Monday, November 3, 2025


 

আর কি কখনো কবে

অনিতা নাগ


এখন আর অল্প বয়সের ব্যস্ততা নেই। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের মতো জীবন কেমন নিস্তরঙ্গ অলস। ছেলে মেয়ে বরের টিফিন করা নেই, সংসারের শতেক কাজ সামলে বাইরে দোকান বাজার করতে ছোটা নেই। দুপুরে খাওয়া সেরে একটু গড়িয়ে নিয়েই বারান্দায় দাঁড়ানো নেই স্কুল ফেরতা ছেলে মেয়ের অটোর অপেক্ষায়। আকাশের মুখ ভার হলে ছুটে গিয়ে জামাকাপড় তোলার ব্যস্ততা নেই। জীবনের চাকা যতো গড়াচ্ছে ততোই নেই এর তালিকা বাড়ছে। মা বাবা, শ্বশুর শাশুড়ী কেউ নেই। সবাই এখন দূর গগনতলে ঘর বেঁধেছেন। ছেলে, মেয়ে জামাই, সকলেই কাজের সুবাদে প্রবাসী। থাকা বলতে এই দুটো মানুষ। তাও যেনো কতো দূরের। তেমন করে আর গল্প করাও হয় না। আত্মীয় স্বজনের বাড়ী যাওয়াও তো উঠে গেছে সেই কোভিডের সময় থেকে। এই অখন্ড অবসরে মন তো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় হেথায় হোথায়। 

ঘর গুছোনোর আছিলায় সু সে'দিন তার পুরোনো সাজের জিনিষপত্র উপুর করে নিয়ে বসলো। কতো রকমের যে গয়না! মাটির, পুঁতির, টেরাকোটা, ডোকরা, রঙিন টার্সেলে কতো রকমের লকেট। সাথে ম্যাচিং দুল। শাড়ীর সাথে ম্যাচিং গয়নায় সাজতে খুব ভালো বাসতো সে। কোনোটাই আহামরি নয়, তবু খুঁজে খুঁজে পছন্দ করে কেনা। সেই যে মহামারী এলো, ঘরবন্দী জীবন। জীবনের চলনটাই কেমন পাল্টে গেলো। সাজ গোজ রইলো তোলা আলমারী আর প্যাঁটরাতে। তখন বাঁচার তাগিদে শুধু দূরে দূরে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে থাকা। খালি হাত ধোয়া, স্যানিটাইজড করা। এই করতে করতে আজ যখন জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে তখন হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। এখন আর গল্প হয় না। এখন পাশাপাশি থাকলেও মুঠোফোনে মুখ গুঁজে সব খুঁজে নেওয়া। অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিষের খোঁজে মনের ঘরে সিঁধ কাটা। একবার সিঁধ কেটে ঢুকে গেলে কতো যে মণিমাণিক্য, হিরে-জহরত তার ঠিক নেই।  

গয়নার বাক্স থেকে বেছে বেছে রাখছে সু। কতো গয়নার রঙ গেছে চটে, কতো গয়না গেছে বিবর্ণ হয়ে। সেগুলো সব আলাদা করে একটা ব্যাগে রাখলো। সাহায্যকারিনী মেয়েটা যদি নেয়। নাহলেই বলবে একবার দেখালে না, ফেলে দিলে! এ'সব গোছাতে গোছাতে একটা কি যেনো লাগলো হাতে। অনেক কসরত করে সেই প্যাকেট বাইরে এনে আনমনা হলো সু। এ'যে অরুপ রতন! তার ভালোবাসার ধন। আজ অনাদরে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

একটা বিবর্ণ প্যাকেট। তাতে রয়েছে জীবনের কতো যে স্মৃতি, কতো ভালোলাগা, কতো স্বপ্ন। অথচ অনাদরে, অবহলোয় পড়েছিলো। সু এর মনেও ছিলো না এদের কথা। আস্তে আস্তে প্যাকেটাকে দু'হাতে আগলে রাখলো বুকের কাছে। ছোটবেলার সোনালী দিনগুলোর আগল গেলো খুলে। প্যাকেট থেকে একটা একটা করে বার করলো বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মেডেল গুলো। বেশ অনেক গুলো। সবগুলো পাওয়া বিভিন্ন নাচের কমপিটিশন থেকে। মা' র উৎসাহেই নাচ শেখা। তারপর কখন যে নাচকে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে মনে নেই। বছরে একবার নাচের স্কুলে কমপিটিশন হতো। লোকনৃত্য, রবীন্দ্রনৃত্য, শাস্ত্রীয় নৃত্য। মা নিয়ে যেতেন। সংসারের শতেক কাজ সামলে মা যে কিকরে অতোক্ষণ সময় বার করতেন আজ আর তা মনে নেই। ফিরেই তো রান্নাঘরে ছুটতেন। অনেকটা রাস্তা। পুরোটা রিক্সায় যাওয়ার সামর্থ্য ছিলো না। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিক্সায়। পথে পড়তো এক নামী মিষ্টির দোকান। কাচের শোকেসে থরে থরে সাজানো মিষ্টি। সবচেয়ে লোভনীয় ছিলো জল ভরা তালশাঁস সন্দেশ। ওই দোকানের সেরা মিষ্টি। দামেও সেরা। তাই দেখেই মন ভরানো। কিন্তু এই একদিন সেটা পাওয়া যেতো সহজে। ওই তো মা'র কথা শুনতে পাচ্ছে সু। সব বিভাগে সেরা হলে জলভরা তালশাঁস সন্দেশ পাওয়া যাবে। কি মজা, কি মজা। বাকী পথটা লাফাতে লাফাতে চলতো সু। নাচের স্কুলে পৌঁছে সবাই যখন ভয়ে কাবু, সু তখন দিব্যি মজায়। একে তো নাচ করতে তার বড্ড ভালো লাগে, সাথে জলভরা! আর তাকে পায় কে! এমন কতো কম্পিটিশনের স্মৃতি লেগে রয়েছে এই মেডেল গুলোয়! নাচের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে লাল সার্টিন জড়ানো এই মেডেল গলায় পড়িয়ে দিতেন মাষ্টার মশায়। সু চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছে মা আর বাবার গর্বিত মুখ দুটো। কতো হাততালির আওয়াজ! কোনো বিভাগে প্রথম, কোনটায় দ্বিতীয়, কোনটায় বা তৃতীয়। কিন্তু তিনটে বিভাগের পুরস্কার আসতো বাড়ীতে। নাচ নিয়ে বাড়ীতে আর কারুর তেমন উৎসাহ ছিলো না। কিন্তু মা আর বাবা যে বড্ড খুশী হতেন তা বুঝতো সু। 

মনের কোন ঘরে, অতল অন্ধকারে লুকিয়ে ছিলো সেই স্মৃতি। দু' চোখ ঝাপসা। ফ্রক পড়া, দু বেণী বাঁধা ওই তো সেই মেয়ে! কতো পথ পেরিয়ে আজ স্মৃতি হাঁতরে খুঁজে দেখছে সু নিজেকে। ছেট ছোট আনন্দে ভরা ছোটবেলা। ছোট ছোট পাওয়া। তালশাঁস সন্দেশ, টানা রিক্সার টুংটাং, আলোয় ভরা স্টেজ, করতালির মুখরতা, সাইকেলের পিছনে কেরিয়ারে বসে বাবার সাথে বেড়াতে যাওয়া, বল খোঁপা বাঁধা, লাল টিপ পড়া মা'র মুখ! এমন সব টুকরো স্মৃতির কোলাজ। আনমনা সু। আবার যদি ইচ্ছা করে আর কি ফিরে আসবে সেই দিন! মনের মাঝে রবি কবির সুর বাজছে.
 'যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব'সে রইব কতো আর'

No comments:

Post a Comment