স্বপ্ন দেখায় চাঁদ
শ্রাবনী সেনগুপ্ত
হেমন্তের ভোর। আজ অনেকদিন পর মালতির ছোট্ট ঘরে পুরোনো ব্যস্ততার আঁচ। সক্কাল সক্কাল উঠোন নিকিয়ে দুটো মুড়ি দেবে মৃত্যুঞ্জয়কে। আজ সাত মাস পরে কাজে যাবে মানুষটা। আবার বাতের রোগে পঙ্গু শাশুড়ি হাঁক দিয়ে বলবে ' অ বৌ ! আমারে এট্টু বাইরে নে যা না , ছেলেটার খাওয়া দেখি'। আজ আর বিরক্ত হবে না মালতি , এককালের বিরক্তি উদ্রেক করা ডাক শোনার জন্য যে সে এতকাল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। অথচ আগেও এমনটা ছিলোনা , মালতির এই ছোট্ট সংসার। স্বামী,শাশুড়ি, দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গড়ে ওঠা তার এই ছোট্ট সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও সুখের অভাব ছিল না। রোজ সকালে দুটো পান্তা খেয়ে মাঠে চলে যেত ক্ষেতমজুর মৃত্যুঞ্জয়। লক্ষ্মীর বেশ কয়েকটি মৃত সন্তান প্রসবের পর, অনেক ধর্ণা,হত্যে দেওয়া,মানত,তাবিজ -কবজ করে জন্ম এই ছেলের। তখন রায়বাড়ির গিন্নিমা বলেছিলেন -'ওরে লক্ষ্মী তোর ছেলের নাম রাখ মৃত্যুঞ্জয় ,তাহলেই দেখবি ও মৃত্যুকে জয় করেছে’ । না হলে তাদের মতো সংসারে কে আর এইধরণের নাম রাখার বিলাসিতা করে। তাই সেই ছেলে সকালে কাজে বেরোনোর আগে যখন খেতে বসতো, তখন পঙ্গু মায়ের রোজকার বায়না ছিল সেই সময় তাকে উঠোনে নিয়ে যাবার। শতেক কাজে ব্যস্ত মালতী মুখ ঝামটা দিলেও তাকে ধীরে ধীরে এনে উঠোনের এককোণে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িতে বসাতো। মৃত্যুঞ্জয় কাজে চলে গেলে বাকি সব কাজে হাত লাগতো মালতী।
শাশুড়িকে নাইয়ে- খাইয়ে,ছেলে-মেয়েদের সামলে নিয়ে , বাড়ির হাঁস দুটোকে পুকুরে নিয়ে যেত। ঘরের সামনের এক চিলতে জমিতে সবজি ফলাতো। এরপর নিজে নেয়ে-খেয়ে দুটো মুড়ি ভাজতে বসতো। রায় গিন্নিমার বরাত দেওয়া চালের মুড়ি। যাহোক কিছু আয় তো হতো এই দারিদ্র্যের সংসারে ! মৃত্যুঞ্জয় দুপুরে বাবুদের ওখানেই খেত।
মৃত্যুঞ্জয় ফিরত সন্ধ্যেবেলা , হাট থেকে চাল-ডাল-তেল -আলু নিয়ে।তারপর সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে খেতে বসতো কুপির আলোয়। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কাজ সারতো মালতী। নাহলে কুপির তেল ফুরোবে। এই গ্রামে তাদের কয়েকঘরের ইলেকট্রিক আলো নেই। ভোটের আগে পঞ্চায়েতের বাবুরা প্রত্যেকবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, কিন্তু ভোট হয়ে গেলেই বাবুরা সব ভুলে যান। এতেও মালতির সুখের সংসারে কোনো ভাঁটা পড়েনি।
হঠাৎ করে সাতমাস আগে নেমে এলো করোনা নামের এক অলক্ষ্মীর কালো ছায়া। তার ধারালো অস্ত্রে খান খান হয়ে গেলো কতশত মালতীর সুখের সংসার। মৃত্যুঞ্জয়ের কাজ গেলো,বন্ধ হলো মালতীর মুড়ি বেচাও। এই সাতমাস কি করে যে তাদের চলেছে, তা শুধু মালতীই জানে।কোনোরকমে বাড়ির হাঁসের ডিম্ বেচে , শাকপাতা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। ছেলে-মেয়ে দুটো আর পারছে না। গত একমাস ধরে শুধু পুকুরের গেঁড়িগুগলি আর শাকসবজি খেয়ে পেট ভরাতে হয়েছে। চাল কেনার পয়সা নেই। যাওবা খুদকুঁড়ো কিছু ঘরে ছিল, এখন আর তাও নেই। স্বামী, ছেলে-মেয়ে আর বুড়ি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাতে পারে না মালতী। মৃত্যুঞ্জয়ও যেন খুঁজে পায় না তার মালুকে। গরীবঘরের মেয়ে , বৌ, হয়েও তার মধ্যে ছিল এক ঢলঢলে ভাব , হাসলে কি মিষ্টি দেখাতো মুখখানা। এই ক'মাসে কি হতশ্রী চেহারা হয়েছে মেয়েটার, গালের হনু উঁচু হয়ে গেছে। মৃত্যুঞ্জয়ও কেমন যেন গুম মেরে গেছে। সে বলে - ' বৌ কি যে করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না রে। কোথাও কোনো কাজ নেই'।
