মনজয়ী এক বিজয় নগর
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
সদ্য সকাল পেরোনো রোদেলা এক দিনকে গায়ে মেখে ইতিহাসের গন্ধে ভরপুর হবার লোভে আমরা আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রির ডাকে সাড়া দিয়ে এসে পৌঁছেছিলাম সেখানে।বিছিয়ে রাখা বিস্তীর্ণ ইতিহাসের পাতায় পাতায় চোখ রেখে কখনো আপ্লুত,কখনো আবেগপ্রবণ আবার কখনো বা চমকিত হয়ে উঠেছে মনের অলিগলি।
সেখানকার নিজস্ব গাড়িগুলি পর্যটকদের নিয়ে দলে দলে রওনা দিয়েছিল ফতেপুর সিক্রির মূল স্থাপত্যগুলির দিকে।পথের ধারে ধারে অতীতের খন্ডহারগুলি কিছু গল্প নিয়ে আজও অমলিন।ভাবতে অবাক লাগছিল যে একসময় পথের ধারের এই টাকশালে সোনা রূপো আর তামার কত হাজার হাজার মুদ্রা তৈরি হতো,যা কালের গর্ভে কোথায় হারিয়ে গেছে শুধু ভাঙাচোরা কাঠামোর স্মৃতিটুকু রেখে। 
মূল প্রবেশদ্বারের ভেতরে এসে দেখেছিলাম খোলামেলা সবুজের মাঝে লাল বাড়িটি নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।জেনেছিলাম এটিই দিওয়ান- ই- আম। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের এক সময় ফতেপুর সিক্রি ছিল মুঘলদের রাজধানী। সম্রাট আম জনতাদের সঙ্গে এখানে দেখা করতেন,তাঁদের কথা শুনতেন,অভিযোগ শুনতেন এবং কোনকিছু ঘোষনার জন্যও তিনি হাজির হতেন এখানে। গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা দিওয়ান- ই- খাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল এরপর। এর স্থাপত্য অবাক করবার মতো এবং এটির মূল আকর্ষণ অবর্ণনীয় সৌন্দর্যময় কেন্দ্রীয় স্তম্ভটি। এখানে সম্রাট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ও মন্ত্রীদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করতেন ও দরকারী সিদ্ধান্ত নিতেন।আকবরের বসবার জায়গা থেকে শুরু করে সবই বিশেষ ভাবে বানানো এখানে। পাহারাদার হিসেবে বোবা কালা লোকেদের রাখা হতো,যাতে এখানকার কোনো আলোচনা বাইরে না পৌঁছোতে পারে। 
ফতেপুর সিক্রির পঞ্চ মহল এক অন্যতম দ্রষ্টব্য।মোহিত হতে হয় এটির সামনে দাঁড়িয়ে।পাঁচতলা অপরূপ এই মহলটি মূলত রাজার বিশ্রাম ও বিনোদনের আবাস ঘর হিসেবেই বানানো হয়েছিল।এখান থেকে আকবরের মুসলিম রাণী রুকাইয়া সুলতান বেগম চাঁদ দেখতেন,ধর্মের করণীয় নিয়মকানুন করতেন আর আকবরের হিন্দু স্ত্রী যোধাবাঈ সূর্য প্রণাম করতেন ও তুলসীকে স্নান করাতেন।আজ থেকে কত যুগ আগে একজন মুসলিম রাজা সমস্ত ধর্মের উর্ধ্বে উঠে সংস্কার মুক্ত মন নিয়ে জীবন কাটাতেন ভাবলেও মন ভালো হয়ে যায় এই পঞ্চ মহলের কাছে এসে। 
