Monday, November 3, 2025


 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: বাংলার আলোকবর্তিকা 
বটু কৃষ্ণ হালদার

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—শুধু একটি নাম নয়, তিনি এক শক্তিশালী যুগপুরুষ, যিনি ভারতীয় সমাজের এক গভীর অন্ধকারে আলোর দীপ জ্বালিয়েছিলেন। মানবতা, শিক্ষা, নারী-অধিকার ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এমনই অসাধারণ ও হৃদয়স্পর্শী যে আজও তিনি অমর, জীবন্ত এক প্রেরণা। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও দয়ার প্রতিমূর্তি, ছিলেন বাঙালির হৃদয়ের কাছে সবচেয়ে আপন। এই লেখা তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে থাকা লড়াই, প্রেম, বেদনা, স্বপ্ন ও আত্মত্যাগের এক হৃদয়গ্রাহী ।

১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার ছোট্ট গ্রাম বীরসিংহে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র, কিন্তু ধর্মভীরু ও শিক্ষানুরাগী মানুষ। পরিবারের আর্থিক অনটনের মধ্যেও ঠাকুরদাস পুত্রের শিক্ষার জন্য কলকাতায় নিয়ে যান, যাতে তার ভবিষ্যৎ আলোকিত হয়।

কলকাতায় এসে শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্রের প্রকৃত সংগ্রাম। কখনও পয়সা ছিল না বই কেনার, কখনও রাতের খাওয়া জুটত না। কিন্তু মনের মধ্যে ছিল জেদ, নিজের প্রতি বিশ্বাস। এই কঠিন সংগ্রামেই তৈরি হতে থাকে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় দেন। সংস্কৃত, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস—সব বিষয়ে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। এমনকি সংস্কৃত ভাষায় এত দক্ষতা অর্জন করেন যে, তিনি "বিদ্যাসাগর" উপাধি লাভ করেন। এই ‘বিদ্যার সাগর’ তখন থেকেই শুরু করলেন জ্ঞানকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ।

তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অদ্বিতীয়, কিন্তু সেই জ্ঞানকে কখনও অহংকারের ঢাল বানাননি। বরং সহজ ভাষায়, সাধারণ মানুষের উপযোগী করে তা পরিবেশন করেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী অধ্যায় হল নারী শিক্ষা নিয়ে তাঁর কাজ। সে সময় সমাজে প্রচলিত ছিল, নারীকে শিক্ষা দেওয়া পাপ। নারী জন্মগ্রহণ করে শুধুই গৃহকর্ম করার জন্য—এই চিন্তাধারাকে তিনি চ্যালেঞ্জ জানান। তিনি নিজের হাতে শুরু করেন বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন। রাস্তায় হেনস্থার শিকার হয়েছেন, সমাজ তাঁকে "বিধর্মী" বলেছে, তাঁর নিজের পরিবারকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে—তবুও তিনি দমে যাননি। বিদ্যাসাগরের এই সাহস ও মানসিক দৃঢ়তা আজও সমাজ সংস্কারকদের অনুপ্রাণিত করে।

ঈশ্বরচন্দ্রের সবচেয়ে মানবিক ও সাহসী পদক্ষেপ ছিল বিধবা বিবাহ চালু করার প্রচেষ্টা। তখনকার সমাজে বিধবাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত করুণ। সমাজের চোখে তারা ছিল অপবিত্র, অলক্ষণে। এই নিষ্ঠুরতা বিদ্যাসাগরের মনকে ক্ষতবিক্ষত করত। তিনি ইংরেজ সরকারে চাপ দিয়ে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করান (১৮৫৬), যার মাধ্যমে বিধবারা পুনরায় বিবাহের অধিকার পান। এই আইনের কারণে বিদ্যাসাগরের উপর সমাজের এক বিশাল অংশ আক্রমণ করেছিল। তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, ঘরবাড়ি ঘিরে গালিগালাজ, এমনকি হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। তবুও তিনি পিছু হটেননি। মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি প্রমাণ করে দেন, সাহসিকতাই প্রকৃত জ্ঞানীর গুণ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষাকে সহজ ও প্রাঞ্জল করে তুলেছিলেন। তাঁর লেখা "বর্ণপরিচয়" বাংলা শিক্ষার এক যুগান্তকারী পুস্তক। আজও শিশুরা যখন “অ আ ই” শেখে, তখন তারা অজান্তেই বিদ্যাসাগরের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে। তিনি শুধু শিশুশিক্ষা নয়, পাঠ্যবই লেখার ভাষাকেও করে তুলেছিলেন সরল ও হৃদয়গ্রাহী। তাঁর গদ্য ছিল তীক্ষ্ণ, অথচ কোমল। বাংলা সাহিত্যের ভাষা পরিশীলিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

