Monday, November 3, 2025


 

মুনা 

অনলাইন কার্তিক  সংখ্যা ১৪৩২


সম্পাদকের কথা 

কার্তিকের নবান্নের এই দেশে স্বস্তি কোথায় আর! `আমার সোনার বাংলা` আজ এই দেশে করুণার পাত্র। ন্যায্য দাবি নিয়ে বসে আছেন রাজ্যের শিক্ষিতরা। যে বাংলা একদিন পথ দেখাত, আজ সে নিজেই পথহারা। নাগরিকত্ব প্রমাণে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। যদিও দেখে নেওয়া উচিত, কে বৈধ আর কে নয়। প্রকৃতির ওপর লুন্ঠন এত যে সেও আজ মুখ ফিরিয়ে প্রবল প্রত্যাঘাতে তছনছ করে দিয়েছে উত্তরভূমি। তবু আমাদের নৃত্য থামেনি। সব কিছু মিলে দিশেহারা দশা আমাদের। তবু কার্তিক আসে, নবান্নের আশ্বাস নিয়ে। ফিরে আসে স্বপ্ন নতুনের। স্বপ্ন নব অন্নের, আশা নব দিনের।  


অনলাইন কার্তিক  সংখ্যা ১৪৩২


রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি- কোচবিহার রাজপ্রাসাদ  

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

পরাগ মিত্র, গৌতম চক্রবর্তী, অনিতা নাগ,

চিত্রা পাল, লীনা রায়, অম্বালিকা ঘোষ, শুভেন্দু নন্দী,

রণিতা দত্ত, ছবি ধর, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, গৌতমেন্দু নন্দী,

সোহম ভট্টাচার্য, মনোমিতা চক্রবর্তী, জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বটু কৃষ্ণ হালদার,

তন্ময় ধর, অশোক কুমার ঠাকুর, অভিজিৎ সেন, 

আসিফ আলতাফ, মোঃ আব্দুল রহমান, প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী,

আকাশলীনা ঢোল, সম্রাট দাস, কেতকী বসু,

দীপ্তিমান মোদক, জীবন সরখেল, অমিত আভা,

প্রতিভা পাল, অর্পিতা রায় আসোয়ার, বিজয় বর্মন,

পার্থ সারথী নন্দী, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অলকানন্দা দে, 

চৌধুরী নাজির হোসেন, শংকর হালদার, মাথুর দাস,

প্রশান্ত লোহারা, চিত্রাক্ষী রায়, মজনু মিয়া,

মহঃ সানোয়ার, শাহীন খান


অনলাইন কার্তিক  সংখ্যা ১৪৩২


 

ফোকাস 



আশংকার ঘনঘটা ও ছাব্বিশ হাজার

পরাগ মিত্র 


চুনরীতে দাগ লাগলে বাবুল সে নজর মেলানো কঠিন। ভবিষ্যতে সংখ্যাটা বাড়লেও বাড়তে পারে তবে ১৮০৬’র গায়েই শুধু নয়, অপযশের ছাপ রয়ে গেল ২৬০০০ র গায়েই। এ যন্ত্রনার উপশম কখনও হবে? এসএসসি ভু-ভারতে সেই বিরল সংস্থা যে স্বচ্ছতার বড়াই কোর্টে অস্বচ্ছতার কথা স্বীকার করল, চাল থেকে কাকড় আলাদা করতে পারবেনা জেনেও সিঙ্গেল বেঞ্চের রায় না মেনে হায়ার কোর্টে গেল। ঢাকি শুদ্ধ ঢাকও বিসর্জন দিল‌। টেইন্টেড শুধু কি ছেলেমেয়েরা? কর্তারা নয়?

আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রভুদের অসীম ক্ষমতা। শিরোমনিদের কথা বলাই বাহুল্য পাড়ার কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েতও দাপুটে সামন্ত। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। চাকরি ব্যতিক্রম হবে কেন? দলের আমি দলের তুমি দল দিয়ে যায় চেনার স্বজনপোষণের ইতিহাসেরও দীর্ঘ অতীত আছে। 

বিজয় সিংহ, ধনপতি, শ্রীমন্ত, চাঁদ সওদাগরের জাবর কাটা হোক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যতই মাথা কুটে মরুন মাসান্তে ‘থোক টাকাটা’র জন্য চাকুরীর অনুরাগের কথা ১৮৭৪’র ‘কেরানি দর্পণে মালতিও বলেছে। তবে বাঙালি শিক্ষারও কদরদার। যখন শিক্ষকদের আর্থিক হাল বেহাল ছিল তখনও মাচার  প্রথম লাউ থেকে পুকুরের মাছ মাস্টারের ঘড়ে পৌঁছে যেত অনুকম্পা নয়, আন্তরিক শ্রদ্ধার স্মারক হিসেবেই। 

একদিনে হাল ফেরে নি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে ১৯২১শে প্রতিষ্ঠিত অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন যখন কোনও একক ঝান্ডার নয়, সব শিক্ষক শিক্ষিকার ছিল, সম্মানজনক বেতন তখন থেকেই প্রধান দাবি। এই দাবিতেই  ১৯৫৪’র শিক্ষক আন্দোলন চমকে দিয়েছিল দেশকে। বাম আমলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের বেতনের দায়ভার সরকারের ঘাড়ে বর্তায়। মাইনেতে সরকারি গ্যারান্টি, পে- কমিশন দৌলতে শিক্ষকতার পেশাও সমাজের স্ট্যাটাসের অন্যতম সিম্বল হয়ে ওঠে।

রিক্রুটমেন্টের ক্ষমতা ছিল ভোটে নির্বাচিত দলহীন ম্যানেজিং কমিটির হাতে। নামেই  দলহীন। সুতো নিগূঢ়ে বাঁধা ছিল দলীয় অনুশাসনেই। বিক্ষিপ্ত ব্যতিক্রমগুলো বাদ দিয়ে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী নিয়োগে ‘দলের ছেলে’র তকমাটা ভাইটাল মাইলেজ। অর্থ, যোগ্য প্রার্থীকে ইন্টারভিউতে বাঁধা, পছন্দের কোরাম থেকে বিয়ের শর্ত… যে বলবে শোনে নি, সে ভীনগ্রহের প্রানী। এখন যেমন ভাঙা চাতাল থেকে দেদীপ্য প্রোমোটার সবাই তৃণমূল, লাল বাংলায় তখন প্রায় প্রত্যেক চাকরিপ্রার্থীর পকেটেই লাল লেটারহেডে সুপারিশ। চাকরি একজনের। গোঁসার সংখ্যা বহু। 

এই আবহেই এসএসসি’র জন্ম। বছরের পর বছর স্কুলে নগরের উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক দিনমজুরের সন্তানের সাফল্য নিয়ে বিন্দুমাত্র ফিসফাসের অবকাশ ছিল না। একই স্টাফ রুমে পাশাপাশি চরম বাম বাবুন, কট্টর দক্ষিণপন্থী সঞ্জীব আর কস্মিনকালেও রাজনীতির ছায়া না মারানো আনোয়ার। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মতই সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে নিয়োগে এসএসসি দেশে পথিকৃৎ পথিকৃৎ। অর্জন করেছিল বিশ্বাস সম্ভ্রমের অনন্য মাত্রা। পরিবর্তনের পরের পরীক্ষাতেও এসএসসি’র স্বাভীমান অটুট ছিল। 

সিকি শতাব্দী পেরিয়ে সেই এসএসসি চাকরির প্যানেলের বদলে প্রকাশ করছে চাকরি বাতিলের লিস্ট। ঘটনাক্রমের পুনরাবৃত্তি নিরর্থক। এখন নতুন পরীক্ষা, নতুন নিয়োগগের ডঙ্কা। এবার প্রতি ইঞ্চি মেধার ভিত্তিতে মেপে প্যানেল তৈরি হলেও  আস্থাহীনতার দায়মুক্ত এসএসসি হতে পারবে? বাংলার যৌবন যে দৃঢ়তায় সাফল্যের সাথে ব্যর্থতাকেও মেনে নিত- সে সব সহজেই অ্যাজ ইট ইজ হবে? গ্যারান্টি দিতে পারবে যে প্রাপককে শুনতে হবে না, “কত দিলে”?  ওএমআর শিট, প্যাকিং, সিলিং, ট্যাবুলেশন থেকে রেজাল্ট - পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব  ভিডিওগ্রাফির দাবি উঠলে অন্যায় হবে? সাদা খাতা, ওএমআর লোপাট, পরীক্ষা না দিয়ে চাকরি… সন্দেহ জাগবে না? মামলার চক্কর আর অনিশ্চয়তার দোলাচল কেটে যাবে? হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ঠেলাই নয়, এক লহমায় তিল তিল করে গড়ে ওঠা ভরসাকে চৌচিরের দায় কি দাগী ছেলেমেয়েদের? ওরা কি ধর্মের ষাঁড়, যে দাপ দেখিয়ে সবজির বস্তায় মুখ গুঁজে দিল? পসরা সাজিয়ে কে বসেছিল? 

টেইন্টেডদের সুদসহ টাকা ফেরতের প্রশ্ন যদি যুক্তিগ্রাহ্যতা পায় তাহলে আনটেইন্টেডরা পরীক্ষার ফি ফেরতের সাথে ক্ষতিপূরণের দাবি ন্যায্য।

কর্মসংস্থানের দিশায় যখন ‘চপ’ ‘ঝালমুড়ি’র দিশা, সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন ভোকাট্টা, তখন প্রতাপান্বিত ব্যক্তি সটান বলে দিচ্ছেন নিয়োগের পরীক্ষাটা দুর্গাপূজা নয় যে ফি বছর আয়োজন করতেই হবে। ‘ফ্যালো কড়ি নাও চাকরির আড়কাঠিরা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা থেকে বক্সিরহাটের শেষ প্রান্ত। চোখের সামনে জ্বলজ্বল বাঁকা পথের হাতছানি। অর্থবানরাই শুধু নয়, জোতজমি বেঁচেও অনেকে ঝাঁপ দিতে বাধ্য হয়েছে। 

আজ প্রকট আস্থাহীনতা। এবছর আবেদনকারী গত পরীক্ষার এক তৃতীয়াংশও নয়। কাজ পেয়ে হারানোর চেয়ে টোটো চালানো, কম বেতনে ছোটখাটো কাজকে উঁচু মেধার ছেলেমেয়েরা শ্রেয়ঃ মানছে। আতঙ্কের লাইনে প্রাথমিকের ষাট হাজার।  রাজনীতি সর্বস্বতার কচকচানি সোস্যাল মিডিয়া, প্যানেল ডিসকাশন থেকে মোড়ের চায়ের দোকান। ইস্যুকে ঘিরে শাসক-বিরোধীর মগ্ন অংকে অনিশ্চয়তার আঁধার শুধু ভুক্তভোগী যৌবনে। 

এসএসসি সম্ভবতঃ ব্রহ্মান্ডের সেই বিরলতম সংস্থা যে কোর্টে ভুল স্বীকার করেও নির্ভুল তালিকা দিল না। পরিণামে ‘টেইন্টেড’ না হয়েও  ডিসেম্বরে ছাঁটাইয়ের গ্যারান্টি। আগে বারবার সুযোগ পেয়েও পারল না, এইবার ঠিকঠাক প্যানেল তৈরি করবে? দীর্ঘ প্রস্তুতিতেও চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য আসে না। এবার তো প্রস্তুতির  অনভ্যাস, বয়সের পলির বাঁধা।  উপরন্তু ব্যাংকের ইঅএমআই, সন্তানের স্কুল, বীমার প্রিমিয়াম। “সুখে দুঃখে হয়ে কৃত্ত্বা” থাকা সম্ভব? মাথার ধমনীতে দপদপানি তীব্র হয়। দুদিন আগে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত সুবল সোরেনরা কি শুধুই কার্যকারণহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

এটা ঠিক, রাজনৈতিক ক্ষমতাই প্রধান কুশীলব। দেশভাগের পর স্বাধীনত্তোর বাংলায় বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়ে তার দায় এতটুকুও কম নয়। ব্যতিক্রম থাকলেও, রাজনীতির লোকজন মানেই অস্বচ্ছ এরকম ধারণা সাধারণের রয়েছে। দলীয় বিশ্বাস থাকতে পারে এসএসসি’র কর্তাদের মনোনয়নে মেধা আবশ্যিক। মন্ত্রী, নেতার চাপের মুখে তাদের মেরুদন্ডের ঋজুতা কোথায়? কথায় নাকথায় সব রোগের জন্য অশিক্ষাকেই প্রধান দায়ী যারা করেন একবার কি মিলিয়ে দেখবেন শিক্ষিতদের স্থাপিত দৃষ্টান্ত?

