Wednesday, November 12, 2025


 

আলোর উৎসবেও আঁধারে রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকেরা

মনোমিতা চক্রবর্তী


জলপাইগুড়ির তিস্তা বাঁধের পাশেই অবস্থিত রায়পুর চা বাগান, যে বাগানে বিগত সাত বছর ধরে সাইরেন বাজে না। কাঁচা চা পাতার গন্ধও বাতাসে ভাসে না। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, বয়ে নিয়ে এসেছে শরতের আগমনের বার্তা। সদ্য পেরিয়ে গেল বিশ্বকর্মা পুজা এবং বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসব। বিশ্বকর্মা পুজা, বোনাস,দুর্গা পুজা এবং দীপাবলি নিয়ে চা বাগানগুলোতে একরকম সাজো সাজো রব পড়ে যায়। তবে রায়পুর চা বাগানের দৃশ্যটা একটু অন্য রকম।

শরতের এক পড়ন্ত বিকেলে রায়পুর চা বাগানের চা শ্রমিক অভিষেক মুন্ডা জানান, ২০১৮ সাল থেকে এই বাগান বন্ধ। তাই এবারও বিশ্বকর্মা পুজো হয়নি বাগানে। বাগান যখন খোলা ছিল তখন বিশ্বকর্মা পুজোর প্রস্তুতি ছিল দেখার মত। আগের দিন থেকে চলত তার প্রস্তুতি পর্ব। পুজার শেষে সকলে মিলে খিচুড়ি খাওয়ার সেই দৃশ্য কি আর কখনো দেখা যাবে এই রায়পুর চা বাগানে ?      

আসলে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলো যেভাবে ধুঁকছে এবং একের পর এক চা বাগান যেভাবে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে উত্তরের অনেক চা শ্রমিকদের। তাই শরৎকাল এলেই উৎকণ্ঠা বাড়ে তাদের। কারণ চা বাগানগুলো হঠাৎ করেই পুজোর মুখে পাওনা বোনাস না মিটিয়ে দুম করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা আসলেই দুশ্চিন্তার কারণ।

জলপাইগুড়ির রায়পুর, সোনালী চা বাগান যেমন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ তেমনি সাম্প্রতিককালে বন্ধ হয়ে গেল আলিপুরের চিনচুলা চা বাগান ,জলপাইগুড়ির রেড ব্যাংক এবং সুরেন্দ্র নগর চা বাগান। এই মুহূর্তে তরাই, ডুয়ার্স এবং পাহাড় মিলে প্রায় কুড়িটিরও বেশি চা বাগান বন্ধ ।

পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের রক্তিম আভার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপর চা বাগান শ্রমিক করণ লোহার জানান, `বিগত সাত বছর ধরে বাগান বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। শ্রমিকদের অনেকেই বাগান ছেড়ে ভিন রাজ্যে কাজে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আমরাও সিজনের সময় আশপাশের বাগানে দিনমজুরি করে কোনক্রমে টিকে আছি। তবে বাগানের অফ সিজনে আমাদের দুর্দশার ঠিক থাকে না।`

কথা হচ্ছিল চা শ্রমিক রিংকী লোহার এর সঙ্গে। কথায় কথায় উনি বলেন, `মেয়েটি লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিল আমার। কিন্তু বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওকে আর পড়াতে পারলাম না। অন্য রাজ্যে পাঠিয়েছি কাজ করে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য।` কথাগুলো বলতে বলতে দুচোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি।

দীর্ঘদিন রায়পুর চা বাগান বন্ধ থাকার দরুন এখানকার চা শ্রমিকেরা যেমন যেমন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তেমনি তাদের জীবনযাত্রা হয়েছে অনিশ্চিত। বাগান বন্ধ থাকায় চা শ্রমিকরা যেমন অপুষ্টিতে ভুগছেন তেমনি নারী ও শিশুরাও ভুগছেন রক্তাল্পতা, ম্যালেরিয়ার মত অসুখে। চা শ্রমিকরা তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুইটি থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। 