বিদ্যাসাগরের জীবন এক জীবন্ত কাব্য। তাঁর মানবতাবাদ ছিল নিঃস্বার্থ। তিনি নিজে অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, অথচ হাজার হাজার গরিব ছাত্র-ছাত্রী, বিধবা নারী, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সাহায্য করেছেন নিজের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে। তাঁর আয়ের প্রায় সবটাই তিনি দান করতেন। একবার একজন দরিদ্র পণ্ডিত কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি নিজের পরনের দামী কাপড় খুলে দিয়ে বলেছিলেন, "তোমার যদি প্রয়োজন হয়, তবে এটা রাখো।"

এই হৃদয়বৃত্তি, এই মমত্ববোধ তাঁকে করে তোলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী।


দারিদ্র্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ—সব বিরুদ্ধে একা যোদ্ধা - 

ঈশ্বরচন্দ্র কখনও ইংরেজ সরকারের তোষামোদি করেননি। একদিকে সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসন—এই দুইয়ের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। ইংরেজ শাসকেরা যখন সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁকে ব্যবহার করতে চায়, তিনি বলেন, "আমি যা করি, তা আমার বিবেকের নির্দেশে করি, কারো আদেশে নয়।"। এই আত্মসম্মানবোধ, এই সততা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার, প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা—সব কিছুর মধ্যেই ছিল তাঁর এক দৃঢ় নৈতিকতা।

সনাতনী সমাজ ও ব্যক্তিগত বেদনা -

সমাজ সংস্কারক হিসাবে বিদ্যাসাগরকে যতটা শক্ত মনে হয়, ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ততটাই কোমল। নিজের সন্তান নারায়ণচন্দ্র ছিল বিপথগামী—মাদকাসক্ত ও উচ্ছৃঙ্খল। বিদ্যাসাগর বহু চেষ্টা করেও তাকে সঠিক পথে আনতে পারেননি। এই ব্যর্থতা তাঁর হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। তবুও তিনি থেমে যাননি। অন্যের সন্তানদের শিক্ষিত করে, গড়ে তুলে তিনি যেন নিজের সন্তানের প্রতি সমাজের ঋণ শোধ করছিলেন।

১৮৫৮ সাল। এই সময় শিক্ষা বিভাগের বিশেষ অধিকর্তা ইয়ং সাহেবের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের প্রতি পদে বিরোধ দেখা দিল। ইয়ং সাহেব সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের বেতন বাড়াতে চাইলেন, বিদ্যাসাগর বাধা দিলেন। তিনি অনুরোধ করলেন ইয়ং সাহেব স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ বিদ্যাসাগর কোন ভাবেই মেনে নিতেন না । তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ইস্তফাপত্র লিখে উপর মহলে পাঠিয়ে দিলেন। বিদ্যাসাগরের ইস্তফাপত্র দেখে হ্যালিডে সাহেব ডেকে পাঠালেন।