বঙ্গভঙ্গ, জালিওয়ানাবাগ, বক্সা…  রবীন্দ্রনাথের বাংলা উৎপল দত্তের হয়ে রাজপথে সত্যজিৎ রায়’কে দেখেছে, দেখেছে তিমিরের জন্য শঙ্খ ঘোষকে। সিলেক্টিভ প্রতিবাদের দৌলতে  ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটাই ব্যঙ্গে অধঃপতিত। দুঃখজনক সত্যিটা হল সহকর্মীদের জন্য শিক্ষক সংগঠনগুলোও দলীয় লক্ষ্মনরেখা পেরিয়ে সমবেত প্রতিবাদে ব্যর্থ।

ঘটিবাটি বিক্রি করে দুবার ঠকা ছেলেমেয়েদের যদি সুদসহ মাইনে ফেরৎ দিতে হয় কিডনি বিক্রি করেও অনেকে জোটাতে পারবে না। যোগ্যতা সত্ত্বেও যার চাকরি গেল কিংবা যে প্যানেলে বাইরেই থাকল- সে তঞ্চকতার সীমা নেই। ঈশানে আবার মামলার ভ্রুকুটি। সরকারি স্কুলে সবচেয়ে বেশি এনরোলমেন্টের হারের বাংলায় স্কুলকে ঘিরেই অনাস্থার আড়চোখ।

উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় মৃত্যুর তালিকা বাড়ালে গাইতে পারব তো ’ .. জাগে আমার গান’!



 

শীতকাল বদলায়নি, সময় বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছি আমরা

গৌতম চক্রবর্তী



“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, ফিরে আর আসবে কি কখনও”? হয়তো আর ফিরে আসবে না। কারণ শীত হারিয়েছে তার চিরসঙ্গীদের। আজ সে বড় একা। “এক মাঘে শীত যায় না”। তাই পৃথিবীর পাক খাওয়া নিয়মে প্রতি পৌষ-মাঘে সে আবার ফিরে ফিরে আসে। আসলে শীত মানে তো শুধু উত্তাপ কমে যাওয়া নয়, বরং শীত এলে আমাদের আনন্দের উত্তাপটা যেন অনেকটাই বেড়ে যেত। কারণ শীত তার ঝুলিতে উপহার নিয়ে আসত অনেক কিছু। কিন্তু সেই শীত আর আসে কই! শীত বদলে গিয়েছে, নাকি সময়ের সঙ্গে আমরাই বদলে যাচ্ছি? বদলে যাচ্ছে আমাদের বোধ! বদলে যাচ্ছে আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা। বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনশৈলী। হয়তো এই সব কিছু মিলেই বিজ্ঞান-নির্ভর সভ্যতায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। বিজ্ঞান এনে দিচ্ছে অনেক কিছু, কিন্তু হয়তো কেড়ে নিচ্ছে তার চেয়েও বেশি। ফলে অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে আমরা হয়ে পড়ছি নস্টালজিক। এখন শীত এলেই হারানো খতিয়ানের হিসেব কষতে ইচ্ছে করে। কোনও বিশেষ আত্মীয়তা না থাকলেও বিশেষত শীতকালে সন্ধ্যের পর কাঠকুটো বা পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই আড্ডা জমে উঠত। সেই আড্ডায় উঠে আসত সেইদিনের শীতের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে সিনেমা, রাজনীতি, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে সময়ে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবরাখবর। আধো অন্ধকারে শীতকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। শীতের আগুণ থাকা মানেই সকলের অবাধ যোগদান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। যৌথ পরিবার ভেঙে, ফ্ল্যাটবাড়ি কালচারে আজকের শৈশব অনেকটাই সেই প্রবীণদের সান্নিধ্য হারিয়েছে। হ্যারি পটারের যুগে এসে হারিয়ে গেছে পরী ও দৈত্যেরাও। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই?




ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানোর জন্য আমাদের ছোটবেলায় আসতো শীতকাল। আর তখন থেকেই তোড়জোড় শুরু হত শীতকালকে আমন্ত্রণের। সেই তখনকার শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া দিনে গ্লিসারিন সাবানের গন্ধে আমাদের বেঁচে থাকার গল্পগুলো আজ রূপকথা। স্নান করতে যাওয়ার আগে নারকেল তেল গলিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা রোদের কাছে, উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখনকার প্রজন্মের মনে হবে “কি গেঁয়ো ভুত” রে বাবা! প্রতিবার ভাবতাম পুজোর আগে কুল খাবো না। কিন্তু শেষ রক্ষা হত না কিছুতেই। ইট দিয়ে কুল পাড়ার মজা ছাড়া যায়? যায় না বলেই পকেটে পকেটে ভর্তি থাকতো কাঁচা পাকা কুল। এখনকার প্রজন্ম ভাববে “কি রে বাবা, কুল আবার খাওয়ার বিষয় হল”? “তার জন্য এত কিছু”? আচারের শিশির গায়ে রোদ পড়তো আর আমরা ছোটরা, খুড়তুতো, জেঠতুতোরা লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঠিক এই সময় ধীরে ধীরে বসন্ত পঞ্চমী' নামটি বুঝিয়ে দিত রং লেগেছে বনে বনে, ঢেউ জেগেছে সমীরণে। একদিকে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখতে দেখতে মনে হতো জীবনের আসল রং খুব সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, আবার স্কুল থেকে সরস্বতী পুজোর স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রতিযোগিতাও ছিল জীবনের আর এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েদের স্কুলে কে কে কার্ড দিতে যাবে এই নিয়ে কত রঙ্গরস! কাঁধে ব্যাগ, চুল উড়ছে, হিরো সাইকেলে চড়ে হাতল ছেড়ে হিরো হওয়ার বাসনাতে যেন দিগবিজয় করে ফিরতাম। গার্লস স্কুল থেকেও কেউ কেউ আসত মাঝে মাঝে। বুকের ভেতর কেমন একটা হত যা খালি চোখে দেখা যেত না। একটু উঁকিঝুঁকি, সামান্য চোখাচোখি। ঘুরে ফিরে তাকানোর পঞ্চমী প্রহর। নতুন শাড়ি সামলে নেওয়ার বয়ঃসন্ধি। আসলে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু 'অকথা' থাকে। বন্ধুরা সে কথা জানবেই। স্কুলের পুজোর দ্বাদশ শ্রেণী। সারস্বত উৎসব। পরিবেশনের দায়িত্ব। সে আসে ঠিক। নিজের হাতে খেতে দিই। স্যার বলেন দেখে দিবি কিন্তু। হ্যাঁ দিই তো। প্রসাদের সঙ্গে সন্দেশ দিই। হাতে একটু ছোঁয়া লাগে। এক পলকে দুজনের দেখা। সে সময়কাল শীতকাল। 



অশোকবাবুর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় যখন সাইকেলের বেল বাজাতাম তখন সোহারই মোড়ের সেই সাদামাটা মেয়েটা, যার নাম ছিল বীণা, কেন যে ভালো লাগত আমিও জানি না, চোখের সামনে ঝুঁকে থাকা অবাধ্য চুল কানের পাশে তুলে রাখত। সে জেনে যেত এবং বুঝে নিত বেল বাজিয়ে যে আসছে পেছনে না তাকালেও দেখা যায় সেই আসা। আচ্ছা সাইকেলের বেলেরও কি মোবাইলের মত ভিন্নধর্মী রিংটোন ছিল নাকি? কোনদিন শাড়ি পড়তো, আবার কোনদিন সালোয়ার কামিজ। আমার এক বন্ধুর কাছে যখন বলেছিলাম শাড়ি পড়লে মেয়েদের বড় বড় লাগে তখন ‘প্রেমিকার বুকের সেফটিপিন' কবিতা লিখে ফেলে সেই কবি বন্ধু সাহিত্য মহলে জবরদস্ত মুরগী। শাড়ি আসলে খুবই সংক্রামক। আসলে আমাদের অনেকের জীবনের ভালোবাসার বর্ণমালার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল এইসব শীত বিকেলে। আমরা মফস্বলের মাঠ জুড়ে স্বপ্ন ফেরি করতাম। হাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করা এই বয়সে ডাকাবুকো প্রেমিকের দলকে কেউ মনে রাখে কিনা এইকথা ভাবতে ভাবতেই ছোটবেলার মুগ্ধতা ভিড় করে আসে চোখের পাতায়। বাণী বন্দনার শীতসকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে হৃদয়ে অবাধ্য ছেলে কার মুখ ভেবেছিল মন কি তা জানে? মনের গতিবিধি বোঝা দায় যে। কত কবি বন্ধু ছিল সেইসময় আমার ক্লাশে তা কি জানতাম? কার মধ্যে কি সুপ্ত প্রতিভা আছে কি করে জানবো? বঙ্কিমচন্দ্রের বাবু পড়াবার সময় নির্মলবাবু মজা করে মদনকে বলেছিলেন ‘বলতো মদন, ‘মদন আগুণ কি’? মদন অবলীলাক্রমে বলেছিল ‘মদন আগুণ’ হল এমন আগুণ যা বালতি বালতি জল ঢাললেও নেভে না’। সেই মদন বাসন্তীকে চিঠি লিখল ‘পলাশ ও শিমূল পাশাপাশি / আঙ্গুলে শাড়ির খুট, লজ্জা…… ভালোবাসাবাসি’। এটা নিয়ে কয়েকদিন বন্ধুমহলের জমজমাট আলোচনা ক্রমে ক্রমে জমে ক্ষীর। মদন-বাসন্তীর এখন এক ছেলে এক মেয়ে। 



এটা অস্বীকার করা যাবে না আমবাঙালির কাছে শীত বরাবরই এক ‘সুস্বাদু’ মরশুম। তরতাজা সব্জিভরা বাজারে ঢুকলে খরচের হাতটাও যেন বাগে আসতে চাইত না। এই মরশুমে কেনার ক্ষমতা লাগাম ছাড়া হতেই হবে, কেন না শীত এসেছে যে। ফুলকপি কেনার পরে কই মাছ দেখলে গোটা গোটা বড়িসহ ফুলকপি আর আলু দিয়ে কইমাছের ঝোলের কথা ভেবে ঢোক গেলে না এমন নির্লিপ্ত আসক্তিহীন বাঙালি আছে কি ইহজগতে? কিংবা মুলো, বেগুন, আলু, ধনেপাতা দিয়ে মৌরলার চচ্চড়ি যে প্রাণিত বাঙালি খায়নি তার তো বাঙালি জন্মই বৃথা। আবার কালজিরে ও পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা চিকন বেগুন সহযোগে পাবদার ঝোল, নতুবা টাটকা সতেজ পিয়াজকলি দিয়ে ছোট চিংড়ির প্রিপারেশন খেয়ে কত ভিনজাতি পুরুষ যে বাঙালি শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে, হিসেব নেই। মাছেভাতে বাঙালি অনায়াসে দিনকতক মাছ ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেও তো হওয়ার নয়। শীতকালের মাছ বাজার রুপোলি শস্যে ভরা। সুন্দরী মৌরলা, আদুরে কাজলি, লাবণ্যময়ী পাবদা, রূপসী বোরোলি, বিদুষী সরপুঁটি, দাপুটে কই, হ্যান্ডসাম কাতলা। শীত এলে ব্যাগে ঝলমল করত রূপসী ফুলকপি, চিরসবুজ তন্বী পেঁয়াজকলি, বার্মিজ রুবির মত গাঢ় লাল চকচকে অপরূপা টমেটো, ঝিনুক থেকে বের করা সবুজ মুক্তোর মত মটরশুটি, সপ্তমীর চাঁদের মত বাঁকা কচি সিম, ব্ল্যাকবিউটি বেগুন, লজ্জায় গোলাপী ফরসা নধর মুলো, পাটভাঙা তসরের মত সজীব পালং, পরতে পরতে রহস্যময়ী বাঁধাকপি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? আসলে বাঙালির কাছে আমিষ নিরামিষে তফাৎ যে খুব কম এই ঋতু সেটাই প্রমাণ করে দেয়। কিন্তু না, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ফসল ফলাতে এখন আর শীতের তোয়াক্কা করে না। শীতের নিজস্ব ফসল ফলছে সারা বছর, শীতের ফুলকপি এখন সারা বছর ধরে খাচ্ছি আমরা। সেই স্বাদ আর নেই। তাই খেতে বসে অতীত আর আজকের শীত ভিন্নতা লাভ করে আমাদের হৃদয়কে আরো ব্যাথাতুর করে সুদূর অতীতে ফিরিয়ে দেয়। তবুও কিন্তু বাজার ফেরতা কর্তার ঠাসা ব্যাগে উঁকি দিয়ে আহ্লাদিত গিন্নি ঘন দুধে মালাইদার কফি নয়ত আদা দিয়ে কড়া ফ্লেভারের চা বানিয়ে আনে।



