ফোকাস
আশংকার ঘনঘটা ও ছাব্বিশ হাজার
পরাগ মিত্র
আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রভুদের অসীম ক্ষমতা। শিরোমনিদের কথা বলাই বাহুল্য পাড়ার কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েতও দাপুটে সামন্ত। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। চাকরি ব্যতিক্রম হবে কেন? দলের আমি দলের তুমি দল দিয়ে যায় চেনার স্বজনপোষণের ইতিহাসেরও দীর্ঘ অতীত আছে।
বিজয় সিংহ, ধনপতি, শ্রীমন্ত, চাঁদ সওদাগরের জাবর কাটা হোক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যতই মাথা কুটে মরুন মাসান্তে ‘থোক টাকাটা’র জন্য চাকুরীর অনুরাগের কথা ১৮৭৪’র ‘কেরানি দর্পণে মালতিও বলেছে। তবে বাঙালি শিক্ষারও কদরদার। যখন শিক্ষকদের আর্থিক হাল বেহাল ছিল তখনও মাচার প্রথম লাউ থেকে পুকুরের মাছ মাস্টারের ঘড়ে পৌঁছে যেত অনুকম্পা নয়, আন্তরিক শ্রদ্ধার স্মারক হিসেবেই।
একদিনে হাল ফেরে নি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে ১৯২১শে প্রতিষ্ঠিত অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন যখন কোনও একক ঝান্ডার নয়, সব শিক্ষক শিক্ষিকার ছিল, সম্মানজনক বেতন তখন থেকেই প্রধান দাবি। এই দাবিতেই ১৯৫৪’র শিক্ষক আন্দোলন চমকে দিয়েছিল দেশকে। বাম আমলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের বেতনের দায়ভার সরকারের ঘাড়ে বর্তায়। মাইনেতে সরকারি গ্যারান্টি, পে- কমিশন দৌলতে শিক্ষকতার পেশাও সমাজের স্ট্যাটাসের অন্যতম সিম্বল হয়ে ওঠে।
রিক্রুটমেন্টের ক্ষমতা ছিল ভোটে নির্বাচিত দলহীন ম্যানেজিং কমিটির হাতে। নামেই দলহীন। সুতো নিগূঢ়ে বাঁধা ছিল দলীয় অনুশাসনেই। বিক্ষিপ্ত ব্যতিক্রমগুলো বাদ দিয়ে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী নিয়োগে ‘দলের ছেলে’র তকমাটা ভাইটাল মাইলেজ। অর্থ, যোগ্য প্রার্থীকে ইন্টারভিউতে বাঁধা, পছন্দের কোরাম থেকে বিয়ের শর্ত… যে বলবে শোনে নি, সে ভীনগ্রহের প্রানী। এখন যেমন ভাঙা চাতাল থেকে দেদীপ্য প্রোমোটার সবাই তৃণমূল, লাল বাংলায় তখন প্রায় প্রত্যেক চাকরিপ্রার্থীর পকেটেই লাল লেটারহেডে সুপারিশ। চাকরি একজনের। গোঁসার সংখ্যা বহু।
এই আবহেই এসএসসি’র জন্ম। বছরের পর বছর স্কুলে নগরের উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক দিনমজুরের সন্তানের সাফল্য নিয়ে বিন্দুমাত্র ফিসফাসের অবকাশ ছিল না। একই স্টাফ রুমে পাশাপাশি চরম বাম বাবুন, কট্টর দক্ষিণপন্থী সঞ্জীব আর কস্মিনকালেও রাজনীতির ছায়া না মারানো আনোয়ার। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মতই সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে নিয়োগে এসএসসি দেশে পথিকৃৎ পথিকৃৎ। অর্জন করেছিল বিশ্বাস সম্ভ্রমের অনন্য মাত্রা। পরিবর্তনের পরের পরীক্ষাতেও এসএসসি’র স্বাভীমান অটুট ছিল।
সিকি শতাব্দী পেরিয়ে সেই এসএসসি চাকরির প্যানেলের বদলে প্রকাশ করছে চাকরি বাতিলের লিস্ট। ঘটনাক্রমের পুনরাবৃত্তি নিরর্থক। এখন নতুন পরীক্ষা, নতুন নিয়োগগের ডঙ্কা। এবার প্রতি ইঞ্চি মেধার ভিত্তিতে মেপে প্যানেল তৈরি হলেও আস্থাহীনতার দায়মুক্ত এসএসসি হতে পারবে? বাংলার যৌবন যে দৃঢ়তায় সাফল্যের সাথে ব্যর্থতাকেও মেনে নিত- সে সব সহজেই অ্যাজ ইট ইজ হবে? গ্যারান্টি দিতে পারবে যে প্রাপককে শুনতে হবে না, “কত দিলে”? ওএমআর শিট, প্যাকিং, সিলিং, ট্যাবুলেশন থেকে রেজাল্ট - পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব ভিডিওগ্রাফির দাবি উঠলে অন্যায় হবে? সাদা খাতা, ওএমআর লোপাট, পরীক্ষা না দিয়ে চাকরি… সন্দেহ জাগবে না? মামলার চক্কর আর অনিশ্চয়তার দোলাচল কেটে যাবে? হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ঠেলাই নয়, এক লহমায় তিল তিল করে গড়ে ওঠা ভরসাকে চৌচিরের দায় কি দাগী ছেলেমেয়েদের? ওরা কি ধর্মের ষাঁড়, যে দাপ দেখিয়ে সবজির বস্তায় মুখ গুঁজে দিল? পসরা সাজিয়ে কে বসেছিল?