 হ্যালিডে সাহেব বললেন- 'পন্ডিত, আপনি ইস্তফা ফিরিয়ে নিন' বিদ্যাসাগর বললেন- 'না সাহেব, যে কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারবো না, শুধু টাকার জন্য সে কাজ করতে আমি রাজী নই।'
হ্যালিডে আবার খুব বিনয়ের সাথে বললেন- আমি জানি, আপনি সব দান ধ্যান করেন, বহু গরীব ছাত্রদের পড়াশোনার খরচ দেন, নিজের জন্য কিছুই রাখেন না। চাকরি ছেড়ে দিলে আপনার চলবে কী করে? বিদ্যাসাগর উত্তরে বললেন - 'সাহেব, ভাববেন না, এখন দুবেলা খাই, তখন না হয় একবেলা খাবো। তাও না জোটে একদিন অন্তর খাবো, কিন্তু যে কাজে সম্ভ্রম নেই , সে কাজ আমি করতে চাইনা।'
 বিদ্যাসাগরের কিছু বন্ধুস্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষী এই ঘটনা জেনে বললো- 'বিদ্যাসাগর তুমি ভালো কাজ করলে না। এখন তোমার চলবে কী করে? বিদ্যাসাগর হেসে বলেছিলেন- 'আমার কাছে আত্মসম্মানই বড়, টাকা বড় নয়।' এও বলেছিলেন- 'আমি যখন সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ পরিত্যাগ করেছিলাম, তখন আমার কী ছিল? এখন তবু ত আমার প্রণীত ও প্রকাশিত পুস্তকের কতক আয় আছে।'

একবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতার এক জনাকীর্ণ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি এক বৃদ্ধকে মাথা নিচু করে অস্থির অবস্থায় দেখতে পেলেন। এটা দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কী হয়েছে? কী সমস্যা?” বৃদ্ধ লোকটি তার দুঃখ প্রকাশ করা ঠিক হবে না ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র সহানুভূতি প্রকাশ করে বললেন, “দয়া করে আপনার সমস্যাটা আমাকে বলুন। হয়তো আমি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবো।”
ঈশ্বরচন্দ্রের অনুনয়-বিনয় শুনে বৃদ্ধ লোকটি একটু আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “আমি একজন দরিদ্র মানুষ। আমি আমার মেয়ের বিয়ের জন্য কারো কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও তা পরিশোধ করতে পারিনি। এখন সেই ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আমার উপর ইতিমধ্যেই ঋণের বোঝা ছিল, এখন আদালতের ঝামেলা।” ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, “চিন্তা করবেন না। আমি অবশ্যই কিছু সমাধান খুঁজে বের করবো।” 

ঈশ্বরচন্দ্র সেই দরিদ্র ব্যক্তির কাছ থেকে মামলার পরবর্তী তারিখ, আদালতের নাম ইত্যাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিবরণ নিয়ে সেখানে যান।মামলার জন্য নির্ধারিত তারিখে, বৃদ্ধ ব্যক্তি আদালতে পৌঁছে এক কোণে বসে তার নাম ডাকার অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন কারণ, তিনি টাকার ব্যবস্থা করতে পারেননি। কিন্তু ডাক না আসায় তিনি আদালতের কর্মীদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি জানতে পারেন যে, কেউ তার ঋণের পুরো টাকা জমা দিয়েছে এবং মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে, বৃদ্ধ ব্যক্তি জানতে পারেন যে, যে ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধ করেছিলেন তিনি সেই ধার্মিক ব্যক্তি যার সাথে কয়েকদিন আগে রাস্তায় দেখা হয়েছিল।

এইভাবে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই ব্যক্তির জীবন থেকে একটি বড় সংকট দূর করেছিলেন। তিনি কোনও প্রদর্শনী ছাড়াই এইভাবে মানুষদের সাহায্য করতেন এবং তাদের দুঃখ দূর করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভদ্রতা, দয়া এবং সহযোগিতামূলক স্বভাব ছিল এমনই।

১৮৮০ সালে সরকার বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ' সি আই. ই' উপাধি দেয় কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে ওই পদক নিতে চাননি। সেইজন্য চমৎকার পথ বেছে নিলেন। কলকাতায় না থেকে কয়েকদিনের জন্য কার্মাটাড়ে চলে গেলেন। উপাধি বিতরণ শেষ হলে ফিরবেন। ওই উপাধি নিতে তাঁকে রাজভবনে যেতে হত, আছে নির্দিষ্ট ড্রেস কোড। অনেক হ্যাপা ওদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙালির সাধারণ পোশাক ছাড়া অন্যকিছু পরিধান করেন না তিনি কিভাবে রাজভবনের নির্দিষ্ট ড্রেস কোড মানবেন?

