ইতিহাসের আলোকে গঙ্গারামপুর
গৌতমেন্দু নন্দী
"গঙ্গারামপুর" ----এই নামের সাথে সাধারণ জনমানসে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি শব্দ হলো "দই"-----"গঙ্গারামপুরের দই"। স্বাদে, গন্ধে, মিষ্টত্বে এই উত্তরবঙ্গে যার জুড়ি মেলা ভার। শুধু তাই নয়, তাঁত শিল্প এবং নৌ-শিল্পেও এই মহকুমা শহরের নাম এই রাজ্যে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু চোখ নিয়ে এই শহর এবং তার আশপাশের এলাকাকে খুব বেশি জন দেখেননি।
     দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার জেলা শহর বালুরঘাট  থেকে ৪৫ কিমি দূরে পুনর্ভবা নদীর পাড়ে অবস্থিত মহকুমা শহর গঙ্গারামপুরকে ঘিরে আছে এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সন্ধানে আজও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎসাহী ব্যক্তিরা ছুটে আসেন। সেই আকর্ষণেই আমিও গিয়েছিলাম এবার। এই জনপদে যাকে ঘিরে রয়েছে বাণগড়, ধলদীঘি  কালদীঘি, তপন এর মতো ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ স্থান।
       গঙ্গারামপুর নামকরণের নেপথ্যেও রয়েছে  এক সুন্দর পৌরাণিক কাহিনী------- 
 রামচন্দ্র একদিন গঙ্গা কে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই অঞ্চলে অদূরে বাণগড়ে( তখন নাম ছিল কোটিবর্ষ) এসে পৌঁছলে তিনি এক সুন্দরী বালিকার নৃত্য প্রদর্শন দেখে মুগ্ধ হন। সেই বালিকাটি রামচন্দ্রের চরণ দুটি স্পর্শ করলে রামচন্দ্র তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ ক'রে বালিকার নাম  রাখেন "পুনর্ভবা"। রামচন্দ্রের সঙ্গী গঙ্গা তাঁর জলধারা উপহার দেন পুনর্ভবা কে। সেই স্মৃতি, পুণ্যতোয়া গঙ্গা আর রামচন্দ্রের স্মৃতি কে ধরে রাখতে গঙ্গা এবং রামের নাম একত্রিত করে স্থানটির নাম হয় গঙ্গারামপুর-----এসবই পৌরাণিক কাহিনি। এরকমই  আরও নানা কাহিনী এই জনপদকে ঘিরে। 
         বর্তমানে এক লক্ষের অধিক জনসংখ্যার জমজমাট শহর গঙ্গারামপুরের প্রাণকেন্দ্র "ঘড়ি মোড়" থেকে প্রায় এক-দেড় কিমি উত্তরে ইতিহাসের গন্ধ নিয়ে,  ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন ক'রে ভগ্নাবশেষের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে আজও পড়ে আছে বাণগড়ের  বিখ্যাত প্রত্ন কীর্তি।
        দিনাজপুর জেলার প্রত্ন কীর্তির জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলটি অতীতে পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বলা হয় পুন্ড্রবর্ধন উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল। পঞ্চম শতক থেকে পাল-- সাম্রাজ্যের শেষ শাসনকাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচশত  বছর পুন্ড্রবর্ধনের গৌরব ও মর্যাদা অটুট ছিল।
      বাণগড়ের পূর্ব নাম কোটিবর্ষ, পুনর্ভবা নদীর  পূর্ব পাড়ে গঙ্গারামপুর শহরের এক কিমি উত্তরে 
বর্তমানে রাজীবপুর মৌজায় অবস্থিত। বাণগড়ের নামকরণ নিয়েও একাধিক কাহিনীর অন্যতম হোল----পুরাকালে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা  ছিলেন বলি রাজা। কথিত যে,বলির মৃত্যুর পর  এই স্থানটি শাসন করতে থাকেন তাঁর পুত্র বাণ  এবং তাঁর নামে রাজ্যের নাম হয় বাণ রাজ্য এবং রাজধানীর নাম হয় বাণ নগর, বর্তমানের বাণগড়।