কণ্ঠ আর কণ্ঠি। শব্দদু’টো সঙ্গীতকে জড়িয়ে হলেও খানিক আলাদা। হিন্দি ও বাংলা জনপ্রিয় ফিল্মের গান যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতেন মূলত তারাই বিভিন্ন দিকপাল কণ্ঠশিল্পীদের ‘কপি সিঙ্গার’ বা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন আমাদের ছোটবেলায়। কিশোর কন্ঠ, রফিকন্ঠ, মুকেশ কন্ঠ, লতাকন্ঠি বা আশাকন্ঠি নামে অভিহিত এই কণ্ঠশিল্পীদের শীতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। বাঁশের মাচা বেঁধে এ পাড়ায় সে পাড়ায় গানের জলসা ছিল শীতের সন্ধ্যেরাতের এক বিশেষ আকর্ষণ। সুপারহিট নানান গানকে কণ্ঠে নিয়ে শীতের এই মাচা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই অনেক কণ্ঠশিল্পীর জন্ম। কোন পাড়ায় কোন অর্কেস্ট্রার প্রোগ্রামের খবর বাতাসের থেকেও ক্ষিপ্র গতিতে আগাম ছড়িয়ে পড়ত। পাড়া কাঁপিয়ে শীতের সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেক রাত অবধি চলত শরীর দুলিয়ে সেই গান শোনা। অর্কেস্ট্রা শব্দটির অর্থ ‘সমবেত বাদকদল’। সেই দল থেকেও শীত বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। সারা বছর রোজগারের তাগিদে অর্কেস্ট্রার সঙ্গে শীতের সে প্রণয় আর নেই। আজ আর কলকাতা বা বোম্বের আর্টিস্ট দেখতে আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম আর নেই। ফলে শীতের কাটে নিঃসঙ্গ রাত। এখন উৎসবের মুহুর্তগুলোতে যখন সেই কন্ঠশিল্পীরাই গানের রিমেক নিয়ে বিভিন্ন পুজোমন্ডপে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেজে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন তখন দেখি কেউ সারেগামার অংশগ্রহণকারী, কেই ইন্ডিয়ান আইডলস, কেউ বা আবার ড্যান্স বাংলা ড্যান্স বা মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার অভিধাতে অভিহিত। এখন হাতের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কয়েক হাজার গানের সম্ভার শীতের রাতের সেই গানের জলসার আকর্ষণকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এখন সারা বছরই টিভির পর্দায়, হাতের মোবাইলে ‘তারাদের’ সহজলভ্যতা। তাই আজ আলাদা করে শীতের রাত জেগে খেলার মাঠের প্যান্ডেলে ত্রিপলে বা কাঠের চেয়ারে বসে তারকাবহুল স্টার নাইট দেখার ধূম ধীরে ধীরে হারিয়েই যাচ্ছে। তবুও দুর্গাপুজো কালীপুজোর রাতে ‘ব্র্যান্ডেড’ বা ‘রেস্তোওয়ালা’ বিশিষ্টজনেদের পুজোতে নামীদামীদের দেখতে এখনো ভিড় জমে। সঙ্গীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কৌতুক শিল্পীদের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ব্র্যান্ডীয়করণের যুগে আমার হারিয়ে যাওয়া শীতকালের সেই ছোটবেলার অনাবিল মজার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আর নস্টালজিক হয়ে যাই। 




বাতাসে শিরশিরে অনুভূতির সঙ্গেই যেন আগাম ভেসে আসত শীতের রসনার সুবাস। মন ভালো হয়ে যেত আগাম কল্পনার রসাস্বাদনে। শৈশবের আচরণে কিছুদিনের জন্য হলেও বড় হওয়ার ভাব এনে দিত এই শীত। শীত এলেই দুই আঙুল মুখের সামনে সিগারেটের মতো ধরে বেশ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বার সময়ে বড়দের সামনে বড়গিরির সুযোগটা শীতই এনে দিত। ঘুম থেকে উঠেই কিংবা দিনের অন্যান্য সময়েও মুখের ধোঁয়া বের হতে দেখাটা ছিল আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের কাছে শীতের এক উপরি আকর্ষণ। পাতা খসানোর সময় শুরুর বার্তা অনেক আগেই পৌঁছে যেত আমলকী গাছের কাছে। আর সেই সময় এক নতুন ঋতুর জন্য আমরা তৈরি হতে থাকতাম। পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে, স্টিলের আলমারির মাথা থেকে নামত লেপ, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, শাল, শেয়ালরঙা আলোয়ান। গ্রামগঞ্জ মফস্বল শহরের পুরনো পাড়ার পুরনো বাড়িতে মনে আছে টিভি তখনও শুরু হয়নি। শীত এলেই আমাদের মফস্বলের ছোট মাঠে বা একটু বড় খোলা জায়গায় চারপাশ ঘেরা ছাউনি পড়ত। মাটি থেকে একটু উঁচুতে ছোট্ট মঞ্চ বরাবর মাটিতে ত্রিপল পেতে পুরুষ ও নারীর বসার জায়গা আলাদা করে দেওয়া হত। টিকিটের দাম খুব বেশি না হওয়ায় এবং প্রতিদিন বিভিন্ন কাহিনী পরিবেশিত হওয়ায় প্রায়দিনই এই আসরে ভিড় জমত। স্ট্রিং, রড আর গ্লাভস এই তিন ধরনের পাপেটের মধ্যে স্ট্রিং অর্থাৎ দড়ি দিয়ে উপর থেকে ঝোলানো পুতুল দিয়ে চলত এই পুতুল নাচ। সুরেলা সংলাপ আর কীর্তনের সুরে গান গেয়ে রাজা হরিশচন্দ্র, নিমাই সন্ন্যাস, কালীয় দমন, বেহুলা লক্ষ্মীন্দর, সীতাহরণ, শহিদ ক্ষুদিরাম ইত্যাদি নানান কাহিনীর সঙ্গে শৈশবকে আলাপ করিয়ে দিতে শীতের পুতুল নাচের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এখনও চাইলে শীত শৈশবকে সেই সুযোগ দেয়, কিন্তু দেখি শীতকে জড়িয়ে আজকের শৈশবের সেইসব আবেগ, অনুভূতির সময়টাই নেই। ফলে শীত নীরবে আসে, আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। এখন সারা বছরব্যাপী টেলিভিশনের অ্যানিমেশন চ্যানেলগুলো শৈশবের দখল নিয়েছে। শীত সেখানে অনাহুত। বদলে যাওয়া জীবন-শৈলীর বিনোদনের পসরা শীতের জন্য আলাদা করে কোনও জায়গা ছেড়ে দেয় না। তাকে ছেড়ে গিয়ে অথচ তাকে মনে রেখেই আজ তার সঙ্গীরা দিয়েছে শীত ঘুম। 


শীত এলেই সন্ধেবেলায় এলাকার ছোট খালি জমিতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত অনেক জায়গাতেই। শীতের শীতলতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই যেন সন্ধেবেলায় এই ঘাম ঝরানোর আয়োজন। আমরাও খেলতে যেতাম। শীতের গোটা সময়টাই সান্ধ্য এই খেলা চলত। শীতের শেষভাগে কোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলার পাট চোকানো হত সে বছরের মতো। নেটের দুই প্রান্তের খুটির মাথায় বোর্ডের বালবগুলো জ্বলে উঠতেই চারপাশ আলো আঁধারির মধ্যে ঝলমল করে উঠত রাতের ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। না, এখন আর চিলতে জমি ফাঁকা পড়ে থাকে না, মাটি ফুঁড়ে সেখানে বিল্ডিং গজিয়ে গিয়েছে। হয়তো হাতে নেই খেলার মতো অবসরও। তাই সান্ধ্য এই খেলার উদ্যোগ কমে গিয়েছে অনেকটাই। শীত হারিয়েছে তার এই সান্ধ্য খেলার আসরকে। শীত হারিয়েছে গোলকুন্ডের আগুণে আড্ডাকেও। তীব্র শীতের দিনের যে কোনও সময় বিশেষত সন্ধ্যের পর কাঠকুটো পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই বাবা কাকুদের আড্ডা জমে উঠত দেখতাম। মাঝেমাঝে পড়া শেষ হয়ে গেলে নিভন্ত আগুণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম আমরাও। আধো অন্ধকারে উষ্ণ আগুণ ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্ন চারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। তথাকথিত আধুনিকতা আর বৃক্ষ সংরক্ষণ এই দুইয়ে মিলে শীতে আগুন পোহানো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। সমাজের নিম্নবিত্ত লোকজনদের মধ্যে কালেভদ্রে শীতের সন্ধ্যায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুণ পোহানোর ছবিও এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই! 


আমাদের ছোটবেলাতে শীতের পথেঘাটে বাতাসে ভেসে আসত হিন্দি ও ইংরাজিতে অদ্ভুত নরম আওয়াজের ধ্বনি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই দর্শকের উল্লাসের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত রেডিয়োর মধ্যে দিয়ে। কানে ছোট্ট রেডিয়ো ধরে পথ চলা কারও উদ্দেশে ‘দাদা কত হল? প্রশ্নটা ছিল খুব কমন। কোথাও বা খানিক বড় রেডিও ঘিরে জটলা। রেডিয়োতে ক্রিকেট কমেন্ট্রি ততদিন শুধুই শোনার জিনিস ছিল। যতদিন না সাদাকালো টিভি এসে সেই জায়গার দখল নেয়। এখন সারা বছরের ক্রিকেট তার চরিত্র বদলেছে। শুধুমাত্র শীতের সঙ্গে ক্রিকেটের যে বন্ধুত্ব সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে অনেকদিন। তখন বাংলা ছবির যুগ। আর বাংলা ছবি মানেই বেশিরভাগ সাদাকালো। তাই হিন্দি ছবি দেখার বাড়তি আকর্ষণই ছিল তার রঙিন চেহারা। এই রংয়ের কারণেই হিন্দি সিনেমার টিকিটের দামও ছিল বেশি। খেলার মাঠে অনেকটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে তার ভিতরে বাঁশের ফ্রেমে বড় সাদা পর্দা টাঙিয়ে সপ্তাহব্যাপী চলত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সন্ধে ও রাতে প্রতিদিন দু’টো করে শো হতো। প্রতি শোয়ের রোজের টিকিট কিংবা সারা সপ্তাহের সিজন টিকিটের ব্যবস্থা থাকত। শো চলাকালীন বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমাদের মত ইচড়ে পক্কদের কৌতূহলী চাউনি ছিল রোজের অঙ্গ। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি মুহুর্তে নানান সিনেমার সম্ভার। শীত এলে বড় শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়। কিন্তু সে এখন মাঠ ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে উঠে এসেছে। বদলে গিয়েছে তার আঙ্গিক ও লক্ষ্য। শীত হারিয়েছে তার মাঠের সঙ্গীকে।


শীতের মাসে লেপকম্বল ছাদে শুকাতে দেওয়া, অথবা রোদে বসে কমলালেবু খেতে খেতে গল্পের বই পড়ার মধ্যে এক রকম যৌথ জীবনযাপন কৌমজীবনের অনুষঙ্গ ছিল। লাঞ্চ শেষে বারান্দায় আরাম কেদারায় গা এলিয়ে কৌণিকভাবে আছড়ে পড়া মিঠে রোদ শরীরে মেখে আলতো হাতে খোসা ছাড়িয়ে কমলা খেতে খেতে ঝিমঝিমে অনুভূতি লা জবাব। গরম চা আর নানারকম পিঠেপুলিতে সেরে নেওয়া হয় পৌষ সংক্রান্তির উৎসব। একইসঙ্গে অগুণতি আমন্ত্রণ, একাধিক আত্মীয়-স্বজন-বান্ধবের শুভ পরিণয়, যেখানে উপস্থিত থাকা ইজ আ মাস্ট, সেগুলোর কথা ভুলি কী করে? ছাদ-পিকনিক কিংবা কাছাকাছি কোনও বাগানবাড়ি ভাড়া করে দলেবলে গিয়ে হইহুল্লোড় ও খানাপিনা করে একটা বেলা কাটিয়ে আসা। শীতের শৈত্যকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম আমরা, আর শীতের ওমে তার হাজার মজাকে বুক চিতিয়ে আবাহন করতাম। দিন পাল্টাচ্ছে। গালভরা রাশভারী সাহেবি নাম দিয়ে বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে শতেক লাইফ-স্টাইল ডিজিজ। সুগার, প্রেসার, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল, ইউরিক অ্যাসিড, গ্যাস-অম্বল, বদহজম নিয়ে নিত্য বসত করা বহু বাঙালির জীবন থেকে কাটছাট হয়ে গেছে অনেক শখ আহ্লাদ। তবু শীতের ক’টা দিন তারা বেপরোয়া থাকতে চেষ্টা করে। অসুখ তো জীবনভর থাকবে। কিন্তু কড়াইশুটির কচুরি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, জয়নগরের মোয়া, ফুলকপির পুরভরা শিঙাড়া, টোপা টুসটুসে কমলালেবু এ সব তো মাত্র ক’দিনের অতিথি। এদের যথাযথ আপ্যায়ন না করলে হয়? আজকের পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়ির কালচারে শীত সেভাবে বোঝাই যায় না। তীব্র গরমের দহন থেকে নিস্তার পেতে শীতের উত্তাপটুকুই এখন লোকে চায়। 