এই চত্বরে সম্রাট আকবরের মুসলিম,হিন্দু ও খৃষ্টান তিন পত্নীর পৃথক পৃথক প্রাসাদ রয়েছে যেগুলি নিজের নিজের মতো করে নজরকাড়া।রুকাইয়া বেগমের মাত্র ন' বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে বিবাহের বন্ধনে জড়িয়েছিলেন সম্রাট।অপেক্ষাকৃত ছোট ভবনটি যেন সেই ছোটবেলা থেকে পরিণত বয়সের কতশত মুহূর্তের দলিল হয়ে অনেক বড় এক স্মৃতির সম্ভার হয়ে বিরাজমান আজও।রাণী ডোনা মারিয়া ( যদিও এনাকে নিয়ে মতান্তর রয়েছে) প্রাসাদটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।গুজরাটি কারুকার্য খচিত যোধাবাঈয়ের সুদৃশ্য বিশাল প্রাসাদটি মুঘল স্থাপত্যের অতুলনীয় এক নিদর্শন। গরম ও শীতকালের জন্য আলাদা শয়নকক্ষ থেকে শুরু করে প্রার্থনা গৃহ, তুলসী মঞ্চ সবকিছু পরিপূর্ণ ভাবে এখানে বিদ্যমান। রাণীদের জন্য জন্য আমিষ ও নিরামিষ দুটি রান্নাঘরের দেখা মেলে এই চত্বরে।যোধাবাঈয়ের রান্নাঘরের দেওয়ালে তাঁর পরিহিত কানের দুলের ছাপ জায়গাটিকে আরো আকর্ষণীয় করেছে।যোধাবাঈয়ের জন্য একটি কৃষ্ণ মন্দির করে দিয়েছিলেন সম্রাট।যোধাবাঈয়ের দাদা মান সিংয়ের দেওয়া কৃষ্ণ মূর্তিটি সেই উপাসনা গৃহের দেওয়ালের সুদৃশ্য এক কুলুঙ্গিতে স্থান পেয়েছিল। সম্রাট আকবরের পরধর্মের প্রতি এই শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি সম্মান জাগায় গভীর থেকে। 
মহল- ই- খাসের বিস্তৃত উঠোন জুড়ে এ সময় মীনা বাজার বসতো,যেখানে শুধুমাত্র মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল। রাণীরা,তাঁদের দাসীরা খোলা মনে আনন্দ নিতেন এখানে। এককথায় এটি ছিল অভিজাত এক বাজার যেখানে বিভিন্ন রত্ন,রাজকীয় সাজ পোশাক ও বিলাস সামগ্রীর ক্রয় বিক্রয় চলতো। 
সম্রাট আকবরের নিজস্ব প্রাসাদটির কক্ষে অনেকটা উঁচুতে ওনার শোবার ব্যবস্থা ছিল।সংলগ্ন জানালা,হাওয়া চলাচলের বন্দোবস্ত সবই রয়েছে সেখানে।শূন্য শুধু সে আসনখানি যেখানে ধর্মীয় মলিনতা কোনো ছাপ রাখতে পারেনি,শূন্য শুধু সেই কুলুঙ্গিরা যেখানে মহানুভবতার প্রদীপ জ্বলে ওঠেনা আজ।প্রকৃত অর্থেই খোয়াব গাহ ছিল এটি, যেখান থেকে এক মুসলমান সম্রাট স্বপ্ন দেখেছিলেন দীন ই ইলাহীর মতো ধর্মীয় সহনশীলতার ও মিলনের,প্রশাসনিক, সামরিক, ধর্মীয় সবদিক থেকে সুসংহত এক রাষ্ট্রের। বিরাট এক জলাধারের দেখা মেলে এই প্রাসাদ চত্বরের এক কোণে,যেটির মধ্যে জমিয়ে রাখা গঙ্গাজল সম্রাট আকবরের তৃষ্ণার উপশম ছিল সে সময়কালে।সময়ের ধুলো গায়ে মেখে আজও সেই জলাধার রয়ে গেছে স্মৃতির চিহ্ন হয়ে। 
'মহল- ই- খাস- এর উঠোন ধরে এগোতে এগোতে এরপর মন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছিল চারটি সেতু যুক্ত একটি জলাশয়ের সামনে এসে। এটিই সেই ঐতিহাসিক জলাশয় অনুপ তালাও।যেখানে বসে আকবরের রাজসভার নবরত্নের অন্যতম রত্ন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী তানসেন সুরের জাদুতে মোহিত করতেন শ্রোতাদের।