পদক বিতরণ শেষ হয়েছে বিদ্যাসাগর নিশ্চিন্ত মনে কার্মাটাড় থেকে কলকাতায় ফিরেছেন। কিন্তু বিপদ তাঁর দুয়ারে এসে হাজির। কলকাতায় ফিরলেই দুজন সরকারি কর্মী পদক নিয়ে বিদ্যাসাগরের দূয়ারে উপস্থিত। বিদ্যাসাগর দুজনকে বললেন শোনো আমি একটা কথা বলি তাতে তোমাদেরও সুবিধা আমারও সুবিধা। এই পদকখানা নিয়ে বাজারে গিয়ে বেচে দাও। যা পাবে দুজনে মিলে ভাগ করে নিও। 
আর একবার 'মহামহোপাধ্যায়' উপাধির প্রস্তাব এল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে। এবার তিনি অসুস্থতার দোহাই দিলেন। বললেন যা চাপানো আছে তা ফিরিয়ে নিলে তিনি রক্ষা পান। ১৮৬৪ সালে জার্মানির শ্রেষ্ঠ ও প্রাচ্যবিদ্যার কেন্দ্রের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। ওই বছরই বিলেতের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য হলেন তিনি। এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু গোল বাধল ১৮৮০ সালে যখন ভারত সরকার বিদ্যাসাগর মহাশয় কে ' সি আই. ই' উপাধি দিয়ে দিল। তারপর 'মহামহোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য সি আই. ই' পদক নেবেন না বলে তিনি কার্মাটাড় চলে গিয়েছিলেন আর মহামহোপাধ্যায় উপাধি তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখান করেন।

সাম্প্রদায়িক বিদ্যাসাগর:_বিদ্যাসাগর কলেজে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়। উইল করে আইনগত ভাবে পাকাপোক্ত ভাবেই করেছিলেন। তাঁকে কি 'সাম্প্রদায়িক' উপাধিতে ভূষিত করবে কমিউনিস্ট/সেকুলাররা? অভিনেতা মোহাম্মদ জাকারিয়া ছিলেন বাংলাদেশের থিয়েটার নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা, বিটিভির প্রযোজক ও একুশে পদক প্রাপ্ত। মুকুল শিকদার তাঁর "পাবলো পিকাসো ও অন্যান্য প্রবন্ধ" গ্রন্থটিতে সেই মোহাম্মদ জাকারিয়ার স্মৃতিকথায় কি লিখেছেন সুধী অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক দুটি কুসুমের একটির অন্তর্গত আধুনিক উদার ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি একটু পড়ে নিক এই বেলা :"কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ ওঠে এলো বীরভূমে । আমি তো কলেজে পড়তে পারার আনন্দে আত্মহারা । তাছাড়া বিদ্যাসাগর কলেজে পড়তে পারার আনন্দ সত্যি অন্যরকম । স্কুলে বিদ্যাসাগরকে পেয়েছিলাম পাঠ্য হিসেবে । মায়ের কাছে স্কুলের স্যারদের কাছে বিদ্যাসাগরের কথা কতভাবে শুনেছি । তাই সঙ্গত কারণে বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল প্রশ্নাতীত । কিন্তু বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি ফরম আনতে গিয়ে শুনলাম, কোনো মুসলমান ছাত্র বিদ্যাসাগর কলেজে পড়তে পারবে না । কারণ তিনি তাঁর উইলে স্পষ্ট উল্লেখ করে গেছেন হিন্দু ছাত্র ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বী ছাত্র তার কলেজে পড়তে পারবে না। রাগে,দুঃখে এবং অপমানে সেদিন কেঁদে ফেলেছিলাম । বিদ্যাসাগরের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা আমাকে আপ্লুত করেছিল । বিদ্যাসাগরের মতো মানুষও এতটা সাম্প্রদায়িক ছিলেন অথচ বাহির থেকে তাকে কত বড় করে দেখানো হয়েছে"। (পাবলো পিকাসো ও অন্যান্য প্রবন্ধ - মুকুল শিকদার, পৃষ্ঠা ১৩)

বিদ্যাসাগরের কলেজে আরবদের শিক্ষা লাভ নিষিদ্ধ ছিল। ছাত্রদের ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দিতেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। শিক্ষার পরিবেশই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

ধর্মনিরপেক্ষতা নামক আমড়া কাঠের ঢেঁকির উৎপাদনে তিনি উৎসাহী ছিলেন না। সিরাজের স্বরূপ তিনি বাঙ্গালীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে কমিউনিস্টরা বিদ্যাসাগরকে কাটছাঁট করে ধর্মনিরপেক্ষ রূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে।