আমাদের সেই স্বার্থপূরণে শীত নীরবে আসে আবার একদিন নীরবে চলেও যায়। এখন শীত মানে শুধুই ঠান্ডা উত্তাপ আর ধোঁয়া মেশা কুয়াশার আভরণ। সেই ধোঁয়াশার আড়ালে যেন ওত পেতে থাকে কোনও বিপদ, কোনও অজানা আতঙ্ক। সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি গরিব মানুষের কাছে শীতের নির্দয় রূপ। অনেকবার দেখেছি, বিশেষ করে শীতকালেই, নিথর শায়িত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থাপক টাইপের কিছু মানুষের প্র্যাকটিকাল পরামর্শ। ঝুঁকি না নিয়ে সকাল সাড়ে ছ’টায় শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক মুড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষ ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খুলে চায়ের জন্য আদা পিষছেন বা খোসাসুদ্ধ দাগী আলু কাটতে শুরু করছেন তরকারির জন্য। কোথাও বা লিট্টি সেঁকার আগুনেই জমে যাওয়া হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষোকম্বলে আপাদমস্তক মোড়া আধপাগলা ভবঘুরে যে তার কাঠকুটো আর কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে এক প্রবল শৈত্যপ্রবাহ স্থায়ী হচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতকে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগণিত সংগ্রামী মানুষ লড়াই করছেন, অবস্থান করছেন, যুঝে চলেছেন অনেক জায়গায় সামান্য চাকরির জন্য। তীব্র শীতকালকে উপেক্ষা করে কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার তুলে দিয়েছেন অগণিত বুভুক্ষু জনতার পাতে, কিন্তু সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের উষ্ণতা কি শীতের প্রকোপ কমিয়েছে একটুও? হয়তো একটু হলেও। সঙ্গোপনে হলেও এটুকুই আশা শীতের এই সমবেত লড়াই বিফলে যাবে না।


 

আর কি কখনো কবে

অনিতা নাগ


এখন আর অল্প বয়সের ব্যস্ততা নেই। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের মতো জীবন কেমন নিস্তরঙ্গ অলস। ছেলে মেয়ে বরের টিফিন করা নেই, সংসারের শতেক কাজ সামলে বাইরে দোকান বাজার করতে ছোটা নেই। দুপুরে খাওয়া সেরে একটু গড়িয়ে নিয়েই বারান্দায় দাঁড়ানো নেই স্কুল ফেরতা ছেলে মেয়ের অটোর অপেক্ষায়। আকাশের মুখ ভার হলে ছুটে গিয়ে জামাকাপড় তোলার ব্যস্ততা নেই। জীবনের চাকা যতো গড়াচ্ছে ততোই নেই এর তালিকা বাড়ছে। মা বাবা, শ্বশুর শাশুড়ী কেউ নেই। সবাই এখন দূর গগনতলে ঘর বেঁধেছেন। ছেলে, মেয়ে জামাই, সকলেই কাজের সুবাদে প্রবাসী। থাকা বলতে এই দুটো মানুষ। তাও যেনো কতো দূরের। তেমন করে আর গল্প করাও হয় না। আত্মীয় স্বজনের বাড়ী যাওয়াও তো উঠে গেছে সেই কোভিডের সময় থেকে। এই অখন্ড অবসরে মন তো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় হেথায় হোথায়। 

ঘর গুছোনোর আছিলায় সু সে'দিন তার পুরোনো সাজের জিনিষপত্র উপুর করে নিয়ে বসলো। কতো রকমের যে গয়না! মাটির, পুঁতির, টেরাকোটা, ডোকরা, রঙিন টার্সেলে কতো রকমের লকেট। সাথে ম্যাচিং দুল। শাড়ীর সাথে ম্যাচিং গয়নায় সাজতে খুব ভালো বাসতো সে। কোনোটাই আহামরি নয়, তবু খুঁজে খুঁজে পছন্দ করে কেনা। সেই যে মহামারী এলো, ঘরবন্দী জীবন। জীবনের চলনটাই কেমন পাল্টে গেলো। সাজ গোজ রইলো তোলা আলমারী আর প্যাঁটরাতে। তখন বাঁচার তাগিদে শুধু দূরে দূরে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে থাকা। খালি হাত ধোয়া, স্যানিটাইজড করা। এই করতে করতে আজ যখন জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে তখন হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। এখন আর গল্প হয় না। এখন পাশাপাশি থাকলেও মুঠোফোনে মুখ গুঁজে সব খুঁজে নেওয়া। অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিষের খোঁজে মনের ঘরে সিঁধ কাটা। একবার সিঁধ কেটে ঢুকে গেলে কতো যে মণিমাণিক্য, হিরে-জহরত তার ঠিক নেই।  

গয়নার বাক্স থেকে বেছে বেছে রাখছে সু। কতো গয়নার রঙ গেছে চটে, কতো গয়না গেছে বিবর্ণ হয়ে। সেগুলো সব আলাদা করে একটা ব্যাগে রাখলো। সাহায্যকারিনী মেয়েটা যদি নেয়। নাহলেই বলবে একবার দেখালে না, ফেলে দিলে! এ'সব গোছাতে গোছাতে একটা কি যেনো লাগলো হাতে। অনেক কসরত করে সেই প্যাকেট বাইরে এনে আনমনা হলো সু। এ'যে অরুপ রতন! তার ভালোবাসার ধন। আজ অনাদরে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

একটা বিবর্ণ প্যাকেট। তাতে রয়েছে জীবনের কতো যে স্মৃতি, কতো ভালোলাগা, কতো স্বপ্ন। অথচ অনাদরে, অবহলোয় পড়েছিলো। সু এর মনেও ছিলো না এদের কথা। আস্তে আস্তে প্যাকেটাকে দু'হাতে আগলে রাখলো বুকের কাছে। ছোটবেলার সোনালী দিনগুলোর আগল গেলো খুলে। প্যাকেট থেকে একটা একটা করে বার করলো বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মেডেল গুলো। বেশ অনেক গুলো। সবগুলো পাওয়া বিভিন্ন নাচের কমপিটিশন থেকে। মা' র উৎসাহেই নাচ শেখা। তারপর কখন যে নাচকে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে মনে নেই। বছরে একবার নাচের স্কুলে কমপিটিশন হতো। লোকনৃত্য, রবীন্দ্রনৃত্য, শাস্ত্রীয় নৃত্য। মা নিয়ে যেতেন। সংসারের শতেক কাজ সামলে মা যে কিকরে অতোক্ষণ সময় বার করতেন আজ আর তা মনে নেই। ফিরেই তো রান্নাঘরে ছুটতেন। অনেকটা রাস্তা। পুরোটা রিক্সায় যাওয়ার সামর্থ্য ছিলো না। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিক্সায়। পথে পড়তো এক নামী মিষ্টির দোকান। কাচের শোকেসে থরে থরে সাজানো মিষ্টি। সবচেয়ে লোভনীয় ছিলো জল ভরা তালশাঁস সন্দেশ। ওই দোকানের সেরা মিষ্টি। দামেও সেরা। তাই দেখেই মন ভরানো। কিন্তু এই একদিন সেটা পাওয়া যেতো সহজে। ওই তো মা'র কথা শুনতে পাচ্ছে সু। সব বিভাগে সেরা হলে জলভরা তালশাঁস সন্দেশ পাওয়া যাবে। কি মজা, কি মজা। বাকী পথটা লাফাতে লাফাতে চলতো সু। নাচের স্কুলে পৌঁছে সবাই যখন ভয়ে কাবু, সু তখন দিব্যি মজায়। একে তো নাচ করতে তার বড্ড ভালো লাগে, সাথে জলভরা! আর তাকে পায় কে! এমন কতো কম্পিটিশনের স্মৃতি লেগে রয়েছে এই মেডেল গুলোয়! নাচের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে লাল সার্টিন জড়ানো এই মেডেল গলায় পড়িয়ে দিতেন মাষ্টার মশায়। সু চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছে মা আর বাবার গর্বিত মুখ দুটো। কতো হাততালির আওয়াজ! কোনো বিভাগে প্রথম, কোনটায় দ্বিতীয়, কোনটায় বা তৃতীয়। কিন্তু তিনটে বিভাগের পুরস্কার আসতো বাড়ীতে। নাচ নিয়ে বাড়ীতে আর কারুর তেমন উৎসাহ ছিলো না। কিন্তু মা আর বাবা যে বড্ড খুশী হতেন তা বুঝতো সু। 

মনের কোন ঘরে, অতল অন্ধকারে লুকিয়ে ছিলো সেই স্মৃতি। দু' চোখ ঝাপসা। ফ্রক পড়া, দু বেণী বাঁধা ওই তো সেই মেয়ে! কতো পথ পেরিয়ে আজ স্মৃতি হাঁতরে খুঁজে দেখছে সু নিজেকে। ছেট ছোট আনন্দে ভরা ছোটবেলা। ছোট ছোট পাওয়া। তালশাঁস সন্দেশ, টানা রিক্সার টুংটাং, আলোয় ভরা স্টেজ, করতালির মুখরতা, সাইকেলের পিছনে কেরিয়ারে বসে বাবার সাথে বেড়াতে যাওয়া, বল খোঁপা বাঁধা, লাল টিপ পড়া মা'র মুখ! এমন সব টুকরো স্মৃতির কোলাজ। আনমনা সু। আবার যদি ইচ্ছা করে আর কি ফিরে আসবে সেই দিন! মনের মাঝে রবি কবির সুর বাজছে.
 'যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব'সে রইব কতো আর'


 

গল্প 


ডট পেন

চিত্রা পাল 


বাড়ী থেকে বেরোবার সময়ে ডটপেনটা নেবো না নেবো না করেও সঙ্গে নিয়ে নিলো নিখিলেশ। যদিও জানে এখন কোন কাজে লাগবে না, তাও সঙ্গে নিয়ে নিলো।কী জানি বলা যায় না, যদি কোন কারণে কাজে লেগে যায়। পকেটে গুঁজে নেবার পরে আবার একবার পেনটা  বের করে খবরের কাগজের সাদা জায়গায় ঘসে দেখে হিজিবিজি কেটে দেখেও নিলো কালি ঠিক আছে কি না,দ্যাখে, হ্যাঁ ঠিক আছে। এবার আর ফোনটা পকেটে গুঁজে নিতে দ্বিধা করলো না ।

নিখিলেশ আজ নিয়ে দুতিন্ দিন বাড়িতেই আছে। কদিন সর্দি গা ম্যাজম্যাজ এসবের সঙ্গে গা টা ও যেন গরম গরম লাগছে। ছুটি পাওনা ছিলো বলে অফিস থেকে ছয় দিন ছুটিই নিয়ে নিলো। সবে পুজো পার হয়েছে। মেয়ের এখন স্কুল ও ছূটি। কথায় কথায় বীণা বলে, এই তো ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছ। রিনিরও স্কুল ছুটি, আমরা সবাই মিলে কুচবিহারে মায়ের কাছে ঘুরে আসতে পারতাম। নিখিলেশ বলে, তা যাও না, কে বারণ করেছে। বীণা বলে, তা কি করে হবে, তোমার শরীর ভালো নয়, গা গরম, এভাবে  তুমি যাবে না কি ?নিখিলেশ বলে, না, আমি যাবো না, তোমরা ঘুরে এসো। বীণা আবার বলে, না তা হয় না। তোমার শরীর ভালো নয়, আর তোমাকে রেখে আমি যাব? না ,এমন কিছু শরীর খারাপ  নয়, আমি একা বেশ থাকতে পারব, তুমি বরং রিনিকে নিয়ে ক দিন ঘুরে এসো। এখন ওর স্কুলের ছুটি ওর দিদিমণিও বলে গ্যাছে দিন দশ বারো আসবে না, এটাই যাবার সময়।নিখিলেশের কথা শুনে রিনি বলে, চলো না মা কুচবিহারে, কতদিন যাই না, চলো না, চলো না বলে বায়না ধরে । 