কথিত আছে ধ্রুপদী সঙ্গীতজ্ঞ বৈজু বাওরার সঙ্গে এখানে তাঁর মনে রাখার মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। অনুপ তালাও আসলে একটি উন্মুক্ত প্রেক্ষাগৃহ ছিল যেখানে বিভিন্ন মনোরঞ্জনকারী ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হতো। জলাশয়টির চারপাশে বসবার ব্যবস্থা ছিল দর্শক,শ্রোতাদের। সম্রাট আকবর ও তাঁর রাণীরাও ওনাদের নিজস্ব মহলের নির্দিষ্ট জায়গাগুলিতে বসে বিনোদনের শরিক হতেন। এটির মনোমুগ্ধকর শৈল্পিক সৌন্দর্যের থেকে চোখ ফেরানো দায়।দিঘির টলটলে জলে এখনও যেন ছায়া ভাসে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলির, সেই সুরের মূর্ছনার,সমবেত সেই কথা,উচ্ছ্বাসের।প্রকৃত গুণের কদর করতে জানতেন যে সম্রাট সেই উদার, মহানুভব শাসকের স্থাপত্যের আঙিনায় দাঁড়িয়ে মন সত্যিই আশ্চর্য এক আবেশে ছেয়ে যায়।দেখা যেন শেষ হতে চায়না আর। তবুও ফতেপুর সিক্রির আরো কিছু আকর্ষণ তখনও দেখা বাকি। তাই পা চালাতে হয় সেই পথে। 
চটিজুতো জমা রেখে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি সেলিম চিস্তির মাজারের পথে,যার বেশ খানিকটা আগে থেকেই বিশাল চত্বরটির আরো দুদিকে চোখে পড়ে বুলন্দ দরওয়াজা ও জামা মসজিদ।মাজারে যাওয়ার পথ জুড়ে শুধু কবর আর কবর। সাবধানে পা ফেলে ধীরে ধীরে পেছনের দিক এগোতে দেখা মেলে গোপন এক দরজার যার মাধ্যমে একসময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই জায়গাটির যোগাযোগ ছিল। 
এই মসজিদ চত্বরেই আকবর তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরের প্রেমিকা আনারকলিকে বন্দী করে রাখেন।সে জায়গাটিকেও পর্যটকদের দ্রষ্টব্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।তবে আনারকলি নামে গণিকার কাহিনীটি কল্পনাপ্রসূত বলেই ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস।মুঘল আমলে এ নিয়ে লোকমুখে যে গল্প ছড়িয়েছিল তাতে রঙের পালিশ পড়তে পড়তে এক জীবন্ত কাহিনী হয়ে ওঠে কখন আর সত্য মিথ্যার তাৎপর্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মুঘলদের স্থাপত্যের মাঝেও জায়গা করে নেয়।
সুফিবাদের প্রতি অনুরাগী সম্রাট আকবর সুফী সাধক সেলিম চিশতির মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মান জানাতে জামা মসজিদ প্রাঙ্গনে এই মাজারটি নির্মাণ করে তাঁকে এখানে সমাহিত করেছিলেন। ধবধবে সাদা মার্বেলের এই স্থাপত্য এককথায় অসামান্য ও আকর্ষণীয়। দেশ বিদেশের অগণিত মানুষ প্রতিদিন আসেন এখানে প্রার্থনা করতে, শায়িত সাধকের কাছে মনোবাসনা জানাতে,তাঁর সমাধিতে চাদর বিছিয়ে দিতে,তাঁকে স্মরণ করে মনোকামনার সুতোতে বিশ্বাসের গিঁট বাঁধতে।এত মানুষের মন জয় করেছিলেন যিনি এবং কত যুগ আগে থেকে সশরীরে না থেকেও কতখানি ছেয়ে আছেন এই চরম আধুনিক সময়েও তা এই দরগায় এসে না দেখলে বোঝা যাবে না।