Monday, November 3, 2025


 

বিরল সেই রাতগুলি

পার্থ সারথী নন্দী


রাতগুলো বড় আদুরে পোষা বেড়ালের মত রেশমি কোমল , আমার পায়ে 
পায়ে ,অবাধ্যতায় ঘোরে! দিনগুলি বড় বেশি
প্রকাশ্য, ক্যাটকেটে,ভানিতাহীন,
সোজা সাপটা! বড্ড সোজাসুজি
চোখে চোখ রেখে তোমায় কুঁকড়ে 
দেয়! তুমি দিনের আলোয় প্রাণপণ
তোমার আদিমতা, প্রবৃত্তি,তোমার
নগ্ন চাহিদা গুলি ঢেকে রেখে দাও!
দিনের আলোর কোন চোরা চাহনি
নেই, নেই কটাক্ষ, চোখের তলা
মুড়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ! সেই সব একান্ত
রাতের সম্পত্তি! দিনে সেই মগ্নতা
নেই, স্তব্ধতা নেই,নিঃসঙ্গতা নেই!
তুমি দিনের আলোয় চেষ্টা করলেও
বিপন্ন হতে জানো না! দিনের আলো
না ফুরুলে তোমার বিপন্নতা ফুটে
ওঠে না,সন্ধ্যা আকাশের শুক তারার
মত! এই বিপন্নতা একান্ত তোমার
নিজের, হৃদয়ের প্রিয়তম সঞ্চয়!
এমন কার্তিক সন্ধ্যা ছাড়া উঠোনের এক কোনায়
যখন কেউ তুমি অবয়বহীন , তখনই তো তোমার মুক্তো বিন্দু গুলি
নীরব ভাষা পায়! টুপটাপ ঝরে পড়ে হিমের
মতোই! যদি কখনো এমনি সন্ধ্যায় ঘরছাড়া
হয়ে থাকো,তবে বারবার ঘরের নিভৃত ,একেবারে
অনাদৃত কোনটি তোমায় বারবার হাতছানি
দিয়ে ডাকবে! তোমার মনে হতে থাকবে
যেনো অকূল পাথারে তুমি নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছো! 
ট্রেনের কামরায় যখন
বাইরে অনেক দূরে গ্রাম বা শহরের দ্রুত
অপসৃয়মান আলোকবিন্দু গুলির দিকে
তাকালেও এমনি হেমন্ত রাতে তোমার
ঠেলে কান্না পাবে! মনে হতে থাকবে
তোমার অনেক হারিয়ে ফেলা সুখের,
আনন্দের অবসরের কথা! 
ট্রেন আরো জোরে ছুটতে
থাকে, শীতের প্রবল ঝাপটা তোমায়
এত বিপন্ন,কোণঠাসা করে দেয়,
সারাদিন কর্মব্যস্ত তুমি ভুলেছিলে 
ক্ষুধার কামড়; এখন শীতার্ত
তোমার সেই সৈনিকের মত
ক্ষুধার্ত লাগে! ক্লান্ত তোমার
ঘ্রানেদ্রিয়ে ঝাপটা মারে
কাল্পনিক গরম ভাতের গন্ধ!
তোমার নিতান্ত অবহেলার,
চিরপরিচিত বাড়িটি তখন
তোমার পরম আকাঙ্খার
বস্তু, ! হেমন্ত রাতেই ঘরের 
জন্য এত ব্যাকুলতা আসে
বাউলের মনে!
 তুমি ক্রমাগত বিষন্ন,একাকী,
ফিরে দেখো হৃত সঞ্চয়ের রাশি!
এমন বিষাদ ক্ষণ হেমন্তের রাত ছাড়া
আর কোনো বেলায় কি আসে?