ওদের ট্রেনে তুলে দিয়ে এসে যেন কাত্‌রে পড়লো নিখিলেশ। ওদের নিয়ে কোন চিন্তা নেই, সঙ্গে একজন অফিস কলিগকে পেয়ে যাওয়াতে ও নিজেও খানিক চিন্তামুক্ত। কিন্তু ওর শরীরটা ঠিক  নেই।আজকে যে বেশি খারাপ লাগছে সেটা ও বীণাকে বলেনি।ভাবলো সামান্য সর্দিজ্বর ও দুদিনে সেরে যাবে,কিন্তু বীণা আর রিনি যাবে বলে যে হৈচৈ করছে, ওর  জন্যে বীণা যাওয়া ক্যান্সসেল করে দেবে, তারপরে রিনি গোঁজ হয়ে থাকবে আর বাড়ির আবহাওয়া একেবারে হঠাত্‌ ঘুর্ণীঝড় আসার ঘোষনার পরের অবস্থায় এসে যাবে। তাই যাওয়াটাই বহাল থাকলো। নিখিলেশ ওদের ট্রেনে তুলে দিয়ে  ওষুধের দোকান থেকে জ্বর কমাবার ট্যাবলেট কিনে নিয়ে এলো। রাতে অল্প কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। 

সকালে জ্বর সামান্য কমলেও শরীর ভালো বোধ হচ্ছে না দেখে কাছেই চৌমাথার ওধারে যে ডাক্তারবাবু বসেন তার শরণাপন্ন হলো নিখিলেশ। ডাক্তারবাবু সব দেখেশুনে পাঁচ দিনের ওষুধ লিখে দিলেন।বললেন, এইওষুধগুলো খান ঠিক হয়ে যাবেন। যদি না সারে তবে আসবেন।  

ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে নিখিলেশ কাছের ওষুধের দোকানে গেল। প্রেসকৃপশন দোকানদারকে দেবার আগে নিখিলেশ নিজেই একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো,কি ওষুধ দিয়েছে দেখার জন্য। ডাক্তারবাবুর লেখা এত জটিল আর গুঁড়ি গুঁড়ি যে কিছুই পাঠ্যধার করতে পারলো না। দোকানদার  তিনটে ওষুধ দিয়ে বললো,প্রথমটা যে কি দিয়েছেন,ওটা আমাদের দোকানে নেই।নিখিলেশ সব ওষুধগুলো কিনবে বলে ওই খানকার কাছাকাছি তিন চারটে দোকান ঘুরে এলো, কিন্তু কেউই এক নম্বর ওষুধটা দিতে পারলো না।

এক নম্বর ওষুধ না পাওয়া গেলেও যে তিনটে পাওয়া গ্যাছে, সে গুলো নিয়মমাফিক খেয়ে নিয়েছে। আজ জ্বরটাও আসেনি।শরীরটা আগের থেকে ভালো বোধ হচ্ছে। খাওয়া দাওয়ার পরে দুপুরে একটু বিশ্রাম নিতে বিকেলে বেশ ফুরফুরে লাগলো নিজেকে। ভাবলো, আচ্ছা এক নম্বর ওষুধটার খোঁজে একবার স্টেশনের ওপারের বড় দোকানটায় যাই। দেখি ওরা দিতে পারে কি না। ওদিকটায় আবার  টোটো যায় না। একখানা অটো নিয়ে ওই বড় দোকানটায় হাজির হয় নিখিলেশ।সেখানে বেশ ভীড়।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কজন। নিখিলেশও লাইন দিলো। ওর টার্ন আসতে ও ওর প্রেসক্রিপশনটা কর্মচারিকে দিয়ে বললো,শুধু প্রথম ওষুধটা দেখবেন,অন্যগুলোপেয়ে গেছি। সে খানিকক্ষণ দেখে বোধ হয় বুঝতে না পেরে অন্য দুচারজনকে দেখায়। শেষে একজন বললো, না এ ওষুধটা নেই। নিখিলেশ বলে,কয়েকটা দোকানেতোদেখলাম, পাইনি জানেন। আচ্ছা ওষুধটা কি সংক্রান্ত বলতে পারেন? অনেক দেখেটেখে বলে ঠিক বঝতে পারছি না,কোন বড় অসুখ ক্যন্সার ট্যান্সারের হতে পারে, আপনি কাইন্ডলি অন্য দোকানে জিজ্ঞেস করে নিন।

   শুনে নিখিলেশ বেজায় চিন্তায় পড়ে গেলো। কি হলো, আমার আবার ক্যান্সার হলো নাকি?জ্বর শরীর দুর্বলতা কি তারই পূর্ব লক্ষণ? মেয়েটা ছোট, এখন ও যদি এমন অসুখে পড়ে তবে বীণার কি হবে? বাড়িতে এসেও ওর মাথা থেকে চিন্তা যায় না। এর মধ্যে বীণার ফোন এলো। জিজ্ঞেস করে ,কেমন আছতুমি? বলতে যাচ্ছিলো, না আমি ভালো নেই, বলতে গিয়েও বোললো,আমিভালই আছি, কোন চিন্তা কোরো না।  

রাতে ভালো ঘুম হয়নি, নানারকম আবোলতাবোল চিন্তার জট এসে মাথায় ভীড় করে। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সকালে ঠিক করে, না, আর কোন চিন্তা নয়, আগে আর একবারডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করি। এই ভেবে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করে প্রেস্‌ক্রিপ্‌শন দেখিয়ে বলে, যেমন ওষুধ দিয়েছেন তেমনই খেয়েছি, কিন্তু এক নম্বর ওষুধটা কোন দোকানে পাইনি। ওটা কোথায় পাব?ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দেখে বললেন, আরে, ওটা কোন ওষুধই নয়। আমার পেনটা ঠিক ছিলো না বলে আপনার পেনটা নিয়ে লেখার আগে একবার দেখে নেবার জন্য ওই লেখাটা লিখে আবার কেটেও দিয়েছি। নিন, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না।ভালোই আছেন দেখছি।নিখিলেশ প্রথমে একটু হকচকিয়ের গেলো। কি থেকে কি ভাবছিলো ও।ভাগ্যিস্‌ বীণাকে কিছু বলেনি।তাহলে আর এক কান্ড হতো। তারপর ডট পেন টা পকেট থেকেনিয়ে একেবারে ফেলে দিতে গিয়েও  থমকে গেলো দোষটা কার সেই ভেবে।      


 

দিন বদলের গল্প

লীনা রায়

 
গভীর ঘুম থেকে মাঝ রাতে ডেকে তুলেছিল মা। কিছু বোঝার আগেই হাতে জামা প্যান্ট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল তৈরী হয়ে নিতে। আর তার কিছুক্ষন বাদে ব্যাগে খানকয়েক জামা প্যান্ট, গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়া। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সঙ্গী ছোটকাকা। বাড়ি থেকে বের হবার ঠিক আগে মা গুটিকয় আম আর মুড়ি পুঁটলি বেঁধে সঙ্গে দিয়েছিল। বলেছিল, “খিদে পেলে খেয়ে নিস।”

তখন অনেকেই দেশ ছাড়ছে। কাকার সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসে রতন। উঠেছিল জলপাইগুড়ি জেলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এক রাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন নিজেদের বাড়িতে। কাকা সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল। দু' কাঠা জমিতে দু' কামরার টিনের চালা। সেখানেই শুরু হল কাকা ভাইপোর সংসার।

 বড় রাস্তার ধারে বাড়ি। আশে পাশে কোন প্রতিবেশী নেই। কিছুটা হেঁটে যেখানে রাস্তা দু' ভাগ হয়েছে সেখানে একটি বাড়ি। কাকা সকালে রান্না করে। বালতি ভরে খাবার জল নিয়ে আসে। বাড়ির কাছেই নদী। সেখানেই চান, ধোয়া কাচা। তবে এখানকার নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের নদীর অনেক তফাৎ। এখানকার নদীতে শীতকালে জল থাকে না বললেই চলে।

 রতন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাড়ির পাশেই সেনা বাহিনীর ক্যাম্প। ওখানে দশটার ঘন্টা বাজলেই ভাত খায়। আর তারপরে স্কুল। স্কুল ছুটি হলে ঘুরে বেড়ায়। ফাঁকা বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করে না। ক্যাম্পের কাঁটা তারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে মার্চ পাস্ট দেখে। কোন কোনদিন নদীর ধারে বসে থাকে। সন্ধ্যা হবার মুখে বাড়ি ফেরে।

মায়ের দেওয়া আম খেয়ে আঁটিটাকে ঘরের পাশে ফেলে রেখেছিল। সেটা থেকে চারা বেরিয়েছে। রতন বেড়ার ধারে সেটাকে লাগিয়েছে। প্রতিদিন জল দেয়। তরতর করে বাড়ছে গাছটা। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে রতনের। দেশ ছেড়ে সব কিছু গুছিয়ে বাবা, মা চলে আসবে। কিন্তু কবে?

কাকা সকালে কাজে বেরিয়ে রাতে ফেরে। কাকা ফিরলেই খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কেরোসিনের দাম খুব বেশি। রতন শুয়ে শুয়ে বাড়ির কথা ভাবে। বন্ধুদের কথা ভাবে। এক বছর পার হয়েছে। আবারও শীত এসেছে। এখানে ঠান্ডার জোর বেশি। কুয়াশা কাটতে কাটতে দুপুর হয়ে যায়। তার ওপরে বৃষ্টি। ঠান্ডার সময় লেপের ভেতর মায়ের গায়ে লেপ্টে শুয়ে থাকার কথা মনে পড়ে। নতুন গুড়ের পায়েস, পিঠের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

 সকালে উঠে উত্তরদিকে পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। কাকা বলেছে পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবে। ছুটির দিনে আধ ঘন্টা হেঁটে পৌঁছে যায় চা বাগানে। দেখে মনে হয় সবুজ গালিচা বিছানো। নি:ঝুম, শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে পাখির ডাকে স্তব্ধতা ভাঙে। এখানকার বাতাস খুব ঠান্ডা। প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

নদী, চা বাগান, সেনা ক্যাম্প - সব নিয়েই রতন বেড়ে উঠছিল। মা বাবার জন্য অপেক্ষা শেষ হয়েছে। কিছুদিনের ব্যবধানে দুজনেই তাদের ছেড়ে চলে গেছে। খবর পেয়েছে অনেক দেরিতে। মায়ের জন্য মন কেমন করে রতনের। আম গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছের গায়ে হাত রাখে।

অবসরে রতন হাঁটে। পিচ রাস্তার দু' ধারে বিশাল বিশাল শাল, সেগুন গাছের সারি। আবার রেল লাইন পার হয়ে কিছুটা এগোলেই ঘন জঙ্গল। রতন বার বার একই জায়গায় যায়। প্রতিবার নতুন লাগে। এখানকার প্রকৃতি অপরূপা। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাড়ি ফেরে। আমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে।

 সময় গড়ায়। ছোটকাকা আর নেই। স্কুলের চাকরি, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে স্বচ্ছল সংসার রতনের। পাকা বাড়ি, ইঁটের পাঁচিল। আর পাঁচিলের গা ঘেঁষে সেই আমগাছ। আমগাছের নিচেই সকাল সন্ধ্যার চায়ের আসর।

এখানে বসেই চল্লিশ বছরের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে রতন। ছিন্নমুল হয়ে অন্য দেশে থিতু হবার গল্প। তার একলা জীবন। একাকিত্ব ভুলতে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া। আর তার মায়ের স্মৃতি – তার বড় প্রিয় আমগাছ।

কিন্তু চোখ খুললেই সব হারিয়ে যায়। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গলি, মহল্লা, বাজার ঘাট সর্বত্র। উঁচু উঁচু বাড়ি, গাড়ি, মোটর সাইকেলে জমজমাট রাস্তা। রাস্তায় কত লোক। দলে দলে লোক আসছে ভিন্ন শহর, ভিন্ন রাজ্য থেকে। প্রকৃতির টানে। ব্যবসা বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। কমেছে শীত, বৃষ্টি দুটোই। রতনের অচেনা লাগে সব কিছু। ছেলেবেলায় যে নদী তাকে সঙ্গ দিত, তার অস্তিত্ব আর নেই। আস্ত একটা নদী কর্পূরের মতো কবে যে উবে গেছে! বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আর পাহাড় দেখা যায় না। চা বাগান বন্ধ। কিন্তু শহর বাড়ছে।

এর মধ্যে সরকারি নোটিশ এলো। রাস্তা চওড়া হবে। ভাঙ্গা পড়ল রাস্তার দু' ধারের বাড়ি, দোকান। রতনের বাড়ির ইঁটের পাঁচিল ভাঙ্গা গেল। কাটা পড়ল আম গাছ।

