বিজয়ার পরে 
অম্বালিকা ঘোষ
জানলার পাশ থেকে সাবধানে বাহারি গাছের পটগুলো সরিয়ে এনে জানলার পাল্লা বন্ধ করে দেয় অনুপমা, বিকেল সাড়ে চারটা, পাঁচটা বাজতে না বাজতেই কেমন দিনের আলো যাই যাই করে ওঠে এখন। আশ্বিনের প্রায় মাঝামাঝি, বেশ একটা হিমেল ভাব বাতাসে ভোর ও সন্ধ্যায়। অনতিদূরে ঢাক বাজছে,রব উঠছে, ’আবার কবে, বছর পরে’। আজ তাহলে বিজয়াদশমী। সাম্প্রতিককালে যে ঝড় বয়ে গেছে অনুপমার জীবনে, তার আবহে কোনদিক দিয়ে যে পুজোও চলে গেলো, বোঝেনি অনুপমা। অথচ পুজো মানেই অনুপমার কাছে ছিল নীল আকাশ, কাশের গুচ্ছ, শিউলির সুবাস, অষ্টমীর অঞ্জলি ও ঢাকের বাদ্যি। বন্ধ দরজার ওপারে এবার সন্তর্পর্ণে পুজো এলো, চলেও গেলো। মনের দরজা জানালাগুলি বন্ধ হয়ে গেলে বুঝি এরকম নির্লিপ্ত হয়ে সবই উপেক্ষা করে থাকা যায়! সজল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অনুপমার বুকের গভীর গুমোট প্রকোষ্ঠ থেকে। ভিতরটা কেমন যেন শূন্য মনে হয় অনুপমার, বেশি কিছু ভেবে উঠতে পারে না। হালকা বাঁশির শব্দে সম্বিৎ ফেরে অনুপমার, মুঠোফোনের ওপার থেকে বুবুন মানে তার ছেলে ডাকছে। ফোনটা তুলে কানে চেপে ধরে অনুপমা,’বল’। ‘কি করছো? চা খেয়েছো?’ ওপার থেকে বুবুনের গলা ভেসে আসে। বুবুন, মানে অরিত্র, অনুপমা আর শিবেশের একমাত্র ছেলে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বেঙ্গালুরুতে বর্তমানে কর্মরত। এখন প্রতিদিন সকালে ও বিকেলের দিকে এসময় প্রায় নিয়ম করেই মাকে ফোন করে বুবুন, আবার রাতে একবার ঘুমাতে যাবার আগে। নতুন চাকরী, একবছরও হয়নি,তাই বাবা চলে যাবার পর বেশিদিন বাড়িতে থাকতে পারেনি বুবুন। সেই অপরাধবোধে ভোগে সে, অনুপমা বোঝে। ছেলের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলে ফোন রাখার পর অনুপমা বসার ঘর থেকে ভিতরের ঘরে আসে। ভাল করে ঘরের চারদিকে নজর বোলায় সে, নিপাট পরিপাটি করে সাজানো এই শয্যাকক্ষ, কোথাও কোনকিছু অবিন্যস্ত হয়ে নেই। কোনকিছু অগোছালো হয়ে পড়ে নেই, ঠিক যেখানে যেমন থাকা দরকার, সেখানে তেমন ভাবেই সবকিছু যেন রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে বা পড়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে শোবার খাটের পাশে রাখা আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনুপমা, চাবি গলিয়ে হাতল মুচড়ে আলমারীর একটা পাল্লা খোলে অনুপমা। শিবেশের শার্টপ্যান্ট সব ঝোলানো রয়েছে একদিকে। পাটপাট করে, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় সব ঝুলে রয়েছে ব্যবহৃত হবার অপেক্ষায়, কিন্তু ব্যবহারকর্তাই অনুপস্থিত। হ্যাঙ্গার থেকে শিবেশের একটা জামা খুলে নিয়ে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে অনুপমা, শিবেশের গন্ধ পায় সে কাচা জামা থেকেও। প্রতিটা মানুষের উপস্থিতির, তার