Monday, November 3, 2025


 


ভ্রমণ 


টিনটিনের দেশে এসে 

রণিতা দত্ত

সত্যি ই কি বড্ডো সাদামাটা ছিল আমাদের শৈশব, কৈশোর ? যারা ভাবেন তেমনটা, তারা ভীষণ ভুল ভাবেন। তখন হয়তো মস্ত এল সি ডির স্ক্রিনে বা মোবাইলফোনের ইন্টারনেটে এখন যা কিছু আছে তার বালাই ছিলনা। অথবা তখন যা ছিল, এখন অতিপাতি খুঁজেও তার হদিশ খুঁজে পাবেন না ।রিক্রিয়েষণ কি আমাদের ছিলনা? ছিল। বিনোদন বলতে ছিল সবুজ ঘাসে মোড়া খেলার মাঠে হুটোপুটি, সাদাকালো আখরে গল্পের বই। বরাদ্দ মাসিক কিছু পত্রিকা। শুকতারা, কিশোর ভারতী, আনন্দমেলা। বিশেষ পরিচিত জন কাকাবাবু সন্তু, প্রফেসর শঙ্কু, রুকু সুকু । মিথ্যে বলি কি করে ? সব থাকলেও আনন্দমেলার ঝলমলে কুড়ির পাতাটি মনকে সবচাইতে বেশি টানতো । দু'পাতা মাত্র। সে'জন্য সারা মাস অধীর আগ্রহের অপেক্ষা। রঙিন মন ছোঁয়া কমিকস স্ট্রিপে থাকতো টিনটিন।






ছোট্টখাটো চেহারার ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিস্ট এই টিনটিন। ফরাসীরা উচ্চারণ করে ত্যাঁত্যাঁ| দেশ তার বেলজিয়াম বটে কিন্তু 'বোম্বেটে জাহাজ'এ চেপে 'লোহিত সাগরে হাঙ্গর' ধরতে ধরতে 'কৃষ্ণদ্বীপে' পৌঁছে যান রহস্য ভেদ করতে। কখনো বা 'মমির অভিশাপ' ভ্রষ্ট হয়ে 'সূর্য্যদেবের বন্দী' হয়ে যান। 'ওটোকারের রাজদন্ড' হাতে নিয়ে 'ফ্যারাও এর চুরুট' ফুঁকতে ফুঁকতে 'সোভিয়েত দেশে' গিয়ে পৌঁছান। হয়তো 'কালো সোনার দেশে' যাওয়ার পথে 'কঙ্গো' আর 'তিব্বত'ও ঘুরে নেন। মহাকাশের 'উল্কা' ছুঁয়ে 'চন্দ্রলোকে' পাড়ি জমান টিনটিন । কিশোরী মন। কমিকস এডভেঞ্চারে বুদ। দুপাতায় সন্তুষ্টি। ওদিকে অজানা ছিল তথ্য যে আমাদের"আনন্দ মেলা'র তৎকালীন সম্পাদক কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী ই কিন্তু বাংলায় এই কমিকসের অনুবাদক। অনেকটা বড় হয়ে যখন জানলাম, তখন টিনটিন এডভেঞ্চারের এক একটা আস্ত বই ই পাওয়া যায়। আমাদের মত বাপ্ মা বই মেলায় উচ্ছসিত হয়ে কিনে দেন পরবর্তী প্রজন্মকে। আমরা পিছিয়ে যাই। প্রজন্ম এগোয়। বই চিৎপাত হয়ে কোথায় উল্টে পড়ে থাকে। চোখ তাদের আটকে থাকে টিভির কার্টুন শো তে। এখানে এসে এও জানলাম বাইকেলের মত হার্জের টিনটিন ও বহু ভাষায় অনুদিত বই । 