রতন আজকাল ঘরেই থাকে। বারান্দায় অব্দি আসে না। সবাই তাকে বোঝায়। রতন চুপচাপ শোনে। কথা বলে না। বাবার মন খারাপ ছেলে বোঝে। সেজন্য নার্সারি থেকে আম গাছের চারা এনে বাড়ির সামনে বসিয়েছে। বার বার ডেকেছে ওকে দেখার জন্য। রতন যায়নি। সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখে ইঁটের পাঁচিল। আর পাঁচিলের গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা তার প্রিয় আমগাছ। হাওয়ায় দুলছে ঝাঁকড়া ডালপালা। আমের মুকুলের গন্ধে ম ম করছে চারদিক।

স্বপ্নটা ভেঙে যেতেই ছুটে ঘরের বাইরে আসে রতন। চোখে পড়ে কালো কুচকুচে পিচ রাস্তা। আলো আঁধারে হিলহিলে সাপের মত লাগছে। গা গুলিয়ে ওঠে রতনের।


 


বিজয়ার পরে

অম্বালিকা ঘোষ


জানলার পাশ থেকে সাবধানে বাহারি গাছের পটগুলো সরিয়ে এনে জানলার পাল্লা বন্ধ করে দেয় অনুপমা, বিকেল সাড়ে চারটা, পাঁচটা বাজতে না বাজতেই কেমন দিনের আলো যাই যাই করে ওঠে এখন। আশ্বিনের প্রায় মাঝামাঝি, বেশ একটা হিমেল ভাব বাতাসে ভোর ও সন্ধ্যায়। অনতিদূরে ঢাক বাজছে,রব উঠছে, ’আবার কবে, বছর পরে’। আজ তাহলে বিজয়াদশমী। সাম্প্রতিককালে যে ঝড় বয়ে গেছে অনুপমার জীবনে, তার আবহে কোনদিক দিয়ে যে পুজোও চলে গেলো, বোঝেনি অনুপমা। অথচ পুজো মানেই অনুপমার কাছে ছিল নীল আকাশ, কাশের গুচ্ছ, শিউলির সুবাস, অষ্টমীর অঞ্জলি ও ঢাকের বাদ্যি। বন্ধ দরজার ওপারে এবার সন্তর্পর্ণে পুজো এলো, চলেও গেলো। মনের দরজা জানালাগুলি বন্ধ হয়ে গেলে বুঝি এরকম নির্লিপ্ত হয়ে সবই উপেক্ষা করে থাকা যায়! সজল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অনুপমার বুকের গভীর গুমোট প্রকোষ্ঠ থেকে। ভিতরটা কেমন যেন শূন্য মনে হয় অনুপমার, বেশি কিছু ভেবে উঠতে পারে না। হালকা বাঁশির শব্দে সম্বিৎ ফেরে অনুপমার, মুঠোফোনের ওপার থেকে বুবুন মানে তার ছেলে ডাকছে। ফোনটা তুলে কানে চেপে ধরে অনুপমা,’বল’। ‘কি করছো? চা খেয়েছো?’ ওপার থেকে বুবুনের গলা ভেসে আসে। বুবুন, মানে অরিত্র, অনুপমা আর শিবেশের একমাত্র ছেলে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বেঙ্গালুরুতে বর্তমানে কর্মরত। এখন প্রতিদিন সকালে ও বিকেলের দিকে এসময় প্রায় নিয়ম করেই মাকে ফোন করে বুবুন, আবার রাতে একবার ঘুমাতে যাবার আগে। নতুন চাকরী, একবছরও হয়নি,তাই বাবা চলে যাবার পর বেশিদিন বাড়িতে থাকতে পারেনি বুবুন। সেই অপরাধবোধে ভোগে সে, অনুপমা বোঝে। ছেলের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলে ফোন রাখার পর অনুপমা বসার ঘর থেকে ভিতরের ঘরে আসে। ভাল করে ঘরের চারদিকে নজর বোলায় সে, নিপাট পরিপাটি করে সাজানো এই শয্যাকক্ষ, কোথাও কোনকিছু অবিন্যস্ত হয়ে নেই। কোনকিছু অগোছালো হয়ে পড়ে নেই, ঠিক যেখানে যেমন থাকা দরকার, সেখানে তেমন ভাবেই সবকিছু যেন রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে বা পড়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে শোবার খাটের পাশে রাখা আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনুপমা, চাবি গলিয়ে হাতল মুচড়ে আলমারীর একটা পাল্লা খোলে অনুপমা। শিবেশের শার্টপ্যান্ট সব ঝোলানো রয়েছে একদিকে। পাটপাট করে, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় সব ঝুলে রয়েছে ব্যবহৃত হবার অপেক্ষায়, কিন্তু ব্যবহারকর্তাই অনুপস্থিত। হ্যাঙ্গার থেকে শিবেশের একটা জামা খুলে নিয়ে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে অনুপমা, শিবেশের গন্ধ পায় সে কাচা জামা থেকেও। প্রতিটা মানুষের উপস্থিতির, তার অভ্যাসের একটা নির্দিষ্ট সুবাস থাকে বুঝি। তার বহুল ব্যবহৃত জিনিসে সেই সুবাসটুকু থেকে যায় তার চলে যাবার পরও। শিবেশের চলে যাবার পর সেটা আবিস্কার করেছে অনুপমা। এই বাড়ির প্রায় সবকিছুতে, বিশেষ করে  শোবার ঘরের প্রতিটা জিনিসে শিবেশের শরীরের ঘ্রাণ পায় অনুপমা। তার ব্যবহারের ঘ্রাণ পায় বলা ভাল। শেষদিনও শিবেশ যে বইটা পড়ছিল, সেই বইটা হাতে নিয়ে বহুক্ষণ বিছানার উপর বসে থাকে অনুপমা, পাতা মোড়া রয়েছে তিনশো বাষট্টি পৃষ্ঠায়, পাঠক যদিও আর এসে বাকিটা পড়বে না। অনুপমা ভাবে, আচ্ছা, শিবেশ কি বুঝতে পারেনি, ওই পৃষ্ঠার পর তার আর কোনদিনও বইটি পড়া হবে না!নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি, জানলে সে পাতা মুড়িয়ে রাখত না। বেডসাইড টেবিলে জলের গ্লাসে এখনো অর্ধেক জল রাখা, যার বাকিটা শিবেশ খেয়ে শুয়েছিল শেষ রাতে, সে চলে যাবে জানলে কি বাকি জলসহ গ্লাসটা প্লেট দিয়ে অমন করে ঢেকে রাখত শিবেশ! নিশ্চয়ই না,অনুপমা ভাবে। শিবেশের চশমা, বই, তামার জলের গ্লাস, ওষুধের বাক্স সব যেমন রাখা হত, যখন ব্যবহার হত, ঠিক তেমনই রাখা আছে এখনো, আজ সতেরোদিন হল সেগুলি ব্যবহার হয়নি।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষে একদিন শেষরাতে নির্মম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় শিবেশের,বাথরুম থেকে বেরিয়ে সেই যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শিবেশ, আর উঠতে পারেনি। পাশের বাড়ির লোকের সহায়তায় দ্রুতই নিকটবর্তী নার্সিং হোমে নিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। খবর পেয়ে পরদিন দুপুরের মধ্যেই ছুটে আসে বুবুন, তারপর সবকিছুই যেন একটা যান্ত্রিক নিয়মে হয়ে চলে, অনুপমা বুঝে উঠতে পারেনা কিভাবে কি হয়ে গেল! হার্টের সমস্যা কিছু ছিল শিবেশের, কিন্তু সে নিয়মিত চেক আপের মধ্যেই থাকত এবং নিয়মমাফিক জীবনযাপনই করত, তাও তার এভাবে চলে যাওয়া অনুপমা মেনে নিতে পারেনি। যে মানুষটার সাথে সাতাশ বছর একছাদের নীচে বসবাস করেছে, সংসার সাজিয়েছে, সে এরকম নিঃশব্দে চলে যাবে, অনুপমার বিশ্বাস হয়না।  তার সবসময়ই মনে হয় শিবেশ কোন কাজে বাইরে গেছে, আবার ফিরে আসবে। বুবুন তার মাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বেঙ্গালুরুতে, কিন্তু যায়নি অনুপমা। এই বাড়ি, এত বছরের সংসার ফেলে যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না।  বুবুন বুঝেছিল,মায়ের আবেগকে সম্মান দিয়ে সেও আর জোর করেনি। সকাল বিকেল মায়ের খোঁজ নেয় সে ফোনে। দুশ্চিন্তা হয় তারও মায়ের জন্য। ভরসা করতে হয় বহুদিনের পুরোনো কাজের সহায়িকা সবিতা মাসির উপর। আগে সারাদিন কাজকর্ম করে চলে গেলেও বাবা চলে যাবার পর থেকে রাতে এসে মায়ের সাথে থাকে সে। বুবুনই ঠিক করে গেছে, সে জানে মায়ের একা থাকার অভ্যেস নেই।

বেল বাজতেই অনুপমা গিয়ে দরজা খুলে দেয়, বারান্দাটা অন্ধকার হয়ে আছে। প্রতিদিন সবিতা যাবার সময় আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।সবিতা রোজ রাতে এসে শোয়, কিন্তু আজ তার ছেলের জন্মদিন, তাই আজ রাতের ডিউটি থেকে অব্যাহতি চেয়েছে। বুবুন চিন্তা করছিল, অনুপমা অভয় দিয়েছে, একটা রাত একা থাকলে তোর মা মরে যাবে না, দিব্যি থেকে যাবে। সবিতা আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ওবেলায় চলে গেছে, তাই বারান্দার আলোটাও আর জ্বালানো হয়নি। স্ট্রিটলাইটের স্বল্প আলোতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতেই অনুপমা বুঝতে পারে, শিবেশ দাঁড়িয়ে আছে। ‘তুমি, এত দেরী করে এলে?’দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় অনুপমা। ‘আর বলো না, এবার বিসর্জন অনেক দেরী করে হল’, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল শিবেশ। ‘একি, একদম ভিজে গেছো যে!’,শিবেশের পরণের সাদা পাঞ্জাবী পাজামা বেশ ভেজা,দেখে বলে অনুপমা। ‘হ্যাঁ, এত জল ছেটালো সবাই ওইসময়, একদম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তো, তাই...’শিবেশ বলে ওঠে। ‘তুমি ঘরে যাও, মাথা মুছে জামা ছেড়ে নাও, আমি খাবার বাড়ছি, অনেক রাত হল’, তৎপর হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অনুপমা। তারপর হঠাৎ থমকে গিয়ে ফিরে আসে শিবেশের কাছে। শিবেশ ঘরের মাঝে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার স্মিত হাসি। তার দিকে তাকিয়ে সলাজ হাসে অনুপমা, শাড়ির আঁচলটা পিঠের উপর টেনে নিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সে। অভ্যেসমত মাথায় হাত রাখে শিবেশ, অনুপমা স্পর্শে অনুভব করে, সে বলে, ‘আজ সাতাশ বছর ধরে বিজয়ার পরে তোমাকে প্রণাম করে আসছি, এবারেরটা বাকি ছিল। এত দেরী করে ফিরলে না তুমি!’প্রত্যুত্তরে শিবেশ কিছু বলে না, মুখে তার শুধু লেগে থাকে প্রশান্ত হাসি। তার সামনে এবার হাত পাতে অনুপমা,’দাও’। ‘এবার তো পাইনি অনু, এবার সীতাভোগ আর কুচো নিমকি নিয়ে একটাও দোকান বসেনি ঘাটে, শুধু রজনীগন্ধা আর সাদা ফুলের দোকান’, শিবেশের গলা বেজে ওঠে। ‘এ আবার কেমন ব্যাপার! প্রতিবার এইদিন তুমি আমার জন্য নিয়ে আসো, তাছাড়া মিষ্টি ছাড়া বিজয়া হয় নাকি!’বিষ্ময় ফুটে ওঠে অনুপমার গলায়। ‘সত্যিই অনু, আর তাই কিছুই আনতে পারলাম না তোমার জন্য’, ব্যথিত শোনায় শিবেশের গলা। ‘ঠিক আছে, কি আর করা যাবে, দুটো নাড়ুই না হয় আনছি আমি, মিষ্টিমুখ করাই তোমাকে’,কথা বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অনুপমা। নাড়ু নিয়ে ঘরে এসে অনুপমা দেখে শিবেশ বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ আধবোজা। ‘কি গো, শুয়ে পড়লে যে?খাবে না?’ শিবেশের বুকের উপর ঝুঁকে পড়ে অনুপমা। ‘নাহ অনু, বড় ক্লান্ত লাগছে,আমি এবার ঘুমাই’, শিবেশ বলে ওঠে ঘুম জড়ানো গলায়। ‘বেশ, তুমি ঘুমাও, আমি বরং তোমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই’, খাটের পাশের টেবিলে নাড়ুর বাটিটা রেখে পা তুলে খাটে শিবেশের মাথার পাশে বসে অনুপমা। শিবেশের মাথায় হাত বুলায় সে পরম মমতায়। শিবেশের দুচোখ বোজা,অনুপমা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,’না বলে চলে গেছিলে কেন, না বলে চলে যেতে নেই’। ধীরে ধীরে কখন যে অনুপমারও চোখ বুজে আসে।

