরাং একথা বলা যায় যে, সংবিধান প্রদত্ত আইন ও আইনসভা প্রণীত আইনের মাধ্যমে অন্যান্য অধিকারের পাশাপাশি মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
সাম্প্রতিককালে কালে মানবাধিকার ও মানবাধিকার আন্দোলন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। একদল তাত্ত্বিক মনে করেন যে, মানবাধিকার আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা উচিত। আবার আরেকদল মনে করেন, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন বিকাশ ও তার শর্ত হিসেবে মানবাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে কাজ করবে। মানুষের যে তিনটি স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে সেগুলির মধ্যে বাঁচার অধিকার, সম্পতির অধিকার, সুরক্ষার অধিকার- এই তিনটি মানবাধিকারের অংশ একথা অনস্বিকার্য। মানুষের এই ভিত্তিগত অধিকারগুলি প্রায়ই বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় কারণে যখন অবহেলিত হয় তখনই শুরু হয় মানবাধিকার আন্দোলন।
সময়ের কথা
নির্লিপ্ত শৈশব
বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়
ইরাক আমেরিকার বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায় ২০০৩ সালে। ডিসেম্বরের তেরো তারিখে রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন গ্রেপ্তার হবার পর বিক্ষিপ্ত ভাবে চলছিল অরাজকতা। কট্টর মৌলবাদী রাজদ্রোহীদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছিল কুর্দিশ, নিরুপেক্ষ ইরাকি ও আমেরিকান সৈন্যদল। ২০০৫ সালে ইরাকের সংসদীয় নিবাচন শেষ হতেই শুরু হয় প্রবল গৃহযুদ্ধ। ৩০ শে ডিসেম্বর ২০০৬, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড সম্পন্ন হবার পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্বাবধানে চতুর্দিকে পুনর্বাসন ও পুনঃস্থাপন পর্ব শুরু হয়। তা সত্বেও শুধু ইরাকের কুর্দিস্তান প্রদেশ ছিল একমাত্র শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। অন্যান্য এলাকায়, বিশেষতঃ বাগদাদ, কিরকুক ও মোসুল শহরে মাঝে মধ্যেই রাজদ্রোহীরা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ জনগণের জীবননাশ করে বজায় রেখেছিলো আতঙ্কের নাভিশ্বাস।
ইরাকের উত্তরদিকে, তুরস্ক, জর্ডন, সিরিয়া ও ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকায় স্বীকৃত হয় এক নতুন দেশ, কুর্দিস্তান। তবে এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি।
সেই সময় রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনে কুর্দিস্তানের বৈদ্যুতিক পরিকাঠামো পুনঃসংস্কারের কাজে আমাদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন সংস্থার সাথে আমাদের কোম্পানিও যোগদান করে। কুর্দিস্তানের রাজধানী এরবিলে'র সাথে তখনও আন্তর্জাতিক বায়ুপথে যোগাযোগ সচ্ছল হয়নি। তুরস্ক থেকে সীমানা পেরিয়ে ঢুকতে হত।
আমিরশাহি'র শারজাহ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে কুর্দিস্তানের (ইরাক) সোরান শহরে আসতে হয়েছিল ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসের শেষে।
তুরস্কের দিয়ারবকির বিমানবন্দর থেকে মার্দিন শহর প্রায় একশো কিলোমিটার। পরবর্তীতে দুর্গম জাগ্রোস পর্বতমালার বুক চিরে রাস্তা। ডিসেম্বর থেকে মার্চ অবধি এই রাস্তা মানুষ প্রমান বরফে ঢাকা থাকে। এপ্রিল মাসেও রাস্তার ধরে বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়েছিল বরফের টুকরো। একদিকে বিশাল উঁচু পাহাড় অন্যদিকে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। মাঝখানে তৈরি রাজপথে বেশ জোরেই চলছিল আমাদের এসইউভি। কাঁচবন্ধ জানালায় সেই অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। মার্দিন থেকে দুশো-নয় কিলোমিটার পর সীমানা পেরিয়ে যখন কুর্দিস্তানের 'জাখো' শহরে ঢুকলাম তখন বেলা বারোটা।
মনোরম সুন্দর পাহাড়ি শহর। অবাক হয়ে দেখলাম প্রায় ছয় থেকে দশ-বারো বছর বয়েসী ছেলে মেয়েরা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নানারকম নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করছে। শহরের কোনো বাজারে বা সুপারমার্কেটে ঢোকার মুখেই এদের ভিড়। ওদের মধ্যে বেশির ভাগই ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলছে।
-"স্যার, প্লিজ বাই ফ্রম আস। উই আর সেলিং ইন সেইম প্রাইস।"
দারুন সুন্দর দেখতে একটি শিশুকন্যা। সাত কি আট বছর বয়েস। হালকা নীল রঙের ভেজা চোখের মনি। লালচে কোঁকড়ানো রুক্ষ চুল। অনেকদিন পরিচর্যা করেনি। মুখে মলিন ছাপ। মোবাইল ফোনে তার একটা ছবি তুলে নিলাম।
-"হাউ সুইট ! হোয়াটস ইওর নেম?"
-"আদ্রা !"
ওর কাছ থেকে বিস্কুট আর জুস্ কিনে ইচ্ছে করেই বেশি পয়সা দিতে চাইছিলাম, কিছুতেই নিলোনা।
বেশ কয়েকজন শিশুকেই প্রশ্ন করলাম, "তোমরা লেখাপড়া করোনা? কেন জিনিস বিক্রি করো?"
ওরা খিলখিল করে হাসে। বললো, রাতে পড়াশুনা করি। কিন্তু হাসির মধ্যে কোথাও একটা গোপন বেদনার রেশ ছিল।
সন্ধ্যে নাগাদ আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। খুব ছোট একটা শহর, নাম 'সোরান', গ্রাম বললেই চলে। কিন্তু আরবিতে 'মদিনা' বললো অর্থাৎ একটা শহর। আমাদের বাড়ির সামনে বড়রাস্তা। সশস্ত্র রক্ষীরা চারদিকে চব্বিশ ঘন্টা পাহারা দেয়। পরদিন সকালে কাজে বের হয়েই দেখলাম সেই একই দৃশ্য।
জনা সাতেক বাচ্চা ছেলে মেয়ে সামনের সুপারমার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করছে। ওদের কাছ থেকেই কিছু জিনিস কিনলাম। সুপারমার্কেটে গিয়ে দেখলাম সেই জিনিসের একই দাম। আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। আমাদেরই প্রতিবেশী, যিনি আমাদের সুরক্ষা প্রহরীর কাজ করেন তার নাম ঘানিম ইয়োসেফ। তিনিই বললেন বাচ্চারা যখন বাজার থেকে পাইকারি হারে জিনিস কেনে তখন কিছুটা দাম কম দেয়। কিন্তু সে তো যৎসামান্য।
-"বাচ্চারা এরকম কাজ করে কেন?"
-"ওরা অনাথ। দিনে এইসব কাজ করে, রাতে পড়াশুনা করে।"
-"কিন্তু শিশুশ্রম তো আইনবিরুদ্ধ।"
-"এখনো দেশে আইন তৈরি হয়নি সাহেব। যুদ্ধের পর সরকারি পরিসংখ্যানে পঞ্চাশ লক্ষ অনাথ শিশু রয়েছে। তার মধ্যে অনাথ আশ্রমে, ও প্রতিবেশী দেশে মাত্র কয়েক হাজার ঠাঁই পেয়েছে। বেসরকারি হিসেবে এখনো অনাথ শিশুর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি !"
কয়েকটা মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। অনতিদূরে একটা এগারো-বারো নিষ্পাপ শিশু দাঁড়িয়ে। বুক খোলা জ্যাকেটের মাঝে ওর জামাটা দেখেই মনে হলো, কোনো দামি স্কুলড্রেস। রুক্ষশুষ্ক অবিন্যাসি চুল। হালকা ছাই রঙের ভেজা ভেজা চোখের মনির গভীর দৃষ্টি। মুখায়ব মলিন হলেও দেখেই বোঝা যায় প্রচন্ড বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। হাতে কয়েকটা চকলেট আর টিসু পেপার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে এলাম।
ছেলেটি ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলছে। নিখুঁত ইউরোপিয়ান উচ্চারণে কথা বলার সময় শরীরটা সাবলীল ভঙ্গিতে ঝুকিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে বিশ্বস্ততার ছাপ। ইংরেজিতে যাকে বলে স্মার্ট বডি ল্যাংগুয়েজে ফুটিয়ে তুলেছে, তার ফিজিক্যাল বিহেভিয়ার, এক্সপ্রেশন আর ম্যানারিজম।
কাছে আসতেই বিনম্রতা'র স্বরে বলে উঠলো,"গুডমর্নিং স্যার, ডু য়ু নিড চকলেটস, হাউ মেনি?"
চোখে জল চলে আসছিলো, সামলে নিলাম। বললাম, "অল ম্যাটেরিয়ালস হোয়াট ইউ হ্যাভ।"
-"ওকে স্যার।"
ইংরেজিতেই প্রশ্ন করলাম,"তুমি কি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছো।"
একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে নিচের ফাটা ঠোঁটটা কেঁপে উঠলো,"হ্যাঁ স্যার।"
-"কোন ক্লাস অবধি পড়েছো?"
-"সিক্সথ স্ট্যান্ডার্ড। আমি ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়তাম।"
পাশে দাঁড়ানো প্রতিবেশী, যিনি আমাদের প্রহরীর কাজ করেন, বললেন,"এই দেশের সবচেয়ে বড় স্কুলে পড়ত। ওই স্কুল থেকে পাশ করলে সোজাসুজি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, লন্ডনে স্টাইপেন্ড সহ পড়ার সুযোগ থাকে।
একটু নিচু হয়ে ছেলেটির কাছে এসে দুই কাঁধে হাত রাখলাম। তারপর নাম জিজ্ঞেস করলাম।
স্মার্টলি জবাব দিলো," সাহিবুল বুরহান। ….আর ইউ ইন্ডিয়ান?"
-"ইয়েস মাই ডিয়ার।"
-"আই রেড ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি। ক্যান রিমেম্বার অল। ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স অন ফিফ্টিনথ অগাস্ট নাইনটিন হান্ড্রেড এন ফর্টিসেভেন। ইউর ফার্স্ট প্রাইম মিনিস্টার মিস্টার জওহরলাল নেহেরু......"
আঠারোশো সাতান্নর সিপাহ বিদ্রোহ থেকে উনিশশো বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লব থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের সে অনেকটাই জানতো। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের অন্তর্ধান কোন সালে হয়েছিল তাও সঠিক বলেছিলো। পঞ্চম শ্রেণীতে পঠনকালে সে আন্তর্জাতিক ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিল।
আবেগে গলা জড়িয়ে আসছিলো। খুব স্নেহের সুরে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলাম,"কি এমন হয়েছিল, যে তুমি লেখাপড়া ছেড়ে এখানে চলে এসেছো? তুমি কি আমাকে সেই কথা শেয়ার করবে?"
কয়েকটা মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো সাহিবুল। হয়তো আমাকে পছন্দ হয়েছিল তাই সে তার জীবনের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কর ঘটনা আমার কাছে অকপটে স্বীকার করলো। নিখুঁত ইংরেজিতে, তারিখ ও সময় সহ বলে সে প্রমান করেছিল, তার স্মৃতিশক্তি সত্যি প্রখর। পরে ইন্টারনেটে আমি মিলিয়েও দেখেছিলাম, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
-"গত বছর অর্থাৎ দুইহাজার ছয় এর তেইশে নভেম্বর। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। আমাদের স্কুলে ক্লাস চলছিল। ঠিক বিকেল তিনটে বেজে দশে প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছিল বাগদাদ শহর। বিকেল চারটে অবধি চলেছিল অনবরত গাড়ি-বোমা বিস্ফোরণ। তার মধ্যে দুটো গাড়ি-বোমা ফেটেছিল শহরের সদর এলাকায়, আমাদের বাড়ির কাছে। এরপর হয়েছিল মর্টার শেল বিস্ফোরণ। পরেরদিন পর যখন বাড়ির কাছে যেতে পেরেছিলাম, দেখলাম গোটা পাড়াটাই ধুলোয় মিশে গেছে। চারদিকে শুধু ছাই আর বিক্ষিপ্ত কালো ধোঁয়া। আবার পুলিশের গাড়ি আমাদের ফিরিয়ে অরফ্যান রিফুজি ক্যাম্পে নিয়ে এলো। সে ছিল বাগদাদের সবচেয়ে মারাত্মক আতঙ্কি হামলা। টিভিতে বলেছিলো মাত্র দুশো পনেরোজন মৃত। কিন্তু আসলে কতজন পরবর্তীকালে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলো, তার হিসেব নেই। আমার পরিবার তো দূর, আমাদের কোনো আত্মীয় -স্বজন পর্যন্ত বাঁচেনি।"
কথা বলার সময় তার এতটুকুও গলা কাঁপেনি। তার চোখে একফোঁটাও জল আসেনি।
এক আবেগহীন নির্লিপ্ত শৈশব যেন মৃত প্রকৃতির বুকে এক অবশেষ হয়ে বিরাজ করে চলেছে।
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,পাগল ওগো
দেবর্ষি সরকার
বড়দিনের সকাল। অয়ন, সৌম্য, অনিন্দ্য, মৌলিক অনন্যা, শর্বরী মোট ছয়জনের এই তিনটি মোটঘাট বেঁধে বেরিয়েছে বাঁকুড়া শহর পর্যবেক্ষণে। ঘুরতে ঘুরতে তারা এসে পৌঁছল সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ির মূল ফটকের সামনে। বড়দিনের দৌলতে রবিবারের ছুটির আমেজ শরীরে জড়িয়ে আপামর বাঙালির ভিড়ে কালীবাড়ি চত্তর ভেসে যাচ্ছে কোনো এক অজানা সভ্যতার ভেলায় চেপে দূরবন্ধুর অভিসারে। কালীবাড়ির ফটকের ঠিক নিচে হতভাগা দেশের হতভাগা ভিখিরীদের জটলা। কারো স্টিলের বাটি খুচরো টাকশাল তো কারো সামনে পড়ে থাকা লালসালুটি হয়ে উঠেছে রাতের আকাশ যেখানে তারা গুলো শরীরে এক দুইয়ের ছাপ টেনেটুনে পাঁচ থেকে দশের সীমানায় পৌঁছে গেছে অবলীলায়। যাইহোক ঠিক তাদের মধ্যে থেকেই ধুলিমলিন ফ্রক জামায় শতাধিক ছিদ্র নিয়ে রুক্ষ চুলের মধ্যে থেকে কালো কালো মুক্তোর মত চোখ নিয়ে এক কিশোরী হঠাৎ অনন্যার চুরিদারের ওড়না টেনে ধরল। সাহিত্যের সেই বিখ্যাত শব্দবন্ধটির সার্থকতা পুনরায় প্রমাণিত হয়ে গেল ঢিল মারলে পাটকেল খেতেই হয় ! চলতে গিয়ে হঠাৎই বাধার সম্মুখীন হওয়ায় অনন্যা রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল তারপর পেছন ফিরে রগরগে চোখে সে কিশোরীটিকে একবার দেখে নিয়েই হেঁচকা টানে ওড়নাটির প্রান্ত সেই ফ্যালফ্যাল করে হাসা মেয়েটির আসুরিক জাল থেকে মুক্ত করে ফেললো।
- কি হলো অনন্যা থেমে গেলি যে ?
- আর বলিস না মৌলিক; এই যে ভিখিরীর বাচ্চা পেছন থেকে ওড়নার খুট ধরে টানছে। কত বড় স্পর্ধা ! একবার বলা নেই সোজা গায়ে হাত !!
হঠাৎ পেছন থেকে একটা রুক্ষ হাত অনন্যা ও মৌলিকের মধ্যেকার ঘনিষ্ঠতাকে আষাঢ়ের মেঘের মতো উড়িয়ে দিয়ে সামনে এসে উপস্থিত হল।
এবার তেলেগুনে জ্বলে উঠে অনন্যা বলল, 'এই মেয়ে তুই আবার এখানে চলে এসেছিস ! লজ্জা নেই তোর আমার ওড়না ধরে টেনেছিস ?
