Monday, November 3, 2025


 

ভালো থাক সবুজ গালিচা তৈরির  অবহেলিত হিরোরা

মনোমিতা চক্রবর্তী

ঢাকে কাঠি পরা শুধু সময়ের অপেক্ষা। সকলের মনেই এখন  একটা খুশি খুশি আমেজ।শরৎ তার শুভ্রতার প্রতীক নিয়ে জানান দিচ্ছে মা দুর্গার আগমনের বার্তা। সমগ্র বাংলার সাথে আমাদের উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স তরাইয়ের চা বাগান গুলিতেও একটা সাজো সাজো রব।

 চা বাগান গুলিতে পুজো বোনাস পর্ব শুরু হলো বলে। সারা বছর হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর এই বোনাসই তো সম্বল চা বাগানের শ্রমিক এবং বাবু স্টাফদের।

 দিনভর চলবে বোনাস পর্ব। হাসিমুখে সকলে ঘরে ফিরবেন বোনাসের টাকা হাতে নিয়ে। কিন্তু বাগানের আরেক শ্রেণীর কর্মচারী যাঁরা চা বাগানের এক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী-  ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজমেন্ট এর অন্তর্গত ম্যানেজার এবং সহকারি ম্যানেজার, চা শ্রমিকরা যাঁদের "সাহেব " বলে সম্বোধন করেন তাঁরা কিন্তু খালি হাতেই একটা দীর্ঘশ্বাস আর এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে ঘরে অর্থাৎ নিজের বাংলোতে ফিরবেন। 

কোন কোন চা বাগানে ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষদের বোনাস ব্যবস্থা থাকলেও নব্বই শতাংশেরও বেশি  বাগানে ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষের তথা ম্যানেজার এবং সহকারী ম্যানেজারদের  কোনরকম বোনাসের ব্যবস্থা থাকেনা।

বাইরে থেকে চা বাগান দেখতে যতটা সুন্দর চা বাগানের ভেতরের কাহিনী কিন্তু মোটেও ততটা সুন্দর নয়। এক কাপ চা উৎপাদনে যাদের মেধা বা অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে বা যারা চা উৎপাদনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন সেই সাহেব বা সহকারী ম্যানেজারদের জীবনযাপন একটা সময় বেশ জাঁকজমকপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে তার ছিটেফোটাও নেই। চা বাগানের এই সহকারী ম্যানেজারদের বাবু স্টাফদের মত নেই কোন সি এল বা এম এল এর মত ছুটির ব্যবস্থা। 

আমাদের উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় সাহেবরা পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাতে বাধ্য হন । তাঁদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় কেটে যায় আত্মীয় পরিজন বন্ধু-বান্ধব পরিবার ছাড়াই।

বৃষ্টিতে ভিজে , ভাদ্রের তালপাকা  রোদে পুড়ে, ঘাম ঝরা শরীর নিয়ে তারা কাজ করে যান চা বাগানের জন্য। তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের কর্মজীবন কাটে নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বে। 

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলিতেও চা বাগানের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য চা বাগান থেকে বের হতেও পারেন না এই সাহেবরা।

কঠোর  পরিশ্রমী এবং দায়িত্বপূর্ণ এই সাহেবেরা সাধারণত চা বাগানের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করেন। শ্রমিকদের দ্বারা শুধু চা উৎপাদন নয় সঙ্গে শ্রমিকদের তত্ত্বাবধান, বাগান রক্ষণাবেক্ষণ, শ্রমিকদের দাবি, শ্রমিকদের অসন্তোষ সামলানো তথা বাগানে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। খাওয়া এবং ঘুমের সময়টুকু ছাড়া  প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই তাদের অলিখিত  অন ডিউটি থাকতে হয়,যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর  প্রভাব ফেলে। চব্বিশ ঘন্টা অন ডিউটি থাকার পরও এনাদের জীবনে নিরাপত্তার কোনরকম ব্যবস্থা নেন না বাগানের মালিক কর্তৃপক্ষ ।তাইতো আমরা প্রায়ই দেখতে পাই ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষের ওপর শ্রমিকদের আক্রমণের ঘটনা ।সাহেবদের চাকরিরও কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। মালিক তাদের যেকোনো সময় বরখাস্ত করতে পারেন।  

চা বাগানের সাহেবদের  কম বেতন এবং বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার একটা মানসিক চাপ সবসময় থাকে বলে তাঁদের মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে হয়। 

 একদিকে শ্রমিকদের দাবি অন্যদিকে মালিকদের চাপ দুই দিক সামলাতে গিয়ে সহকারী ম্যানেজাররা সব সময় মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকেন।

পুজোর চারটে দিন বাগান বন্ধ থাকবে, সকলেই আনন্দে মেতে উঠবেন তাদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে। কিন্তু বাগান ছুটি থাকলেও ছুটি পাবেন না বাগানের ম্যানেজার ও সহকারী ম্যানেজারেরা অর্থাৎ সাহেবরা ।

কোন প্রত্যন্ত এলাকায় নিরিবিরি চা বাগানের বাংলোতে বসে পূজোর স্মৃতির রোমন্থনে ডুবে রইবেন এই সাহেবেরা।

 সকালের  ঘুম ঘুম ভাব দূর করার এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা কিংবা বিকেলের ক্লান্তি ও মনের চাপ নিরাময়ক  এক কাপ  চা তুলে দেবার পেছনে সবুজ গালিচা তৈরির যে কারিগরেরা রয়েছেন তারা কিন্তু আজও রয়ে গেছেন পর্দার আড়ালে ।শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল এই সাহেবদের জন্য ।ভাল থাক পর্দার আড়ালে থাকা গালিচা তৈরির এই হিরোরা । উত্তরের চা শিল্প আরও উন্নত হোক সাথে ভালো দিন ফিরে আসুক  সাহেবদের জীবনেও।

No comments:

Post a Comment