ট্রিং ট্রিং ট্রিং, ট্রিইইইইইইং, ধড়মড়িয়ে বিছানার উপর উঠে বসে অনুপমা, বাইরে ক্রমাগত বেজে যাওয়া কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার।‘মাসিমা, ও মাসিমা, কি গো’, বাইরে চিৎকার করছে সবিতা। ‘আ আসছি’, কোনরকমে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় অনুপমার। বিছানা থেকে নেমে আলুথালু অবস্থায় কোনরকমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে অনুপমা। সাথে সাথে শরতের রোদ ও সবিতার প্রশ্ন একসাথে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে। ‘কি গো তুমি, কতক্ষণ ধরে বেল দিচ্ছি! এরপর তো পাশের বাড়ির কাকুকে ডাকতে যেতাম আমি’। ‘তোর মেসো ছিল তো’, অনুপমা বলতে যায়। ‘কি’,সন্ধিহান চোখে তাকায় সবিতা। বাকি কথাটুকু গিলে ফেলে অনুপমা। ধীর পায়ে সবিতার পিছে পিছে নিজের ঘরে প্রবেশ করে অনুপমা। বিছানার দিকে তাকায়, শিবেশ নেই, তারপর রান্নাঘর, বাথরুম, আর বুবুনের ঘরেও ঘুরে আসে অনুপমা, কোথাও নেই শিবেশ। স্থাণুবৎ শোবার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনুপমা। শিবেশের জলের গ্লাস তেমনই ঢাকা দেওয়া, বালিশের পাশে রাখা বইটির পাতা তেমনই তিনশো বাষট্টি পৃষ্ঠায় মোড়া। টেবিলটায় অনুপমার দুচোখ নাড়ুর বাটিটা খোঁজে, নাহ,নেই! তবে কি শিবেশ সত্যি আসেনি? স্বপ্ন দেখেছে অনুপমা! এত জীবন্ত স্বপ্ন! ‘চা খাবে তো, বানিয়ে দিই?’, পিছনে সবিতা এসে দাঁড়ায়। হুম, সাড়া দেয় অনুপমা। ধীরপায়ে পুবের জানলায় এসে দাঁড়ায় সে, শিবেশ তাকে না বলে চলে গিয়েছিল। তাই তাঁর যাওয়া অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। মায়ের বিসর্জনের দিন এসে শিবেশ তাই অনুপমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলো। চায়ের কাপটা এনে টেবিলের উপর রেখে সবিতা এগিয়ে আসে অনুপমার দিকে।ঝুঁকে দুহাতে অনুপমার পদস্পর্শ করে সে। তারপর হাতে তুলে দেয় কুচো নিমকি আর সীতাভোগের প্লেট। ‘শুভ বিজয়া মাসিমা, তুমি খেতে ভালবাসো আমি জানি, প্রতিবার মেসো এনে দিতো’, সবিতা আর্দ্রস্বরে বলে ওঠে। সবিতার দুহাত ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে অনুপমা। সবিতা বাঁধা দেয় না,জমানো শোকের পাথরটা গলে যাওয়া দরকার।


 

এও কী সম্ভব?

শুভেন্দু নন্দী 


হালদার পাড়ার এই অপরিচ্ছন্ন ও এঁদো গলির মুখে একটা ছাপড়ার ঘর, টিন ও টালির ছাদ। ঐ ঘরটিতে চা-বিস্কুটের দোকান। সামনে বেঞ্চ পাতা। সামনে একটা বড়ো সড়ক। এখানে অর্ণব আসে মাঝে মাঝে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মজলিশী আড্ডা,হালকা গল্প গুজব আর ঘন্টার পর ঘন্টা  চায়ের পেয়ালায় তুফান। বেশ মনে পড়ে অর্ণবের। 

চাকরীতে তখনও প্রবেশ ঘটেনি তার। এ পাড়ার একদম শেষ মাথায় ভাড়া বাড়ি তাদের। আশেপাশে কিছু আধবুড়ো,  পুরনো ও প্রবীণ বসতবাড়ি। পায়রার খোপের মত কিছু ঘুমটি ঘর,পান-বিড়ির দোকান, লনড্রী, কুকুরের ঘেউ,ঘেউ একটানা চিল-চিৎকার  কাকেদের কোলাহল সকালবেলায়। এটাই ছিলো এ পাড়ার কৌলিন্য।কর্মজীবনের প্রায় দশটা বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত। একটা মার্কেনটাইল ফার্মের ম্যানেজার। অনেক টাকার ঋণ করে একটা বাড়িও করেছে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরে। মাকে ছোটবেলায় হারিয়েছে সে। দূর সম্পর্কের এক পিসি তাদের সংসারটাকে আগলিয়ে রেখেছেন। পিছন ফিরে তাকালো সে। পুরণো ভাড়া বাড়িতে একদিন ফিরে যাবার সময় বাড়ির গলিতে এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। একটা আর্ট স্কুল থেকে ফিরছিলেন।  বেশ সুদর্শন, শুভ্র বেশবাস,চোখে চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত, কাঁধে লম্বা ঝোলানো ব্যাগ। অর্ণবের সাথে আলাপও হয়েছিলো। নাম জেনেছিলা সুবীরেশ রায়। বাড়ির ঠিকানা, ফোন নং দিয়েছিলেন। ব্যস, শুধু এইটুকুই। তাঁর পরিবার, পেশা, সাংসারিক জীবন সম্বন্ধে তেমন কৌতুহলও ছিলোনা। কিন্তু তাঁর কথা সবসময় ভাবতো। এইসময় এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটতে থাকলো। কর্মস্থলে যাবার তাগিদে যখনই ট্রাম,বাস কিম্বা ট্রেন ধরবার জন্য ছোটাছুটি করতো- তখনই তাঁর আশেপাশে হোতো তাঁর অদ্ভূত রকমের আবির্ভাব। অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা কী কোনও অসুখ, না কী হ্যালুসিনেশন! ফাইল থেকে তাঁর দেওয়া ঠিকানায় মনোনিবেশ করলো। 

নাঃ- কাল রবিবার। যেতেই হবে ওখানে। খোঁজখবর নিতে হবে তাঁর। ....মনে মনে ভাবলো অর্ণব। রাতে আবার স্বপ্নে তাঁর আবির্ভাব। আলুথালু বেশ, চোখমুখ শুকনো। অনেক খুঁজে তাঁর বসতবাড়ির খোঁজ পেলো। বালিগঞ্জে ।

দরজায় কড়া নাড়তেই একজন বেড়িয়ে আসলো। অর্ণব অনুমান করলো - সুবীরেশবাবুর বউ। 
- আসুন । আপনিই বোধ হয় অর্ণববাবু? আপনার কথা উনি প্রায়ই বলতেন। 
ঘরে ঢুকে একটা ফ্রেমে বাঁধানো সুবীরেশের ফটো দেখলে অর্ণব। গলায় শুকনো ফুলের মালা। ঘরে স্তুপাকারে ছড়িয়ে আছে অজস্র ছবি।
- এত ভালো ছবি আঁকতেন তিনি! তার মন ডুকরে উঠলো।
- ছবি আঁকাই ছিলো তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান- বউ কাঁদো কাঁদো মুখে নিম্নস্বরে বলতে লাগলো।
- কিছুদিন আগেই চলে গেলেন তিনি।
- কি হয়েছিলো? অর্ণবের প্রশ্ন। 
- ইদানিং তিনি প্রায়ই ব্যস্ত থাকতেন। একাডেমীতে তাঁর ফটোর যথেষ্ট কদর ছিলো। ফটো-প্রিয়রা
তাঁর আঁকা ফটোই কিনতেন। তারপর প্রতিযোগিতার বাজার চলে এলো। এটাই তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো। সংসারকে তিনি ভালোবাসতেন খুব। উপার্জন কিন্তু মন্দ হোতোনা। তবুও অকারণে তাঁর এই চিন্তা। একদিন বাড়ি ফেরার সময়ে লোডশেডিং-এর কারণে একটা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে সজোরে আঘাত,  হাসপাতাল,চিকিৎসা,প্রচুর অর্থব্যয় - সবই গেলো বিফলে। খুব সঞ্চয়ী ছিলেন তিনি। আমাদের একটা জয়েন্ট একাউন্ট আছে। মাসখানেক চলবে তাতে। তারপর......ভাবতেও পারছিনা। এই আমাদের একমাত্র সন্তান।  টিউশনি পড়িয়ে এলো। সামনে মাধ্যমিক। 
- দেখি তোমার পাশবুক, বৌদি।
ডাইরীতে নোট করে নিলো সব অর্ণব। ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হোলো অর্ণব।

পরদিন অর্ণব এক লাখ টাকা ট্রান্সফার করলো ঐ একাউন্টে। মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করলো কিছুটা। হঠাৎ তার স্বপ্নের কথা মনে হোলো। সুবীরেশবাবু এটাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, " আমি তো চলে গেলাম, আমার সংসারটাকে একটু  দেখে রেখো, অর্ণব"


 


ভ্রমণ 


টিনটিনের দেশে এসে 

রণিতা দত্ত

সত্যি ই কি বড্ডো সাদামাটা ছিল আমাদের শৈশব, কৈশোর ? যারা ভাবেন তেমনটা, তারা ভীষণ ভুল ভাবেন। তখন হয়তো মস্ত এল সি ডির স্ক্রিনে বা মোবাইলফোনের ইন্টারনেটে এখন যা কিছু আছে তার বালাই ছিলনা। অথবা তখন যা ছিল, এখন অতিপাতি খুঁজেও তার হদিশ খুঁজে পাবেন না ।রিক্রিয়েষণ কি আমাদের ছিলনা? ছিল। বিনোদন বলতে ছিল সবুজ ঘাসে মোড়া খেলার মাঠে হুটোপুটি, সাদাকালো আখরে গল্পের বই। বরাদ্দ মাসিক কিছু পত্রিকা। শুকতারা, কিশোর ভারতী, আনন্দমেলা। বিশেষ পরিচিত জন কাকাবাবু সন্তু, প্রফেসর শঙ্কু, রুকু সুকু । মিথ্যে বলি কি করে ? সব থাকলেও আনন্দমেলার ঝলমলে কুড়ির পাতাটি মনকে সবচাইতে বেশি টানতো । দু'পাতা মাত্র। সে'জন্য সারা মাস অধীর আগ্রহের অপেক্ষা। রঙিন মন ছোঁয়া কমিকস স্ট্রিপে থাকতো টিনটিন।






ছোট্টখাটো চেহারার ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিস্ট এই টিনটিন। ফরাসীরা উচ্চারণ করে ত্যাঁত্যাঁ| দেশ তার বেলজিয়াম বটে কিন্তু 'বোম্বেটে জাহাজ'এ চেপে 'লোহিত সাগরে হাঙ্গর' ধরতে ধরতে 'কৃষ্ণদ্বীপে' পৌঁছে যান রহস্য ভেদ করতে। কখনো বা 'মমির অভিশাপ' ভ্রষ্ট হয়ে 'সূর্য্যদেবের বন্দী' হয়ে যান। 'ওটোকারের রাজদন্ড' হাতে নিয়ে 'ফ্যারাও এর চুরুট' ফুঁকতে ফুঁকতে 'সোভিয়েত দেশে' গিয়ে পৌঁছান। হয়তো 'কালো সোনার দেশে' যাওয়ার পথে 'কঙ্গো' আর 'তিব্বত'ও ঘুরে নেন। মহাকাশের 'উল্কা' ছুঁয়ে 'চন্দ্রলোকে' পাড়ি জমান টিনটিন । কিশোরী মন। কমিকস এডভেঞ্চারে বুদ। দুপাতায় সন্তুষ্টি। ওদিকে অজানা ছিল তথ্য যে আমাদের"আনন্দ মেলা'র তৎকালীন সম্পাদক কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী ই কিন্তু বাংলায় এই কমিকসের অনুবাদক। অনেকটা বড় হয়ে যখন জানলাম, তখন টিনটিন এডভেঞ্চারের এক একটা আস্ত বই ই পাওয়া যায়। আমাদের মত বাপ্ মা বই মেলায় উচ্ছসিত হয়ে কিনে দেন পরবর্তী প্রজন্মকে। আমরা পিছিয়ে যাই। প্রজন্ম এগোয়। বই চিৎপাত হয়ে কোথায় উল্টে পড়ে থাকে। চোখ তাদের আটকে থাকে টিভির কার্টুন শো তে। এখানে এসে এও জানলাম বাইকেলের মত হার্জের টিনটিন ও বহু ভাষায় অনুদিত বই । 







