।। পাঠ প্রতিক্রিয়া।।
সন্ধ্যার পাখি: বিপুল আচার্য
জীবন বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এক জীবনে কখন কী হবে জানিনা কেউই। জানিনা বলেই অনেক সময় কিছু একটা ঘটে গেলে বিস্মিত হই। চেষ্টা করি সেটাকে ভুলে নতুন করে আবার শুরু করবার। কিন্তু মুশকিল হল, জীবনের ট্র্যাকে কোনও রিউইন্ড হয় না। হয়ত একটু সচেষ্ট হলে সেটা এড়ানো যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞতা অথবা অনিচ্ছা কিংবা অতল মনের টানাপোড়েনে বিদ্ধ মানুষ এমন অবস্থায় পড়ে যে, ঘটনা পরম্পরার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। এই ক্ষেত্রে দোষ কাকে দেওয়া যাবে? ভাগ্যকে নাকি ব্যক্তিকে? এই প্রশ্ন চিরন্তন।
লেখক বিপুল আচার্যের দ্বিতীয় উপন্যাস `সন্ধ্যার পাখি` প্রশ্নকেই উস্কে দিয়েছে। `স্ট্রিম অফ কনশাসনেস`-এর ঢংয়ে লেখা তাঁর এই উপন্যাসের নায়ক, একদা বিপ্লবী, বরেণ চ্যাটার্জির জীবনে অনেকগুলি শেড। তার কলেজ জীবনের সহপাঠিনী যাকে সে হয়ত আলাদা চোখে দেখত, ঘটনাচক্রে সে একদিন হয়ে গেল তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। বিপ্লবের ভূত তাড়া করছিল তখন বরেণকে। নিজেরও কিছু নেই। ফলে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বৌদি বিধবা হলে এবং সরকারি বদান্যতায় বরেণ চাকরি পেলে, তারা হয়ত অন্যরকমভাবে জীবন শুরু করতে পারত। কিন্তু বৌদি বরেণকে নিজের ভালবাসা বোঝালেও, তার বেশি কিছু করতে চায়নি।
চাকরি নিয়ে বরেণ চলে আসে উত্তরবঙ্গের ছোট্ট জনপদে। সেখানে তার পরিচিতি পেতে বেশিদিন লাগেনি। কেননা সে নিজে ছিল সুলেখক ও কবি। আবৃত্তির গলাও তার ভাল। ফলে শিবুদার মতো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের সাহচর্যে তার একটা সুন্দর জীবন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটাও নষ্ট হয়ে গেল যখন চিন্ময়দা, কালুদা, নিতাইয়ের মতো আপাত-ভদ্র মানুষেরা তার সঙ্গে তমালির জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিলেন। তমালিকে আগে থেকেই শিখিয়ে রাখা হয়েছিল। শরীরের ছলাকলায় পারদর্শিনী তমালি সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিল।
বিয়ের পর শুরু হল বরেণের একক সংগ্রাম। স্ত্রীর ব্যাভিচারিতা দেখেও তার কিছু করবার ছিল না। শেষ আশ্রয় ছিল তার সদ্যজাত পুত্রটি। তাকে ঘিরেই তার সব। আর পাশাপাশি নিজস্ব সৃজন। ছেলে বড় হয়ে চাকরি নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলে বরেণ আবার একা। কিন্তু এই সময় সে নিজস্ব মগ্নতায় ডুবে থাকা নিঃসঙ্গ একজন হলেও, জীবনকে দেখছে অন্যভাবে। আর সেখান থেকেই তুলে আনছে নানা মণিমুক্তো।
বিপুল আচার্যের উপন্যাসের গল্প এরকমই। কখনও ব্যক্তিকথনে আবার কখনও `থার্ড পার্সন ন্যারেশন`-এ গল্প এগিয়েছে। কখনই মনে হয়নি, উপন্যাসের প্লটে কোনও কিছু আরোপ করা হচ্ছে। বরং গল্পের বা উপন্যাসের প্রয়োজনেই যেন সেটি এসেছে।
চরিত্রচিত্রণেও বিপুলের মুন্সিয়ানা যথেষ্ট। কোনও চরিত্রকেই অচেনা মনে হয় না। এরা সকলে আমাদের আশেপাশেই থাকে। তবে বিপ্লবী, কবি বরেণ চাকরি পাওয়ার পর কিছুটা যেন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা হারিয়েছিল। ফলে তমালির মতো মেয়ে তার বাড়িতে গেঁড়ে বসতে পেরেছিল সহজেই। এখানেই ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, বরেণ কেন এতটা দুর্বল হয়ে গেল? তার মনের অতলে কি তমালির জন্য কোনও অনুভূতি আগেই তৈরি হয়েছিল?
লেখক বিপুল আচার্যের বাক্যবিন্যাস ও শব্দচয়ন নিয়েও কোনও প্রশ্ন উঠবে না। বরং যে দার্শনিক তত্ত্বে উপন্যাসটি শুরু হয়, সেটি প্রমাণ করে লেখক সাধারণ ধারণার বাইরে গিয়ে একটু অন্য পথে হাঁটতেই অভ্যস্ত। `তোর জীবন যাপনের সাথে আমার এই জীবনের বহমানতার যে কত মিল তোকে কি করে বোঝাবো? সত্যি বলছি রে জীবনটাকে আমার গুণপনার নিদর্শন দিয়ে বোঝাতে পারলাম না কোনদিন`- এই জাতীয় লাইন বহুক্ষেত্রেই রয়েছে। আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সুপ্তির গভীর থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য কথন।
অক্ষরবিন্যাস প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রচ্ছদ করেছেন রজত দাস। উপন্যাসের থিমের সঙ্গে একদম মানানসই ছবি ও রঙের সুন্দর ব্যবহার গ্রন্থটির মর্যাদা বাড়িয়েছে। বইয়ের কাগজ ও মুদ্রণ যথেষ্ট ভাল। অক্ষবিন্যাস নিজেদের সুনাম বজায় রেখেছেন।
আলোচক- শৌভিক রায়
No comments:
Post a Comment