সফর এবং শীতট্রেন...
উদয় সাহা
'এইবার শীতে খুব ঠান্ডা পড়বে '... প্রতি বছর শীত আসবার প্রাক মুহূর্তে বাবা এই কথাটি বলে থাকেন৷ হেমন্তের হিমগর্ভের পরশটুকু পেতেই শুরু হয়ে যায় রাতের বেলা উষ্ণ জলে হাত ধোওয়ার রেওয়াজ। হাত ধোওয়া হয়ে গেলে হাতে পায়ে বোরোলিন মাখতে মাখতে অনেক গল্প করতেন বাবা৷ খাবারের পর একটা সিগারেট মাস্ট ছিল বাবার৷ একসময় খুব ভালো স্মোক রিং বানাতে দেখেছি বাবাকে৷ সে সব দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিন কানে ভেসে আসত নিউকুচবিহার স্টেশনে ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দ। সেই ট্রেনের আওয়াজ বাবাকে নিজের শৈশবে নিয়ে যেত। তখন এত রিক্সা টোটো অটো ছিল না। ঠাকুরদার হাত ধরে কনকনে শীতে হাফ প্যান্ট পরে পায়ে হেঁটে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট বা নবদ্বীপধাম। সেখান থেকে হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ। বাবার পৈতৃক ভিটে নবদ্বীপ। আর আমারো ট্রেনে করে কোচবিহার থেকে প্রথম বাইরে যাওয়া... ওই নবদ্বীপ৷ সেই সফর ছিল এরকমই এক শীতে৷
বাবা যখন বলেন পূর্বস্থলীর কথা, লক্ষীমপুরের কথা, পাটুলির কথা, অগ্রদ্বীপ স্টেশনের কথা, খাগড়াঘাটের কথা, বাজারসৌ স্টেশনের কথা, আমার তখন সেগুলো কেবল স্টেশনের নাম হিসেবেই মনে থাকে। কিন্তু বাবার? বাবার কাছে ছেলেবেলার কাদামাটি আর অতীত ধূসর পাথরকুচি। যাই হোক বাবা গল্প বলে চলেন আর আমি ভাবি ট্রেন মানে তো দূরে যাওয়া। ট্রেন মানে টিফিন কেরিয়ার, ফয়েল প্যাক, রুটি -পরোটা কিংবা লুচি-মাংস। মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙলে 'চায়ে গরম '। হাওয়ায় ফোলানো বালিশ। মশলামুড়িতে নাক উঁচু করা নারকেল একফালি। এই সবকিছু একসঙ্গে আমাকে জড়িয়ে রাখে ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে। সেই শব্দ ঝিমোনোর সাথে সাথে ধীরেধীরে ফুরিয়ে আসত বাবার সেদিনের মত গল্পকথা।
ট্রেন মানে শুধু দূরে যাওয়াই নয় দৌড়ে যাওয়াও বটে৷ এতগুলো শীত পেরিয়ে গেলেও সুযোগ পেলেই মনটা দৌঁড়ে চলে যায় ফেলে আসা ক্যালেন্ডারে।সহজ সরল গল্পকথার বাবার ছেলেবেলায়৷ ট্রেনে করে উল্টোডাঙা বাবার দূর সম্পর্কের মামাবাড়ি, নয়তো বেলেঘাটা পিসির বাড়ি৷ বাবা বলতেন বটে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্টের কথা, কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার হত না। পরিষ্কার হল তখন যখন প্রথম বাবার আঙুল ধরে কোলকাতা যাবার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে পাঁচ টাকার খয়েরী টিকিট কাটি। এসবই আমার শীতকালীন স্মৃতি৷ শীতকাল এলেই ঘুমের ঘোরে একটা স্বপ্ন-টিকিট পেয়ে গেলেই ব্যস! কু উ উ ঝিক ঝিক ঝিকঝিক... স্বপ্নে কোন ক্রসিং থাকে না। সোজা গন্তব্য। আমি, বাবা জানলার সিট আর খানেক বাদে বাদেই... অ্যাই, চা গরম! ... লেবু চা... ট্রেন থেমে যায় আমাদের বাড়ির উত্তরদিক থেকে আসা শেয়ালের হাঁকে। শীতের রাতে শেয়ালের ডাক অদ্ভুত শোনায়৷ মনে আছে যখন মা এর পাশে ঘুমোতাম। ভয়ে মা কে চেপে ধরতাম৷ মা বলতেন, ভয় নেই বাবা ঘুমো...
এখন আর ঘুমিয়ে থাকা হয়না। ঘুমের ভেতর ভয় মিশে গেছে। ঘুমের ভেতর বরফ। সেই বরফের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। পালকের টুকরোর মতো বরফ কুচি এসে পড়ছে জ্যাকেটে। ঝাড়ছি। তবু ঝড়ছে না। বাবা নিজেই এখন কাছে ডাকেন৷ পাশে বসি৷ আমি উষ্ণতা পাই৷ বরফের টুকরোর অক্ষর সাজিয়ে একটা শব্দ তৈরি করার চেষ্টা করি। বাবাকে বলি, আগামী শীতে আমরা পাহাড় যাব কিংবা মায়াপুরের নীল মন্দির... বাবা আরো একটু শক্ত করে ধরেন আমার হাতটা।
No comments:
Post a Comment