সেই মেয়েটি এবার ফ্যালফ্যাল করে হেসে বলল, ' দিদি দু-তিন ধরে কিছু খাইনি। দুটো টাকা দিলে একবাটি মুড়ি খেতে পাই... দুটি টাকা দাও দিদি।পায়ে পরি।
- এই খবরদার পায়ে হাত দিবি না। ছিঃ ছিঃ! এই বিচ্ছিরি হাতে গায়ে হাত দিবি না আমার। এই বলে নিজের বা পায়ের আঘাতে মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে দিল অনন্যা। দুদিনের অভাবগ্রস্থ শরীর সেই আঘাত সইতে না পেরে রুগ্ন শরীরটি একটু দূরে ছিটকে পরল মফস্বলের ছেলেদের হাতের গুলতির মত।
এতক্ষণে ঘটনাস্থলে সৌম্য, অয়ন, অনিন্দ্য, শর্বরীরও এসে উপস্থিত হয়ে গেছে। মন্দিরে আগত তীর্থযাত্রীদের মধ্যে সেই মেয়েটিকে নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই কেবল দু চারজনকে দেখা গেল দূরে ছিটকে পড়ে থাকা সেই মেয়েটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে যার রংচটা ফ্রকের শরীরে রক্তের ছাপ ঘোরাফেরা করছে। অয়নদের সেই টিমটির প্রত্যেকেই সে ভিখিরি মেয়েটির সূত্র ধরেই সমগ্র ভিখিরি জাতিটিটিকে অকারনেই অশ্লীল গালির ধারায় সিক্ত করে তীর্থ দর্শন শেষে খাসির রগরগে ঝোলে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত সহযোগে দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষে একপ্যাগ করে বিয়ার গ্লাসে চুমুক দিয়েই যে যার মতন ঘরে ফিরে গেল। শেষ হলো নটা থেকে পাঁচটা অফিসের ডেক্সটপে নিজেদের জীবনের মৌরসি পাট্টার সুলুক সন্ধানী আপামার বাঙালি তথাকথিত বড়দিনের আনন্দ। এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও এহেন চিত্র প্রত্যেকের ঘরে ঘরে সমানভাবে ফুটে উঠছে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই কিন্তু যে ভাবি প্রজন্ম আমাদের মুখ চেয়ে আছে ভবিষ্যতের অন্ধ গলিতে ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছে যাবে বলে কিন্তু আমরা তাদের ঠিকঠাক সেই গলিতে নিয়ে পৌঁছাতে পারছি কি ? না ; মোটেও পারছিনা। সে বিশ্বপ্রমত্তের দাপাদাপিতে বড়দিনের সত্যমর্ম ও সত্য ধর্মটাই দিন দিন কর্পূরের মত উবে যাচ্ছ না হলে নম্রতারুপি অগ্নি আজ ঢাকা পড়ছে বিশুদ্ধ আনন্দের মাধ্যমে উড়ে আসা একপ্রকার অসংলগ্ন ধুলোবালির অন্তরালে।
সামাজিক ন্যায়নীতি বিরোধী স্বাভাবিক দোদুল্যমান সময়ের নিরিখে উপরিউক্ত ঘটনাটি অতিশয় কদর্য হলেও সহজ সরল বলেই ধরে নেওয়া যায়। পৈশাচিক উন্মাদনা আজ আমাদের মানসিক সত্তাকে তীব্রতর ভয়ের সম্মুখীন করেছে। দীর্ঘদিন যে ইচ্ছে গুলি চেপে চেপে আপামর মনুষ্যসমাজ দিন গুনেছে সুদিনের আশায় আজ সেই মানুষগুলোই হাড়ি কাঠের বর্মে নিজেদের শরীর ঢেকে ঔপনিবেশিকতার শানিত অস্ত্রে শান দিতে ব্যাস্ত। এই টানাপোড়নের দিনগুলোতে থীতু হওয়ার সময়ের বড্ড অভাব তাই অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সপ্তম ইন্দ্রিয়টি আজ ভোতা থেকে অতি-ভোতা হয়ে এসেছে। আমাদের ব্যভিচারগ্রস্ত মন গান গেয়েছে, উশৃঙ্খল নেচেছে, প্রেতের শরীরে রক্তের ছোঁয়া লাগিয়ে উদ্দাম খিস্তি দিয়েছে।এই অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সকল কাণ্ডের কান্ডারী রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হওয়া যাক। রবীন্দ্রনাথ 'বুদ্ধদেব' প্রবন্ধে বলেছেন,
' তখনি আবার এই কথা মনে হলো যে, বর্তমান কালের পরিধি অতি সংকীর্ণ, সদ্য উৎক্ষিপ্ত ঘটনার ধুলি-আবর্তে আবিল, এই অল্পপরিসর অস্বচ্ছ কালের মধ্যে মহামানবকে আমরা পরিপূর্ণ করে উপলব্ধি করতে পারি নে ইতিহাসে বারবার তার প্রমাণ হয়েছে।'
দেশ ও কালের সীমানার গণ্ডি পায়ে বেঁধে আজীবন বসে থাকলে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই ক্ষতি আর একবিংশ শতাব্দীর এই দশক ক্ষতির চেয়ে লাভের প্রতিই 'লাভ' প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু যা কিছু চেতনাময় যা কিছু ইট কাঠ পাথর গাথা অট্টালিকার চেয়েও সহজ সরল যা কিছু সমাজের বিশবৃক্ষ রূপে কালকূট পান করেও নির্মোঘ থাকতে পারে সেই সত্তাকে অনুসরণ করেও মানুষ যখন শান্তি খুঁজে পেতে অপারগ সেই উত্তাল সময়ে পৌঁছে উচ্চারণ করতে হয় বেদবাক্য যা গুরু মুখনিঃসৃত।
' আমরা সাধারণ লোক পরস্পরের যোগে আপনার পরিচয় দিয়ে থাকি; সে পরিচয় বিশেষ শ্রেণীর, বিশেষ জাতির, বিশেষ সমাজের পৃথিবীতে এমন লোক অতি অল্পই জন্মেছেন যাঁরা আপনাতে স্বতই প্রকাশবান, যাঁদের আলোক প্রতিফলিত আলোক নয়, যাঁরা সম্পূর্ণ প্রকাশিত আপন মহিমায়, আপনার সত্যে। মানুষের খন্ড প্রকাশ দেখে থাকি অনেক বড়ো লোকের মধ্যে; তাঁরা জ্ঞানী, তাঁরা বিদ্বান, তাঁরা বীর, তাঁরা রাষ্ট্রনেতা; তাঁরা মানুষকে চালনা করেছেন আপন ইচ্ছামতো, তাঁরা ইতিহাসকে সংঘটন করেছেন আপন সংকল্পের আদর্শে।কেবল পূর্ণ মনুষ্যত্বের প্রকাশ তাঁরই, সকল দেশের সকল কালের সকল মানুষকে যিনি আপনার মধ্যে অধিকার করেছেন, যাঁর চেতনা খন্ডিত হয় নি রাষ্ট্রগত জাতিগত দেশকালের কোনো অভ্যস্ত সীমানায়।'
আজ গাজায় ঘটা পারমাণবিক বিস্ফোরণ পৃথিবীবাসীর কাছে চাঁপা আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। সে আতঙ্কের পেছনে কাজ করছে রাষ্ট্র সমাজ ও বর্ণবিদ্বেষের মতন ঘৃণতর সামাজিক পেশাদার শ্রেণীর মদতপুষ্ট অতি জঘন্য কিছু নিয়ম কানুন যা পঙ্কিল পথে বেষ্টনী তৈরিতে সাহায্য করে কিন্তু সেই পথের বন্ধুরতম অংশগুলির পরিচয় হতে অপারগ। পৃথিবীটা আদৌতে 'পৃথিবী' আছে না জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের তরলীকৃত বাষ্পে পরিণত হয়েছে ? হিংসের আগুনে পুঞ্জিভূত ক্লেশ আজও সামাজিক ব্যাভিচারের রাস্তায় মদমত্ত হস্তিনীর ন্যায় পদ সঞ্চালন করে। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই প্রশ্ন করেছে।
' বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে, অপবিত্র ভেদবুদ্ধির নিষ্ঠুর মূঢ়তা ধর্মের নামে আজ রক্তে পঙ্কিল করে তুলেছে এই ধরাতল; পরস্পর হিংসার চেয়ে সাংঘাতিক পরস্পর ঘৃণার মানুষ এখানে পদে পদে অপমানিত। সর্বজীবে মৈত্রীকে যিনি মুক্তির পথ বলে ঘোষণা করেছিলেন সেই তাঁরই বাণীকে আজ উৎকণ্ঠিত হয়ে কামনা করি এই ভাতৃবিদ্বেষ কলুষিত হতভাগ্য দেশে। পূজার বেদিতে আবির্ভূত হোন মানবশ্রেষ্ঠ, মানবের শ্রেষ্ঠতাকে উদ্ধার করবার জন্যে। সকলের চেয়ে বড় দান যে শ্রদ্ধাদান, তার থেকে কোনো মানুষকে তিনি বঞ্চিত করেননি। যে দয়াকে, যে দানকে তিনি ধর্ম বলেছেন সে কেবল দূরের থেকে স্পর্শ বাঁচিয়ে অর্থদান নয়, সে দান আপনাকে দান - যে দান ধর্মে বলে 'শ্রদ্ধয়া দেয়ম।' নিজের শ্রেষ্ঠতাভিমান, পুন্যাভিমান ধনাভিমান প্রবেশ করে দানকে অপমাননকর অধর্মে পরিণত করতে পারে এই ভয়ের কারণ আছে; এই জন্য উপনিষদ বলেন 'ভিয়া দেয়ম।' ভয় করে দেবে। যে ধর্মকর্মের দ্বারা মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হারাবার আশঙ্কা আছে তাকেই ভয় করতে হবে। আজ ভারতবর্ষে ধর্মবিধির প্রণালী যোগে মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধার পথ চারিদিকে প্রসারিত হয়েছে। এরই ভয়ানকত্ব কেবল আধ্যাত্মিক দিকে নয়, রাষ্ট্রীয় মুক্তির দিকে সর্বপ্রধান অন্তরায় হয়েছে এ প্রত্যক্ষ দেখছি। এই সমস্যার কি কোনো দিন সমাধান হতে পারে রাষ্ট্রনীতির পথে কোনো বাহ্য উপায়ের দ্বারা ?'
সাম্প্রদায়িকতার ঠুলি এঁটে অসামাজিক মানুষগুলো যে মুহূর্তে নির্মলতার মিথ্যা চাদরের সর্বাঙ্গ আবৃত করে মানুষের ঈশ্বরের দ্বারস্থ হয় ঠিক সেই মুহূর্তেই হয়তো দিগ্বিদিক প্রাবল্যের সহিত ধ্বনিত হয় সেই আত্মবাক্য যে আত্মবাক্যের সুর কঠিনতর কবিতাকেও প্রেমের মায়াজালে জড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। মানুষ গড়ছে আবার মানুষই ভাঙছে। এই ভাঙ্গা গড়া খেলার মধ্যেই নিহিত আছে সুন্দরের পদধ্বনি যে ধ্বনিতে পাখি গায় বনের ফুল উৎফুল্লিত চিত্তে মন্থর বাতাসকে চুমু খেয়ে যায়। বসন্তের কোকিল, গ্রীষ্মের পানকৌড়ি সেই ধ্বনিতে নিজস্বতার বর্মে নিজেকে জড়াতে পারে না। আজ জাতীয়তাবাদী আগ্রাসী মনোভাবের রূঢ়তার দাপাদাপিতে সেইসব অতীতের মনিকোঠায় বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বর্বরতার প্রদীপের আগুনে মানুষকে পুড়িয়ে আজ আমরা সেই মানুষের ঈশ্বরের পুজো করছি। সাধক প্রেম বিলাতে গিয়ে পাগল হয়েছেন। তিনি কি ধরায় আসবেন ?
আজকের লুঠেরা
উমেশ শর্মা
দরজা খুলে শোয়া আমার ধাতে সয়না মোটে
না জানি কখন হঠাৎ করে কোন উত্তমর্ণ জোটে।
সুদটি নেবে আসল নেবে আর লুটবে ঘরের ধন
উদোম করে ফাউ হিসাবে সঙ্গে চাইবে নিতে মন।
ভোট চাইবে মরার আগে আমার ভালোর জন্য
হু হু বাওয়ে শীতকাতুরে বলে হব আমি গণ্য।
উষ্ণতা চাই প্রাণের জন্য মাধুর্য চাই দিলে ও ধরে
খোলা দরজায় আকাশ দেখি শ্বাপদ দেখি ঘরে।
ক্যুয়ো ভ্যাদিস্?
দীপায়ন ভট্টাচার্য
তোমার পিঠ ছুঁয়ে যায় বৈরাগী রোদ
চোখ থাকে উড়ন্ত বালিহাঁসের ডানা
পায়ে ছড়ায় শিশির-ধোয়া ঘাস
ঘড়ির কাঁটার শেকল খুলে
কোথায় যাও তুমি?
মন কি ভেসেছে পথ ওল্টানোর প্রত্ন-স্মৃতিতে
ক্রুসেড পার হওয়া কোনো শান্ত অবকাশে?
তখন সন্ধ্যার গায়ে লেগে ছিল বিশ্রামের কুঁচি
আকাশ খানখান্ করছিল আলস্যবিলাসী চাঁদ
মাঠের ওপারে দিনভাঙা জনতার কোলাহল
অবসন্ন হয়ে নেতিয়ে পড়ছিল বুঝি।
তখনই তুমি শান্ত ধ্যানমূর্তি হয়ে
দেওয়ালের পাহারা এড়িয়ে ছুট দাও
তোমার পায়ের লাথিতে ওড়ে
দিনযাপনের শিলীভূত ধুলো
তোমার পা চলে
এথেনিক পরম্পরা ভেঙে ভেঙেই
ভেঙে ভেঙে ভেঙে।
মেরুদন্ডসপ্তক
উৎপলেন্দু পাল
( ১ )
যারা অন্যের মেরুদন্ড খুঁজে বেড়ায়
সুযোগে আলতো খোঁচা দেয় -
নিজের মেরুদন্ডের প্রসঙ্গ উঠলেই
অজুহাতে ল্যাজ গুটিয়ে পালায় ।
( ২ )
মেরুদন্ডটা হয়তো আগেকার অবস্থানেই ,
শুধু ক্ষয়ে গেছে ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক
হারিয়ে গেছে খানকতক কশেরুকা ।
( ৩ )
রোজ রাতে মেরুদন্ডের হাড় গুনে শুই ,
প্রত্যেক সকালেই অনুভব করি
আগের রাতের গণনার ত্রুটি ।
( ৪ )
যারা মেরুদন্ড নিয়ে রোজ বড়াই করে
আসলে তারা কাঁচের ঘরে বাস করে
প্রতিপক্ষের দিকে বুদ্ধিদীপ্ত ঢিল ছোঁড়ে ।
( ৫ )
একদিন আমারও ঋজু মেরুদন্ড ছিল ,
এখন তোমাদের দেখাদেখি
আমিও বুকে ভর দিয়ে চলি ।
( ৬ )
যাদের মেরুদন্ডে জোর থাকার কথা ছিল
তারা হাতুড়ি ও চাবুকের জয়গানে মত্ত হয়ে
সন্ধ্যায় ধনদেবীর চৌকাঠে দীপ জ্বালে ।
( ৭ )
মেরুদন্ড বিক্রি হয় রাজনগরের হাটে
নিলামে ওঠে রাতের আঁধারে
দালালেরা হাত বদল করে নিশ্চিন্তে
ভোরের আলো ফুটবার আগেই ।
অংশ
লীনা রায়
সময় হলে তুই তো এলি
সব ভুলিয়ে কেবল তুই,
গোলাপ রঙা স্বপ্ন আমার
আলতো হাতে তোকেই ছুঁই।
ঝরছে হাসি টাপুর টুপুর
উপুড় করে খুশ পেয়ালা,
সুখ গুনছি দিন রাত্তির
ঘুম ছবিতে রং দেয়ালা।
আঁকড়ে তোকে বুকের মাঝে
পাঁজর জুড়ে খুশির সুর,
আদর,সোহাগ,ভালবাসায়
স্বপ্ন সুখের সমুদ্দুর।
আধো বুলির লক্ষ কথায়
সহজ পাঠে সেই আমি,
তোর হাসিতেই ভাসান গেল
ইচ্ছে নদীর পার খানি।
আহা ইছামতী
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
জানি না এ কার ইশারায়, কোন হাতছানিতে
প্রান্তজোড়া এই কলকাকলি
এক শান্ত স্রোত বয়ে যায়, আনমনে, অবিরাম
সূর্যকে ছুঁয়ে যাওয়ার একবুক আশা নিয়ে তুমি
আহা ইছামতী,
চরভূমি সেজে ওঠে সবুজে সবুজে
দুই পারে থোকা থোকা আকন্দের ডালী
সোঁদালী বুনো নীল ফুলের নকশা কাটা
পাতাবাহারের একান্ত নিরাপদ আশ্রয়ে
আহা ইছামতী, তুমি ইছামতী।
নদীর জলের সেই কানাকানি শুনি
তার দুই তীরে, কেউ শোনে গান তার
উঁই ঢিপি, নীলপাখি,নীলপরি সুর ভাঁজে।
বনঝোপ থেকে ভেসে আসে মৃদু বাতাসের গান
রাতপাখি রাত জাগে জ্যোৎস্নার আলো হাসে মোহময়, প্রাণময়, আহা ইছামতী।
গ্রামের ঘাটে দু'দশ টা ডিঙ্গি , কার প্রতীক্ষায়?
বাঁশ ঝাড় সরসরে,বিহঙ্গ কাকলি মুখর বনস্থলী
শিমুল গাছের বাঁকা ডালে, মাছ খায় কত পাখি
নিশ্চিন্তে জলমুখী মাছরাঙা একা অপরাধী যেন।
একদিন ভাসবে, ভাসাবে, ভাবাবে, কাঁদাবে সে
চিতার আগুন তবু নেভাতে জাগবে রাত
সাথী হবে তুমি, ইছামতী, আহা ইছামতী।
আরো শীত
দেবদত্তা লাহিড়ী
ঠিক এমন মন আকুল করা সন্ধ্যাকালীন মন খারাপের সময়ে
পাহাড় সমুদ্র একসাথে অকাতরে কাঁদে।
একে খোঁজে অন্য ভাঁজে
আকাশ খামচে ধরে
মরুভূমি মরুদ্যান ফেলে হারিয়ে
বালি দিয়ে চোখ মুছে নেয়।
তারা যখন নিরুদ্দেশ
নদী তৈরী হয় তখন
তার নেই সাগর
দুকুল উপচে যেতে যেতে
ছিলাম, আছি, থাকব দেয় জানান।
ধানের দেশে
অভিজিৎ সরকার
চেনা পথ ধরে হেঁটে যাই
তাকিয়ে থাকি সবুজ ধানক্ষেতের দিকে
ইট-কাঠের দেওয়ালে আমার ঘুম আসেনা
সবুজ ধানক্ষেত আমার রাতের বিছানা।
নিমেষেই বুঝতে পারি ধানের গন্ধ, বাবার শ্রম,
আর আমাদের বেঁচে থাকার বীজমন্ত্র,
ক্ষুধায় কাতর হলে আমরা চেয়ে থাকি সবুজের দিকে
কখন পাল্টে নেবে সবুজ তার রং
সোনালী গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে শরীরে,
এভাবেই অপেক্ষায় থাকি একটা যুগ শেষ হবার
অপেক্ষায় থাকি একটি ধানের দেশে পাড়ি দেবার...
নতুন ঘর
রীনা মজুমদার
হেমন্তের গায়ে শীত শীত
হালকা বাতাসে পাকা ধানের গন্ধ
ধানের তলে তলে শিশিরের দানা
হেমন্তিকা আলপথে, চোখে তার আনন্দ
ক্ষেতি বাড়ি শাঁখ বাজে, জোঁছনায়
ভিজে যায় কচি লাউয়ের ডগা
বারোমাস অন্ধকারের গভীরতা থেকে
জেগে ওঠে ঋতু, নাবান্নের হেমন্তিকা
ধানের গোলায় গোলায় পাখির কলতান
রঙ লাগে ফুলে, মাটি গড়ার ক্যানভাস
হেমন্তিকার আঁচলে ফেনা ভাতের গন্ধ
স্বপ্ন সাজাও স্বপ্ন জাগাও ক্লান্তিহীন উচ্ছ্বাস
চড়ুইয়ের ঠোঁটে খড়,
গড়বে নতুন ঘর...
ঝরাপাতার নীরবতা
প্রতিভা পাল
শীতের ঝরাপাতার ব্যথায়
কিছু নীরবতা রাত জাগে আজও ;
হেমন্তর উপসংহারে
কত কবিতা নিমেষে ভেজে কুয়াশায় !
যতদূর ইচ্ছের সংগতি উষ্ণতা মাপে,
জলজ ভাবনার অসম্পৃক্ততা ঠিক ততটাই!
ধারণে অপারগ কান্নার বুদ্বুদ
শিশির ঝরায় ঘাসে,
আর্দ্র হাসির সূর্যকণায়
লেগে থাকে এক দরদী দিনের কাহিনি !
শুষ্ক ঠোঁটে বোরোলিনের মতো
পশমের পেলবতায়,
রোদ-ছোঁয়া আচারের আস্বাদে কিংবা
নবান্নের ঘ্রাণে - অগ্রহায়ণ কখন যেন
ভাললাগা এক শহর এঁকে দেয় মনে,
শব্দের অজান্তে !
শীতের ঝরাপাতার ব্যথায়
কিছু নীরবতা রাত জাগে তবু নীরবে,
একান্তে….
নবান্ন মজনু মিয়া
ফসলের আজ ধুম লেগেছে সোনালি ধান খেতে,
কৃষক কৃষাণী ব্যাস্ত খুব কাজে আছে মেতে।
সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি ধান গোছানোয় থাকে,
কেউ বা মাঠে ছুটে যায় তার ধান নাকি পাকে।
ধান তুলা তার হলে সারা পিঠা পায়েস রাঁধে,
শত কাজের ফাঁকে কিন্তু গৃহিণী চুল বাঁধে।
পরিযায়ী
অলকানন্দা দে
আয় মন বেড়াতে যাবি!
যাব বৈকি ভাই! আমার যে বাসা নাই!
বিরতি-বিহীন ঘুরে বেড়াই পরগণা থেকে পরগণা
প্রকৃতি সাধনার আর কোনো উপাচার জানা নেই আমার।
ভ্রমণই অর্ঘ্য, ভ্রমণই দেবদর্শন গতানুগতি ছিঁড়ে।
প্রজাপতির সাথে দেখা হয়। জেনে নিই কোন সুদূর থেকে সে আসে ইন্দ্রধনু সাজে।
যোজন দূরের পাহাড়ের ওপারে মনের সূর্য ওঠে
ভাবনাকে ভাসিয়ে দিই আলোর সলিলে।
সে নিজেকে দেখতে চায় নুর সংসারে। এতকাল ছিল মূর্ছিতা মর্মভাঁজে।
চাঁদের ভেল্কি দেখি, দেখি তারার কারচুপি অজবীথি জুড়ে।
পরিস্নাত সকালের হিমসিক্ত ঘাসে চরণ রাখি
একখণ্ড জীবনকে আহরণ করি পথ-কিণারে!
শাল তমাল পিয়াল মোহ লাগায় চোখের কোলে!
প্রকৃতিতে সাজাই ঘরকন্না! ভ্রমণে ফুরায় সময়।
জীবনের দিগন্তে ছড়ায় প্রেম! মাঝখানে ফুলের প্লাবন!
শান্তির খোঁজে
সুমন্ত সরকার
সুমিষ্ট শান্তির খোঁজে
চলি আমি বহুদূরে,
ক্লান্ত এই শহর ছেড়ে
একলা আমি আসি একটু ঘুরে।
অবিচ্ছিন্ন এই পড়ন্ত বেলায়
দিগন্তে সূর্যের হাসি,
মনের সব ক্লান্তি মুছে
কেবল চাই স্নিগ্ধ শান্তি।
রোদের সেই শহর ছেড়ে
চলে এলাম অনেক দূরে,
শরীরের সব একঘেয়েমিতা
একনিমেষে দিলাম সব ছুড়ে।
শান্ত প্রকৃতির মাঝে
দিলাম নিজেকে মেলে,
সুন্দর ওই কৃষ্ণচূড়ারা
আমার ওপরে পড়ে ঝড়ে।
শান্ত ওই নদীর জলে
মাছেরা করে খেলা,
সুন্দর একটি দিন আমার
কাটলো প্রকৃতির সাথে একলা।
মনের মাঝে যত্ন করে
গেঁথে রাখলাম মাথায়,
চলো আবার ফিরে যাই
একঘেয়ে ওই চঞ্চল জায়গায়।
মুক্তগদ্য
ভোরের ভাবনা
বিনয় বর্মন
" ভোরের আলোয় দেখো কত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে
সোনালী আলো চারিপাশে পড়ছে গড়িয়ে
এসব তো তোমার জন্য বুঝতে পারো না বুঝি
প্রভাতের সোনাঝরা আলোয় তোমাকে খুঁজি
তুমি দূরে থাকো শুধু আঁধার সাথী করে
প্রভাতের আলোতে তো নি:শ্বাস নাও না মন ভরে
এতো ঘুমাও; ঘুমিয়ে সজীব ক্ষণ করো সাবাড়
ঝেড়ে আলসেমি উঠো প্রভাতে বলছি আবার……. "
( ~ কাজী ফতেমা ছবি )
প্রথমে টি শার্ট , তার পিছনে ভুঁড়ি , তার পেছনে আমি l তো ভোরবেলা প্যারেড গ্রাউন্ডে বিচিত্র রকম লোক দেখা যায় l ছেলে ছোকরা থেকে বুড়ো বুড়ি l বেশিরভাগই স্বাস্থ্য উদ্ধারে এসেছেন। যথারীতি বাঙালির যা স্বভাব , স্বাস্থ্য হারিয়ে তারপর সচেতন হয়েছেন। ফলে বেশিরভাগই চল্লিশ-ঊর্ধ্ব l কিছু আছে কম বয়স্ক। আসলে সারারাত সোশ্যাল মিডিয়া , নেটফ্লিক্স ইত্যাদি ওটিটিতে 'নাইট ডিউটি' করে ছেলেমেয়েদের শরীরচর্চার সময় মেলেনা l দিন শুরুই হয় বেলা দশটায় l অবশ্য পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে যোগদানের আশায় কিংবা শুধুমাত্র ফিটনেস এর জন্যই শরীর চর্চায় নেমেছে কেউ কেউ l তবে তারা সংখ্যায় লক্ষ্যণীয় ভাবে কম l
হাঁটতে হাঁটতে কিছু পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দেখা হয় l টুকটাক কথা ভেসে আসে l
পাশ দিয়ে দৌড়ে গেলেন একজন মধ্য ৪০ এর অবাঙালি মহিলা। মাঝারি চেহারা l শাড়ি পড়েই দৌড়াচ্ছিলেন l পায়ে অবশ্য স্পোর্টস শু l কিছুটা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাপাতে হাঁটছিলেন l তার পরিচিত আরেক দম্পতির সঙ্গে আলাপ শুরু হলো।
- সকাল সকাল চলে এসেছো ... বাড়িতে রাগ করবে না ?