যুগ বিশ্বয়নের। ব্যক্তির স্থানিক অবস্থানটা খুব আপেক্ষিক। অতিসামান্য প্রয়োজন সাপেক্ষ্যে বদলে যায়। আমিই বা কিকরে এসে পৌছালাম বেলজিয়ামে। ব্রেসেলস । অদ্ভুত এক শহর। ফ্রান্স নেদারল্যান্ড আর জার্মানির ফোঁকোরে এমনি ভাবে ঢুকে আছে যে ডাচদের প্রভাব কোথাও রমরমে, কোথাও ফরাসিদের হম্বিতম্বী। জার্মানির সীমান্ত অল্প বলে ওরা খানিকটা নির্বিকার থাকে । টিনটিনের বাড়ির মার্লিন স্পাইক হলের ঠিকানাটা ভোলার নয় , 26, ল্যাব্রাডর রোড। তবে ব্রেসেলসের কোন কমিউনে এই রাস্তার অস্তিত্ব নেই মোটে। এদিকে আমার জামাতাটিও বেশ কার্টুন পাগল। ওর কাছেi জানলাম একটি গোটা মিউজিয়ামই নাকি আছে হার্জের কার্টুন ওয়ার্কের। সে খানিক দূরে এক ছোট্ট ছিমছাম শহরে ।একদিন সময় থাকতে লুভ্যেইঁ লা-নিউভ ( louvain-la-neuve) শহরের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। ওখানে ই সেই 'আর জে' র সারাজীবনে আঁকা কার্টুন সযত্নে রাখা আছে। রাস্তার দুপাশে রঙ বেরঙের পাতার খেলা। বিচিত্র বর্ণে সেজে রয়েছে সারিবদ্ধ পর্ণমচি। অপেক্ষা রিক্ত শূন্যপত্র হয়ে শীতের ৱ্যাপার মুরি দেওয়ার। শুনলুম ডাচদের ছিল এই লুভ্যেইঁ শহর। ফরাসীরা জমিয়ে বসে নামের আগে জুড়ে দিলে 'লা নিউভ' অর্থাৎ নতুন লুভ্যেইঁ। মিউজিয়াম বিল্ডিংটি নিজেই নিজের মত সুন্দর । ইতিউতি বিচ্ছিন্ন কিছু ম্যাপেল বন সামনে। আর জে যাকে জর্জ রেমি বলে ঠিক কেউই চিনবেন না, মানে আমাদের হার্জের একটি মূর্তি সেখানে। নিবিষ্ট মনে বসে স্কেচ করছেন। এক পাশে টিনটিন সঙ্গে কুট্টুস। মিউজিয়ামে প্রবেশ পথে বিশাল কাঁচের দরজা। সসম্ভমে নিজে থেকে খুলে গেল। যেন অতিথি অভিবাদন করে অভ্যার্থনা জানাচ্ছে। টিকিট কাউন্ডারের সামনে ই রাখা নানা এডভেঞ্চারের সাক্ষ্যি সবুজ জিপ গাড়িটা । মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্য মাত্র ২ ইউরো । সঙ্গে দিচ্ছে একটা করে অডিও ভিজ্যুয়াল ডিভাইজ। ল্যাঙ্গুয়েজ সেট করে নাও। তারপর শোনো,দেখ,ঋদ্ধ হও। ঋদ্ধ হওয়ার কথা কেন বললুম সে যখন মিউজিয়াম ছেড়ে ঘরমুখো হবো তখন আপনারাই বলবেন । মিউজিয়ামটি তিনতলা। টপফ্লোর থেকে প্রদর্শনী শুরু। টিনটিন যেন আর কেউ নন, স্রষ্টার নিজস্ব চরিত্রের চিত্রায়ন।