অভ্যাসের একটা নির্দিষ্ট সুবাস থাকে বুঝি। তার বহুল ব্যবহৃত জিনিসে সেই সুবাসটুকু থেকে যায় তার চলে যাবার পরও। শিবেশের চলে যাবার পর সেটা আবিস্কার করেছে অনুপমা। এই বাড়ির প্রায় সবকিছুতে, বিশেষ করে  শোবার ঘরের প্রতিটা জিনিসে শিবেশের শরীরের ঘ্রাণ পায় অনুপমা। তার ব্যবহারের ঘ্রাণ পায় বলা ভাল। শেষদিনও শিবেশ যে বইটা পড়ছিল, সেই বইটা হাতে নিয়ে বহুক্ষণ বিছানার উপর বসে থাকে অনুপমা, পাতা মোড়া রয়েছে তিনশো বাষট্টি পৃষ্ঠায়, পাঠক যদিও আর এসে বাকিটা পড়বে না। অনুপমা ভাবে, আচ্ছা, শিবেশ কি বুঝতে পারেনি, ওই পৃষ্ঠার পর তার আর কোনদিনও বইটি পড়া হবে না!নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি, জানলে সে পাতা মুড়িয়ে রাখত না। বেডসাইড টেবিলে জলের গ্লাসে এখনো অর্ধেক জল রাখা, যার বাকিটা শিবেশ খেয়ে শুয়েছিল শেষ রাতে, সে চলে যাবে জানলে কি বাকি জলসহ গ্লাসটা প্লেট দিয়ে অমন করে ঢেকে রাখত শিবেশ! নিশ্চয়ই না,অনুপমা ভাবে। শিবেশের চশমা, বই, তামার জলের গ্লাস, ওষুধের বাক্স সব যেমন রাখা হত, যখন ব্যবহার হত, ঠিক তেমনই রাখা আছে এখনো, আজ সতেরোদিন হল সেগুলি ব্যবহার হয়নি।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে একদিন শেষরাতে নির্মম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় শিবেশের,বাথরুম থেকে বেরিয়ে সেই যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শিবেশ, আর উঠতে পারেনি। পাশের বাড়ির লোকের সহায়তায় দ্রুতই নিকটবর্তী নার্সিং হোমে নিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। খবর পেয়ে পরদিন দুপুরের মধ্যেই ছুটে আসে বুবুন, তারপর সবকিছুই যেন একটা যান্ত্রিক নিয়মে হয়ে চলে, অনুপমা বুঝে উঠতে পারেনা কিভাবে কি হয়ে গেল! হার্টের সমস্যা কিছু ছিল শিবেশের, কিন্তু সে নিয়মিত চেক আপের মধ্যেই থাকত এবং নিয়মমাফিক জীবনযাপনই করত, তাও তার এভাবে চলে যাওয়া অনুপমা মেনে নিতে পারেনি। যে মানুষটার সাথে সাতাশ বছর একছাদের নীচে বসবাস করেছে, সংসার সাজিয়েছে, সে এরকম নিঃশব্দে চলে যাবে, অনুপমার বিশ্বাস হয়না।  তার সবসময়ই মনে হয় শিবেশ কোন কাজে বাইরে গেছে, আবার ফিরে আসবে। বুবুন তার মাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বেঙ্গালুরুতে, কিন্তু যায়নি অনুপমা। এই বাড়ি, এত বছরের সংসার ফেলে যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না।  বুবুন বুঝেছিল,মায়ের আবেগকে সম্মান দিয়ে সেও আর জোর করেনি। সকাল বিকেল মায়ের খোঁজ নেয় সে ফোনে। দুশ্চিন্তা হয় তারও মায়ের জন্য। ভরসা করতে হয় বহুদিনের পুরোনো কাজের সহায়িকা সবিতা মাসির উপর। আগে সারাদিন কাজকর্ম করে চলে গেলেও বাবা চলে যাবার পর থেকে রাতে এসে মায়ের সাথে থাকে সে। বুবুনই ঠিক করে গেছে, সে জানে মায়ের একা থাকার অভ্যেস নেই।