- কেন বর রাগ করবে কেন ? ঘরের সব কাজ সেরে এসেছি l এখন গিয়ে বাদাম ইত্যাদি খাব l তারপর এক ঘন্টা একদম রেস্ট l তারপর আবার কাজ শুরু l সারাদিন তো কাজই করতে হয় l
ভালো লাগলো মহিলারাও স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছেন l সংসার সামলে নিজেদেরকে ভালো রাখার চেষ্টা করছেন l
অন্যদিকে স্কুটি নিয়ে মাঠে এসেছে এক নব্য যুবক l স্কুটির সিটে বসে এক হাতে সিগারেট , আর এক হাতে ফোন নিয়ে কারো সঙ্গে লাউডস্পিকারে ঝগড়া করছে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে l সম্ভবত গার্লফ্রেন্ড l বাড়িতে হয়তো প্রাণ খুলে ঝগড়া করা অসুবিধা l ভোর ভোর চলে এসেছে পেন্ডিং ঝগড়া কমপ্লিট করতে!
এক বৃদ্ধ ওয়াকার নিয়ে এসেছেন প্রাণপণ চেষ্টায় ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন। পেছনে তার কেয়ার গিভার l দেখে মন ভালো হয়ে গেল l বাঁচার কি অদম্য ইচ্ছা l মানুষের এই জীবন কি অগাধ !
স্মরণ
হাংরি আন্দোলন ও মলয় রায়চৌধুরী
সঞ্জয় এস.সাহা
বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্য কেউ থাকে । সাহিত্যের কাজ কি ? ক্যাথারসসি কারা ? মানে, মোক্ষম ? বরং হাংরিদের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসসির উল্টোদিকে হাঁটে । মোক্ষম করা, শান্তি দেওয়া তাদের কাজ নয় বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য ! প্রতিষ্ঠান সাহিত্যের জোতদারদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছেন হাংরি আন্দোলনকারীরা তাদের কাজের দ্বারা, লেখার দ্বারা, ড্রইং এর দ্বারা । হাংরি আন্দোলনকারীরা কেবল আত্মবীক্ষণ ও আত্মআবিষ্কারের আলো ফেলতে চেয়েছিলেন । সেই আলোচিত, সমালোচিত আন্দোলনকারীদের প্রধান ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । ভাবলেই শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রয়াত হাংরি আন্দোলনের জনক কবি ও উপন্যাসী বলয় রায়চৌধুরী । ২৬ শে অক্টোবর, বৃহস্পতিবার দুপুরে মৃত্যু হয় তাঁর । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর ।
১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর সুতানুটি-গোবিন্দপুর- কলকাতা খ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারে জন্ম হয় মলয় রায়চৌধুরীর। তার বাবা গৌচপ্রম রায় চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী ও ফটোগ্রাফার। তার মা 'আমিতা' ছিলেন নিলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দোপাধ্যায় (রোনাল্ড রস এর সহায়ক ) বড় মেয়ে। কলকাতা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদের সংরক্ষিত সংগ্রহশালার তথ্য অনুযায়ী মলয়ের রায় চৌধুরী ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার শিল্পী । তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী ছিলেন একজন লেখক। ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসের পাটনা শহর থেকে একটি ইস্তেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত । আর যেসব কবি এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা নিজেদের "হাংরি জেনারেশন" হিসেবে নিজেদের দাবি করেন। শুরুর দিকে সমীর রায় চৌধুরী,মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের মত কবি সাহিত্যিকরা ছিলেন এই আন্দোলনের দিক নির্দেশিকা । কিন্তু হাংরি আন্দোলনের প্রকৃত রূপকার ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী।
হাংরি আন্দোলনের শব্দটি বাংলা ভাষায় ঠিক যেভাবে প্রবেশ করেছে যেভাবে মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দগুলো, আর এই ক্ষুধার্ত তরুণ কবিদের নেতৃত্ব ছিলেন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় এর অর্থনীতি বিভাগের ২১ বছরের এক তরুণ তুর্কি মলয় রায়চৌধুরী যিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন একজন কালচারাল বাস্টার্ড হিসেবে । তাঁর সঙ্গ দিয়েছিলেন দাদা সমীর রায় চৌধুরী, আন্দোলনের সম্প্রদায় ও বিতরণী ছিলেন কবি দেবী রায় এবং নেতৃত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।
১৯৬১ সাল । দেশভাগের পর পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু শরণার্থীর ভিত, অন্য দিকে অর্থনৈতিক স্বরাজ্যের খোয়াবকে গুঁড়িয়ে চলছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা। কবি মলয় রায়চৌধুরী নিজেই বলেছিলেন, "স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী সমৃদ্ধ উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ডগে গিয়ে পঁচতে শুরু করেছে উত্তর উপনিবেশিক কাল খন্ডে।"
ঠিক এই সময় আবির্ভাব ঘটল আভাঁগার্দ রূপে এই তরুণের। ১৯৫৯ ষাট সালে ইতিহাসের দর্শন এবং মার্কসবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে দুটি লেখা নিজে কাজ করার সময় হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা মলয় রায়চৌধুরী অনুভব করলেন । হাংরি শব্দটি প্রথমে পেয়েছিলেন কোভিদ জিওফ্রে চসারের "In swore hungry Time " বাক্যটি থেকে । স্পেঙ্গলারের লেখা "The Decline of West " বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী "প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি" নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, "কোন সংস্কৃতি ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তার এক যুগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়, তাহলে জৈব প্রক্রিয়া এবং সেই কারণে নানা অংশের আকার কোন দিকে বাঁকবদল ফাটাবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিচে সৃজন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যম নতুন স্ফুরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয়ে যায় যখন তার নিজের সৃজন ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।''
এই ক্ষুধা অবশ্য আক্ষরিক অর্থে ক্ষুধা ছিল না । তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষুধা যথার্থ শব্দ প্রয়োগের ক্ষুধা, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা আর অবদমিত কামনা পূরণের ক্ষুধা । তার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙ্গালীর আবির্ভাব আর ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত।
হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। যেগুলো পাটনা থেকে প্রকাশিত, সেগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তারা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতেহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস, পত্রিকা দফতর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তারা বিতরন করতেন । ১০৮টি বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার মাত্র কয়েকটি ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি’ এবং ঢাকা বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। আমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল যা ওই বয়সের কবি লেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে অকল্পনীয়। কলকাতায় এই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল: "ইহা কি বেহুদা পাগলামি?, দেবদূতেরা কি ভয়ংকর, চতুষ্পর্ণা, সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?, হা-ঘরে সম্প্রদায়, কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌন লালসা, পুলিশি বেটন কি শিল্প বিচার করবে?"।
হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত। ১২০বি এবং ২৯৪ ধারা তুলে নিয়ে কেবল ২৯২ ধারায় চার্জশিট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য ; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান। কিন্তু মোকাদ্দমাটির কারণে মলয় রায়চৌধুরী খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি কিংবদন্তি নামে একটি গ্রন্থে আন্দোলনের ইতিহাস তত্ব ও তথ্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। পরবর্তীকালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নথিপত্র, আদালতে সাক্ষ্য, আদালতের রায় এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয় হাংরি আন্দোলন গ্রন্থ। এ আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা রাখায় তাকে উপাধি দেওয়া হয় "ক্ষুধার্ত প্রজন্মের পিতা"।
১৯৬৩ সালের শেষার্ধে সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু-কিছু কার্যকলাপের কারণে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয়। বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন। এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন। হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে।
১৯৬৪ সালে প্রচন্ড বৈদ্যুতিক সুতার কবিতাটি লেখার জন্য রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । তাকে জেলেও থাকতে হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়েও তিনি লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছিলেন । সারা জীবন লিখেছেন দুই শতাধিক গ্রন্থ । কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস প্রবন্ধ অনুপাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত । "শয়তানের মুখ", "জখম", "ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস" , "নামগণ্ধ চিকিৎসার সমগ্র", "কৌণপের লুচি মাংস", "মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো" তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা । তবে তার সারা জীবনই ছিল বিতর্কিত । ২০০৩ সালের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । বহুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান অসুখে ভুগছিলেন কিন্তু তাঁর কলম ছিল সচল ।
বিশেষ নিবন্ধ
কোচবিহার রাসমেলার রাসচক্রঃ এক সম্প্রীতির বার্তাবাহক
অমলকৃষ্ণ রায়
রাসমেলা কোচবিহারের এক ঐতিহ্যবাহী মেলা। এবছর এই মিলনমেলা ২১১ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। কবে কার বদান্যতায় এই মেলা শুরু হয়েছিল? কথিত আছে, ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ ভেটাগুড়িতে কুলদেবতা মদনমোহন ঠাকুরের রাস উৎসবের সূচনা করে সেখানকার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন। সেই শুভ সূচনালগ্নকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তিনি ভেটাগুড়িতে কয়েকদিন ব্যাপী একটি মেলার আয়োজন করেন। তার নাম ছিল রাসমেলা। তবে এই রাসমেলার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মদনমোহন মন্দির। তাই আলোচনার শুরুতে সেটা কবে স্থাপিত হয়েছিল, এও জানা দরকার। জানা যায়, ১৭৭৩ সালে কোচবিহার রাজ্য স্বাধীন করদমিত্র রাজ্যে পরিণত হবার পর ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত নাজির খগেন্দ্র নারায়ণ ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ সম্পূর্ণরূপে রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ১৮০১ সালে। ১৮০৭ সালে কোচবিহারের সাগরদিঘী খনন করা হয়। সেসময়েই হিরন্যগর্ভ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মেলা উপলক্ষে মদনমোহন মন্দির এলাকার উন্মোক্ত প্রাঙ্গণে একটি বাঁশের তৈরি রাসচক্র থাকে। সেটি রঙবেরঙের কাগজে মোড়া। রাসমেলায় আগত দর্শনার্থীরা এই চক্রকে পায়ের জুতো খুলে ঘুরিয়ে প্রণাম করে থাকেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, সেটা হলো যারা এই চক্রকে ধরে ঘুরিয়ে থাকেন, তারা কে কোন ধর্মালবম্বী সেটা নিয়ে মেলা কর্তৃপক্ষ মাথা ঘামায় না। অর্থাৎ যে কোনও মানুষের জন্য এটি অবারিত। এটি কোনও বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্য নয়, কারও জন্য এ ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় না। এই প্রথা রাসমেলা শুরুর লগ্ন থেকেই হয়ে আসছে। এই উদারতা যে সমাজকে শতাধিক বর্ষ ধরে একটা সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে আসছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এবারে আসি সেই গূঢ় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, জনসাধারণকে এই সম্প্রীতির বার্তা দিতে তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ কেন চক্রকেই বেছে নিলেন? ধর্মের সঙ্গে চক্রের যোগসূত্র কী? তাৎপর্যই বা কী?
প্রথমে আসি প্রাচীনতম বৌদ্ধ ধর্মে চক্রের কী তাৎপর্যের কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে ধর্মচক্র বলে একটা কথা আছে। বৌদ্ধধর্মের মূল ভাবার্থে বলা হয়, আমরা যারা নিত্যময় সংসারে জন্মলাভ করে ভোগবিলাসময় জীবন অতিবাহিত করছি, তাদের সঠিক ধর্মাচরণ হয় না। যদি আমরা যথার্থভাবে ধর্মানুশীলন করে জীবন গঠন করতাম, তাহলে সবকিছুতেই অনাবিল সুখ এবং শান্তি লাভ করা সম্ভব হতো। জীবন সেই অর্থে অর্থবহ হয়ে উঠত। মনুষ্যজীবনের সত্যিকারের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হতো। তাতে আমাদের জন্ম নিম্নগামী হবার সম্ভাবনা থাকত না। ভগবান বুদ্ধ এ বিষয়ে সবার উদ্দেশ্যে পালনীয় বার্তা দিতে দেশনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাকে আমরা ত্রিপিটক বলে জানি। এই দেশনা বা ত্রিপিটক হলো
১) সূত্র পিটক বা ব্যবহারিক দেশনা।
২) বিনয় পিটক বা আজ্ঞা দেশনা
৩) অভিধর্ম পিটক বা পরমার্থ দেশনা।
‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ সূত্র পিটকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ পাঁচটি নিকায় বা খণ্ড রয়েছে— ক) দীর্ঘ, খ) মধ্যম, গ) সংযুক্ত, ঘ) অঙ্গুত্তর এবং ঙ) খুদ্দক।
সংযু্ক্ত খণ্ডে পাঁচটি বর্গ রয়েছে— ক) গাথা খ) নিদান গ) খন্ধ ঘ) ষড়ায়তন এবং ঙ) মহাবর্গ। মহাবর্গের আবার বারোটি উপবিভাগ বা বর্গ রয়েছে।
ধর্মচক্র প্রবর্তন গৃহিত হয়েছে সংযুক্ত উপবর্গের দ্বিতীয় বর্গ থেকে। এবং এটা ষষ্ঠ সংগীতির প্রারম্ভে পাঠ করা হয়েছিল। এটি সংযুক্ত খণ্ডে ৩৬৮ পৃষ্টা থেকে ৩৭১ পৃষ্টা অবধি সংরক্ষিত রয়েছে। এই সূত্রের ভূমিকায় ‘এবং মে সুতং, একং সময়ং ভগবা’ (ভাবার্থ—আমার দ্বারা এরূপে শ্রুত হয়েছে।) এই সূত্রটি ভগবানের প্রথম দেশনা।
এসব সূত্রের শুরুতে দিনতারিখ উল্লেখ না থাকাতে কোনটা কবে লেখা হয়েছিল, তা নির্ণয় করা যায়নি। তবে মোটামুটি ভাবে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। যদি ধরে নেওয়া হয়, আজ থেকে ২৫৫০ বছর বা তারও কিছু বছর আগে ভগবান কুশিনগরে মহা পরিনির্বাণলাভ করেছিলেন। এবং বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনি ৪৫ বছর ধরে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাহলেই বোঝা যাবে যে, তিনি এসব রচনা করেছিলেন, সেই সময়ের কোনও বিশেষ সালে। অর্থাৎ সময়কালটা মোটামুটি ভাবে ২৫৫০+ ৪৫ = ২৫৯৫ বছরের আগেকার। সেসময়ের কোনও এক পূর্ণিমা তিথিতে দেশনা করা হয়েছিল। সেখানে হরিণদের নির্বিঘ্নে থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেজন্য সেখানে তাদের বাস করার মতো উপযু্ক্ত বনজঙ্গলের পরিবেশ রচনা করা হয়েছিল।
বৌদ্ধ ধর্মে উদারতার কথা বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে এই ধর্মে মানুষের মধ্যে মৈত্রী, করুণা, উদারতা, জ্ঞান এবং আরও কিছু ইতিবাচক গুণাবলী বিকাশের কথা বলা হয়েছে। সমাজের ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকা এবং হিতকর কাজে যুক্ত হবার বার্তাও ত্রিপিটকে রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের চাকা চরৈবেতির মতো প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধরে সমাজের এসব ইতিবাচক বার্তা বয়ে অনন্ত কাল ধরে গতিশীল থাকবে। চক্রকে ঘোরানোর পিছনে রয়েছে এই চক্রকে গতিশীল রাখার অঙ্গীকার।
এবার আসি সনাতন হিন্দু ধর্মে চক্রের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনায়। হিন্দুসৃষ্টি চক্রের সঙ্গে মহাজগততত্ত্বের সময়চক্রের সাদৃশ্য রয়েছে। তত্ত্বটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি এবং ধ্বংসের ধারণা প্রদান করে। ভারতের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ, উপনিষদ, মহাভারতে এই সৃষ্টিচক্রের কথা বর্ণিত হয়েছে। হিন্দুসৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ৮৬৪ কোটি বছর পরপর ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়। বর্তমান ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে এবং পরে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি এবং ধ্বংস হয়েছে এবং হবে। এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতে থাকে। এই সময়কালকে এক ব্রহ্ম অহোরাত্র বলা হয়ে থাকে। এই ধর্মের চার পুরুষার্থ হলো ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। অর্থ এবং কাম হলো বৈষয়িক। ধর্ম এবং মোক্ষ হলো আধ্যাত্মিক। হিন্দুধর্মের অন্তিম গতি হলো মোক্ষ বা মুক্তি। পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি। ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং নিরন্তর সাধনার দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। তাহলে নিজেই ব্রহ্মে পরিণত হওয়া সম্ভব অর্থাৎ ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’। সাধনার দ্বারা একবার চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসতে পারলে আর পুনর্জন্মের চরৈবেতির চক্রে আর ঘুরতে হবে না।
আজ থেকে দ্বিশতাধিক বর্ষ আগে মহারাজা এই রাস চক্রের উদ্ভাবন করে হয়তো পৃথিবীর নানা ধর্মের মানুষদেরকে এই সম্প্রীতির বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। ধর্মের মূলেই যে প্রতীকি চক্র রয়েছে, জীবনচক্রের চরৈবেতি রয়েছে, রাসচক্রকে তারই একটা ধর্মনিরপেক্ষ প্রতীকি রূপ বলা যেতে পারে।
এই রাসচক্রের বর্তমান নির্মাতা আলতাফ মিঞা। তিনি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। জানা যায়, আলতাফের দাদু মামুদ মিঞা রাসচক্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। তারপর আলতাফের বাবা আজিজ সে দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি অসুস্থ থাকায় সে দায়িত্ব তারই বংশধরেরা পালন করছেন।
এটা সহজেই অনুমেয় যে, তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের মহারাজগণ বংশপরম্পরায় এই রাসচক্রের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষদেরকে এক অভিন্ন যোগসূত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে, কোচবিহারের ঐতিহ্যবাহী রাসমেলাকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির বার্তাবহনকারী এই মেলা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হতে থাকবে। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বস্তরের এংশগ্রহণ করবে। রাসমেলা হয়ে উঠবে সকলের সম্প্রীতির এক মিলনমেলা। এই প্রত্যাশায় বিশেষ করে কোচবিহারবাসীরা সারাবছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন, কবে আসবে কোচবিহারের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা। রসনাতৃপ্ত আহার্য, বিনোদনের পশরার পাশাপাশি নানারকম সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে সেজে উঠবে মেলার মাঠ।
শিশুদিবসের আবাহন
শিশুর মানসিক বিকাশে মায়ের ভূমিকা
আবদুস সালাম
শিশুর বিকাশ বলতে গ্রোথ এবং ডেভেলপমেন্ট উভয়কেই বোঝায়। গ্রোথ হল আকারগত পরিবর্তন বা পরিমাণগত পরিবর্তন যা কিনা শিশুর ওজন, উচ্চতার মাঝে ধরা পড়ে। অপর দিকে ডেভেলপমেন্ট হল গুনগত পরিবর্তন যা কিনা আচরণের মাঝে ধরা পড়ে। অর্থাৎ একটি শিশুর গ্রোথ এবং ডেভেলপমেন্ট এর উপর ধরা পড়ে তার সার্বিক বিকাশ। এই বিকাশ কালীন সময়ে মায়ের সান্নিধ্যর ভূমিকা অপরিসীম।