প্রথম ঘরে ঢুকে ই হার্জে রেমির হাস্যজ্জ্বল একটি মুখ, যা ক্রমে মিলিয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠলো পেন্সিলের আঁকিবুকি। টিনটিনের স্কেচ। ওই ঘরের চতুর্দিকের দেওয়ালে আলোছায়ায় ছোটছোট বৃত্ত। বৃত্তে চলমান ছবি। একএক করে ছবি জীবন্ত হচ্ছে আবার মুহূর্তে পরিবর্তীত হচ্ছে। কখনো টিনটিন, কখনো ক্যাপ্টেন হ্যাডক, কুট্টুস তো আছেই তার পছন্দের হাড়ের টুকরোটি নিয়ে। আছেন আরও সব সঙ্গোপাঙ্গরা। সে এক বিচিত্র ঘোর লেগে থাকা মায়াময় পরিবেশ। এরপর থেকে যে ঘরে ই গেলাম সেখানে কাগজে আঁকা কমিকসের অরিজিনাল স্কেচ। কাঁচের শোকেসে কমিকসের গল্পানুক্রমে সযত্নে সংরক্ষিত। আমার গলায় ঝোলানো ডিভাইজে যে বিবরণী চলছে সে একই তথ্যচিত্র প্রতিটি ঘরের একটি দেওয়ালের স্ক্রিনে ও চলছে। প্রতিটি এডভেঞ্চার, তাদের প্রেক্ষাপট,সমসাময়িক থিম, আলোচনা সমালোচনা। এবারে দোতালায় এলাম। ওখানে ঘরের দেওয়ালে এক একটি চরিত্র ভিন্ন ভঙ্গিতে আঁকা। এই যেমন পাইপ ঠোঁটে টিনটিনের অভিন্ন হৃদয় নাবিক বন্ধুটি যিনি সিঙ্গেলমল্ট স্কচের প্যাশানেট সেই ক্যাপ্টেন হ্যাডক আছেন, আছেন গোলফ্রেমের চশমা নাকে ডগায় গুঁজে বেটেখাটো, কানেও বেশ খাটো, অথচ অংকে দর প্রফেসর ক্যালকুলাস।, মাথায় রাউন্ড ব্ল্যাক ক্যাপ, হাতে ব্যাঁকানো লাঠি এক্কেবারে অপদার্থ জোড়া গোয়েন্দা জনসন রনসনস গল্পে হাসির খোরাক জোগানো কাজ তাদের, আর ওই যে টিয়া পাখির ঠোঁটের মত নাক,কোকিল কন্ঠী মিলানের বিখ্যাত গায়িকা বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওকা বা আর ক্যাপ্টেন হ্যাডকের বাড়ির হাউজহোস্টেজ নেস্টর কিংবা জেনারেল আলেকজেন্ডার এদের মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমার সারিবদ্ধ স্কেচ। যদিও এরা এডভেঞ্চার কাহিনীর সহায়ক চরিত্র তবু কি তারা পাঠকের চেনা নন ? হার্জের তৈরী সহায়ক চরিত্ররা অবশ্যই মূলচরিত্র থেকে পরিচিতিতে জনপ্রিয়তায় খুব একটা খাটো নন। এডভেঞ্চার কাহিনী রূপায়নে চারিত্রায়ন এতো সাবলীল, প্রাঞ্জল যে প্রত্যেকের উপস্থিতি যেন কাহিনীটিকে নির্ভরযোগ্য ভাবে সঞ্চালনার জন্য অপরিহার্য। মনে গেঁথে ছিল সকলের কথা।হার্জে এই কমিক স্ট্রিপ সিরিজটি আঁকতে লিন ক্লেয়ার (ligne claire) নামের শৈলী ব্যবহার করেছিলেন বলে জানলাম।