যুগ বিশ্বয়নের। ব্যক্তির স্থানিক অবস্থানটা খুব আপেক্ষিক। অতিসামান্য প্রয়োজন সাপেক্ষ্যে বদলে যায়। আমিই বা কিকরে এসে পৌছালাম বেলজিয়ামে। ব্রেসেলস । অদ্ভুত এক শহর। ফ্রান্স নেদারল্যান্ড আর জার্মানির ফোঁকোরে এমনি ভাবে ঢুকে আছে যে ডাচদের প্রভাব কোথাও রমরমে, কোথাও ফরাসিদের হম্বিতম্বী। জার্মানির সীমান্ত অল্প বলে ওরা খানিকটা নির্বিকার থাকে । টিনটিনের বাড়ির মার্লিন স্পাইক হলের ঠিকানাটা ভোলার নয় , 26, ল্যাব্রাডর রোড। তবে ব্রেসেলসের কোন কমিউনে এই রাস্তার অস্তিত্ব নেই মোটে। এদিকে আমার জামাতাটিও বেশ কার্টুন পাগল। ওর কাছেi জানলাম একটি গোটা মিউজিয়ামই নাকি আছে হার্জের কার্টুন ওয়ার্কের। সে খানিক দূরে এক ছোট্ট ছিমছাম শহরে ।একদিন সময় থাকতে লুভ্যেইঁ লা-নিউভ ( louvain-la-neuve) শহরের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। ওখানে ই সেই 'আর জে' র সারাজীবনে আঁকা কার্টুন সযত্নে রাখা আছে। রাস্তার দুপাশে রঙ বেরঙের পাতার খেলা। বিচিত্র বর্ণে সেজে রয়েছে সারিবদ্ধ পর্ণমচি। অপেক্ষা রিক্ত শূন্যপত্র হয়ে শীতের ৱ্যাপার মুরি দেওয়ার। শুনলুম ডাচদের ছিল এই লুভ্যেইঁ শহর। ফরাসীরা জমিয়ে বসে নামের আগে জুড়ে দিলে 'লা নিউভ' অর্থাৎ নতুন লুভ্যেইঁ। মিউজিয়াম বিল্ডিংটি নিজেই নিজের মত সুন্দর । ইতিউতি বিচ্ছিন্ন কিছু ম্যাপেল বন সামনে। আর জে যাকে জর্জ রেমি বলে ঠিক কেউই চিনবেন না, মানে আমাদের হার্জের একটি মূর্তি সেখানে। নিবিষ্ট মনে বসে স্কেচ করছেন। এক পাশে টিনটিন সঙ্গে কুট্টুস। মিউজিয়ামে প্রবেশ পথে বিশাল কাঁচের দরজা। সসম্ভমে নিজে থেকে খুলে গেল। যেন অতিথি অভিবাদন করে অভ্যার্থনা জানাচ্ছে। টিকিট কাউন্ডারের সামনে ই রাখা নানা এডভেঞ্চারের সাক্ষ্যি সবুজ জিপ গাড়িটা । মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্য মাত্র ২ ইউরো । সঙ্গে দিচ্ছে একটা করে অডিও ভিজ্যুয়াল ডিভাইজ। ল্যাঙ্গুয়েজ সেট করে নাও। তারপর শোনো,দেখ,ঋদ্ধ হও। ঋদ্ধ হওয়ার কথা কেন বললুম সে যখন মিউজিয়াম ছেড়ে ঘরমুখো হবো তখন আপনারাই বলবেন । মিউজিয়ামটি তিনতলা। টপফ্লোর থেকে প্রদর্শনী শুরু। টিনটিন যেন আর কেউ নন, স্রষ্টার নিজস্ব চরিত্রের চিত্রায়ন।প্রথম ঘরে ঢুকে ই হার্জে রেমির হাস্যজ্জ্বল একটি মুখ, যা ক্রমে মিলিয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠলো পেন্সিলের আঁকিবুকি। টিনটিনের স্কেচ। ওই ঘরের চতুর্দিকের দেওয়ালে আলোছায়ায় ছোটছোট বৃত্ত। বৃত্তে চলমান ছবি। একএক করে ছবি জীবন্ত হচ্ছে আবার মুহূর্তে পরিবর্তীত হচ্ছে। কখনো টিনটিন, কখনো ক্যাপ্টেন হ্যাডক, কুট্টুস তো আছেই তার পছন্দের হাড়ের টুকরোটি নিয়ে। আছেন আরও সব সঙ্গোপাঙ্গরা। সে এক বিচিত্র ঘোর লেগে থাকা মায়াময় পরিবেশ। এরপর থেকে যে ঘরে ই গেলাম সেখানে কাগজে আঁকা কমিকসের অরিজিনাল স্কেচ। কাঁচের শোকেসে কমিকসের গল্পানুক্রমে সযত্নে সংরক্ষিত। আমার গলায় ঝোলানো ডিভাইজে যে বিবরণী চলছে সে একই তথ্যচিত্র প্রতিটি ঘরের একটি দেওয়ালের স্ক্রিনে ও চলছে। প্রতিটি এডভেঞ্চার, তাদের প্রেক্ষাপট,সমসাময়িক থিম, আলোচনা সমালোচনা। এবারে দোতালায় এলাম। ওখানে ঘরের দেওয়ালে এক একটি চরিত্র ভিন্ন ভঙ্গিতে আঁকা। এই যেমন পাইপ ঠোঁটে টিনটিনের অভিন্ন হৃদয় নাবিক বন্ধুটি যিনি সিঙ্গেলমল্ট স্কচের প্যাশানেট সেই ক্যাপ্টেন হ্যাডক আছেন, আছেন গোলফ্রেমের চশমা নাকে ডগায় গুঁজে বেটেখাটো, কানেও বেশ খাটো, অথচ অংকে দর প্রফেসর ক্যালকুলাস।, মাথায় রাউন্ড ব্ল্যাক ক্যাপ, হাতে ব্যাঁকানো লাঠি এক্কেবারে অপদার্থ জোড়া গোয়েন্দা জনসন রনসনস গল্পে হাসির খোরাক জোগানো কাজ তাদের, আর ওই যে টিয়া পাখির ঠোঁটের মত নাক,কোকিল কন্ঠী মিলানের বিখ্যাত গায়িকা বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওকা বা আর ক্যাপ্টেন হ্যাডকের বাড়ির হাউজহোস্টেজ নেস্টর কিংবা জেনারেল আলেকজেন্ডার এদের মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমার সারিবদ্ধ স্কেচ। যদিও এরা এডভেঞ্চার কাহিনীর সহায়ক চরিত্র তবু কি তারা পাঠকের চেনা নন ? হার্জের তৈরী সহায়ক চরিত্ররা অবশ্যই মূলচরিত্র থেকে পরিচিতিতে জনপ্রিয়তায় খুব একটা খাটো নন। এডভেঞ্চার কাহিনী রূপায়নে চারিত্রায়ন এতো সাবলীল, প্রাঞ্জল যে প্রত্যেকের উপস্থিতি যেন কাহিনীটিকে নির্ভরযোগ্য ভাবে সঞ্চালনার জন্য অপরিহার্য। মনে গেঁথে ছিল সকলের কথা।হার্জে এই কমিক স্ট্রিপ সিরিজটি আঁকতে লিন ক্লেয়ার (ligne claire) নামের শৈলী ব্যবহার করেছিলেন বলে জানলাম।




এতকাল বিনোদন হিসেবে কমিকস পড়েছি। তবে সেখানে ও পেন্সিল স্কেচের ব্যাকগ্রাউন্ডে আপাত স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতির মত মূল উপাদান যেগুলোকে এড়িয়ে গেলে কোন শিল্পকর্ম ই কালোজয়ী হতে পারেনা। প্রকাশিত হলো হার্জের প্রথম কার্টুন কাহিনী "সোভিয়েত দেশে টিনটিন'।বলশেভিক বিপ্লবের যুগ ।পশ্চিমা বিশ্ব 'লাল আতঙ্কে' তটস্থ। কখন বা বিপ্লব ঘটে। খেটেখাওয়া মানুষের দখলে যায় ক্ষমতা ! ।হার্জে কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সমাজ তন্ত্রের নামে ভণ্ডামি তুলে ধরলেন।কার্টুন গল্পে দেখানো হলো মস্কোর রাস্তায় প্রকাশ্যে যারা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট বলে স্বীকার করছে শুধু তাদেরকেই সরকারি ত্রাণ দেওয়া ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নইলে লাইন থেকে লাথি মেরে বের করে দেওয়া হচ্ছে। লিখলেন,"তুমি এমন আস্তানায় এসেছ যেখানে লেনিন, ট্রটিস্ স্তালিন সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বহু সম্পদ জমিয়ে রেখেছে।” হার্জে টিনটিনের মুখ দিয়ে কতটা শক্ত থাকলে এই সংলাপ তিনি লিখতে পারেন। কার্টুন কাহিনীতে আসন্ন যুদ্ধের বারুদের গন্ধ। জার্মানরা বেলজিয়াম দখল করেছে।যুদ্ধের আবহে লেখা হলো "কাঁকড়া রহস্য "দ্য ক্র্যাব উইথ গোল্ডেন ক্লোস"। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ব্যঙ্গ আঁকাঝোঁকায় রূপ নিল কার্টুনে 'ওটোকারের রাজদণ্ড " কাহিনীতে। ক্রমে কলম পেন্সিল স্বাধীনতা হারালো। হার্জ যে সংবাদপত্রে কাজ করতেন, সেটি নাৎসি নিয়ন্ত্রিত । এই সময়ে টিনটিনের গল্পে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন হার্জ । কমিকস থেকে রাজনৈতিক উপাদান ছেটে ফেলেন।বেশি মনোযোগ দেন চরিত্রায়ণ, কাহিনী এসব দিকে । তবে "কঙ্গোর জঙ্গলে "কাহিনীতে বর্ণবৈষম্য সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রকাশ পাওয়ায় হার্জকে সমালোচনার মুখোমুখি করে। চোরাচলানকারীর পিছু ধাওয়া করে টিনটিন এল মিশরে। কাহিনী "ফ্যারাও এর সিগারেট"। সেখান থেকে টিনটিন এল ভারতে। এরপর এল চীনের সাংহাই শহরে।কাহিনী 'ব্লু লোটাস'। চীনে জাপানি দখলদাররা কিভাবে পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে চীনের জনগণের ওপর এ সত্য তুলে ধরে হার্জের কাহিনী হয়ে উঠলো চীনের এক অন্ধকার সময়ের দলিল।এভাবেই আলোচকদের বিশ্লেষণ চলছিল, সংশ্লিষ্ট তথ্য ও কিছু সমকালীন ছবি উপস্থাপনা চলছিল। যদিও একসাথে চোখে দেখা, কানে শোনা, দ্রুত ইংরেজি অনুধাবন কাজগুলো বেশ হেকট্রিক লাগছিলো। একটা গোটা দিন হয়তো প্রয়োজন ছিল ছোট্ট একরত্তি এই মিউজিয়ামটি বুঝে উঠতে। জানা ছিল না এমনি ভাবে কমিকস কাহিনীর প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনার চুলচেরা পর্যালোচনা হয়।কিভাবে 





  বিকেল ৫:৩০, অ্যালার্ম বেজেছে। এবারে মিউজিয়াম বন্ধ হবে। সুভিনির শপ থেকে দুটো পোস্টকার্ড নিয়েছি। এখন আন্তর্জালের যুগ। যদিও এমনি খেয়ালগুলো মানুষের কমেছে তবে  বিলুপ্ত হয়ে তো যায়নি। মিউজিয়াম দেখে ভালো লাগলো এতো কি আর বলবো। সম্পূর্ণ অন্য স্টাইলে প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ সমালোচনা আর ঘন্টা সাড়ে চার পেরিয়েছে কখন খেয়াল করিনি। শুকনো পাতার গালিচায় পা রেখে এগোচ্ছি। মর্মর শব্দ শুনছি। যখন এসেছি তখনও পাতার মর্মর শব্দ নিশ্চই হয়েছে কিন্তু আলাদা করে কানে তো আসেনি অবচেতন আর সচেতন দুই অবস্থার মাঝে ফারাক এই এতটুকু ই মাত্র।