সাধারণভাবে একটি শিশুকে আমরা ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখতে পাই এবং তার বয়স গণনা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভূমিষ্ঠ হবার ৯ মাস বা ২৮০ দিন পূর্বেই তার জন্মের সূচনা হয়েছে। একটি শিশুর জন্মের সূচনা থেকেই শুরু হয় তার বর্ধন ও বিকাশ । সে কারণে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে মায়ের খাদ্য, যত পরিচর্যা, মায়ের মনোভাব, মানসিকতা প্রভৃতি শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখে। গর্ভাবস্থায় মা যদি পুষ্টিহীন থাকে তবে সন্তান অপুষ্ট, রুগ্ন ও কম ওজন, উচ্চতা নিয়ে জন্মাবে। সর্বোপরি তার বিকাশ ব্যাহত হবে। যেমন-আয়োডিনের অভাবে শিশু শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিবে। অনেক সময় বোবা-কালা, হাবা-গোবা, বামুনও হয়ে থাকে। ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব হলে অন্ধ, লৌহের অভাবে রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
মূলত শৈশবে শিশুর সার্বিক বিকাশের উপর নির্ভর করে- তার পরবর্তী জীবনের সুখ ও স্বাভাবিকতা। এ কারণে শত ব্যস্তাতার মাঝেও মা-বাবাকে কিছুটা সময় বের করে নিতে হবে শিশুর সান্নিধ্যে থাকার জন্য।
অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। পিতামাতার বচসা-ভুল বোঝাবুঝির ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠে, তার হতাশ অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। না অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনোসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। প্রতিদিন পিতা-মাতার বিবাদের প্রত্যক্ষদর্শী বহু শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের। গর্ভকালে যেসব মাতা নির্যাতনের শিকার কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাদের সন্তানও জন্মের পর নানা প্রতিকূলতায় ভোগে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য এক জরিপে দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর মধ্যে বেশি। মেয়েশিশুদের ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশের পাশাপাশি ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ ছেলেশিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
শিশুর বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকার বিকল্প নেই। শিক্ষক ছাড়া শিশুর বিকাশ সম্ভব নয়। শিক্ষকগণ হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষক শিশুর বিকাশে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারেন। শিশুরা সেই শিক্ষকদের থেকেই বিকশিত হবে। শিক্ষকগণ হচ্ছেন দেশ ও জাতির আলো। শিশুরা সেই শিক্ষকদের থেকে আলোকিত হবে, বিকশিত হবে। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য কী? এর জবাবে বলা হয়েছে শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞান মনস্কতায়, ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। শিশুর এসব ধরনের বিকাশ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে শিক্ষকদেরকেই।
শিক্ষককে হতে হবে মেধাবী, সুশিক্ষিত, সুদক্ষ, সুযোগ্য, কর্মঠ, ধার্মিক, সৎ ও মহৎ। কারণ উক্ত গুণাবলী ছাড়া একজন লোক প্রকৃত শিক্ষক হতে পারেন না। আর প্রকৃত গুণের শিক্ষক ছাড়া সেই শিশুরা বিকশিত হতে পারবে না। একজন শিক্ষক মেধাবী হলে ছাত্রও মেধাবী হবে, একজন শিক্ষক সুদক্ষ, সৎ ও মহৎ হলে ছাত্রও সুদক্ষ, সৎ ও মহৎ হবেই। এক কথায় শিক্ষক হচ্ছেন শিশুর বিকাশের অনন্য চাবিকাঠি। শিক্ষকদের থেকেই শিশুরা উন্নত জীবন গঠনের প্রকৃত দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকে।
কবির ভাষায় ‘ মানব কোলে জন্মে কি সবাই মানুষ হয়/ আদর্শ মানুষ জন্ম দেয় আমাদের বিদ্যালয়।’
আদর্শ মানুষ সোনার মানুষ হতে হলে জীবনকে বিকশিত করতে হলে বিদ্যালয়ে যেতে হবে, শিক্ষকের সাহচর্য একান্ত জরুরী। একজন শিশুর বিকাশে মাতাপিতা যেসব পদ্ধতি উপস্থাপন করতে পারেন এর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পদ্ধতি উপস্থাপন করতে পারেন একজন শিক্ষক। কেননা সাধারণত অনেক সময় একজন শিক্ষক জ্ঞান দক্ষতায় মাতাপিতার চেয়ে অনেক উচ্চ মানের হয়ে থাকেন। যেসব ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশ মাতাপিতার দ্বারা করা সম্ভব হয় না সেসব ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয় একমাত্র শিক্ষকের মাধ্যমেই। এজন্য প্রয়োজন বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিশুর প্রতি শিক্ষকদের আন্তরিক হওয়া। বিদ্যালয়ে প্রতিটি শিশুকে শিক্ষকগণ আন্তরিকভাবে পাঠদান করাননা বলেই অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা পিছিয়ে পড়ে। ফলে এসব শিশুরা জীবনে বিকশিত হতে পারে না।
বিদ্যালয়ের শিশুর বিকাশে এগিয়ে আসা সকল শিক্ষকের মহান দায়িত্ব। শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। সেই শিশুদের বাদ দিয়ে পরিবার, সমাজ, দেশ ওজাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তাই সর্বাগ্রে শিশুর বিকাশে এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।
আমরা আজ গ্লোবাল ভিলেজে বাস করছি। বিশ্বায়নের প্রভাবে আজ আমরা সবাই প্রভাবিত। মোবাইল ফোনে আমরা বিশ্বের সমগ্র সংবাদ পেয়ে থাকি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুনিয়ার সব তথ্য আমরা সংগ্রহ করে থাকি। ডিস লাইন যুক্ত টিভির সাহায্যে আমরা বিশ্বের শত শত দেশের নাগরিকদের চাল-চলন, আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস পোশাক পরিচ্ছদ, কৃষ্টি, কালচার তাৎক্ষণিকভাবে দেখি বা জানতে পারি। কোমলমতি শিশুরা ভিন্ন কৃষ্টি, কালচারেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এদের আচার আচরণ অস্বাভাবিক হওয়ার সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সমস্যা দূরীকরণে মেধা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।
টিভির চাকচিক্যময় প্রচার প্রপাগান্ডা আজ আমাদেরকে প্রভাবিত করছে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলির মার্কেটিং এর প্রভাব আজ বিত্তহীন বিত্তবান সব পর্যায়ের পরিবারকে প্রভাবিত করছে।
পোশাক পরিচ্ছেদেও দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন। ভাল সুন্দর প্যান্ট শার্ট পরিত্যাগ করে জোড়া তালি দেওয়া জিনসের প্যান্ট শার্ট পরছে আমাদের কিশোর যুবকেরা। আবার একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন সবার কারনে এয়ারফোন আর পকেটে ওয়াকিটকি। তারা সাধারণ মানুষের কথা শুনেনা। তারা ২৪ ঘন্টা রেডিও, টিভি ও ক্যাসেট, ভিডিও শুনে সময় কাটায়। এদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য বাবা, মা এবং শিক্ষক সকলকেই নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ।
তবেই গড়ে উঠবে সুন্দর সুশীল সমাজ। আগামী প্রজন্মের কাছে রেখে যাবো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথায় —-
"এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্হান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যার্থ ,মৃত আর ধ্বংসস্তুপ- পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব -তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণ পণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল ,
এবিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার -"
শিশুদের অধিকারশ্রাবণী সেনগুপ্ত
যে কোনো পরিস্থিতি, পরিবেশে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষাহীনতায় ভোগে শিশুরা। সমাজ- সংসারে অসুরক্ষিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির শিকার তারা। শিশুদের সুরক্ষা প্রদান করার জন্য আঠারো বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে কতগুলি আইন বলবৎ করা হয়েছে। আমার আজকের লেখায় আমি সেগুলির সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
স্যার উইলিয়াম ব্ল্যাক স্টোন সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার তিনটি দায়িত্ব চিহ্নিত করেছেন, সেগুলি হল- রক্ষণাবেক্ষণ, সুরক্ষা, এবং শিক্ষা। লীগ অফ নেশনস শিশু অধিকারের জেনেভা ঘোষণাপত্র(১৯২৪) গ্রহণ করে, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের প্রয়োজনীয়তা ,ক্ষুধার্থ শিশুকে খাওয়ানোর অধিকার ,অসুস্থ শিশুকে স্বাস্থ্য পাওয়ার অধিকার প্রকাশ করে। পিছিয়ে পড়া শিশুদের অধিকার, অনাথ শিশুদের আশ্রয়ের অধিকার ,শোষণ থেকে সুরক্ষার অধিকার জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র( ১৯৪৮) অনুচ্ছেদ ২৫ (২) এ মাতৃত্ব এবং শৈশবকে 'বিশেষ সুরক্ষা ও সহায়তা 'এবং সকল শিশুর সামাজিক সুরক্ষার অধিকার কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘের শিশু অধিকারের ঘোষণাপত্র(১৯৫৯) গৃহীত হয়, যা শিশুদের সুরক্ষার অধিকার এবং বৈষম্য থেকে সুরক্ষার অধিকার সহ শিশুদের অধিকার সুরক্ষার জন্য দশটি নীতিমালা ঘোষণা করে। গত ৫০ বছরে শিশুদের অধিকার নির্ধারণে ঐক্যমত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হিলারি ক্লিনটনের( তৎকালীন একজন অ্যাটর্নি) ১৯৭৩ সালের একটি প্রকাশনা বলেছিল যে, শিশুদের অধিকারের ধারণা এখনো ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে শিশুদের দুই ধরনের মানবাধিকার রয়েছে, তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই মৌলিক সাধারণ মানবাধিকার রয়েছে যদিও কিছু মানবাধিকার -যেমন বিয়ের অধিকার তাদের বয়স না হওয়া পর্যন্ত উপলব্ধ হবে না; দ্বিতীয়ত তাদের বিশেষ মানবাধিকার রয়েছে, যা তাদের সংখ্যালঘু অবস্থায় তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়।
শিশুদের বিশেষ মানবাধিকারের মধ্যে রয়েছে -বেঁচে থাকার অধিকার, একটি নামের অধিকার, শিশু সংক্রান্ত বিষয়ে তার মত প্রকাশের অধিকার, বিবেক এবং ধর্মের অধিকার, স্বাস্থ্য সেবার অধিকার ,অর্থনৈতিক ও যৌন শোষণ থেকে সুরক্ষার অধিকার এবং শিক্ষার অধিকার। শিশুদের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষাগত নির্দেশিকাগুলি শিশু অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশনে বর্ণিত অধিকার গুলিকে 3 PS হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করে-বিধান, সুরক্ষা এবং অংশগ্রহণ। এগুলি নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে- বিধান-শিশুদের পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা শিক্ষা ও সেবা এবং খেলাধুলা ও বিনোদনের অধিকার রয়েছে , শিশুদের একটি সুষম খাদ্য ,ঘুমোনোর জন্য উপযুক্ত বিছানা এবং স্কুলে পড়াশোনার প্রবেশাধিকার রয়েছে ।সুরক্ষা--শিশুদের অপব্যবহার, অবহেলা শোষণ এবং বৈষম্য থেকে সুরক্ষার অধিকার রয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের নিরাপদ জায়গা পাওয়ার অধিকার, গঠনমূলক শিশু লালন পালনের আচরণ এবং শিশুদের বিকশিত ক্ষমতার স্বীকৃতি।অংশগ্রহণ---সমাজে বা কমিউনিটিতে অংশগ্রহণের অধিকার আছে --এর মধ্যে রয়েছে লাইব্রেরী এবং কমিউনিটি প্রোগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ এবং তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
শিশু অধিকার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক (সিআরআইএন) এই অধিকারকে দুটি গ্রুপের শ্রেণীবদ্ধ করে ---অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। মৌলিক মানুষের চাহিদা যেমন -খাদ্য ,বাসস্থান ,শিক্ষা ,স্বাস্থ্যসেবা এবং লাভজনক কর্মসংস্থান পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলির সাথে সম্পর্কিত অধিকার;পরিবেশগত সাংস্কৃতিক এবং উন্নয়নমূলক অধিকার ,যাকে কখনো কখনো তৃতীয় প্রজন্মের অধিকার বলা হয় এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের অধিকারসহ জনগণের গোষ্ঠীর সংস্কৃতি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অধিকার রয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শিশুদের চারটি বিশেষ অধিকার সমর্থন করে- যার মধ্যে প্যারোল ছাড়া কিশোর কারাবাস এর অবসান ,শিশুদের সামরিক ব্যবহার বন্ধ, শ্রেণিকক্ষে মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ।হিউম্যান রাইটস ওয়াচ- একটি আন্তর্জাতিক প্রচার সংগঠন ,যা শিশুশ্রম, কিশোর বিচার ,অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশু ,উদ্বাস্তু পথশিশু -এদের ব্যাপারে কথা বলে। নিম্নলিখিত অধিকার গুলি শিশুদের সুস্থ ও মুক্তভাবে বেড়ে ওঠার অনুমতি দেয়- বাক স্বাধীনতা ,চিন্তার স্বাধীনতা ,ভয় থেকে মুক্তি, পছন্দ করার স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার অধিকার ।আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়ট্রিকস (এএপি)( ১৯৯৭) এর বায়ো। ইথিকস কমিটি কনভেনশন অন দা রাইটস অফ চাইল্ড (১৯৮৯) উল্লেখ করে বলেছে যে-'প্রতিটি শিশুর প্রতিরোধযোগ্য অসুস্থতা বা আঘাত থেকে মুক্ত হয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ থাকা উচিত।'
বিশ্বজুড়ে শিশুদের অধিকার সম্বন্ধে বেশ কিছু কনভেনশন এবং আইন রয়েছে, বেশ কয়েকটি বর্তমান এবং ঐতিহাসিক দলিল সেই অধিকার গুলিকে প্রভাবিত করে যার মধ্যে রয়েছে শিশু ও অধিকারের ঘোষণাপত্র ১৯২৩ সালে এ এগলান্টিন জেবের খসড়া, ১৯২৪ সালে লীগ অফ নেশনস দ্বারা অনুমোদিত এবং ১৯৩৪ সালে পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছিল এবং ১৯৫৯ সালে সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। এটি পরবর্তীতে শিশু অধিকারের সনদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে ।জাতিসংঘ ১৯৬৬ সালে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) গৃহীত হয়। আইসিসিপিআর একটি বহু পরীক্ষিত আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা পৃথিবীর প্রায় সব দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ২৩ শে মার্চ এই চুক্তি কার্যকর হয় ।আইসিসিপি আর কর্তৃক সংজ্ঞায়িত অধিকার গুলি সর্বজনীন তাই তারা ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য এবং এদের মধ্যে অবশ্যই রয়েছে শিশু ।শিশুদের জন্য প্রযোজ্য কিছু সাধারণ অধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এতে -বেঁচে থাকার অধিকার, ব্যক্তির নিরাপত্তার অধিকার ,নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার, নিষ্ঠুর অমানবিক বা অবমাননা কর আচরণ বা শাস্তি থেকে মুক্তির অধিকার, অপরাধের অভিযোগে প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে পিথা খাওয়ার অধিকার দ্রুত বিচারের অধিকার এবং তাদের বয়সের সাথে উপযুক্ত আচরণ করার অধিকার জাতিসংঘের ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার কানভেনশন বা সিআরসি মানবাধিকারের সম্পূর্ণ পরিসর -নাগরিক, সাংস্কৃতিক ,রাজনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার গুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রথম বাধ্যতামূলক আইন। এর বাস্তবায়ন শিশু অধিকার কমিটি দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয় ,যারা এটি অনুমোদন করে তারা শিশুদের অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে এই প্রতিশ্রুতির জন্য জবাবদিহি করতে সম্মত হয়। সিআরসি চারটি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে আছে, সেগুলি হল--- বৈষম্যহীনতার নীতি, সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ জীবন বেঁচে থাকার এবং উন্নয়নের অধিকার এবং তাদের বয়স এবং পরিপক্কতা অনুযায়ী তাদের প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্তে শিশুর মতামত বিবেচনা করা। ভিয়েনা ঘোষণা পত্র এবং কর্মসূচির ধারা ২,অনুচ্ছেদ ৪৭ এ সব দেশকে বিশ্ব সামিট প্ল্যান অফ একশন এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সহায়তায় তাদের উপলব্ধ সম্পদের সর্বোচ্চ পরিমাণে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে এবং রাজ্যগুলিকে তাদের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় শিশু অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশন জানানো হয়। এই জাতীয় কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, অপুষ্টি ও নিরক্ষরতার হার হ্রাস এবং নিরাপদ পানীয় জল এবং মৌলিক শিক্ষার উপলব্ধি প্রদানকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অনুচ্ছেদ ৪৮ সকল রাজ্যকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সহায়তায় ,বিশেষ করে কঠিন পরিস্থিতিতে শিশুদের তীব্র সমস্যা মোকাবিলার আহ্বান জানায়। শিশুদের শোষণ এবং অপব্যবহার সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করা উচিত, যার মধ্যে তাদের মূল কারণগুলি মোকাবিলা করা -নারী শিশু হত্যা ,ক্ষতিকর শিশুশ্রম শিশু, অঙ্গ বিক্রয় বৃদ্ধি এবং অন্যান্য ধরনের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োজন। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রক্রিয়া বিদ্যমান, এর মধ্যে রয়েছে-- জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে শিশু অধিকার দলের সমিতি। শিশু অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং সম্মতি প্রচারের জন্য এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের শিশু অধিবেশনের বিশেষ অধিবেশন এবং প্রক্রিয়ার সময় শিশু অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।এনজিও গ্রুপ ফর দ্যা ফর কনভেনশন অন দা childs হল আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার একটি জোট ,যা মূলত ১৯৮৩ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের বাস্তবায়নের সুবিধার্থে গঠিত হয়েছিল। বিশ্বের অনেক দেশে শিশুদের অধিকার পালক বা শিশু কমিশনার রয়েছে ,যাদের সরকারি কর্তব্য শিশুদের অধিকার সম্পর্কে পৃথক নাগরিকদের দ্বারা রিপোর্ট করা অভিযোগগুলি তদন্ত এবং সমাধান করে জনস্বার্থে প্রতিনিধিত্ব করা ।শিশুদের নাইপাল ব্যক্তিরা একটি কর্পোরেশন একটি সংবাদপত্র একটি এনজিও বা এমন কি সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করতে পারে ।
ভারতের সংবিধানে শিশুদের যে অধিকারগুলি বিশেষভাবে গণনা করা হয়েছে ,সেগুলি হল-
ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী সকল শিশুর জন্য বিনামূল্যে এবং কঠোরতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার(অনুচ্ছেদ ২১ক )
১৪ বছর পুরনো পর্যন্ত যে কোনোরকম জটিল ও ঝামেলার কাজ না করার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৪)
বয়স বা শক্তির পক্ষে উপযুক্ত নয় এমন কোন কাজে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার কারণে যোগ দেওয়া এবং নিগৃহীত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৯ ঙ)
স্বাধীনভাবে ও মর্যাদার সঙ্গে এবং সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সব রকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার এবং নৈতিক ও বস্তুগত পরিত্যাগ ও নিগ্রহের বিরুদ্ধে শৈশব ও যৌবনকে রক্ষা করার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৯চ)
এই সমস্ত অধিকার গুলি ছাড়াও যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় নারী বা পুরুষ যেসব অধিকার ভোগ করে থাকেন ভারতের নাগরিক হিসেবে সেসব অধিকারী শিশুদের রয়েছে-- সাম্যের অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৪)
বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫) ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আইনের যথাযোগ্য প্রক্রিয়ার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২১ )
বেগার শ্রমিক হিসেবে কাজ করা এবং পাচার হওয়া থেকে বাঁচার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৩) দুর্বল শ্রেণীর মানুষদের সামাজিক অন্যায় ও সবরকম শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার (অনুচ্ছেদ ৪৬ )