শেষ জীবন ও অন্তিম বেদনা -

জীবনের শেষ পর্যায়ে ঈশ্বরচন্দ্র চলে যান ঝাড়খণ্ডের কাঁকসায়, কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে। সমাজের আঘাতে আহত এই মানুষটি তখন ছিলেন একা, কিন্তু শান্ত।

১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই, তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রেখে যান এক আলোর পথ, এক জীবন্ত আদর্শ, যা শত বছর পেরিয়েও আজও উজ্জ্বল। মৃত্যুর পরেও যিনি করেছেন মানুষের উপকার 
বিদ্যাসাগর তাঁর সারা জীবনে প্রচুর মানুষের উপকার করেছিলেন কিন্তু প্রতিদানে উপকৃতরা তাঁর শুধু সমালোচনাই করেছিলেন। নিমতলা মহাশ্মশানে তাঁর মরদেহের ছবি, যে ফটোগ্রাফার ছবিটি তুলেছিলেন তিনি তার ফটোগ্রাফী ব্যবসার সূচনায় দিল্লিতে একটি দোকান করেন। কিন্তু ব্যবসায় প্রভূত লোকসান হওয়ায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে কলকাতায় ফিরে এসে যখন আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছেন।

সে সময় ওনার ডাক পড়ে  বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্তিম যাত্রাকালের ফটোটি তোলার জন্য । ফটোটি তোলবার সময় তাঁর মুখটা দেখা যাচ্ছিল না, তাই শবযাত্রীবৃন্দ মৃতদেহকে ঠেলে কিছুটা উপরের দিকে তুলে দেন। সেই ফটোগ্রাফারই বোধহয় একমাত্র যিনি বিদ্যাসাগর সমন্ধে বলেছিলেন --

“তৎকালে ধনাঢ্য লোকের তো কথাই নাই, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পর্যন্ত এই ছবি কিনিয়া গৃহে রাখিয়া দিয়াছিলেন.. দিল্লিতে থাকিয়া যে লোকসান দিয়াছিলাম, কলিকাতায় আসিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কৃপায় তাঁর চতুর্গুণ লাভ করিয়াছি। একটি কথা আপনাদিগকে প্রাণ ভরিয়া বলিতেছি, বিদ্যাসাগর মহাশয় জীবিত থাকিয়া অনেকের অনেক উপকার করিয়াছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর পরেও তিনি আমার এই পরম উপকার করিলেন...! ”

তিনি কি শুধুই সমাজ সংস্কারক? বিদ্দ্বান? শিক্ষাবিদ? মাতৃভক্ত? বর্ণপরিচয়ের জনক? না, তিনি এসবের উর্ধে আরও বিরাট মাপের এক মানুষ যাকে স্বয়ং রামকৃষ্ণ দয়ার সাগর রূপে বর্ণনা করেছিলেন।

আসুন, আধুনিক ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যিনি শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করেছিলেন সেই বিদ্যাসাগরকে অন্তত কিছুটা সম্মান জানিয়ে তাঁর প্রতি আমাদের ঋণ কিছু মাত্র হলেও শোধ করি।

বিদ্যাসাগর, এক চিরন্তন চেতনার নাম -

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন কেবল একটি জীবনী নয়—এ এক কাব্য, এক বিপ্লব, এক মানবিকতার মহাকাব্য। তিনি প্রমাণ করেছেন, জ্ঞানী হওয়া যথেষ্ট নয়—মানবিক হওয়াই সর্বোচ্চ গুণ। তাঁর সাহস, নির্লিপ্তি, নিরহংকারতা ও দয়ালু হৃদয় আমাদের শেখায় কিভাবে মানুষ হওয়া যায়।

আজকের সমাজেও তাঁর আদর্শ প্রাসঙ্গিক। নারী অধিকার, শিশু শিক্ষা, মানবতা—এসব বিষয়ে তাঁর দেখানো পথ আজও বাতিঘরের মতো আমাদের পথ দেখায়।

তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো মানে শুধু পুষ্পার্ঘ্য দেওয়া নয়, বরং তাঁর আদর্শকে জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ধারণ করা।

বিদ্যাসাগর ছিলেন না কোনো রাজা বা মহারাজা, ছিলেন না কোনো যোদ্ধা বা ধর্মগুরু, তবুও তিনি ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। কারণ, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের মানুষ।

ওই যে এক বিদ্যাসাগর, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে,, বিধবাবিবাহ প্রথা সমাজে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।।

তাতে ফল টা কি হলো?