আশেপাশের বাগানগুলিতে সিজন টাইমে কাজ থাকলেও অফ সিজনে বাইরের বাগানের শ্রমিকদের জন্য কোনো রকমই কাজ থাকে না প্রায়। আর সেই সময়টা রায়পুর চা শ্রমিকদের জন্য একরকম বিভীষিকাময় জীবন বলে মনে হয়।

রায়পুর চা বাগানের চা শ্রমিক সুশীলা কেরকাট্টা জানান, `দীর্ঘদিন ধরে স্বামী অসুস্থ, ফলে সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হয়েছে। আমার সামান্য উপার্জনে তিনজন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেয়ে যাই। বাড়ির কাজ সেরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গ্রামের দিকে যাই মাঠে আলু চাষের কাজ করতে। কখনো কখনো নদীর চরে বাদাম চাষ করার কাজেও যাই। সারাদিনের পর হাজিরা হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরি। সারা বছর কৃষিকাজ হয় না তাই সারা বছর কিন্তু রোজগার করার উপায়ও নেই আমাদের। যখন কাজ থাকেনা তখন খুব কষ্ট হয়। আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে তোলা কচু ,শাক, চা ফুলই ভরসা হয় তখন। সামান্য ডাল ভাত খাওয়াটাও মাঝে মাঝে আমাদের কাছে বিলাসিতা মনে হয়। কবে যে বাগান খুলবে ভগবান জানেন ! বাগানটা খুললে নিশ্চিত একটা আয়ের পথ খোলা থাকতো। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে জানেন। হতাশ হয়ে যাই । তবুও হার না মেনে এগিয়ে চলি। যদিও  প্রত্যেক বারের মতো এবারও আমরা বাগানের শ্রমিকরা টাকা একত্রিত করে ছোট করে দুর্গা পুজা করেছি। পুজার ওই কটা দিন জীবনের দুঃখ কষ্ট ভুলে সবাই একটু আনন্দ করেছি। সামনেই দীপাবলি, আলোর উৎসবে মেতে উঠবে গোটা দেশ। আমরাও মন খারাপ করে থাকতে চাই না। আমাদের জীবনে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও শুধু মাত্র একটু ভাল থাকার জন্য আমরা আমাদের মত করে সাধ্য মত দীপাবলির আয়োজন করব যাতে ছেলেপুলেদের মুখে হাসি ফোটে।`

রায়পুর চা বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে শুধু চা শ্রমিকদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসেনি, সঙ্গে চা বাগানের বাবু স্টাফদের জীবনেও কিন্তু বিপর্যয় নেমে এসেছে। রুটিরুজির তাগিদে তারাও হয়েছেন ঘরছাড়া। তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংসার চালাতে তারাও হিমশিম খাচ্ছেন। তারাও চাইছেন তাদের জীবনের এই অন্ধকারময় পরিস্থিতির অবসান হোক। দীপাবলীর আলোর উৎসবে যখন ভাসছে গোটা দেশ তথা রাজ্য, সেই সময়েও  অন্ধকারে পড়ে ছিলেন  রায়পুর চা বাগানের মত বন্ধ হয়ে থাকা চা বাগানগুলোর শ্রমিকেরা।

তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ থাকা বাগানগুলো পুনরায় খোলা হোক। সরকার অনেক চেষ্টা করেছেন এই বাগানগুলোকে খোলার। আবারও যেন সরকার এগিয়ে আসেন রায়পুর চা বাগানকে সচল রাখার জন্য। বাগানে ফের সাইরেন বাজুক ।কচি চা পাতার গন্ধে ভরে যাক ফ্যাক্টরি সহ পুরো বাগান। সুদিন ফিরে আসুক রায়পুরের চা বাগিচায়।

No comments:

Post a Comment