এতকাল বিনোদন হিসেবে কমিকস পড়েছি। তবে সেখানে ও পেন্সিল স্কেচের ব্যাকগ্রাউন্ডে আপাত স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতির মত মূল উপাদান যেগুলোকে এড়িয়ে গেলে কোন শিল্পকর্ম ই কালোজয়ী হতে পারেনা। প্রকাশিত হলো হার্জের প্রথম কার্টুন কাহিনী "সোভিয়েত দেশে টিনটিন'।বলশেভিক বিপ্লবের যুগ ।পশ্চিমা বিশ্ব 'লাল আতঙ্কে' তটস্থ। কখন বা বিপ্লব ঘটে। খেটেখাওয়া মানুষের দখলে যায় ক্ষমতা ! ।হার্জে কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সমাজ তন্ত্রের নামে ভণ্ডামি তুলে ধরলেন।কার্টুন গল্পে দেখানো হলো মস্কোর রাস্তায় প্রকাশ্যে যারা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট বলে স্বীকার করছে শুধু তাদেরকেই সরকারি ত্রাণ দেওয়া ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নইলে লাইন থেকে লাথি মেরে বের করে দেওয়া হচ্ছে। লিখলেন,"তুমি এমন আস্তানায় এসেছ যেখানে লেনিন, ট্রটিস্ স্তালিন সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বহু সম্পদ জমিয়ে রেখেছে।” হার্জে টিনটিনের মুখ দিয়ে কতটা শক্ত থাকলে এই সংলাপ তিনি লিখতে পারেন। কার্টুন কাহিনীতে আসন্ন যুদ্ধের বারুদের গন্ধ। জার্মানরা বেলজিয়াম দখল করেছে।যুদ্ধের আবহে লেখা হলো "কাঁকড়া রহস্য "দ্য ক্র্যাব উইথ গোল্ডেন ক্লোস"। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ব্যঙ্গ আঁকাঝোঁকায় রূপ নিল কার্টুনে 'ওটোকারের রাজদণ্ড " কাহিনীতে। ক্রমে কলম পেন্সিল স্বাধীনতা হারালো। হার্জ যে সংবাদপত্রে কাজ করতেন, সেটি নাৎসি নিয়ন্ত্রিত । এই সময়ে টিনটিনের গল্পে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন হার্জ । কমিকস থেকে রাজনৈতিক উপাদান ছেটে ফেলেন।বেশি মনোযোগ দেন চরিত্রায়ণ, কাহিনী এসব দিকে । তবে "কঙ্গোর জঙ্গলে "কাহিনীতে বর্ণবৈষম্য সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রকাশ পাওয়ায় হার্জকে সমালোচনার মুখোমুখি করে। চোরাচলানকারীর পিছু ধাওয়া করে টিনটিন এল মিশরে। কাহিনী "ফ্যারাও এর সিগারেট"। সেখান থেকে টিনটিন এল ভারতে। এরপর এল চীনের সাংহাই শহরে।কাহিনী 'ব্লু লোটাস'। চীনে জাপানি দখলদাররা কিভাবে পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে চীনের জনগণের ওপর এ সত্য তুলে ধরে হার্জের কাহিনী হয়ে উঠলো চীনের এক অন্ধকার সময়ের দলিল।এভাবেই আলোচকদের বিশ্লেষণ চলছিল, সংশ্লিষ্ট তথ্য ও কিছু সমকালীন ছবি উপস্থাপনা চলছিল। যদিও একসাথে চোখে দেখা, কানে শোনা, দ্রুত ইংরেজি অনুধাবন কাজগুলো বেশ হেকট্রিক লাগছিলো। একটা গোটা দিন হয়তো প্রয়োজন ছিল ছোট্ট একরত্তি এই মিউজিয়ামটি বুঝে উঠতে। জানা ছিল না এমনি ভাবে কমিকস কাহিনীর প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনার চুলচেরা পর্যালোচনা হয়।কিভাবে 





  বিকেল ৫:৩০, অ্যালার্ম বেজেছে। এবারে মিউজিয়াম বন্ধ হবে। সুভিনির শপ থেকে দুটো পোস্টকার্ড নিয়েছি। এখন আন্তর্জালের যুগ। যদিও এমনি খেয়ালগুলো মানুষের কমেছে তবে  বিলুপ্ত হয়ে তো যায়নি। মিউজিয়াম দেখে ভালো লাগলো এতো কি আর বলবো। সম্পূর্ণ অন্য স্টাইলে প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ সমালোচনা আর ঘন্টা সাড়ে চার পেরিয়েছে কখন খেয়াল করিনি। শুকনো পাতার গালিচায় পা রেখে এগোচ্ছি। মর্মর শব্দ শুনছি। যখন এসেছি তখনও পাতার মর্মর শব্দ নিশ্চই হয়েছে কিন্তু আলাদা করে কানে তো আসেনি অবচেতন আর সচেতন দুই অবস্থার মাঝে ফারাক এই এতটুকু ই মাত্র।

No comments:

Post a Comment