শিশুদের এইসব অধিকার বাস্তবায়নে পিতা মাতা পরিবার ও সমাজের সকলের ভূমিকা অপরিসীম। শিশুদের সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিত করে তাদের শিক্ষিত ও দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। অর্থনৈতিক ধর্মীয় লিঙ্গ গোত্র শারীরিক কোন শ্রেণী ভেদে শিশুদের বিভাজন করা যাবে না এইসব পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলেই শিশুরা হয়ে উঠবে আমাদের আগামী কর্ণধার আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক বিকাশ এবং পুষ্টি নিশ্চয়তা থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে আমাদের কর্তব্য। শিশুরা চায় তাদের চারপাশের মানুষজন তাদেরকে ভালোবাসুক এবং স্নেহের পরশ দেয় তারা চায় একটি সুন্দর নিরাপদ আশ্রয়। দেশের সব শিশুকে উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করার জন্য সরকার নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নবজাতকের জীবন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিশুর জীবন রক্ষায় পরিচ্ছন্নতা,সময়মতো জন্ম নিবন্ধন ,শিশুর সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, শৈশবের পরিচর্যা ও বিকাশ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর ওপর সহিংসতা রোধ,বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ,কিশোর কিশোরীদের শিক্ষা সুযোগ নিশ্চিত করা ,বয়সন্ধিকালের স্বাস্থ্য সেবা এই সকল বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দেওয়ার জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই শিশুদের আগামী ভবিষ্যৎ সুরক্ষা সুনিশ্চিত হবে।
শিশুশ্রম বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় চরম লজ্জার
বটু কৃষ্ণ হালদার
আমাদের দেশে শিশুরাই আগামীর পথ,উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আজ যে চারা গাছ আগামীতে সে মহা বৃক্ষ। ঠিক তেমনই আজ যে শিশু আগামীতে সে পিতা অর্থাৎ একজন দেশের নাগরিক। শিশুই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। প্রত্যেক শিশুর মধ্যে ভবিষ্যৎ দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতিভা সুপ্ত রয়েছে। এ সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন হলে প্রতিটি শিশু জাতির কর্ণধারের ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুরাই প্রত্যেক পরিবার, সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছেন- Child is the father of men. জাতি আশা করে, আজকের শিশু সার্বিক গুণে গুণান্বিত হয়ে দেশের আদর্শ নাগরিক হবে। প্রতিটি শিশুর মধ্যে নিহিত আছে বিপুল সম্ভাবনা।
কারণ শিশুরাই বড় হয়ে একদিন সমাজ ও দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। শিশুমানসে তাদের প্রতিভা লুক্কায়িত থাকে। তাই সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্ম তথা শিশুদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। আর এ দায়িত্ব সর্বাগ্রে যারা পালন করবেন তারা হলেন পিতামাতা। শিশুরা অনুকূল ও উপযুক্ত পরিবেশে প্রতিপালিত হলে এবং সুশিক্ষা পেলে আদর্শ মানুষ হয়ে দেশ ও দশের সুনাম বৃদ্ধি করবে। শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে শিশুমানসের সযত্ন গঠন দরকার। উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষার অভাবে আমাদের দেশের বহু শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য শিশুর উপযুক্ত মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা করা সবার একান্ত কর্তব্য।
শিশুরাই ভবিষ্যতে বড় হয়ে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেবে। তাই শিশুদের প্রতি যত্ন নেওয়া প্রত্যেকের নৈতিক কর্তব্য। ভবিষ্যতে শিশুরাই আমাদের স্থানে স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করবে। শিশুদের সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি গোলাম মুস্তাফা তাঁর কিশোর কবিতায় শিশুদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন:_ "ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে/ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।"
সাল ২০২৩,স্বাধীনতার ৭৬ বছর অতিক্রান্ত,দেশ আধুনিক সভ্যতার আঙিনায় পা রেখেছে।অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যাবহারে ভারত বর্ষ ডিজিটাল ইন্ডিয়া তে রূপান্তরিত হয়েছে।কিন্তু আদপে ভারত বর্ষ কি সত্যিই সভ্য হয়ে উঠেছে? কারণ যে আধুনিকতার রঙে আমরা সবাই রঙিন হয়ে উঠেছি সেই সভ্য সমাজের মুখোশের পেছনে রয়েছে আরও একটি অন্ধকারের বিভীষিকা ময় রূপ।সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সেটি হল আমাদের সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা গুলির মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ।সেই জ্বলন্ত সমস্যার নাম শিশু শ্রম।দেশ স্বাধীন তার প্রায় ৭৫ বছর অতিক্রান্ত, দেশের সরকার বারবার এই জীবন্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করলেও রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকান ,ইটভাটা ,হোটেল চাষের ক্ষেত বিড়ি বাধা, বোতল কুড়ানো, গৃহভিত্তিক কর্ম,রাজমিস্ত্রি জোগাড়ে,এমনকি ভিক্ষা করতে ছোট ছোট শিশু দের ব্যাবহার করা হচ্ছে। ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানোটা আজকাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাতে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাজনৈতিক অনেক রথি মহারথীরা যুক্ত রয়েছেন। বিটিশা প্রায় ২০০ বছর যাবত আমাদের ভারতবর্ষকে লুণ্ঠন করে তাদের সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছে সোনার চামচ, আর আমাদের দেশের সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে।তবে স্বাধীনতার পরে শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানা আইন তৈরি হলেও তার হয়ে গেছে খাতা কলমে। ব্রিটিশরা যেটুকু ভারতবর্ষে রেখেছিল তা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা লুটেপুটে খাচ্ছে। তাতে ভারত বর্ষ আরো গরীব দেশে পরিণত হচ্ছে।বেড়ে চলেছে শিশু শ্রমের সংখ্যা।শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানান আইন তৈরি হলে তা খাতা কলমে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
মানব জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে শৈশবের অবস্থান।এই বয়সে তাদের হাসি খেলা এবং পড়াশোনা নিয়ে থাকার কথা সেই বয়সে তারা হয়ে উঠছে কর্মমুখী। অথচ এই শিশুদেরকে বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ।কর্মমুখী হওয়ার ফলে বহু শিশুদের প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠিকঠাক মতো ভাবে পরিচর্যা করলে হয়তো দেখা যেত ওই সমস্ত শিশুগুলোর মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ দেশের মুখ উজ্জ্বলকারী সন্তান হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু সমাজের বুকে জায়গা করে নিচ্ছে শিশু শ্রমিক হিসেবে। আর এইসব শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটছে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ। তারা তাদের কম পয়সা দিয়ে অথবা দুবেলার খাবার দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নিচ্ছে।
২০১৯ এর করানো মহামাড়িতে দেশে লকডাউন চলতে থাকায় বন্ধ ছিল সমস্ত মানুষের রোজগার। উল্লেখযোগ্যভাবে বন্ধ ছিল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়।যার ফলে অনেক ছোট ছোট পড়ুয়ায় পড়াশোনার ব্যাগ কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শিশু শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয় বিশেষত ফুটপাতের দোকানগুলিতে। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ে খুললেও আর বিদ্যালয় মুখী হয়নি সেই সব ছেলেমেয়েরা। তারা শিশু শ্রমিক হিসেবে থেকে গেছে সমাজের বুকে।শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করার জন্য আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন আইন, রয়েছে শিশু সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কমিটি।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকার এই শিশুশ্রমকে বন্ধ করার জন্য আইন করে ১৪ বছর বয়সের কম শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে।তাতে ও চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ,র তথ্য অনুযায়ী শিশু শ্রমিকদের যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত লজ্জাজনক।সমগ্র ভারতে ৫_১৮ বছরের প্রতি ১১ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শ্রমিক।১৫_১৮ বছরের শিশুদের পাঁচ জনে একজন শ্রমিক।২০০১_২০১১ সালের মধ্যে শহরের শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে সেই পরিসংখ্যান আরো ভয়ংকর, প্রায় ৮০ শতাংশ।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ থেকে চোদ্দ বছরের শিশু শ্রমিক ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ।কিন্তু তবুও আইন লঙ্ঘন করে এই কাজ করে চলেছে অনেকে।যার ফলে নষ্ট হচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ ভেঙে পড়ছে আমাদের জাতির মেরুদন্ড।
আমাদের সকলেরই জানা ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই সমস্যা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।কিন্তু কোন কাজই কঠিন হবে না যদি আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই বিষয়ে সচেতন হওয়াটা খুবই জরুরী।কিন্তু আমরা যদি এখন থেকে শিশুশ্রম এর মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছোট ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে থাকি তবে ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদেরকে বড় মূল্য দিতে হবে। পঙ্গু হয়ে পড়বে আমাদের ভারত বর্ষ।কারণ শিশুরাই হল জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আমরা যদি ঠিকমতো সুরক্ষা দিতে না পারি তবে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় অভিশাপ অপেক্ষা করছে।তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের উচিত এই জঘন্য ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করা। তবেই ভবিষ্যতে আমরা সোনার ভারতবর্ষ গড়তে পারব।এখন ই করো,শিশুশ্রমের সমাপ্তি এই সংকল্প নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর যারা শিশুদেরকে দিয়ে শ্রম করানোর চেষ্টা করছে তাদের বুঝতে হবে তাদের ঘরের সন্তান আর যারা শ্রম করছে তারাও এই ভারতবর্ষের সন্তান। আর বুঝতে হবে যতদিন শিশু শ্রমের মত সামাজিক ব্যাধি এই দেশ থেকে ধ্বংস না হচ্ছে ততদিন ভারতবর্ষ কখনোই সোনার ভারতবর্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।
দা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ২০০২ সালে বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস হিসেবে আজ অর্থাৎ ১২ই জুন কে বেছে নিয়েছিল।সেই থেকে পালিত হয় আসছে আজকের এই দিন।এখনো সারা বিশ্বে প্রায় ১৫২মিলিয়ন শিশু শ্রম করে ।আন্তর্জাতিক স্তরে তাই ক্যাম্পেন করে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো টা যে অপরাধ তার প্রচার ও প্রসার হয়ে চলেছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার জন্য অসংখ্য বাবা মা তাঁদের শিশুদের কাজ করতে পাঠায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে।যা একেবারেই প্রযোজ্য নয় ।শিশুদের দ্বারা শ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ জেনে ও আজ ও চলছে এই শিশুদের নিয়ে কাজ করানোর প্রবণতা।আইনের ঊর্ধ্বে ফাঁক ,তাই এই ধরনের সমস্যা আজও দেখতে পাওয়া যায় সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নজর রাখলেই অনুমেয়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো শিশুদের খাটনি চায়ের দোকানে,হোটেল রেস্টুরেন্টে, চলচ্চিত্রে প্রমুখ স্থানে শিশুদের পরিশ্রম করতে দেখতে পেলেও প্রতিবাদ করতে পারি না।এই প্রতিবাদ যেদিন কলরবে উচ্চারিত হবে সেদিন আমরা হয়ত আমাদের লজ্জা কে ঢাকতে পারবো।এই বিশ্বে মন ভালো করার সবথেকে সুন্দর জিনিস হল শিশুর হাসি।তাদের কে প্রাণ খুলে খেলতে,হাসতে দিন।ওরা ও এই ধরিত্রীর অমূল্য সম্পদ।ওদেরকে প্রাণ খুলে বাঁচার সুযোগ করে দিন।বিশ্বের সকল শিশু শ্রমের সাথে যুক্ত ক্ষুদেদের প্রতি সমবেদনা জানাই,আর এর পরিবর্তনের উদিত সূর্য্যের অপেক্ষায় রইলাম।
সর্ব ধর্ম সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের উৎসব রেশ সর্বদা বজায় থাকে। এই উৎসবগুলো পালন করতে লক্ষাধিক টাকা এমনকি কোটি কোটি টাকা ও ব্যয় করা হয়। যে দেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উৎসব পালন হয় সেই দেশে শিশু শ্রমিকের হার বেড়ে চলা, কিংবা ছোট ছোট শিশুরা দুই হাত পেতে ভিক্ষা করার চিত্র কি সামাজিক লজ্জা নয়? এ সমস্ত ঘটনাগুলো কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? মনে রাখবেন এই সামাজিক লজ্জা শুধু আমার আপনার নয় সমগ্র ভারতবাসীর? তবে যে যার মত করে উৎসব পালন করুন, সেই উৎসবে ওই অসহায় শিশুগুলোকে আলোর রোশনাই ও প্রাণোচ্ছল জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন।
শিশু দিবসে ভাবনা
বেলা দে
ক্রমান্বয়ে ধারা বদলে যাওয়া শৈশব যাপনে কেউ হয়তো একটু বেশিই উচ্ছ্বসিত, কেউ আবার মানতে
চাইছে না বিগ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর পন্যায়নে স্মার্টফোনের দখলদারি। অতি সভ্যতায় ছুটে চলা শৈশব প্রযুক্তির লাটাই ধরে ভেসে চলেছে ঘুড়ির মতন, ভোঁ কাট্টায় মাটিতে আছড়ে পড়ছে অজান্তেই বহু নাবালক জীবন। অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বরা অবশ্য বলেন বিজ্ঞান সভ্যতার প্রাণ, নি:সন্দেহে বিজ্ঞান এগিয়ে দিয়েছে কয়েক ধাপ উপরে, আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখলে ধ্বংসের দিকে ঠেলেও দিয়েছে নরম
ফুলেল শৈশব। যৌথ পরিবারের পরিকাঠামোর মধ্যে শিশু বড় হলে মানবিক চৈতন্যবোধ ছোট থেকেই তৈরি হতে বাধ্য, এ প্রজন্ম যেটা একেবারে হারিয়ে ফেলেছে ফলে নি:সঙ্গ শৈশব একাকীত্বে ভুগে আসক্ত হয়ে পড়ছে Android হাই টেক স্মার্ট ফোনে,পারদর্শী শিশু নানা আপত্তিকর আপে আঙুল চালিয়ে বের করে আনে মরণদায়ী খেলা। ফলস্বরূপ জীবন সংশয় এবং প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়, আজ গ্রামগঞ্জ ছাপিয়ে চলেছে সে খেলা। ছোটদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছি আমরা অভিভাবকেরা, নিউক্লিয়াসে ঠাকুমা, দিদিমা, দাদু ঠাকুর্দা, কাকা কাকিমা পিসি, মাসি এই সম্পর্কের নামগুলোই এই প্রজন্মের কাছে অচেনা। মা-বাবা চাকুরীক্ষেত্রে চলে গেলে একা ঘরে সঙ্গী করে নেয় মোবাইল বন্ধুকে। আমারা ভুলিয়ে দিয়েছি এদের প্রয়োজনীয়তা, আমাদের জমানায় ছিল তুতো ভাইবোনেদের সাথে আনন্দমুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া, ভাগ করে খাওয়ার সম্পর্ক, ঘর ছোট মাথা অনেকজন, সেখান থেকে তৈরি হয়েছে পারস্পরিক ভালবাসা ও টান। মোবাইল ফোন মানে হেসেখেলে ছুটে বেড়ানো শৈশব কৈশোর বিসর্জন। শিশুদিবসে আমার নিজস্ব প্রতিবেদন এবং ভাবনাও বলা যায় সুচিন্তক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যদি এই বিষয়টি নিয়ে একটু ঘুরে দাঁড়ান তাহলে ভবিষ্যতে বড়সড় রকমের বিপদ আটকাতে সক্ষম হবেন। মানছি প্রযুক্তি মাথার ছাতার মতো কাজ করে, পৌঁছে দিয়েছে গ্রহ তারকার কাছটিতে, চাঁদ আর ছেলে ভোলানো টিপ পড়ানো মামাটি নেই, সজ্ঞান শিশুরা সব বোঝে। মোবাইলের প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি শিক্ষাক্ষেত্রে, বিভিন্নরকম সন্ত্রাসের খপ্পর থেকে সহায়তায়, বিশেষত কন্যাশিশুর কামার্ত পুঙ্গবদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় অথবা কৌশলের কাজেও অসাধ্য সাধন করতে পারে। শিক্ষার জন্য বড় উপহার অন্তর্জাল, কিন্তু ভালো দিকটা বেছে নেয় কয়জন। ১৪ নভেম্বর শিশুদিবসে এমন পরিকল্পনা করা হোক সাপ মরবে লাঠিও ভাঙবে না,শিক্ষা এবং আত্মরক্ষার্থে এইফোন ব্যবহৃত হলেও ক্ষতিকারক আপগুলি বন্ধ করে দেওয়া হলে শিশুদের প্রতি ন্যায় করা হবে বলে মনে করি।
জিৎ-এর শিশু দিবসসোম শুভ্র চক্রবর্তী
(অষ্টম শ্রেণী)
বছর দশেকের জিৎ হঠাৎ একটা অ্যাক্সিডেন্টে সে তার মা-বাবাকে হারায় ।তাই তার জেঠু অভিজিৎ বাবু জিতের সব দায়িত্ব নেন। কিন্তু অভিজিৎ জিৎকে একদম পছন্দ করেনা এবং ভালবাসেন না।
অভিজিৎ একজন বড় হোটেলের মালিক। অভিজিৎ তার ছেলে রীতকে শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্কুলে পড়াশোনা করায়। কিন্তু এদিকে সে তার ভাইপো জিৎ এর পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। সে তার ভাইপোকে ঘরের কাজকর্ম করায় এবং মাঝে মাঝে সে তাকে হোটেলে নিয়ে যায়, হোটেলের কাজ করানোর জন্য।
রীতের সাথে তাদেরই পাড়ার কৌশিকের খুব ভালো বন্ধুত্ব।
কৌশিক খেয়াল করে জিৎ প্রত্যেকদিন রীত কে স্কুল বাসে ওঠার সময় ওর ভারী ব্যাগ তুলে দেয় ।খেলার মাঠে কৌশিকের জন্য জলের বোতল নিয়ে যায় ।
তারপরে সেদিন যখন কৌশিক রীতদের বাড়ি গেল সেদিন সে গিয়ে দেখে জিৎ ঘর মুছছে। তাদেরকে কিছুক্ষণ পর জিৎ খাবার এনে দিল। কৌশিক জানে যে রিতের ভাই হচ্ছে জিৎ।
রীত যেহেতু কৌশিকের ভালো বন্ধু তাই সে রীতকে বলে, -""আরে ও তো তোর ভাই হয় ।তো ওকে তোরা কোনও স্কুলে ভর্তি করাস নি ?ও পড়াশোনাও করে না?
ও এভাবে বাড়িতে কাজ করে কেন ?
এরকম করে কাজ করা তো ঠিক না। "
রীত বলে_" আরে বাদ দে না ওসব ।ও আসলে আমাদের সংসারে একটা বোঝা। আমার কাকু মানে ওর বাবা এক্সিডেন্টে মারা গেছে, তুই তো জানিস।
তাই আমার বাবা ওকে অ্যাডপ্ট করেছে। কিন্তু ওর অত দায়িত্ব আমার বাবা নিতে চাইছে না। তাই বাবা ওকে স্কুলে ভর্তি করাননি।তুই তো জানিস একটা স্কুলে ভর্তি করানো মানে কত খরচা ।বাবা চায় না ওর পিছনে অত খরচা করতে।
রীতের কথাগুলো শুনে কৌশিকের খুব খারাপ লাগলো। সে আর কিছু বলল না। চুপচাপ বাড়ি এসে মন খারাপ করে বসে থাকলো। কৌশিকের মন খারাপ দেখে তার বাবা বলল-"" কি হয়েছে ?"
কৌশিক বলল -"'বাবা তুমি জানো রীতের বাবা রীতির একটা ভাইকে অ্যাডাপ্ট করেছে, ওর নাম জিৎ। ওর মা-বাবা কেউ নেই।
কৌশিকের বাবা -" হ্যা জানি তো।"
কৌশিক _"কিন্তু তুমি কি জানো ওরা জিৎকে স্কুলে ভর্তি করায়নি ।ওকে দিয়ে বাড়ির কাজ করায় ।এটা তো ঠিক না বাবা ।ওরও তো পড়াশোনা করার বয়স । ওতো আমাদের থেকেও ছোট ।বাবা তুমি একটা কিছু করো। তুমি অনেক বড় পুলিশ অফিসার ।আমি জানি তুমি কিছু একটা করতে পারবে ।
কৌশিকের বাবা -"কৌশিক এটা ওদের প্রবলেম।ইট ইজ আ ফামিলিয়াল মেটার। আই ক্যান নট ডু এনিথিং।"
কৌশিক -"বাবা তুমি তো আইনকে রক্ষা করো ।অন্যায় বন্ধ করা তোমার কাজ।কাল তো চৌদ্দই নভেম্বর মানে শিশু দিবস।কাল সব বাচ্চাদের খুশি থাকা উচিত। জহরলাল নেহেরু সব বলে গেছেন ।কারণ উনার কাছে সব বাচ্চা সমান ।সবার লেখাপড়া করার অধিকার আছে ।সবার ভালো থাকার অধিকার আছে ।তাহলে তুমি একজন পুলিশ হয়ে একটা বাচ্চাকে এভাবে অত্যাচারিত হতে দেখবে? তুমি কোন কিছু করবে না ?
এটা তো ঠিক না বাবা। তুমি যদি তোমার দায়িত্ব পালন না কর তাহলে আমি তোমার থেকে কি শিখবো ?তোমার তো এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
কৌশিকের বাবা রাজি হয়ে যায় অভিজিৎ বাবুর সাথে কথা বলার জন্য।
জিতের কাকু মানে অভিজিৎ বাবুদের বাড়িতে গিয়ে কৌশিকের বাবা বলেন -"আপনি একটা ছোট বাচ্চাকে অ্যাডাপ্ট করার নাম করে ওকে দিয়ে সমস্ত রকম কাজ করাচ্ছেন ।ওকে স্কুলেও পাঠাচ্ছেন না ।ও এখনো কত ছোট মাত্র দশ বছর বয়স ।আপনি ওকে দিয়ে যা করাচ্ছেন এটা কিন্তু একটা অনেক বড় ক্রাইম ।আপনি জানেন তো আমি আপনার এই অপরাধে আপনাকে কিন্তু অ্যারেস্ট করতে পারি। তো যাই হোক আপনি আমাদের প্রতিবেশী একটা সুযোগ দিচ্ছি ।আগামীকাল ১৪ই নভেম্বর শিশু দিবস ।আপনার নিশ্চয়ই মাথায় আছে? আপনি আগামীকালই ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন এবং সমস্ত রকম দায়িত্ব পালন করবেন। আর যদি ওকে কখনও অত্যাচার করা দেখি আপনার জায়গা কিন্তু এখানে হবে না। তখন কিন্তু আমি আপনাকে ভুলে যাবো এবং আপনার জায়গা হবে জেলে। মনে থাকবে?