বাল্যবিবাহ হয়না ঠিক কিন্তু বালিকারা নিরাপদ হলো কই।তিলোত্তমা কলকাতার বুকে পুরুষের মতো প্যান্ট জামা পরে কর্মক্ষেত্রে গেলেই ভাবতে হবে বিদ্যাসাগর সফল হয়েছিলেন তাঁর লক্ষ্যে,। পুরুষতন্ত্র আজও অজস্র নারীর হৃদয়ে বাস করে।

ওই যে এক বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রথা শুরু করলেন,তাতে কি হলো? আজও বিধবারা শুভ কাজে থাকে না, নিজেদের আড়াল করে, সমাজ কিছু বলুক আর না বলুক, সাদা অথবা হালকা রঙ ছাড়া নিজেদের দুরে রাখে।কেন গো? স্বওআমি, বলে যায় নাকি, তাঁর শূন্যতায় লাল,মেরুন পরা বারণ। এ কেমন ধরনের স্বাধীন করে গেলেন বাঙালি বিরাঙ্গনাদের ওই বিদ্যার সাগর।

ওই যে এক বিদ্যাসাগর, নারীর শিক্ষা নিয়ে করলেন সারা জীবন অক্লান্ত আন্দোলন,
তাতে কিছু টা সফল হয়েছেন ঠিকই, নারী হাতা খুন্তি ছেড়ে ল্যাপটপ, এপ্রোন,স্টেথো, বিমানের চালক থেকে আরো বিভিন্ন পুরুষালি কাজে ঘর থেকে বাইরে এলো, কিন্তু, আজও যে রাতের অধিকার পুরুষের শুধু, আর একলা নারী রাতের অন্ধকারে হায়নাদের শিকার। একে নারী স্বাধীনতা বলে?

আরে, পুরুষের মতো পোশাক পরে, ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে, ফটফট যেখানে সেখানে ইংরেজি বললে কি সত্যি নারী স্বাধীন হলো?
বিদ্যার সাগর দয়ার সাগর কি সফল হলেন তাঁর লক্ষ্যে?
দুগ্গা এলো, দুগ্গা এলো বলে লাফালাফি করা সমাজ এক জ্বলজ্যান্ত মেধাবী,সাহসী দুগ্গার স্পর্ধায় ভয় পেয়ে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করলো  আর তোমরা উল্লাস করছো মাটির শক্তি নিয়ে,বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় নিয়ে, বিদ্যাসাগরের লক্ষ্য নিয়ে।।

এই সমাজের ভাবনার বদল আনতে,এই সমাজের অজস্র নারীদের লুকিয়ে কাঁদা বন্ধ করতে,আরো প্রচুর ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হতে হবে।আরো অনেক অনেক বর্ণপরিচয় লিখতে হবে। যদি সত্যিই বিদ্যার সাগর কে প্রতিটা বাঙ্গালি পড়তো

তবে আজ সেই মানুষ রূপী পশুরা তাদের মা মাসির কান কামড়ে বলতো,
"একটু যদি সঠিক শিক্ষা টা দিতে হৃদয়ে পুরুষতন্ত্র কে মুছে তবে আজ সঠিক অর্থে পুরুষ হতে পারতাম" বর্ণের পরিচয় হলো মানেই বিদ্যাসাগর কে বুঝলাম এ কথা ভুল, বিদ্যাসাগর কে বোঝার জন্য, উপলব্ধি করার জন্য বর্ণপরিচয়ের প্রতিটা ভাগেই ডুব দিতে হবে আমাদের সক্কল কে।
তোমার আমার বর্ণের পরিচয়, 
মানুষ হওয়ার পরিচয়, লেখা আছে 
ঈশ্বরের বইয়ের পাতায়।

(মতামত ব্যক্তিগত)

No comments:

Post a Comment