এমনি একটি রাত কেটেছিল কোদালবাস্তি 
বিটে! সেটি ছিল পূর্ণিমা রাত! আমরাই
কয়েক জন বন্ধু,আর একটি উন্মুক্ত নদী
বক্ষ! প্রান্তর টি ফসল হীন, দূরে জঙ্গলের
সীমানা সুস্পস্ট! কিছু ক্ষণ আগে হোমস্টের
রাঁধুনি দেখেছে একপাল বাই সন সামনে
বয়ে যাওয়া ক্ষীণ তোর্ষা পেরিয়ে বর্ষার
জলে গজিয়ে ওঠা নতুন ঘাস খাচ্ছে! 
এই মুহূর্তে চাঁদের আলোয় কেউ নেই,
কিচ্ছু নেই! বেশ দূরে কোনো গারো পরিবারে
খুশির রোশনাই জ্বলছে, নৃত্য গীত চলছে!
একটু দূরে শুধু নদীর কলকল শব্দ! পাহাড়ি
নদীর জলে বেশ স্রোত! বর্ষার জলের পুষ্টিতে
এখনো শরীর থেকে সমস্ত পেলবতা ঝরে
যায় নি! মাথার উপরে চাঁদ স্ব মহিমায়! এই
অঘ্রাণ রাত্তিরে নক্ষত্র বড় বেশি প্রতীয়মান
হয়! আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত ব্যালকনি
ছেড়ে মাঠে নেমে আসি! ভুলে যাই
হোমস্টে মালিকের সতর্ক বাণী! এখানে
চারদিকে কোর বনানী,যেকোনো দিক
থেকেই বিপদ মুহূর্তে ঘনিয়ে আসতে পারে!
আমরা হাঁটছি,কোন বিপদের আশঙ্কা
আমাদের স্পর্শ করছে ন! গল্পে মশগুল
আমরা যত বার আকাশের দিকে চোখ
রাখছি,মনে হচ্ছে কোন কোন তারা
যেনো পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসছে!
এই মেঘহীন ,ঝকঝকে রাতে তারাদের
অজস্র দেখা যায়! আমরা তাকিয়ে
দেখতে থাকি কি দ্রুত কিছু আলোর
রেখা আকাশের এই প্রান্ত থেকে যেনো
নিমেষে অন্য প্রান্তে চলে যায়! 
এমনি রহস্যময়তা কি হেমন্তের
নিজস্বতা! কি জানি? আর কখনও
তো রাত কে এত নিবিড়,এত
কৃষ্ণবর্ণ,এত স্থিরতায় পর্যবেক্ষণ
করি নাই! এমনি করে কখনও
কোন রাত্র আমাদের কাছে
উপভোগ্য হয়ে ওঠে নাই! 
আমরা কথায় কথায় অন্যমনস্কতায়
বনের প্রায় সীমানায় পৌঁছে যাই কখন!
অন্ধকারে চোখ যেতেই প্রায় আঁতকে উঠি!
হঠাৎ কোনো বন্যপ্রাণী বেরিয়ে আসলে
হোম স্টে পর্যন্ত বেশ অনেকটা দুরত্ব আমাদের
পালাতে হবে! একটা আতঙ্কের শিহরণ দিলো
শরীরে! জীবনে যত গুলি আতঙ্কের আবহ
সৃষ্টি হয়েছে সেই রাতের কথা অবিস্মরণীয়!
শুরুটা হয়েছিল সন্ধ্যা থেকেই! 
সেদিন সিসিলাইনের ট্যুরিস্ট দের জন্য ঘোরতর নিষিদ্ধ এলাকায় 
আমাদের এক পরিচিত
অরণ্য আধিকারিকের সৌজন্যে পৌঁছেছিলাম
চন্দ্রলোকিত সন্ধ্যায়! ডিপার্টমেন্টের গাড়িটা
নামিয়ে দেবার পর কোয়ার্টার থেকে সল্ট
পিট অবধি যেতেই আমাদের বুক ছ্যাঁত করে
উঠলো! আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে
জ্যোস্না লোকে নির্জনতায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে
ওরা কারা! একদল মহিষাসুর বাইসনের
চোখ গুলি জ্বলছে অন্ধকারে,আর ঠিক মাঝখানে একটি মা গণ্ডার তাঁর সন্তান কে
পরম মমতায় মুড়ে নিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে!
ওরা কি আমাদের দেখতে পাচ্ছে? আমরা
একটুও নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না! আমাদের দাঁড়াবার জায়গা থেকে দুদিকে সরলরেখা টানলে সোজা বনে গিয়ে ঢোকে,আর যখন তখন সেখান থেকে বন্যজন্তু অনিবার্য ভাবে আক্রমণ করতে পারে!