বেল বাজতেই অনুপমা গিয়ে দরজা খুলে দেয়, বারান্দাটা অন্ধকার হয়ে আছে। প্রতিদিন সবিতা যাবার সময় আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।সবিতা রোজ রাতে এসে শোয়, কিন্তু আজ তার ছেলের জন্মদিন, তাই আজ রাতের ডিউটি থেকে অব্যাহতি চেয়েছে। বুবুন চিন্তা করছিল, অনুপমা অভয় দিয়েছে, একটা রাত একা থাকলে তোর মা মরে যাবে না, দিব্যি থেকে যাবে। সবিতা আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ওবেলায় চলে গেছে, তাই বারান্দার আলোটাও আর জ্বালানো হয়নি। স্ট্রিটলাইটের স্বল্প আলোতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতেই অনুপমা বুঝতে পারে, শিবেশ দাঁড়িয়ে আছে। ‘তুমি, এত দেরী করে এলে?’দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় অনুপমা। ‘আর বলো না, এবার বিসর্জন অনেক দেরী করে হল’, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল শিবেশ। ‘একি, একদম ভিজে গেছো যে!’,শিবেশের পরণের সাদা পাঞ্জাবী পাজামা বেশ ভেজা,দেখে বলে অনুপমা। ‘হ্যাঁ, এত জল ছেটালো সবাই ওইসময়, একদম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তো, তাই...’শিবেশ বলে ওঠে। ‘তুমি ঘরে যাও, মাথা মুছে জামা ছেড়ে নাও, আমি খাবার বাড়ছি, অনেক রাত হল’, তৎপর হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অনুপমা। তারপর হঠাৎ থমকে গিয়ে ফিরে আসে শিবেশের কাছে। শিবেশ ঘরের মাঝে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার স্মিত হাসি। তার দিকে তাকিয়ে সলাজ হাসে অনুপমা, শাড়ির আঁচলটা পিঠের উপর টেনে নিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সে। অভ্যেসমত মাথায় হাত রাখে শিবেশ, অনুপমা স্পর্শে অনুভব করে, সে বলে, ‘আজ সাতাশ বছর ধরে বিজয়ার পরে তোমাকে প্রণাম করে আসছি, এবারেরটা বাকি ছিল। এত দেরী করে ফিরলে না তুমি!’প্রত্যুত্তরে শিবেশ কিছু বলে না, মুখে তার শুধু লেগে থাকে প্রশান্ত হাসি। তার সামনে এবার হাত পাতে অনুপমা,’দাও’। ‘এবার তো পাইনি অনু, এবার সীতাভোগ আর কুচো নিমকি নিয়ে একটাও দোকান বসেনি ঘাটে, শুধু রজনীগন্ধা আর সাদা ফুলের দোকান’, শিবেশের গলা বেজে ওঠে। ‘এ আবার কেমন ব্যাপার! প্রতিবার এইদিন তুমি আমার জন্য নিয়ে আসো, তাছাড়া মিষ্টি ছাড়া বিজয়া হয় নাকি!’বিষ্ময় ফুটে ওঠে অনুপমার গলায়। ‘সত্যিই অনু, আর তাই কিছুই আনতে পারলাম না তোমার জন্য’, ব্যথিত শোনায় শিবেশের গলা। ‘ঠিক আছে, কি আর করা যাবে, দুটো নাড়ুই না হয় আনছি আমি, মিষ্টিমুখ করাই তোমাকে’,কথা বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অনুপমা। নাড়ু নিয়ে ঘরে এসে অনুপমা দেখে শিবেশ বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ আধবোজা। ‘কি গো, শুয়ে পড়লে যে?খাবে না?’ শিবেশের বুকের উপর ঝুঁকে পড়ে অনুপমা। ‘নাহ অনু, বড় ক্লান্ত লাগছে,আমি এবার ঘুমাই’, শিবেশ বলে ওঠে ঘুম জড়ানো গলায়। ‘বেশ, তুমি ঘুমাও, আমি বরং তোমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই’, খাটের পাশের টেবিলে নাড়ুর বাটিটা রেখে পা তুলে খাটে শিবেশের মাথার পাশে বসে অনুপমা। শিবেশের মাথায় হাত বুলায় সে পরম মমতায়। শিবেশের দুচোখ বোজা,অনুপমা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,’না বলে চলে গেছিলে কেন, না বলে চলে যেতে নেই’। ধীরে ধীরে কখন যে অনুপমারও চোখ বুজে আসে।
ট্রিং ট্রিং ট্রিং, ট্রিইইইইইইং, ধড়মড়িয়ে বিছানার উপর উঠে বসে অনুপমা, বাইরে ক্রমাগত বেজে যাওয়া কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার।‘মাসিমা, ও মাসিমা, কি গো’, বাইরে চিৎকার করছে সবিতা। ‘আ আসছি’, কোনরকমে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় অনুপমার। বিছানা থেকে নেমে আলুথালু অবস্থায় কোনরকমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে অনুপমা। সাথে সাথে শরতের রোদ ও সবিতার প্রশ্ন একসাথে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে। ‘কি গো তুমি, কতক্ষণ ধরে বেল দিচ্ছি! এরপর তো পাশের বাড়ির কাকুকে ডাকতে যেতাম আমি’। ‘তোর মেসো ছিল তো’, অনুপমা বলতে যায়। ‘কি’,সন্ধিহান চোখে তাকায় সবিতা। বাকি কথাটুকু গিলে ফেলে অনুপমা। ধীর পায়ে সবিতার পিছে পিছে নিজের ঘরে প্রবেশ করে অনুপমা। বিছানার দিকে তাকায়, শিবেশ নেই, তারপর রান্নাঘর, বাথরুম, আর বুবুনের ঘরেও ঘুরে আসে অনুপমা, কোথাও নেই শিবেশ। স্থাণুবৎ শোবার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনুপমা। শিবেশের জলের গ্লাস তেমনই ঢাকা দেওয়া, বালিশের পাশে রাখা বইটির পাতা তেমনই তিনশো বাষট্টি পৃষ্ঠায় মোড়া। টেবিলটায় অনুপমার দুচোখ নাড়ুর বাটিটা খোঁজে, নাহ,নেই! তবে কি শিবেশ সত্যি আসেনি? স্বপ্ন দেখেছে অনুপমা! এত জীবন্ত স্বপ্ন! ‘চা খাবে তো, বানিয়ে দিই?’, পিছনে সবিতা এসে দাঁড়ায়। হুম, সাড়া দেয় অনুপমা। ধীরপায়ে পুবের জানলায় এসে দাঁড়ায় সে, শিবেশ তাকে না বলে চলে গিয়েছিল। তাই তাঁর যাওয়া অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। মায়ের বিসর্জনের দিন এসে শিবেশ তাই অনুপমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলো। চায়ের কাপটা এনে টেবিলের উপর রেখে সবিতা এগিয়ে আসে অনুপমার দিকে।ঝুঁকে দুহাতে অনুপমার পদস্পর্শ করে সে। তারপর হাতে তুলে দেয় কুচো নিমকি আর সীতাভোগের প্লেট। ‘শুভ বিজয়া মাসিমা, তুমি খেতে ভালবাসো আমি জানি, প্রতিবার মেসো এনে দিতো’, সবিতা আর্দ্রস্বরে বলে ওঠে। সবিতার দুহাত ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে অনুপমা। সবিতা বাঁধা দেয় না,জমানো শোকের পাথরটা গলে যাওয়া দরকার।