কৌশিকের বাবার এই ধমক শুনে অভিজিৎ বাবু শুধরে যান এবং তিনি পরের দিনই মানে ১৪ই নভেম্বর জিৎকে ওখানকার সব থেকে বড় স্কুলে ভর্তি করান এবং সবকিছুর দায়িত্ব নেন। ঐদিন থেকে অভিজিৎ বাবু জিৎ কে নিজের ছেলের মতোই দেখেন এবং লালন পালন করে বড় করেন।
আশার চিঠিমনোমিতা চক্রবর্তী
প্রিয় চাচাজি, তুমি কেমন আছো? নিশ্চয়ই ভালো আছো? দেখো, আজ আমি তোমার জন্য লাল গোলাপ এনেছি।স্কুলে দিদিমনির কাছে শুনেছি তুমি গোলাপ খুব ভালোবাসো । আরে একটা কথা তো তোমায় বলতে ভুলেই গেলাম। শুভ জন্মদিন চাচাজি। আজ তোমার জন্মদিন বলে সবাই এই দিনটাকে কত সুন্দর করে পালন করছে দেখো। আজ ধনী, দরিদ্র সব শিশুরাই যেন সমান সবার কাছে। কিন্তু চাচাজি শুধুমাত্র একদিনের জন্য সব শিশুদের সমান চোখে না দেখে যদি প্রত্যেকটা দিন সবাইকে সমান চোখে দেখা হতো তাহলে কত ভালো হতো বলতো ?তোমার জন্মদিন প্রত্যেকদিন কেন হয় না কেন হয়না গো চাচাজি?
যদি প্রত্যেকটা দিন শিশু দিবস হত তাহলে কি মজাটাই না হতো !
আর একটা কথা যদি সব শিশুদের মধ্যে ভেদাভেদ না করা হতো তাহলে হয়তো ফুলকি, টুবলুদের জায়গা স্কুলে হত ।মাঠে-ঘাটে, দোকানে কাজ করে ওদের সুন্দর শৈশবটা নষ্ট হতো না ।
জানো চাচাজি আমাদের পাড়ার শিউলি দিদি ও মাত্র আমার থেকে দু বছরের বড়। ও না কোনদিন স্কুলে যায়নি ।দুবেলা দুমুঠো খাবারের আশায় ও বাবুদের বাড়িতে কাজ করতো।কিন্তু ও যদি স্কুলে পড়ার সুযোগ পেত তাহলে হয়তো ও ক্লাস এইটে পড়ত । কিন্তু আজ আর শিউলি দিদি আমাদের মাঝে নেই।পাড়ার কেউ কেউ বলে শিউলি দিদি নাকি আত্মহত্যা করেনি।দিদিকে নাকি খুন করা হয়েছে । যে বাড়িতে শিউলি দিদি কাজ করতো ওই বাড়ির বাবুর নাকি শিউলি দিদির ওপর কু নজর ছিল ।আর ওই কুনজরের বলি হল শিউলি দিদি। গোটা শরীরটা নাকি শিউলি দিদির ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল।শিউলি দিদিকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় সবাই বলাবলি করছিল ।
এদিকে আমাদের বাড়িতে আমরা পরপর তিন বোন ।তাই বাবা বলে দিয়েছে আমাদের দায়িত্ব বাবা নিতে পারবে না। গত বছর আমার নাইনে পড়া দিদিকে বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। মা বাসা বাড়িতে কাজ করে। অনেক কষ্টে আমি আর বোন লেখা পড়া করছি। আমার খুব ইচ্ছে, লেখাপড়া শিখে জীবনে অনেক বড় মানুষ হবো ।কিন্তু জানিনা সে স্বপ্ন আমার পূরণ হবে কিনা ।কারণ বাবা বলে দিয়েছে আগামী বছর থেকে আমি যেন মার সাথে কাজ করে কিছু রোজগার করি।
আমি শুধু আমার কথা তোমায় বলছি না চাচাজি, আমি আমার সাথে সাথে আমাদের পাড়ার বিল্টুর কথাও বলছি, যে গত বছর রামু, জয়ের সাথে হারিয়ে গেছে ।আজ পর্যন্ত যাদের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। লোকে বলে ওদের নাকি আর খোঁজ পাওয়াও যাবে না ।কারণ ওদের শৈশব এখন বুঝি কাটছে কোন অজানা জায়গায় পথে ঘাটে ভিক্ষে করে। দেহের বিভিন্ন অংশ যেমন কারোর হয়তো কিডনি কারোর চোখ হারিয়ে ।
জানো চাচাজি, আজ পাশের বাড়ির ঝর্ণা দিদি আর তার ভাই রিতম দুজনে মিলে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ফুল বিক্রি করছিল। ওদের দেখে কয়েকজন বাবু ওদের থেকে ফুল কিনেছে।অনেকে নাকি ওদের চকলেট দিয়েছে। আবার কেউ কেউ নাকি সেলফিও তুলেছে ওদের সাথে। অনেক অনেক আদরও করেছে।
আচ্ছা চাচাজি তোমার জন্মদিনটা যদি প্রতিদিন হতো তাহলে কত ভালো হতো বলতো?আমাদের মত শিশুরা রোজ রোজ কত ভালো থাকতো ।
যাই হোক চাচাজি চুপিচুপি একটা কথা তোমায় বলছি শোনো। তুমি প্লিজ এই পৃথিবীতে আবারও ফিরে এসো ।এসে সবাইকে বলে যাও শুধু মিছিমিছি একদিনের জন্য শিশু দিবস পালন না করতে। তুমি বরং আমাদের দেশের সব বড়দের বলে যাও রোজ শিশু দিবস পালন করতে ।তাহলে হয়তো আর কখনো কোন শিউলি দিদি, রামু ,জয়,বিলটু,ফুলকি কিংবা আমাদের মত অবস্থা কারোর হবে না ।আমরাও যে আর সবার মতইএকটা সুন্দর শৈশব চাই চাচাজি । ভালো থেকো তুমি।
ইতি
তোমার বন্ধু আশা
খেলার সাথী নিতাই দে
হঠাৎ এসে জানালায় বসে
দোয়েল বাজায় বাঁশি,
তাইনা দেখে অবাক চোখে
খুকুর সে কী হাসি!
দোয়েল সোনা কাছে আয় না,
আমরা হই সই!
তোর সাথে খেলতে খেলতে
মনের কথা কই।
বাবা অফিসে ভোরে যায় সে,
খেলনা আনে কতো!
মা তো আমার আনে খাবার
সে ও চাকরিরত।
আমার কাছে খেলনা আছে
খেলার সাথী নাই,
মাসি আছেন যিনি দেখেন
মায়ের আঁচল নাই।
বাবা -মা ছাড়া মরু সাহারা
বুকটা খাঁ খাঁ করে,
পথের দিকে নজর থাকে
কখন আসে ঘরে।
বাড়িতে এলে সকল ফেলে
আগে সোহাগ করে;
ঘাসের বুকে যেমন রাখে
শিশির কণা ধরে।
দেখি তখন মায়ের নয়ন
জলে ছলছল করে;
ভোরের বেলা রঙের মেলা
পূব আকাশ জুড়ে।
দোয়েল পাখি বলতো দেখি
একা থাকিস ঘরে?
এই সহেলী তুই ও গেলি
ফুরুৎ করে উড়ে।
শিশুর জীবন গুঁড়িয়ে
চৈতন্য দাশ
আমার দেশের তোমার দেশের
বড়োরা ভীষণ ভালো,
কচিকাঁচা সব শিশুর জীবনে
জ্বালিয়ে নতুন আলো—-
ঘরে ঘরে দেয় শিক্ষার আলো
সকল শিশুর জন্য,
বড়োদের কাজেকর্মে সকল
শিশুর জীবন ধন্য।
তারপরে দেখো, নভেম্বরের
চোদ্দ তারিখে তাঁরা
শিশুতোষ শত কর্মকাণ্ডে
দিকে দিকে ফেলে সাড়া।
মঞ্চে মঞ্চে শিশুর দিবস
পালনে থাকেন ব্যস্ত,
শিশুর জন্য এ-কাজটা যেন
অনেক মহৎ মস্ত!
সেই বড়োরাই বোমা-মিসাইলে
শিশু-পাঠশালা উড়িয়ে
দিচ্ছে খুশিতে মুখোশ-আড়ালে
শিশুর জীবন গুঁড়িয়ে।
ক্রোড়পত্র: ভ্রমণ
দক্ষিণের জঙ্গলে
জয়িতা সরকার
নিজের সঙ্গে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া রয়েছে আমার। নিজেকে এক চক্রব্যূহে ঢুকিয়ে দিয়ে, যুদ্ধ-লড়াই না করে দিব্যি সেই গণ্ডিতে বেঁধে ফেলেছি। যদিও এই গণ্ডি আদিগন্ত। মনকে নতুন কিছু দেখার পাঠশালায় ভর্তি করিয়েছি। রোজ নতুন অনুশীলনী পড়ছে আর তা হাতে কলমে থুড়ি চোখে দেখার আশায় বেড়িয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক।
পাহাড়-জঙ্গল-নদী-সমুদ্র-ঝরনা কোন কিছুতেই অরুচি নেই মনের। যেখানে যাবে সেখানেই বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে কাটিয়ে দেবে দু-চার দিন। তবে এবার মনের একটু অভিমান হয়েছে, বারবার সেই এক পথ দিয়ে এদিক-ওদিক বেড়িয়ে আসছি, কিন্তু ওই সবুজের মাঝে যারা রয়েছে তাদের সঙ্গে দেখা করার কোন তাগিদ কেন নেই ? অগত্যা,পরিকল্পনা করাই বাহুল্য।
রাজ-রাজাদের শখের জঙ্গল এখন জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর। এক সময় মহীশূরের রাজাদের শিকারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এই জঙ্গল। ভাবলেই কেমন শিহরণ জাগে, শিকারের জন্য আস্ত একটা জঙ্গল, এমন সুযোগ যদি এই জমানায় হতো, আমিও লাঠি-বন্দুক, পেয়াদা নিয়ে বেশ একটা রাজকীয় ভাবে জঙ্গল ভ্রমণ করতাম। কিন্তু লাঠি-বন্দুক সিন্দুকে তুলে, সৈন্য-সামন্ত-পেয়াদা ভুলে, যুগের তালে ছন্দ মিলিয়ে গাড়ি-ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গল ঘুরেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছি। এতো কিছুর মাঝে জঙ্গলের পরিচয় তো করানো হয়নি, কর্ণাটকের পর্যটন মানচিত্রে বেশ বনেদিয়ানা নিয়ে বসে রয়েছে আমাদের গন্তব্য বান্দিপুর টাইগার রিজার্ভ।
কর্ণাটক সীমানা ছাড়িয়ে তামিলনাড়ু কিংবা কেরালা যেতে এই জঙ্গল পথে বহুবার যাতায়াত করলেও, জঙ্গলের অলিগলি ঘুরে দেখার প্ল্যান হল এই প্রথমবার। আমরা পাঁচবন্ধু আবার জীবন সঙ্গীও বটে সঙ্গে বন্ধুর এক ছানা মিলে জঙ্গলে রাত কাটাবার পরিকল্পনা করেই ফেললাম। সেই অনুসারে বুকিং করা হল কর্ণাটক গর্ভমেন্ট-এর ' জে-এল-আর এর ভাইসরয় প্যাকেজ'। এই জে -এল -আর এ বিভিন্ন বাজেটের রুম-সাফারি রয়েছে গোটা কর্ণাটক জুড়েই।
জঙ্গলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ নিবিড়। কোনদিনই আমি নিরাশ হয়ে জঙ্গল থেকে ফিরিনি। সেই আশাতেই বুক বাঁধছি এবারও। বান্দিপুর মানেই বাঘের দেখা পাব এই মনোভাব নিয়েই অপেক্ষার দিন গুনছি। জঙ্গলে বাঘের দেখা মেলার প্রবল সম্ভাবনা গরমে, কিন্তু আমরা যাওয়ার আগেই একপ্রস্থ বৃষ্টি হয়েছে মাইশোরে। তাতে আমার হতাশা একটু বেড়েছে, জঙ্গলে জল জমে যাবে, বাঘ আর জলের আশায় এদিক ওদিক ঘুরবে না। তবুও মনে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রওনা হলাম জঙ্গলে রাত্রি যাপনের উদ্দ্যেশ্যে।
রাজা নেই, শিকার নেই, তবুও জঙ্গলের সবুজ রাশি দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর, আর সঙ্গে জে-এল-আর -এর রাজকীয় আতিথেয়তা। সকাল সাতটায় আমরা ব্যাঙ্গালোর থেকে বেড়িয়ে প্রায় সাড়ে বারটা নাগাদ পৌঁছে যাই রিসোর্ট-এর সামনে। বুগী তৈরি ছিল, চেক-ইন করে আমরা আমাদের রুমের সামনে যেতেই দেখি রুমের নাম এলিফ্যান্ট, ঘরে ঢুকতেই দেখি বিরাট এক হাতির ছবি আঁকা রয়েছে দেওয়াল জুড়ে। রুমের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বিছানায় পাতা রয়েছে হাতির ছবি আঁকা বেডকভার। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে গাছ-গাছালি, তার মাঝেই শুনতে পেলাম ধনেশ পাখির ডাক।
ফ্রেশ হতেই ঘড়ির কাঁটা বলছে দেড়-টা বাজে, লাঞ্চ রেডি, যেতে হবে গোল-ঘরে। একদম রাজকীয় আয়োজন, ভেজ-ননভেজের নানা পদে সাজানো টেবিল। আমরা ইচ্ছে মত খাবার বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। লাঞ্চ সেরে এবার তৈরি হলাম সাফারির জন্য। গেটের সামনে পরপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি গুলোতে উঠলাম আমরা। গাড়ি ছুটল টিকিট কাউন্টারের দিকে, ক্যামেরা এন্ট্রি করিয়ে, টিকিট করিয়ে ড্রাইভার দাদা গাড়ি ছোটাল জঙ্গলের দিকে। বিশেষত জানিয়ে রাখি, ক্যামেরার লেন্স অনুযায়ী চার্জ নেয় এখানে।
পিচ রাস্তা ধরে যেতে যেতেই চোখে পড়ল হরিণের পাল, যা এই পথের বিশেষত্ব। কিছুটা পথ যেতেই আমাদের গাড়ি জঙ্গলের ভেতরে মাটির পথে চাকা গড়িয়ে দিল। একের পর এক হাতির পাল চড়ে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই সম্বর হরিণ, বিভিন্ন ভঙ্গিতে যেন নিজেকে ক্যামেরা বন্দি করতে চাইছে সে। ওই পথ ছেড়ে অন্যপথে আসতেই ইন্ডিয়ান গৌড়। তাদের চেহারা দেখে ছোটোবেলার ইতিহাস বইয়ের পাতায় থাকা প্রাণীটির ছবি ভেসে এলো সামনে। এদের সংখ্যাও ছিল প্রচুর।
জঙ্গলের একপাশ ছাড়িয়ে অন্যদিকে আসতেই দেখা মিলল ময়ূরের, একটু এগিয়ে যেতেই চোখ আটকাল জলাশয়ে, আর সেখানেই নেমে আসছে হাতির পাল। জঙ্গলেও কত শৃঙ্খলা আছে, তা সেদিন চাক্ষুষ করেছিলাম। নিয়ম মেনে জলে নামল ওরা, গা ভিজিয়ে কিছু সময় পরে সারি বেঁধে ফিরে গেল নিজেদের আস্তানায়। হাতি, হরিণ দেখছি ঠিকই, মন পড়ে আছে ওই হলুদ-কালো ডোরা কাঁটা প্রাণীটার দেখা পাওয়ার জন্য।
হঠাৎই ড্রাইভার দাদার ফোনে কল এলো, বুঝতে বাকি রইল না, তিনি স্পট হয়েছেন। দাদা সেটা জানাতেই উৎসাহ বাড়াল ঠিকই, কিন্তু দূরত্ব অনেকটা হওয়ায় আশাহত হলাম। তবুও গাড়ি ছুটল দ্রুতগতিতে। প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যখন পৌঁছলাম তখন সে ঝোপের আড়ালে চুপটি করে বসে। দূরবীন দিয়ে দেখতে পেলাম ঠিকই, তবে মন ভরেনি। ক্যামেরা কিল্ক করতে করতেই সে উঠে চলে গেল আরও গভীরে। তবুও দেখা মিলেছে এই খুশিতেই রিসোর্ট-এ ফিরলাম আমরা।
সন্ধ্যের স্নেক্স সঙ্গে চা-কফি খেয়ে ঘরে ফিরে একটু ক্লান্ত লাগছিল। তবুও আড্ডা চলছে, ঘড়ি বলছে সাড়ে ন'টা, ডিনার টাইম, চললাম আবার সেই গোল-ঘরে। রাতের খানাপিনাও ছিল বেশ জমজমাট। খাওয়া সেরে আমরা গল্প জমালাম ক্যাম্প ফায়ার-এর পাশে। রাত বাড়তেই সকালে ওঠার তাগিদে যে যার ঘরের দিকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবার তৈরি হলাম সাফারির জন্য।
চা-কফি ছিল, তবে আমরা সেসব না খেয়েই গাড়িতে চেপে বসলাম। সাফারি পয়েন্টে গিয়ে এন্ট্রি করিয়ে গাড়ি চলল জঙ্গলের দিকে। হরিণের পাল, হাতির মাটি নিয়ে খেলা, ময়ূরের পেখম মেলে ধরা, সব মিলিয়ে সকালটা ছিল অন্য সব সকালের থেকে ভিন্ন। সাফারি সেরে এবার ফেরার পালা। রিসোর্ট-এ ফিরে স্নান ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ির পথে। সব মিলিয়ে জঙ্গলের এক রাতের অভিজ্ঞতা ছিল অবর্ণনীয়।
জঙ্গলের সবুজ, পশু-পাখিদের শৃঙ্খলা, ওদের নিয়ম মেনে ওদের কাছে পৌঁছে যাওয়া সবটা দাগ কেটেছে মনে। জঙ্গলের পরিবারকে চাক্ষুষ করার আনন্দ আর অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে ফিরছি এবার। আবার আসব এই কথাও দিয়ে এলাম ওই এক ঝলক দেখা বাঘিনীকে।
(ছবি- কিংশুক সরকার)
প্রজাপতি মন
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
ঝলমলে রোদমাখা উজ্জ্বল একটি দিনের শুরুতে এই সফর ডানা মেলেছিল ফুড়ুনগাঁও নামে ছবির মতো সুন্দর এক পাহাড়ি গ্রামের দিকে। পথের চেনা পরিসর পেরোতেই কোথাও অরণ্য তার গভীরতার ডাকে, কোথাও চা -বাগান তার সবুজ ফরাস পেতে , আবার কোথাও পথের দুদিকের সুদৃশ্য গাছগাছালি গাড়ির গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়োতে, দৌঁড়োতে দেখার আনন্দকে অবিরত আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল নিবিড় হাতছানিতে। আরও খানিকটা পথ ধরে এগিয়ে ধাপে ধাপে চা -গাছের গালিচা, মনোরম প্রকৃতি, দূরের পাহাড়ের রূপলাবণ্য ছুঁয়ে যাচ্ছিল যাত্রীদের।সময়টা যেহেতু দুর্গাপুজো তাই এই যাত্রাকালে পাহাড়িয়া পথের কোনো কোনো প্রান্তে ছোটখাটো কিছু পুজোমন্ডপ নজরে আসছিল আর সেগুলিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট আকারের দুর্গা মায়ের নজরকাড়া মূর্তিগুলি মনকে কানায় কানায় ভরে তুলছিল।
পাকদন্ডী পথ বেয়ে আনন্দ যাত্রা এগিয়ে চলেছিল সম্মিলিত গল্প,কথায়,হাসি, গানে। তবে দেখে নেওয়ার,পথের ভালোলাগা গুলিকে কুড়িয়ে নিয়ে মনের ঝাঁপিতে আগলে নেওয়ার আর্তি ছিল খুব বেশি করে।গাড়ির জানলায় তখন ছবি আঁকছে রাশি রাশি মেঘের তুলো আর সারি সারি অপরূপ পাহাড়। পাহাড়গুলির গায়ে খেলনার মতো সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তা,বাড়িঘর, নদী, গাছপালা। সূর্যের সোনালী আভা গায়ে জড়িয়ে আশ্চর্য সুন্দর দ্যুতি ছড়াচ্ছে সবুজ নিসর্গ এই পাহাড়ের হাত ধরে। ঘোরানো পথ বেশ খাড়াই এখানে। দীর্ঘ এ যাত্রায় দুপাশের গাছগাছালি ভরা বননীর মাঝখানের খাড়াই পাহাড়ি পথটুকু দিয়ে চলতে চলতে কখনো মনে হয় পথের শেষ হয়তো এখানেই।গভীর কোনো খাদ হয়তো অপেক্ষা করে আছে এরপর।গুগল ম্যাপ পথনির্দেশ করলেও একটি বাঁকের শেষে পথের আর দেখা মিলবে কিনা দুপাশের বিস্তীর্ণ গভীর অরণ্যের দিকে তাকিয়ে গভীর সংশয় জাগে।বেশ দূরে দূরে পাহাড়ের গায়ে নজরে আসা রঙিন হোমস্টেগুলি এরপর জানান দেয় যাত্রা তার গন্তব্যে পৌঁছোতে চলেছে। এরপরও আরো বেশ কিছুটা চড়াই উৎরাই পার করে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। শরীর তখন বেশ ক্লান্ত হলেও নতুন কিছু দেখবার আনন্দ মনের আনাচেকানাচে।