সেখানে দাঁড়িয়ে কার্তিক শেষের তীক্ষ্ণ শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমি দু পাশে গাছগুলির
নড়াচড়া দেখছিলাম! বনবীথি গুলিতে
আলো আর ছায়া আঁকিবুঁকি কেটে যাচ্ছে!
সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা ময়না বা শিমুল
গাছগুলোকে তখন রীতিমত রহস্যের
খাস মহল মনে হচ্ছে! যেনো যে কোনো
মুহূর্তে ওখান থেকে ঝাঁপ দেবে কোনো
হিংস্র,ধূর্ত লেপার্ড! কিংবা ওর গুঁড়ির
পেছন থেকে বেরিয়ে আসবে কোনো
ভল্লুক! এমনি কোন হেমন্ত রাতে!
সেদিন যখন বিট থেকে বাইক 
করে হোম স্টে তে ফিরি,কয়েক চুলের
জন্য একটি বাইসনের সাথে
সংঘর্ষ থেকে রেহাই পাই 
অলৌকিকভাবে! এমনি
কোনো হেমন্ত রাতে!

প্রতিটি হৈমন্তি রাতের মধ্যে
একটি নর্তকী লুকিয়ে থাকে! যে
রাত যত অন্ধকার তাঁর রহস্য তত 
প্রগাঢ়! আর যে রাত পূর্ণ চাঁদের আলো
পান করেছে, তাঁর উন্মত্ত শরীরে
তত নেশা চড়তে থাকে! তেমনি পূর্ণিমা
রাত গুলি বড্ড বেশি জয়ন্তী কিংবা রায়ডাকের 
নদী বক্ষে কাটাতে ইচ্ছে করে! সে রাতে
ভাগ্যে থাকলে হুরি,কিংবা ডামা বানু
কিংবা পরীরা হয়তো বিশ্রস্ত বসনে,
ক্লান্তি অপনোদন করতে এমনি স্রোতে
বয়ে যাওয়া চাঁদের আলো চলকে পড়া
জলে অবগাহনে নামতে পারে!
কে বলতে পারে, নাগরিক জীবন
থেকে , অবিশ্বাসের, অসততা , আবিলতা 
থেকে অত দূরে এই আদিমতায় কোনো
অপ্রাকৃত কিছু নেমে আসে কি না
মর্ত্যলোকে?সকলের সে সব কল্পদৃশ্য
ভাগ্যে জোটে না! জুটলেও তো সামলানো
সহজ কথা নয়! সে আরকের নেশার
মত তোমার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেবে!
এমন করে তোমায় গ্রাস করবে সে
মায়াবিনী নিশি,যে হয়ত তুমি
বাস্তব আর অলৌকিকের সীমারেখা
ভুলে যাবে! আরো এমন হেমন্ত রাত আসুক,
যখন শস্য দানা মুখে পালিয়ে যায়
কোনো মেঠো ইদুর,সদ্য কর্তিত কোনো
ধানক্ষেত থেকে, যখন পেঁচার মারণ 
ঠোঁটে সাঙ্গ হয়ে যায় মেঠো ইদুরের
বাঁচার লড়াই, যখন চাঁদের আলোয়
উপুড় হয়ে আদুর গায়ে কোনো
মেঘবতী রাজকন্যা রূপকথার গল্প
তৈরি করে,যখন মাঝে মাঝে ময়না গাছের অতিকায় বনস্পতি ছায়া দেখে দুঃস্বপ্ন
ভর করে, তেমনি হেমন্তে রাত গুলি
এমনি বিপন্ন হয়ে থাক,রহস্য আর 
মাদকতায় মোড়া থাক, আঁধারের নেশা চলকে
পড়ুক রসিক কোনো পথিকের অনুভবে! -

No comments:

Post a Comment