কাল রাতে হঠাৎ করে বাবুদের বাড়ি থেকে ডাক এলো। পড়িমরি করে ছুটলো মৃত্যুঞ্জয়। গিয়ে দেখে কেষ্ট, কালী ওরাও জনাকয়েক এসেছে , সব দাঁড়িয়ে আছে দূরে দূরে। অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা কঙ্কালসার চেহারা। বড়বাবু সামনে আসেন নি , দোতলার জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন -' শোন্ , এখন ধান কাটার সময়, মাঠে লোক লাগবে,কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তো সকলকে একসাথে জমিতে ডাকা যাবে না,কয়েকজন কালকে কাজ করবি, বাকিরা তার পরেরদিন , এইভাবে চলবে'।
মৃত্যুঞ্জয়কে আজ মাঠে যেতে বলেছেন বাবু। তাই আজ মালতীর এত তাড়া। ঘরের এককোণে রাখা শূন্যপ্রায় মুড়ির টিন থেকে ঝেড়ে বেছে কয়েকটা মুড়ি বার করে দিয়েছে তার স্বামীকে। কাজে গেছে মৃত্যুঞ্জয়। ঘরে মালতী আশায় বুক বেঁধে ঘ্যান ঘ্যান করা মেয়েটাকে বললো-'এট্টুখানি সবুর কর মা,আজ তোকে ভাত দেব'। কচি মেয়ে তার মায়াময় মুখটা তুলে বললো -'সত্যি বলছো মা ?' শাশুড়ি ঘর থেকে বলে উঠলো - ' অ বৌমা, তার সাথে দুটো আলুসেদ্ধ দিস রে ,শাকপাতা সেদ্ধ খেয়ে মুখটা একেবারে মেরে এনেছে '। জানে মালতী কচি ছেলেটা এখনো বুকের দুধ খায়-- অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা মালতীর যে তাতেও টান। আবার দুশ্চিন্তা হয় ,হাড় জিরজিরে মানুষটা আজ ঠিকমতো কাজ করতে পারবে তো? আবার ভেবে আনন্দ হয়, যাইহোক আজ দুটো খেতে তো পাবে। আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো। আজ যেন সময় আর কাটে না। সে উদগ্রীব হয়ে আছে স্বামীর আসার আশায়।সামনে পূর্ণিমা, আকাশে ভরা চাঁদের আলো। মালতী দেখলো চাঁদের আলোয় ভরা পথ বেয়ে হেঁটে আসছে তার স্বামী , হাতে গামছা বাঁধা পোঁটলা। তার মনে হলো , হেমন্তলক্ষ্মী স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়ের রূপ ধরে আসছেন তাদের কুটীরে। তাড়াতাড়ি উঠোন থেকে নেমে এসে সে পুঁটলিটা হাতে নেয়। মেয়ে দৌড়ে আসে 'বাবা বাবা' বলে -। লক্ষ্মীর ডাক শোনা যায় ঘর থেকে - 'অ মিত্যু এলি বাবা'। মৃত্যুঞ্জয় মাথা-মুখের ঘাম মুছে বললো -'জানিস বৌ ,খুব কষ্ট হয়েছে আজ, তবে সব কষ্ট ভুলে গেলাম ঘরে এসে ,তোদের মুখ চেয়ে। আজ বেশ ভালো করে ভাত,ডাল,আলুসেদ্ধ রাঁধ দিকিনি। গামছার এককোণে একখান পেঁয়াজ আছে, আজ বাবুরা ছাতু দেছিলো, সঙ্গের কাঁচা পেঁয়াজটুক গামছায় বেঁধে নে এয়েচি,আলুসেদ্ধর সঙ্গে বেশ করে মেখে দিস অকণ'।মালতী বললো -'দেবো গো দেবো, আগে এট্টুস জিরিয়ে নাও দিকিনি ,সেই কোন সক্কালবেলা বেইরেছো'। মৃত্যুঞ্জয় দাওয়ায় বসে , বৌ তার জল এনে দেয় খাওয়ার জন্য। আর সে জল খেয়ে পুকুরে যায় হাত -পা ধুতে।
বেশ কিছুক্ষণ পর- উঠোনে জ্বলছে কুপির আলো , মাটির উনুনে হাঁড়িতে ভাত ফুটছে টগবগ করে , চারিদিক তার সুবাসে ভরপুর। উঠোনে বসে আছে সবাই। ছেলে হামা টানছে। মালতী বসে আছে উনুনের ধরে, মুখে হাসি, চোখে জল। আজ অনেকদিন পর তার পরিপূর্ণ সংসারের ছবি উঠোন জুড়ে। দূরে কোথায় যেন কার ট্রাঞ্জিস্টারে বাজছে রবি ঠাকুরের গান -'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে , উছলে পড়ে আলো /ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।'
জীর্ণ কুটীরে মালতী যেন কোথায় একাকার হয়ে যাচ্ছে এই গানের সাথে সাথে -- তার উঠোনে যেন আজ সত্যিই চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, চারিদিকে সুখের আলো উথলে পড়ছে। আর সে চাইছে যেন রজনীগন্ধার সৌরভ তার সংসারের অনাগত দিনগুলোকে ভরিয়ে তোলে , সব ঝড়- ঝঞ্জার হাত থেকে তারা যেন রক্ষা পায়। আজ কতদিন পর মৃত্যুঞ্জয় ফিরে পাচ্ছে তার 'মালু'কে -- তার সেই লাজুক মুখের হাসি একচিলতে কুপির আলোয় চাঁদের হাসির মতোই লাগছে। এইভাবেই হয়তো কবির কল্পনায় মালতীরা একাত্ম হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment