Monday, November 3, 2025


 

এও কী সম্ভব?

শুভেন্দু নন্দী 


হালদার পাড়ার এই অপরিচ্ছন্ন ও এঁদো গলির মুখে একটা ছাপড়ার ঘর, টিন ও টালির ছাদ। ঐ ঘরটিতে চা-বিস্কুটের দোকান। সামনে বেঞ্চ পাতা। সামনে একটা বড়ো সড়ক। এখানে অর্ণব আসে মাঝে মাঝে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মজলিশী আড্ডা,হালকা গল্প গুজব আর ঘন্টার পর ঘন্টা  চায়ের পেয়ালায় তুফান। বেশ মনে পড়ে অর্ণবের। 

চাকরীতে তখনও প্রবেশ ঘটেনি তার। এ পাড়ার একদম শেষ মাথায় ভাড়া বাড়ি তাদের। আশেপাশে কিছু আধবুড়ো,  পুরনো ও প্রবীণ বসতবাড়ি। পায়রার খোপের মত কিছু ঘুমটি ঘর,পান-বিড়ির দোকান, লনড্রী, কুকুরের ঘেউ,ঘেউ একটানা চিল-চিৎকার  কাকেদের কোলাহল সকালবেলায়। এটাই ছিলো এ পাড়ার কৌলিন্য।কর্মজীবনের প্রায় দশটা বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত। একটা মার্কেনটাইল ফার্মের ম্যানেজার। অনেক টাকার ঋণ করে একটা বাড়িও করেছে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরে। মাকে ছোটবেলায় হারিয়েছে সে। দূর সম্পর্কের এক পিসি তাদের সংসারটাকে আগলিয়ে রেখেছেন। পিছন ফিরে তাকালো সে। পুরণো ভাড়া বাড়িতে একদিন ফিরে যাবার সময় বাড়ির গলিতে এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। একটা আর্ট স্কুল থেকে ফিরছিলেন।  বেশ সুদর্শন, শুভ্র বেশবাস,চোখে চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত, কাঁধে লম্বা ঝোলানো ব্যাগ। অর্ণবের সাথে আলাপও হয়েছিলো। নাম জেনেছিলা সুবীরেশ রায়। বাড়ির ঠিকানা, ফোন নং দিয়েছিলেন। ব্যস, শুধু এইটুকুই। তাঁর পরিবার, পেশা, সাংসারিক জীবন সম্বন্ধে তেমন কৌতুহলও ছিলোনা। কিন্তু তাঁর কথা সবসময় ভাবতো। এইসময় এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটতে থাকলো। কর্মস্থলে যাবার তাগিদে যখনই ট্রাম,বাস কিম্বা ট্রেন ধরবার জন্য ছোটাছুটি করতো- তখনই তাঁর আশেপাশে হোতো তাঁর অদ্ভূত রকমের আবির্ভাব। অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা কী কোনও অসুখ, না কী হ্যালুসিনেশন! ফাইল থেকে তাঁর দেওয়া ঠিকানায় মনোনিবেশ করলো। 

নাঃ- কাল রবিবার। যেতেই হবে ওখানে। খোঁজখবর নিতে হবে তাঁর। ....মনে মনে ভাবলো অর্ণব। রাতে আবার স্বপ্নে তাঁর আবির্ভাব। আলুথালু বেশ, চোখমুখ শুকনো। অনেক খুঁজে তাঁর বসতবাড়ির খোঁজ পেলো। বালিগঞ্জে ।

দরজায় কড়া নাড়তেই একজন বেড়িয়ে আসলো। অর্ণব অনুমান করলো - সুবীরেশবাবুর বউ। 
- আসুন । আপনিই বোধ হয় অর্ণববাবু? আপনার কথা উনি প্রায়ই বলতেন। 
ঘরে ঢুকে একটা ফ্রেমে বাঁধানো সুবীরেশের ফটো দেখলে অর্ণব। গলায় শুকনো ফুলের মালা। ঘরে স্তুপাকারে ছড়িয়ে আছে অজস্র ছবি।
- এত ভালো ছবি আঁকতেন তিনি! তার মন ডুকরে উঠলো।
- ছবি আঁকাই ছিলো তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান- বউ কাঁদো কাঁদো মুখে নিম্নস্বরে বলতে লাগলো।
- কিছুদিন আগেই চলে গেলেন তিনি।
- কি হয়েছিলো? অর্ণবের প্রশ্ন। 
- ইদানিং তিনি প্রায়ই ব্যস্ত থাকতেন। একাডেমীতে তাঁর ফটোর যথেষ্ট কদর ছিলো। ফটো-প্রিয়রা
তাঁর আঁকা ফটোই কিনতেন। তারপর প্রতিযোগিতার বাজার চলে এলো। এটাই তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো। সংসারকে তিনি ভালোবাসতেন খুব। উপার্জন কিন্তু মন্দ হোতোনা। তবুও অকারণে তাঁর এই চিন্তা। একদিন বাড়ি ফেরার সময়ে লোডশেডিং-এর কারণে একটা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে সজোরে আঘাত,  হাসপাতাল,চিকিৎসা,প্রচুর অর্থব্যয় - সবই গেলো বিফলে। খুব সঞ্চয়ী ছিলেন তিনি। আমাদের একটা জয়েন্ট একাউন্ট আছে। মাসখানেক চলবে তাতে। তারপর......ভাবতেও পারছিনা। এই আমাদের একমাত্র সন্তান।  টিউশনি পড়িয়ে এলো। সামনে মাধ্যমিক। 
- দেখি তোমার পাশবুক, বৌদি।
ডাইরীতে নোট করে নিলো সব অর্ণব। ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হোলো অর্ণব।

পরদিন অর্ণব এক লাখ টাকা ট্রান্সফার করলো ঐ একাউন্টে। মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করলো কিছুটা। হঠাৎ তার স্বপ্নের কথা মনে হোলো। সুবীরেশবাবু এটাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, " আমি তো চলে গেলাম, আমার সংসারটাকে একটু  দেখে রেখো, অর্ণব"

No comments:

Post a Comment