পুনর্ভবা নদীর তীরে রয়েছে বাণের কন্যা ঊষার ঘর যা "ঊষাতিটি"নামে পরিচিত। এই জনপদে বাণের  কন্যা ঊষা এবং শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরূদ্ধ কে নিয়ে প্রচলিত প্রেম কাহিনীও এখানকার আকাশ বাতাসে
ভেসে বেড়ায়। এইসব কাহিনী গঙ্গারামপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে "জ্যোতিষ ভূমি" রূপে 
আখ্যায়িত করে রেখেছে।
এই বাণগড় সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন----- দেবকোট, উমাবন,ঊষাবন শোনিতপুর, কোটিবর্ষ। এখানে খনন কার্য সম্পাদনের পর যেসমস্ত যুগের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল  তা হলো -----মৌর্য,  কুষান, শুঙ্গ থেকে আরম্ভ করে  মুসলিম যুগ পর্যন্ত।
    গঙ্গারামপুর শহরের এক কিমি দক্ষিণে  ধল দীঘির পাড়ে শাহ আতা -এর দরগাহ। সম্ভবত চোদ্দ শতকে নির্মিত হয়েছিল।এটি একটি ছাদবিহীন  কাঠামো যার নিচের অংশটি পাথর এবং বাকি অংশটি ইট দিয়ে তৈরি। মাজারটি মোল্লা আতর--উদ্দিন বা শাহ আতা -এর কবরকে আবদ্ধ করে।  প্রকৃতপক্ষে এটি কুলুঙ্গি সহ মসজিদ,দরগাহ নয়। দেয়ালে আরবি ভাষায় চারটি "ইনস্ক্রিপশন" খোদাই করা আছে। ধলদীঘি র পাড়ে এই স্মারকটি আজ "প্রাচীন স্মারক ও পুরাতাত্ত্বিক স্থল এবং অবশেষ আইন ১৯৫৮ তথা প্রাচীন স্মারক পুরাতাত্ত্বিক স্থল অনুযায়ী রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসেবে 
ঘোষনা করা হয়েছে। ধলদীঘির পাড়ে দরগার মধ্যে ব্যবহৃত পাথরে  হিন্দু সংস্কৃতির কিছু কিছু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।
        বাণগড়, ধলদীঘির ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন চাক্ষুষ ক'রে গঙ্গারামপুর থেকে টোটো রিকসায় চেপে ১৪ কিমি দূরে গঙ্গারামপুর শহরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে  চললাম তপন ব্লকের দিকে। প্রায় অর্ধেক দূরত্ব  অতিক্রম করে নয়াবাজারে এসে পৌঁছলাম। গঙ্গারামপুরের বিখ্যাত দই আসলে এই নয়াবাজারেই তৈরি হয়।  নয়াবাজার থেকে আধঘন্টা পর অর্থাৎ  গঙ্গারামপুর থেকে এক ঘন্টা পর এসে পৌঁছলাম তপন। পুনর্ভবা নদী এই এলাকাকেও পুষ্ট করে চলেছে। ইতিহাস খ্যাত তপন দীঘি এই থানার অন্তর্ভুক্ত। দৈর্ঘ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় চার হাজার ফুট এবং প্রস্থে প্রায় এক হাজার ফুট এই দীঘির বর্তমান চিত্র হতাশাজনক। এই দীঘিকে ঘিরে সামনে অনেকটা পরিসরে গেস্ট হাউস সহ ফাঁকা জায়গা থাকলেও বিস্তীর্ণ দীঘির জল বর্তমানে সবুজ আগাছার আড়ালে সম্পূর্ণভাবেই অদৃশ্য। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গাটির প্রবেশ পথও বন্ধ।  হয়তো দীঘিটি সংস্কারের পর প্রবেশপথ  সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে। কথিত যে, বাণরাজা তাঁর রানির আদেশে এই দীঘিটি খনন করেন।  বাণ রাজা এই দীঘির পাড়ে তর্পণ করতেন বলে এই দীঘির নাম হয় তর্পণ দীঘি এবং সময়ের সাথে  পরিবর্তিত হয়ে "তপণ দীঘি" নামে পরিচিতি লাভ করে। 
হয়তো ধারাবাহিক খনন কার্যের ফলে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার জনপদগুলোতে ইতিহাসের আরও অজানা তথ্য মিলতে পারে।
     এখানে এলাম অথচ মিষ্টির স্বাদ নেবনা ---তা কি হয়! তাই একদিকে মিষ্টির দুর্দান্ত স্বাদ আর এক দিকে "ইতিহাসের স্বাদ" দুটোতেই সমৃদ্ধ হয়ে গঙ্গারামপুর  থেকে ফিরে এলাম বালুরঘাটে।



No comments:
Post a Comment