বেশ অনেক কিলোমিটার আগে পথপ্রান্তের এক পান্থশালায় প্রাতরাশের সুস্বাদু খাবার ততক্ষণে চনমনে খিদের আড়ালে অদৃশ্য। সবকিছু মিলে পরিশ্রান্ত মনে এক লহমায় খুশির ফুল ফোটে,পাহাড়ি ফুলের মতো ছোট্ট মিষ্টি এক মেয়ে যখন যখন গাড়ির দরজাটি খুলে অভ্যর্থনা করে তাদের হোমস্টে তে যাবার জন্য ।নানির কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এরপর সে একে একে অতিথিদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।তাদের সঙ্গী তিন চারটে কুকুরও মনেপ্রাণে বুঝে নেওয়ার নিরলস চেষ্টা চালায় এরা বিশ্বাসযোগ্য কিনা।এই যাত্রার বিশেষ আকর্ষণ জিমি নামের চারপেয়ে বন্ধুকে পেয়ে তারা আহ্লাদে বিগলিত হয়ে ঘনিষ্ঠতা করতে চায় নিমেষেই। অভিভাবকদের বাধ্য ছেলে জিমি অবিরত ঘ্রাণ নিয়ে নতুন পরিবেশটির সঙ্গে পরিচিত হতে হতে নিজস্ব কিছু কথায় কিছুটা সময় চেয়ে নেয় বন্ধু হতে। বড়সড় এক টুকরি হাতে খাটো প্যান্ট, জ্যাকেট আর গামবুট পরা একটি লোক এবার মালপত্র নিতে আসে নীচের পথ থেকে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে অতিথিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে হোমস্টের মালিকের একান্ত অনুগত কালো কুকুরটি। নীচের দিকে নামতে নামতে পাশে তাকিয়ে হঠাৎ ঘোর লাগে চোখে।পথে দাঁড়িয়ে বাড়িঘরের আড়ালে যা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, সেই পাহাড়ের সারি যেন এখন হাতের মুঠোয়।উন্মুখ মনগুলি মুগ্ধতায় ভরে ওঠে।মন বলে রং তুলির এমন অপরূপ টানে এমন সুন্দর করে একে আঁকলো কে? 'ফুড়ুনগাঁও'-মিষ্টি নামের আলোঝরা পাহাড়িয়া ছবিটিতে চোখ আটকে যায়।প্রকৃতি এখানে নিজেকে উজার করে দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করেনি। দিনটি রৌদ্রজ্জ্বল ছিল বলেই বেশ বেলা করে পৌঁছেও এখানে পাহাড়ের এই অনাবিল সৌন্দর্য্যের ষোলো আনা স্বাদে চোখের তৃপ্তি আর প্রাণের আরাম সম্ভবপর হয়েছিল। সিঁড়ির ঢাল বেয়ে নামবার পর আবার বাঁক ঘুরে কিছু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই রঙিন ফুল ও পাতাবাহারে সাজানো সুদৃশ্য হোমস্টেটির বারান্দা।প্রতীক্ষার ছোট্ট বারান্দাটি অচেনা অতিথিদের আপন করে নিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল যেন।রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতেই ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া সিঁড়ির শেষপ্রান্ত ছাড়িয়ে পাশে কিছুটা সমতল জমি ও এদিক থেকে পেছন ফেরা এই হোমস্টেরই আরও একটি নিবাসের ছোট্ট ঠিকানা নজরে এসেছিল।
সিঁড়ির ধাপের সোজাসুজি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ঘেরা ছোট একটি ঘর, যেখানে গৃহস্বামী নিজেই অতিথি সৎকারের জন্য রকমারি রান্নাবান্না করে থাকেন। ছোট্ট পরিসরে ঝকঝকে তকতকে করে মাজাঘষা বাসনকোসন আর নির্দিষ্ট গতিশীলতায় ও কাজের আন্তরিকতায় রুচির ছাপ মেলে।ঠিক পাশটিতে বাঁশ ও কাপড়ে আচ্ছাদিত এক টুকরো খাওয়ার জায়গা। জনা আটেক লোক একসঙ্গে বাঁশের চেয়ার টেবিলে বসে দিব্যি এখানে আরাম করে খেতে পারেন।এই অঞ্চলটিতে বাঁশ গাছের আধিক্য থাকায় ঘরের দেওয়াল থেকে শুরু করে অনেককিছুই বাঁশের অবয়বে তৈরি।এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় গরম গরম খাবার পাতে পড়তেই খাওয়া শুরু করতে হয় এখানে। দুপুরের খাবার মেনুটিও ছিল চমৎকার। থাকবার ঘরগুলিও ছোটর মধ্যে বেশ মনোগ্রাহী। পর্যটকদের আরও একটি দলের আস্তানা হয়েছিল হোমস্টের নীচের ঘরগুলিতে। বিকেলের এক টুকরো সময় হোমস্টের ছোট্ট চত্বরটুকুতে ঘুরেফিরে দারুণ আনন্দে কেটেছিল।অপার বিস্ময়ে প্রকৃতিকে চেয়ে চেয়ে দেখে অভিভূত হতে হয় এখানে।দুপুরের খোলামেলা রোদেলা আকাশে পাহাড়ের একরকম রূপ।গায়ে রৌদ্রস্নান মেখে সে যেন উৎসুক অজস্র আঁখি তারার আলিঙ্গনে বাঁধা পড়বে বলে।পাহাড় এখানে হাত বাড়ালেই বন্ধু।দুচোখ ভরে কাছের পাহাড়টিকে দেখে, ফুল ও পাতাবাহারের মাদকতায় আবিষ্ট হয়ে, ওয়াচটাওয়ারের বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে কাছের পাহাড়ের বন্ধু হয়ে আর দূরের পাহাড়কে কাছে পেতে পেতেই গোধূলির আলোর আভার লজ্জারুণ এক আবিরের ছটা লেগেছিল পাহাড়ের মুখে। সন্ধে নামার আগে সৌন্দর্য্যের সেরার মুকুট পরে শেষবারের মতো উজ্জ্বল পাহাড় আস্তাচলের গেরুয়া আবিরের সঙ্গে হোলি খেলে ঝুপ করে আঁধারে ডুব দিয়েছিল।এর পরের বেশ কিছুটা সময় বারান্দায় বসে গল্প কথায় অতিক্রান্ত হয়েছিল।এর মাঝেই পাহাড়ের আবছা অবয়ব আলোর মালায় সেজে উঠেছিল এক মনকাড়া সাজে। ছোট্ট হোমস্টেটিকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের সারি আলোর বৃত্তের মধ্যমণি করে রেখে দিয়েছিল এটিকে।টুকরো টুকরো আলোগুলি যেন সলমা, জরি চুমকির জারদৌসি কাজে পাহাড়কে ঝিলিমিলি সাজে সাজিয়ে ফুড়ুনগাঁও - এর রাতকে মোহাবিষ্ট করে তুলেছিল।রাতের এই পাহাড় সীমাহীন সৌন্দর্য্যে ভরপুর।রং রূপের পালাবদল হয় প্রহরে প্রহরে।মৌনতাও কথা বলে।তেমন ভাবে প্রচারের আলোর বাইরের প্রায় অপরিচিত এই জায়গাটিকে প্রকৃতি ভরে রেখেছে নিজস্ব আলোয়।পাহাড় ছাড়া সেভাবে এখানে দেখবার কিছুই নেই।পাহাড়ের মৌনতাকে আত্মস্থ করে চুপটি করে একে উপলব্ধি করতে হয়।অনুভবের ঘরে আসন পেতে নিমগ্নতাকে ঠাঁই দিতে হয় সঙ্গোপনে।পাহাড়ও তখন গল্প বোনে, গল্প বলে।
এর মাঝেই সান্ধ্য আড্ডা ও চা -পর্ব চলেছিল ঘরে, বারান্দায়। পৌঁছোনোর সময় থেকে বারান্দার নির্দিষ্ট লক্ষণরেখার বাইরে বসে ছিল পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা সেই কুকুরটি। অবিরত লেজ নেড়ে সে বুঝিয়ে দিচ্ছিল অতিথিদের সঙ্গ তার ভালো লাগছে, বিশেষ করে জিমিকে। রাতের খাবারও খুব পরিতৃপ্তি দিয়েছিল সকলকে। বাইরে যথেষ্ট ঠান্ডা থাকায় এরপর যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে ঢুকে পরা।
পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ভোরবেলার সূর্যোদয়ের ছবিটি মনে রাখবার মতো। পাখিদের কলতানে আর কুসুম কুসুম আলোর রঙে সেজে ফুরেনগাঁও - এ সকাল হয়েছিল। পাতার বাহারে আর ফুলের মাদকতায় একঝাঁক উচ্ছাস এঁকে দিয়েছিল উজ্জ্বল এই সকালবেলা।সকালের রোদ গায়ে মেখে ওয়াচটাওয়ারে বসে চা খাওয়ার মুহূর্তটি মনে রয়ে যাবে।পাহাড়ের রূপ বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করবার নয়। দুচোখ ভরে সেই মনমোহিনীর মাধুর্য্যকে সঙ্গে নিয়ে প্রাতরাশের পর ফিরতি পথে এগিয়েছিল সেই হঠাৎ ভ্রমণ।ফিরতি পথে এক পাহাড়ি নদী চোখ টেনেছিল। এছাড়া বেশ কিছু ঝোরা ও ভিউ পয়েন্ট মনকে অনাবিল আনন্দ দিয়েছিল।
হোমস্টে ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে পথে উঠবার সময় আবারও সঙ্গ নিয়েছিল সেই কুকুরটি। বাঁক ঘুরে গাড়ি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত সে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো বা তারও অনেক পরে পর্যন্ত, আমাদের স্মৃতি নিয়ে আর আবারও নতুন কোনো মুসাফিরের প্রতীক্ষায়।সোনাঝরা রোদ গায়ে মেখে আমরা তখন ফিরে চলেছি নিজস্ব ঠিকানায়।বেশিটা রাস্তা জুড়েই বাঁক ঘুরে ঘুরে পাহাড় পাশে পাশে এসে এগিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। তারপর একসময় হারিয়ে গেছিল পথের বাঁকে। এভাবেই হারিয়ে যায় কাছের মানুষদের সঙ্গে কাটানো টুকরো টুকরো আনন্দের সময়গুলো। স্মৃতির খাতায় রয়ে যায় সেই বেঁধে বেঁধে থাকা, সপরিবারে পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে ভালোলাগার মুহূর্তগুলি একসঙ্গে উপভোগ করবার সেই আনন্দ ছবিখানি। ফুড়ুনগাঁও এমনই সুন্দর থাকুক, উজ্জ্বল থাকুক, সহজ থাকুক। শহুরে কলুষতা যেন সেখানকার পাহাড়কে, প্রকৃতিকে স্পর্শ করতে না পারে। স্নিগ্ধ পাহাড়ের বুকজুড়ে প্রতীক্ষা থাকুক পর্যটকের।পর্যটকের ভ্রমণপিয়াসী মনে অযুত প্রজাপতি ডানা মেলুক,মনজুড়ে থাকুক প্রকৃতিপ্রেম। তাদের কোনো আচরণ যেন বিন্দুমাত্রও আঘাত না হানে প্রকৃতির বুকে। তবেই প্রকৃতি ভ্রমণ, পাহাড় ভ্রমণ উজ্জ্বল হবে, সার্থক হবে।
(ছবি- লেখক)
শিল্প, সাহিত্য, সংগীত --সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের শহর বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর
গৌতমেন্দু নন্দী
বাঁকুড়া শহরের ধলডাঙ্গা মোড় থেকে তিন দিকের তিনটি হাইরোডের সোজা দিকটি পুরুলিয়া, তার বিপরীতে দুর্গাপুর,আর বাঁ দিকের রাস্তাটি চলে গেছে বিষ্ণুপুরের দিকে। সেই পথ ধরেই ওন্দা ব্লক পেরিয়ে ধলডাঙ্গা মোড় থেকে প্রায় চল্লিশ কিঃমিঃ দূরে জয়পুর জঙ্গল সড়ক পথটিকে ছেড়ে ডান দিকের রাস্তায় কিছুটা এগোতেই টেরাকোটার দৃষ্টিনন্দন গেট। টেরাকোটার শিল্পসম্মত নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে বিষ্ণুপুর শহরে প্রবেশের মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই গেট।
বাঁকুড়া জেলার এই শহর আদিতে "বন বিষ্ণুপুর" নামে প্রাচীন মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী ছিল। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত শাসন করে গেছেন যাঁরা তাঁরা "মল্লরাজ" নামে পরিচিত। বাহু যুদ্ধে দক্ষ এমন ব্যক্তিকে "মল্ল" বলা হয়। মল্লরাজারা এই বিষ্ণুপুরে গড়ে তোলেন বিষ্ণু মন্দির, রাসমঞ্চ এবং অন্যান্য সৌধ।
বিষ্ণুপুরে প্রবেশের পর প্রথম যে সৌধের সামনে এলাম তা হল রাসমঞ্চ। বিষ্ণুপুর আর এই রাসমঞ্চ যেন সমার্থক। বিষ্ণুপুর বললে এই সৌধটিই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। "Signature of Bishnupur"ও বলা যায়। মাকড়া পাথরের তৈরী বেদীর উপর ইটের অনবদ্য স্থাপত্য। সৌধের উপরের দিক পিরামিড আকৃতির।নীচের খিলানগুলি ইসলামী স্থাপত্যের মতো. মল্লরাজা বীরহাম্বীর আনুমানিক ১৬০০ খ্রীঃ এই মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
একটি টোটোতে চেপে একে একে জোড়বাংলা, রাধাশ্যাম মন্দির, শ্যামরায় মন্দির এবং ছোটবড় আরও মন্দির দেখে উপলব্ধি করলাম প্রতিটি মন্দির টেরাকোটার গঠন বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক সুক্ষতায়
অসাধারণ। এই মন্দির শহরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষী "লালবাঁধ"। বিষ্ণুপুরের সাতটি বাঁধের মধ্যে এই বাঁধটির গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। জলকষ্ট দূর করার জন্য এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে মল্লরাজারা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই বাঁধ সহঅন্যান্য বাঁধগুলো খনন করেন। দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে লালবাঈ নামে এক মহিলাকে নর্তকী হিসেবে আনার পর রাজা প্রেমে পড়েন সেই নর্তকীর। তাঁরা নিয়মিত এই বাঁধে এসে নৌকা বিহার করতেন। কথিত আছে রানী এবং প্রজারা একদিন ষড়যন্ত্র করে লালবাঈ ও তাঁর ছেলেকে এই বাঁধে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলেন। তখন থেকে এর নাম "লালবাঁধ"। এই জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জঞ্জালপূর্ণ এক অস্বাস্থ্যকর জলাভূমি যেন।
শুধু টেরাকোটা নয়, সংস্কৃতি চর্চারও পীঠস্থান এই বিষ্ণুপুর। একসময় বিভিন্ন সাহিত্যিকরাও সমৃদ্ধ করেছেন এই জনপদকে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ছাতনার বড়ু চণ্ডীদাস। তাঁর রচিত "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" বাংলা সাহিত্যে হস্তলিখিত পুঁথির মধ্যে প্রাচীনতম। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে "বিষ্ণুপুর ঘরানা" এক ঐতিহ্যের নাম। সেই ঘরানা বহন করে চলেছে ধ্রূপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুংরী,টপ্পা,গজল,ভজন ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৈশোর থেকেই বিষ্ণুপুর ঘরাণার বিভিন্ন শিল্পীদের সংস্পর্শে আসেন,তাঁদের মধ্যে যদুভট্ট ছিলেন কবির প্রিয় শিল্পী।
স্থাপত্য,ভাস্কর্য,সংগীত সংস্কৃতিতে বিশিষ্ট শৈলীর ছাপ মল্লভূমি বিষ্ণুপুরের আনাচেকানাচে। বাঁকুড়া তথা বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার উঁচু গ্রীবা সম্পন্ন ঘোড়া আজ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সমাদৃত। টেরাকোটার স্বর্গরাজ্য বিষ্ণুপুর বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে "ওয়ার্লড হেরিটেজ" এর তকমার সম্ভাবনা
নিয়ে বর্তমানে প্রহর গুনছে।
কলকাতা থেকে সড়কপথে দুর্গাপুর হয়ে বেলিয়াতোড় জঙ্গল পথ পেরিয়ে বাঁকুড়া হয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছনো যায়। আবার কলকাতা থেকে হুগলীর আরামবাগ,জয়রামবাটি হয়ে জয়পুর জঙ্গল ঘেরা সড়কপথেও বিষ্ণুপুর আসা যায়। তবে হাওড়া স্টেশন থেকে তিন-সাড়ে তিন ঘন্টায় রেলপথেই বিষ্ণুপুর আসা সুবিধাজনক।
(ছবি- শৌভিক রায়)
বড়ন্তির সূর্যাস্ত
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে
বনের পথে, নদীর ধারে যাই যে ছুটে
কিংবা ছোট একটি টিলা দেখে দাঁড়াই উঠে
ঊর্দ্ধমুখী ----
আকাশ কেমন নীল পশমে মাখামাখি
শাপলাপাতায় মুছে ফেলি
অভিমান আর মন্দবাসা ...
লিখতে লিখতে ডায়রির পৃষ্ঠায় কলম রেখে গাড়ির জানলায় বাইরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। বাসন্তী হাওয়ায় উড়ছে লাল ধুলো, পথের দুপাশে আগুন রঙা গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশ।এই তো এসে গেছি লাল পলাশের দেশে। আমার মুসাফির মন বলে উঠলো - ওগো লাল পলাশ আর নীল ঝিলের দেশ আমাকে দু দিনের অতিথি হয়ে থাকতে দেবে?
ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম --
বড়ন্তি আর কতদূর?
