দিন বদলের গল্প
লীনা রায়
গভীর ঘুম থেকে মাঝ রাতে ডেকে তুলেছিল মা। কিছু বোঝার আগেই হাতে জামা প্যান্ট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল তৈরী হয়ে নিতে। আর তার কিছুক্ষন বাদে ব্যাগে খানকয়েক জামা প্যান্ট, গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়া। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সঙ্গী ছোটকাকা। বাড়ি থেকে বের হবার ঠিক আগে মা গুটিকয় আম আর মুড়ি পুঁটলি বেঁধে সঙ্গে দিয়েছিল। বলেছিল, “খিদে পেলে খেয়ে নিস।”
তখন অনেকেই দেশ ছাড়ছে। কাকার সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসে রতন। উঠেছিল জলপাইগুড়ি জেলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এক রাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন নিজেদের বাড়িতে। কাকা সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল। দু' কাঠা জমিতে দু' কামরার টিনের চালা। সেখানেই শুরু হল কাকা ভাইপোর সংসার।
 বড় রাস্তার ধারে বাড়ি। আশে পাশে কোন প্রতিবেশী নেই। কিছুটা হেঁটে যেখানে রাস্তা দু' ভাগ হয়েছে সেখানে একটি বাড়ি। কাকা সকালে রান্না করে। বালতি ভরে খাবার জল নিয়ে আসে। বাড়ির কাছেই নদী। সেখানেই চান, ধোয়া কাচা। তবে এখানকার নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের নদীর অনেক তফাৎ। এখানকার নদীতে শীতকালে জল থাকে না বললেই চলে।
 রতন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাড়ির পাশেই সেনা বাহিনীর ক্যাম্প। ওখানে দশটার ঘন্টা বাজলেই ভাত খায়। আর তারপরে স্কুল। স্কুল ছুটি হলে ঘুরে বেড়ায়। ফাঁকা বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করে না। ক্যাম্পের কাঁটা তারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে মার্চ পাস্ট দেখে। কোন কোনদিন নদীর ধারে বসে থাকে। সন্ধ্যা হবার মুখে বাড়ি ফেরে।
মায়ের দেওয়া আম খেয়ে আঁটিটাকে ঘরের পাশে ফেলে রেখেছিল। সেটা থেকে চারা বেরিয়েছে। রতন বেড়ার ধারে সেটাকে লাগিয়েছে। প্রতিদিন জল দেয়। তরতর করে বাড়ছে গাছটা। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে রতনের। দেশ ছেড়ে সব কিছু গুছিয়ে বাবা, মা চলে আসবে। কিন্তু কবে?
কাকা সকালে কাজে বেরিয়ে রাতে ফেরে। কাকা ফিরলেই খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কেরোসিনের দাম খুব বেশি। রতন শুয়ে শুয়ে বাড়ির কথা ভাবে। বন্ধুদের কথা ভাবে। এক বছর পার হয়েছে। আবারও শীত এসেছে। এখানে ঠান্ডার জোর বেশি। কুয়াশা কাটতে কাটতে দুপুর হয়ে যায়। তার ওপরে বৃষ্টি। ঠান্ডার সময় লেপের ভেতর মায়ের গায়ে লেপ্টে শুয়ে থাকার কথা মনে পড়ে। নতুন গুড়ের পায়েস, পিঠের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
 সকালে উঠে উত্তরদিকে পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। কাকা বলেছে পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবে। ছুটির দিনে আধ ঘন্টা হেঁটে পৌঁছে যায় চা বাগানে। দেখে মনে হয় সবুজ গালিচা বিছানো। নি:ঝুম, শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে পাখির ডাকে স্তব্ধতা ভাঙে। এখানকার বাতাস খুব ঠান্ডা। প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
নদী, চা বাগান, সেনা ক্যাম্প - সব নিয়েই রতন বেড়ে উঠছিল। মা বাবার জন্য অপেক্ষা শেষ হয়েছে। কিছুদিনের ব্যবধানে দুজনেই তাদের ছেড়ে চলে গেছে। খবর পেয়েছে অনেক দেরিতে। মায়ের জন্য মন কেমন করে রতনের। আম গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছের গায়ে হাত রাখে।
অবসরে রতন হাঁটে। পিচ রাস্তার দু' ধারে বিশাল বিশাল শাল, সেগুন গাছের সারি। আবার রেল লাইন পার হয়ে কিছুটা এগোলেই ঘন জঙ্গল। রতন বার বার একই জায়গায় যায়। প্রতিবার নতুন লাগে। এখানকার প্রকৃতি অপরূপা। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাড়ি ফেরে। আমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে।
 সময় গড়ায়। ছোটকাকা আর নেই। স্কুলের চাকরি, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে স্বচ্ছল সংসার রতনের। পাকা বাড়ি, ইঁটের পাঁচিল। আর পাঁচিলের গা ঘেঁষে সেই আমগাছ। আমগাছের নিচেই সকাল সন্ধ্যার চায়ের আসর।
এখানে বসেই চল্লিশ বছরের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে রতন। ছিন্নমুল হয়ে অন্য দেশে থিতু হবার গল্প। তার একলা জীবন। একাকিত্ব ভুলতে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া। আর তার মায়ের স্মৃতি – তার বড় প্রিয় আমগাছ।
কিন্তু চোখ খুললেই সব হারিয়ে যায়। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গলি, মহল্লা, বাজার ঘাট সর্বত্র। উঁচু উঁচু বাড়ি, গাড়ি, মোটর সাইকেলে জমজমাট রাস্তা। রাস্তায় কত লোক। দলে দলে লোক আসছে ভিন্ন শহর, ভিন্ন রাজ্য থেকে। প্রকৃতির টানে। ব্যবসা বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। কমেছে শীত, বৃষ্টি দুটোই। রতনের অচেনা লাগে সব কিছু। ছেলেবেলায় যে নদী তাকে সঙ্গ দিত, তার অস্তিত্ব আর নেই। আস্ত একটা নদী কর্পূরের মতো কবে যে উবে গেছে! বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আর পাহাড় দেখা যায় না। চা বাগান বন্ধ। কিন্তু শহর বাড়ছে।
এর মধ্যে সরকারি নোটিশ এলো। রাস্তা চওড়া হবে। ভাঙ্গা পড়ল রাস্তার দু' ধারের বাড়ি, দোকান। রতনের বাড়ির ইঁটের পাঁচিল ভাঙ্গা গেল। কাটা পড়ল আম গাছ।
রতন আজকাল ঘরেই থাকে। বারান্দায় অব্দি আসে না। সবাই তাকে বোঝায়। রতন চুপচাপ শোনে। কথা বলে না। বাবার মন খারাপ ছেলে বোঝে। সেজন্য নার্সারি থেকে আম গাছের চারা এনে বাড়ির সামনে বসিয়েছে। বার বার ডেকেছে ওকে দেখার জন্য। রতন যায়নি। সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখে ইঁটের পাঁচিল। আর পাঁচিলের গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা তার প্রিয় আমগাছ। হাওয়ায় দুলছে ঝাঁকড়া ডালপালা। আমের মুকুলের গন্ধে ম ম করছে চারদিক।
স্বপ্নটা ভেঙে যেতেই ছুটে ঘরের বাইরে আসে রতন। চোখে পড়ে কালো কুচকুচে পিচ রাস্তা। আলো আঁধারে হিলহিলে সাপের মত লাগছে। গা গুলিয়ে ওঠে রতনের।

No comments:
Post a Comment