অকুণ্ঠ এক ভক্তি জাগে গভীর থেকে এখানে এলে। কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য তো ছিলই আকবরের সেই আধ্যাত্মিক উপদেষ্টার যাঁর দরবারে গোটা পৃথিবীর মানুষের ঢল,আশার ভিড়,ভিড় স্বপ্নের; তিনি শূন্য হাতে ফেরাবেন না কাউকেই এখানে দাঁড়িয়ে মন থেকে এই প্রার্থনাই জাগে।তাঁর আশীর্বাদে আকবরের প্রথম পুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়েছিল।সবদিক থেকে পরিপূর্ণ,সফল এক সম্রাটের মনের গভীরে সন্তানের জন্য আকুল যে পিতার মন তার পরিতৃপ্তি হয়েছিল,স্বপ্নপূরণ হয়েছিল সেলিম চিশতির আশীর্বাদের স্নেহস্পর্শে। খুব যত্ন নিয়ে,নিখুঁত ভাবে এই দরগার প্রতিটি জায়গাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে সুন্দর নকশায়। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন,ভক্তি ও ভক্তের সমন্বয়ের আদর্শ এক তীর্থক্ষেত্র এই দরগাটি। 
বুলন্দ দরওয়াজার সামনে পৌঁছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল সত্যি সত্যি ইতিহাসের পাতায় পড়া বিশ্বের উচ্চতম দরজাটির কাছে দাঁড়িয়ে আছি।আকবরের গুজরাট জয়ের স্বাক্ষর, ফতেপুর সিক্রির প্রধান প্রবেশদ্বার এই বুলন্দ দরওয়াজা।লাল- হলুদ বেলেপাথরের কাঠামোর প্রায় চুয়ান্ন মিটার উঁচু এই দরজাটির গায়ে সাদা- কালো মার্বেলের নকশা এটিকে অত্যন্ত সুদৃশ্য করেছে।দরজাটির গায়ে কোরানের কিছু আয়াত খোদাই করা আছে। খিলানগুলি আকবরের উদার ধর্মনীতি, গুজরাট জয়ের ইতিহাস এমন সব লিপিবদ্ধ কথা নিয়ে সমৃদ্ধ।ঐতিহাসিক এই মহান দ্বার মহার্ঘ্য এক স্মৃতি রেখে গেল নিঃসন্দেহে।
এই বিজয়নগর পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ বললেও কম বলা হবে। দিনের আলোয় হঠাৎ করেই যেন দিবাস্বপ্ন সত্যি হবার মতো করে একঝাঁক ইতিহাস খোলা আকাশের নীচে আলোয় আলো হয়ে দেখা দিয়েছিল সেদিন। এর আনাচকানাচ জুড়ে ভাগে ভাগে এত দেখার জিনিস যে সেসবের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলেও বড় হয়েই যায়।যে জায়গায় খাঁজে খাঁজে ইতিহাসের জীবন্ত সব দলিল,সেখানকার দেওয়ালে কান পাতলে কত কথাই না উঠে আসে।কিছু জানা আর বেশিটাই না জানা সেসব কথা ভাগ করে নেওয়াতেই আনন্দ সবচেয়ে বেশি।নিজের উপলব্ধির অনুভূতি থেকেও ইতিহাস এ প্রসঙ্গে অনেক বেশি গুরুত্ব দাবি করে।সম্মান জানানোর সে জায়গা থেকেই দ্রষ্টব্য স্থানগুলির ঐতিহাসিক অবতারণা করেছি হয়তো বা সামান্য ছুঁয়ে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতিকেও সঙ্গে করে। ফতেপুর সিক্রি দেখবার,জানবার ও মন্ত্রমুগ্ধ হবার সেরার সেরা হয়ে মনের মণিকোঠায় রয়ে যাবে আজীবন। 






No comments:
Post a Comment