ড্রাইভার জানান দিল - এই তো প্রায় এসে গেছি।
পৌঁছনোর পথটি বড়ই মন ভোলানো। দু পাশে সবুজ গাছগাছালি, পাখির কলরব ,কাছের টিলা আর দূরের ঝাপসা পাহাড় সবাই মিলে সেই মুহূর্তে আমাকে জানাল সাদর অভ্যর্থনা । সঙ্গে তিরতিরে বাতাস। এই নিরালা পরিবেশে অতিরিক্ত পাওনা গ্রামের শিশুদের অমলিন হাসি। তাদের কারো হাতে খেজুর পাতার বাহারি ফুলদানি আবার কারো হাতে পলাশের মালা। আমি দু দিনের জন্য হয়ে গেলাম তাদের কাছের মানুষ।
পুরুলিয়ার ছোট্ট একটি গ্রাম বড়ন্তি। বিহারীনাথ আর পাঞ্চেত এই দুই পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সাতুরি ব্লক এখানেই এই ছোট্ট পাহাড়ি অঞ্চল। জয়চণ্ডী পাহাড় থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে আর মুরারডি স্টেশন থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে এই শান্ত সবুজ গ্রামটি।এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসে প্রাণভরে অক্সিজেন নিতে। এর পাশ দিয়ে কুলকুল বইছে বড়ন্তি নদী। লাল মাটি। আর চারদিকে শাল, সেগুন, শিশু, মহুয়া, পলাশ গাছের জঙ্গল। খরগোশ, হরিণ, শিয়ালের বাসভূমি এই জঙ্গল। ঋতু ভেদে বড়ন্তির রূপ বদলায়। বর্ষায় ঘন সবুজ বেশ, আর বসন্তে পলাশ ফুলের ভিড়ে লালে লাল হয়ে যায় বড়ন্তি।
ইন্টারনেটে প্রায় দু মাস আগেই রুম বুক করে রেখেছিলাম কারণ দোলের আগে বা পরে এ অঞ্চলে কোন রিসর্টে রুম পাওয়া সহজ নয়।আমাদের রিসর্টটির নাম বড়ন্তি ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচার স্টাডি হাট , রামচন্দ্র পুরে এই রিসর্ট ঝিলের খুব কাছে। থাকা খাওয়া পরিবেশ সবই ছিল মনের মত। আমরা গত বছর গেছিলাম দোলের দুদিন পরে, নিজস্ব গাড়িতে।
তবে অন্য ভাবে ও যাওয়া যায় হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে যে কোন ট্রেনে আসানসোল এবং আসানসোল থেকে আদ্রা লাইনের যেকোনো ট্রেনের অল্প পথ মুরাডি।
মুরাডি থেকে তো কাছেই এই গ্রাম।
দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে হালকা রোদ পিঠে মেখে আমি আর আমার কর্তা মশাই হাঁটতে বের হলাম। কিছুটা এগুতেই দেখলাম বড়ন্তির টলটলে জলের বাঁধ। বাঁধের ধার দিয়ে বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি। আর এক পাশে একটু নীচুতে চাষের ক্ষেত। একটা দুটো করে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা উড়ে যাচ্ছে-- আবার কখনো একঝাঁক। বকের মত, হাঁসের মত দেখতে আরো কত পাখি। বাঁধের জলে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার-- এই আছে, এই নেই। মাছরাঙা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে-- মাছ খুঁজছে। সবুজের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার যে কত আনন্দ সে যে যায় সেই জানে।শাল, পিয়াল, পলাশ, আকাশমণি, মহুয়া গাছের ঘন জঙ্গলে ঘেরা লালমাটির পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে গ্রামে পৌছালাম সেই গ্রামটির আসল নাম অবশ্য রামজীবনপুর। তবে এখন সবাই বলে জীবনপুর । এখানে বেশীর ভাগ সাঁওতালরদের ই বাড়ি। ঝকঝকে নিকোনো উঠান , কোনো কোনো বাড়ির দেওয়ালে আলপনা।চাষবাস বলতে ধান আর কিছু সব্জি। টুসু, ভাদু, বাঁধনা এই সব পরবে এখানে ভাল উৎসব হয়। শুধু এই গ্রামই নয়, আশপাশের সাঁওতালদের গ্রামজুড়েও মাদলের দ্রিম দ্রিম ধ্বনিতে, নাচের ছন্দে, মেলার জৌলুসে জমে ওঠে বর্ণময় সব আচার-অনুষ্ঠান।গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই আলাপ হয়ে যায় সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে। ওরাই কথায় কথায় জানিয়ে দেয়, কার্তিক মাসে বাঁধনা উত্সবের সময় মারাং-বুরু (আদিবাসী দেবতা) পুজোর কথা, কিংবা মাঘ মাসের পরবে ধানসিং-মানসিং (আর এক দেবতা) পুজোর কথা। ঐগ্রামের এক প্রান্তে বড়ন্তি নদী। ভারী সুন্দর সে নদী এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। এই নদীর ওপরই বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে বড়ন্তি লেক। জীবনপুর গ্রামে কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম রিসর্টে। পড়ন্ত বিকেলে চললাম সূর্যাস্ত দেখতে বড়ন্তি ঝিলে।
বড়ন্তিতে সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো। সূর্য তখন দিগন্তে ডুবতে শুরু করেছে, প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মোহময় ক্যানভাস আর লাল, কমলা, গোলাপী এবং বেগুনি রঙ দিয়ে দিনান্তের সূর্য যেন সেই ক্যানভাসে তুলি দিয়ে এঁকে দিচ্ছে অপরূপ রঙের রামধনু। হ্রদের জলে তার অতুলনীয় প্রতিচ্ছবি।চোখ ফেরানো যায় না।সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে আকাশে সিঁদুরে আভার বিচ্ছুরণ আর আশেপাশের পাহাড় ও গাছের শাখাগুলি সেই নরম আলোয় স্নান করে নিচ্ছে। ঝিলের জল আরো কমনীয় হয়ে উঠেছে, এই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কত ছবি যে ক্যামেরা বন্দী করে রাখলাম। হৃদয়ের মণিকোঠায় যত্ন করে তুলে রাখলাম এই অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। এই সূর্যাস্তের অভিজ্ঞতা অনুভব করার জন্য বেশ কয়েকটি সুবিধাজনক পয়েন্ট ও রয়েছে। কিছু পর্যটক কাছাকাছি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখছিলেন। তবে আমরা ঝিলের পাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম।এদিকে ওদিকে পর্যটকদের ভিড় ছিল দেখার মত। শুনেছি চাঁদনি রাতে ঝিলের জলের রুপোলি আভা চোখ ঝলসে দেয়। এই সময় বড়ন্তিতে থাকলে নাকি রোমান্টিকতার স্বর্গে বাস করা যায় তবে তা দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি।
রাত্রিবেলায় রিসোর্টে ছিল আদিবাসী নাচের আয়োজন। খুব ভালো লাগলো মাদলের বোলের সঙ্গে নাগরিক সাজসজ্জা হীন সরল সাঁওতাল রমণীদের ছন্দবদ্ধ নাচ।
পরের দিন খুব ভোরে উঠলাম।গাড়ি প্রস্তুত এবার যাব অযোধ্যা পাহাড়।পথে দেখে নেব পাখি পাহাড়, আপার ড্যাম,লোয়ার ড্যাম, বামনী ফলস্ ও মারবেল রক। মুখোশের গ্রাম চড়িদা দেখার জন্য মন আগ্রহে অধীর। অযোধ্যা পাহাড়ে রিসর্ট বুক করা আছে আগেই। যাবার পথে বড়ন্তি ঝিলকে বিদায় জানিয়ে বললাম আবার ঠিক ফিরে আসব এখানে এক পূর্ণিমার রাত্রিতে.. দেখব মায়াবী জোছনার সৌন্দর্য ....
(ছবি- লেখক)
কাশ্মীর শেষে পাঞ্জাব ছুঁয়ে
স্বপন দত্ত
গত ৩০শে অক্টোবর '২০২৩ তারিখ রওনা হয়ে সপরিবারে জম্মু কাশ্মীর ও অমৃতসর ঘুরে গত ১২ ই নভেম্বর '২৩ শে ফিরে এলাম।
সত্যিই কাশ্মীর ভূস্বর্গ। প্রথম দিনেই বৈষ্ণুদেবী দর্শনের জন্য ছিল বরাদ্দ। কেউ ঘোড়ায়, কেউ ডুলিতে, কেউ হেলিকপ্টার আবার কেউ পদব্রজে চলেছেন দেবী দর্শনে।
পরদিন রওনা দিলাম সোনমার্গের উদ্দেশ্যে। বাসে পৌঁছে সেখান থেকে ছোট গাড়িতে জিরো পয়েন্ট। পাহাড়ের গায়ে প্রচুর বরফ রাস্তায়,ড্রেনে মাঠে সর্বত্র শুধুই বরফ। প্রচুর ছবি তোলা হলো। বরফের উপর হুটোপুটি চললো। একেবারে আনন্দের ফোয়ারা।
পরদিন গন্তব্য গুলমার্গ। বাসে পৌঁছে সেখান থেকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে গন্ডোলায় ওঠার জন্য লাইন দেওয়া। গন্ডোলা হলো রোপ ওয়ে। প্রতিটি বক্সে ৪/৬ জনের বসার ব্যবস্থা। আকাশের নীচে পাহাড়ের উপর প্রায় ১৫ কিঃমিঃ সফর। প্রথম পর্যায়ের পর আরও এগিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়। সেখানে বরফের ছড়াছড়ি। তারপর দিন শিকারা চেপে ডাল লেক ভ্রমণ। এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। নিজেকে মনে হচ্ছিল রাজা বাদশা। ভাসমান বাজার,মিনা বাজার, জলের উপর ফসলের ক্ষেত দেখলাম।
একদিন লোকাল সাইট সিইং করা হলো। শ্রীনগরে হলো মার্কেটিং। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঝিলাম নদী। কাশ্মীরের বিখ্যাত চিনার গাছ দেখলাম। কোন গাছের পাতা হলুদ আবার কোনটার পাতা লাল। পরদিন দেখলাম নেহেরু বোটানিক্যাল গার্ডেন,নিশাত বাগ, মোগল গার্ডেন, টিউলিপ গার্ডেন। অবশ্য টিউলিপ গার্ডেন এখন ফুল শূণ্য।
এবার আমাদের গন্তব্য পহেলগাও। রাস্তার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। পথে সারি বেঁধে আপেল বাগান। গাছ থেকে পেড়ে রাখা আপেল কিনলাম। খেলাম আপেলের জুস। পহেলগাও পৌঁছে উপভোগ করলাম দারুণ শীত। হোটেলের ঘরে রুম হিটার লাগানো। তাও দারুণ ঠান্ডা। ছোট গাড়িতে প্রথমে গেলাম চন্দনওয়ারি। পাহাড় ঝর্না দারুণ দৃশ্য। অমরনাথ যাত্রা শুরু হয় ওখান থেকেই। আছে হেলিপ্যাড। মাত্র চার হাজার টাকা ভাড়া। তখনই মনে মনে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললাম। এরপর গেলাম বেতাব ভ্যালি। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। সেখানে ' বেতাব' চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহন হয়েছিল। দেখলাম অরোভ্যালি। সেটাও খুব সুন্দর জায়গা।
এরপর শ্রীনগর থেকে জম্মুর উদ্দেশ্যে বাসে করে রওনা। সেখান থেকে ট্রেনে পৌঁছাই অমৃতসর। দেখলাম স্বর্ণমন্দির। রাতে ও সকালে দুবার দেখেও আশ মেটে না। তবে রাতের দৃশ্য রূপকথার মতো। পাশেই জালিয়ানওয়ালা উদ্যান। মনটা আপনিই খারাপ হয়ে গেল। দেওয়ালের গায়ে ব্রিটিশ পুলিশের ছোড়া গুলির চিহ্ন এখনও রয়েছে। প্রাণভয়ে দৌড়ে লাফ দিয়ে কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করা সেই কুয়োটি এখনো রয়েছে। জ্বলছে অনির্বাণ দীপশিখা। দেখলাম শহীদ স্তম্ভ। সবসময় ভিডিও তে শো চলছে।
বিকেলে ওয়াঘা সীমান্তের ভারত পাকিস্তানের সেলামী কুচকাওয়াজ প্রদর্শন অনুষ্ঠান দেখতে গেলাম। হাজার হাজার দর্শক। মাইকে বাজছে দেশাত্মবোধক গান। মনটা আপনিই দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে গেল। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্যারেড মন ভরিয়ে দিল। তারপর উভয় দেশের জাতীয় পতাকার অবনমন একই সঙ্গে ঘটলো। অনুষ্ঠান শেষে হোটেলে প্রত্যাবর্তন।
পরদিন শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে নিউ দিল্লি। সেখান থেকেই রাজধানী এক্সপ্রেস করে বাড়ি ফেরা। মনের স্মৃতি কোঠায় এই ভ্রমণের কথা মনে রইবে চিরকাল।
(ছবি- লেখক)
ত্রিপুরার
স্থাপত্য শিল্পঃ ঊনোকোটি
চিত্রা পাল
ত্রিপুরায় এলে ঊনকোটিতে আসতেই হবে। না এসে উপায় নেই।
কারণ এমন পার্বত্য ভাস্কর্য ত্রিপুরাতে আছে এই এক জায়গাতেই, আর এই নিদর্শন আমাদের
দেশেই বিরল। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে এর দূরত্বও কম নয়। তবে ত্রিপুরার আর এক
শহর কৈলাসহর থেকে কাছে। কৈলা শহর থেকে থেকে মাত্র ৮ কিলো মিটার দূরে জঙ্গল ঘেরা
রঘুনন্দন পাহাড়ে এই ঊনকোটি পার্বত্য স্থাপত্য।এর নামের মধ্যেই রয়েছে নাম করণের
রহস্য।
এখানকার সমস্ত পাহাড় জুড়ে
ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র পাথরের মূর্তি। শুধু মূর্তি নয় অনেকাংশেই পাহাড় খোদাই করে তার
গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রচুর দেবদেবীর মূর্তি। কোনটি প্রমাণ আকারের, কোনটির
উচ্চতা আবার কমপক্ষে ত্রিশ ফুট। ঊন কথাটার অর্থ কোটির এক কম।অর্থাত্ এখানে
এখানে এক কোটির এক কম দেবদেবীর মূর্তি আছে।আসলে পুরাণ আর লোককথা অনুযায়ী সমস্ত
পাহাড় জুড়ে রয়েছে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি। সেই থেকেই এই নাম করণ। সংখ্যাটা
নিশ্চিতভাবেই বেশ বেশি, তবে কোটির কম কিনা তা এখনও প্রমাণিত নয়।কিন্তু কবে হয়েছিলো
এই আশ্চর্য ভাস্কর্যগুলো, আর কারাই বা করেছিলো এখনও এই প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে। হিন্দু
পুরানের এই নামকরণের কাহিনীতে কথিত আছে যে কালু কামার নামে একজন স্থাপত্যকার ছিলেন, সে জন দেবী
পার্বতীর ভক্ত ছিলেন। একবার দেবী-মহাদেবের সাথে কৈলাসে যাচ্ছিলেন তখন কালু কামার
বায়না ধরলেন তাকে যেন তাদের সঙ্গে নেন। তখন মহাদেব ওনার ওপর শর্ত আরোপ করে বলেন, উনি যেতে পারেন তবে
তার জন্য তাকে এক রাত্রির মধ্যে এককোটি দেবদেবীর মূর্তি তৈরী করে দিতে হবে। কিন্তু
কালু কামার এককোটি থেকে একটি কম মানে (৯৯ লক্ষ ৯৯ হাজার নয় শত নিরানব্বই)
ঊনকোটি-টি মূর্তি তৈরী করে দিতে সক্ষম হন।
ঊনকোটির
মূর্তিগুলি নিয়ে যে একাধিক কাহিনি প্রচলিত আছে, তার মধ্যে
উল্লেখযোগ্য আর একটি কাহিনি আছে, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল মহাদেব।
দেবাদিদেব শিব একবার দেবতাদের নিয়ে ত্রিপুরার উপর দিয়ে বারাণসী যাচ্ছিলেন। মহাদেবকে
নিয়ে দেবতাদের সংখ্যা ছিল এক কোটি। সন্ধ্যে নামার পর রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয় এই
রঘুনন্দন পাহাড়ে। পথপরিশ্রমে ক্লান্ত দেবতারা গভীর নিদ্রায় অচেতন হলেন। পরেরদিন
সূর্যোদয় হওয়ার আগে সবার বারাণসীর উদ্দেশে যাত্রা করার কথা, কিন্তু
মহাদেব ছাড়া অন্য কোনো দেবতাদের নিদ্রাভঙ্গ হল না। মহাদেব বিরক্ত হয়ে একাই বারাণসীর উদ্দেশে রওনা
দিলেন। গভীর নিদ্রায় সমাধিস্থ দেবতাদের কালনিদ্রা আর ভাঙ্গল না এবং তারা
অনন্তকালের জন্য পাথর হয়ে রইলেন। এই দেবতাদের সংখ্যা ছিল এক কম কোটি তাই ঊনকোটি।
সেই থেকেই এই রঘুনন্দন পাহাড় হয়ে গেল শৈবতীর্থ ঊনকোটি।
ঐতিহাসিকদের মতে আনুমানিক অষ্টম
বা নবম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিলো এই মূর্তিগুলি। স্থানীয়দের বিশ্বাস ভগবান শিব
এখানেই বসুবাস করতেন। এমনকি শিবরাত্রি ও সংক্রান্তিতে তিনি এখনও এখানে ঘুরে যান।
সেইজন্য বিশেষ বিশেষ তিথিতে মেলাও বসে এখানে।স্থানীয়দের কাছে পরিচিত হলেও, বিশ শতকেরও শুরুর দিকে এক ইংরেজ
ঐতিহাসিকের হাত ধরেই বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ঊনকোটি। তারপর কেটে গেছে
প্রায় একশো বছরের বেশি সময়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কোর অস্থায়ী ‘হেরিটেজ
তালিকা’-তেও
জায়গা পেয়েছে এই ঐতিহাসিক স্থান। তবে তারপরেও রহস্যের মেঘ কাটেনি ঊনকোটির উপর থেকে। নানা
প্রাকৃতিক বিপর্যয় এর ওপরে আঘাত হানছে। জানি না কতদিন একে রাখা যাবে। ত্রিপুরায়
এসে দেখে এলাম এক বিস্ময়কর স্থাপত্য যার নিদর্শন মেলা ভার।
(ছবি- সংগৃহিত)
নান্দী হিলস এ যখন সন্ধ্যা নামে......
মিঠু অধিকারী
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটো বিষয়েই কর্নাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরু এখন অনেকেরই গন্তব্য। ব্যাঙ্গালুরু শহরটি সুন্দর ও সাজানো।একটি দুটি দিন শহরকে কেন্দ্র করে কাটানোই যায়। এবার আমরা শহর ছেড়ে একটু দূরে গেলাম। বেঙ্গালুরু শহর থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে চিকাবল্লাপুর জেলায় রয়েছে নান্দি হিলস,এটি একটি ব্যাঙ্গালোরের একটি জনপ্রিয় হিলস্টেশন।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৪৮৫১ ফিট।
নান্দি হিলস একসময় টিপু সুলতানের সামার রিট্রিট বা গ্রীষ্মকালীন আবাস ছিল। হিল টপ থেকে ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ সত্যি অপরূপ। বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর গাছপালা আর অসংখ্য পাখি নান্দি হিলসের আর্কষন বাড়িয়েছে। এখানে রয়েছে নন্দেশ্বর টেম্পল। নান্দি হিলস থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই খুব সুন্দর দেখা যায়। আমরা অবশ্য সূর্যাস্তই পেয়েছিলাম।
নান্দি হিলসে সন্ধ্যা নামার মুহূর্তটি সত্যিই বড় নান্দনিক। ব্যাঙ্গালুরু সিটি থেকে ভাড়া গাড়ি অথবা নিজস্ব গাড়ি করে নান্দি হিলসের গেট পর্যন্ত যাওয়া যায়। ভেতর রয়েছে কর্ণাটক ট্যুরিজমের বাস।জনপ্রতি পঁচিশ টাকা ভাড়ায় আপনাকে নিয়ে যাবে নান্দি হিলস এর ভিউ পয়েন্টে। ট্রেকিং প্রেমিরা পায়ে হেঁটে ভিউ পয়েন্ট অব্দি আসতেই পারেন। ভিউ পয়েন্টে রয়েছে চা কফির রিফ্রেশমেন্ট এর ব্যবস্থা।এছাড়াও নন্দী হিলসে রাত্রিযাপনের জন্য রয়েছে হোটেল ও লজ।চারপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যি মনমুগ্ধকর।
(ছবি- লেখক)
ঘুরে এলাম গড় পঞ্চকোট ও বড়ন্তি
শ্রাবণী সেন
পাহাড় আর সবুজে ঘেরা পুরুলিয়া জেলার পাহাড়ের নীল আর বনের শ্যামলের সাথে মিশে আছে মনোরম হ্রদ ও জলাধার।
এবারের কালীপুজোর দুদিন পরে আমি আর প্রফেসার সেন ঘুরে এলাম পুরুলিয়া। তবে এখানে আমি শুধু আমাদের গড় পঞ্চকোট ও বড়ন্তি ভ্রমণের কথাই লিখব।
পুরুলিয়া শহর থেকে গড় পঞ্চকোট মোটামুটি ষাট কিলোমিটার মত রাস্তা। আমরা পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় থেকে গড় পঞ্চকোট ও বড়ন্তির উদ্দেশে বেরিয়েছিলাম সকাল বেলা।
গড় পঞ্চকোট হল পঞ্চকোট বা পাঞ্চেৎ পাহাড়ের নিচে পঞ্চকোট রাজাদের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ। একদা এখানেই ছিল রাজার আবাস এবং নানান মন্দির। ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে হাত ধরাধরি করে চলে। এখানে পুরানো মন্দির ও প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আছে আর আছে অপূর্ব সুন্দর নিসর্গের রূপ। পাঞ্চেৎ পাহাড় আর চার পাশের ঘন সবুজ শাল, পলাশ আর নানান লতাগুল্মের অপরূপ লীলায়িত ভঙ্গিতে সত্যিই মন হারিয়ে যায়। আমরা পরিত্যক্ত ও ভগ্ন মন্দিরগুলি দেখলাম, ঘুরে ঘুরে প্রাসাদ, প্রাচীর, নজর মিনারের অবশেষ দেখে এলাম। রাস মন্দিরটিতে আছে টেরাকোটার অপরূপ কারুকাজ।
দামোদর শেখর সিংদেও "শেখর" বংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর একত্রিশতম উত্তরপুরুষ কীর্তিনাথ শেখর পঞ্চকোটে তাঁর রাজধানী পারা থেকে স্থানান্তরিত করেন। শেখর বংশের রাজারা এখানে প্রায় আটশো বছর রাজত্ব করেছিলেন।
গড় পঞ্চকোট থেকে আমরা এলাম বারো কিলোমিটার দূরের বড়ন্তিতে। শাল, পলাশ আর সেগুন ছাওয়া সবুজ পাহাড় আর স্বচ্ছ হ্রদ বড়ন্তিকে মোহময় রূপ দিয়েছে।
এখানের সূর্যাস্ত খুবই সুন্দর বলে কথিত। কিন্তু সেদিন আকাশ মেঘলা থাকায় আমরা সূর্যাস্ত দেখিনি। বড়ন্তি লেকের জলে পাহাড়ের ছায়া মন ভরিয়ে দিয়েছিল আমাদের।
দুটি স্থানেই রাত্রিবাস করার সুবিধা আছে যদিও আমরা গড় পঞ্চকোট, বড়ন্তির লেক ও আসে পাসে ঘুরে সেদিনই ফিরে আসি।
(ছবি- লেখক)
মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩০
No comments:
Post a Comment