টেইন্টেডদের সুদসহ টাকা ফেরতের প্রশ্ন যদি যুক্তিগ্রাহ্যতা পায় তাহলে আনটেইন্টেডরা পরীক্ষার ফি ফেরতের সাথে ক্ষতিপূরণের দাবি ন্যায্য।
কর্মসংস্থানের দিশায় যখন ‘চপ’ ‘ঝালমুড়ি’র দিশা, সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন ভোকাট্টা, তখন প্রতাপান্বিত ব্যক্তি সটান বলে দিচ্ছেন নিয়োগের পরীক্ষাটা দুর্গাপূজা নয় যে ফি বছর আয়োজন করতেই হবে। ‘ফ্যালো কড়ি নাও চাকরির আড়কাঠিরা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা থেকে বক্সিরহাটের শেষ প্রান্ত। চোখের সামনে জ্বলজ্বল বাঁকা পথের হাতছানি। অর্থবানরাই শুধু নয়, জোতজমি বেঁচেও অনেকে ঝাঁপ দিতে বাধ্য হয়েছে।
আজ প্রকট আস্থাহীনতা। এবছর আবেদনকারী গত পরীক্ষার এক তৃতীয়াংশও নয়। কাজ পেয়ে হারানোর চেয়ে টোটো চালানো, কম বেতনে ছোটখাটো কাজকে উঁচু মেধার ছেলেমেয়েরা শ্রেয়ঃ মানছে। আতঙ্কের লাইনে প্রাথমিকের ষাট হাজার। রাজনীতি সর্বস্বতার কচকচানি সোস্যাল মিডিয়া, প্যানেল ডিসকাশন থেকে মোড়ের চায়ের দোকান। ইস্যুকে ঘিরে শাসক-বিরোধীর মগ্ন অংকে অনিশ্চয়তার আঁধার শুধু ভুক্তভোগী যৌবনে।
এসএসসি সম্ভবতঃ ব্রহ্মান্ডের সেই বিরলতম সংস্থা যে কোর্টে ভুল স্বীকার করেও নির্ভুল তালিকা দিল না। পরিণামে ‘টেইন্টেড’ না হয়েও ডিসেম্বরে ছাঁটাইয়ের গ্যারান্টি। আগে বারবার সুযোগ পেয়েও পারল না, এইবার ঠিকঠাক প্যানেল তৈরি করবে? দীর্ঘ প্রস্তুতিতেও চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য আসে না। এবার তো প্রস্তুতির অনভ্যাস, বয়সের পলির বাঁধা। উপরন্তু ব্যাংকের ইঅএমআই, সন্তানের স্কুল, বীমার প্রিমিয়াম। “সুখে দুঃখে হয়ে কৃত্ত্বা” থাকা সম্ভব? মাথার ধমনীতে দপদপানি তীব্র হয়। দুদিন আগে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত সুবল সোরেনরা কি শুধুই কার্যকারণহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
এটা ঠিক, রাজনৈতিক ক্ষমতাই প্রধান কুশীলব। দেশভাগের পর স্বাধীনত্তোর বাংলায় বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়ে তার দায় এতটুকুও কম নয়। ব্যতিক্রম থাকলেও, রাজনীতির লোকজন মানেই অস্বচ্ছ এরকম ধারণা সাধারণের রয়েছে। দলীয় বিশ্বাস থাকতে পারে এসএসসি’র কর্তাদের মনোনয়নে মেধা আবশ্যিক। মন্ত্রী, নেতার চাপের মুখে তাদের মেরুদন্ডের ঋজুতা কোথায়? কথায় নাকথায় সব রোগের জন্য অশিক্ষাকেই প্রধান দায়ী যারা করেন একবার কি মিলিয়ে দেখবেন শিক্ষিতদের স্থাপিত দৃষ্টান্ত?
বঙ্গভঙ্গ, জালিওয়ানাবাগ, বক্সা… রবীন্দ্রনাথের বাংলা উৎপল দত্তের হয়ে রাজপথে সত্যজিৎ রায়’কে দেখেছে, দেখেছে তিমিরের জন্য শঙ্খ ঘোষকে। সিলেক্টিভ প্রতিবাদের দৌলতে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটাই ব্যঙ্গে অধঃপতিত। দুঃখজনক সত্যিটা হল সহকর্মীদের জন্য শিক্ষক সংগঠনগুলোও দলীয় লক্ষ্মনরেখা পেরিয়ে সমবেত প্রতিবাদে ব্যর্থ।
ঘটিবাটি বিক্রি করে দুবার ঠকা ছেলেমেয়েদের যদি সুদসহ মাইনে ফেরৎ দিতে হয় কিডনি বিক্রি করেও অনেকে জোটাতে পারবে না। যোগ্যতা সত্ত্বেও যার চাকরি গেল কিংবা যে প্যানেলে বাইরেই থাকল- সে তঞ্চকতার সীমা নেই। ঈশানে আবার মামলার ভ্রুকুটি। সরকারি স্কুলে সবচেয়ে বেশি এনরোলমেন্টের হারের বাংলায় স্কুলকে ঘিরেই অনাস্থার আড়চোখ।
উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় মৃত্যুর তালিকা বাড়ালে গাইতে পারব তো ’ .. জাগে আমার গান’!

No comments:
Post a Comment