Friday, January 3, 2025


 

মুনা 

অনলাইন পৌষ  সংখ্যা ১৪৩১

সম্পাদকের কথা

আবার নতুন। আবার শুরু। বিগত বছরের হিসেবে যদি ধরি, তবে কিন্তু না পাওয়ার ওজন হবে বেশি। না, জাগতিক কিছু পাওয়ার কথা বলছি না। আমরা পাইনি বিচার, আমরা পাইনি নিরাপত্তা। আমাদের মনুষ্যত্ব আমাদের ত্যাগ করেছে। চরম স্বার্থপর হয়ে উঠেছি আমরা। বুঝে নিতে চেয়েছি নিজেদের টুকু। ফল? হারিয়েছি বিবেক, হারিয়েছি নিজের চোখে চোখ রেখে তাকাবার সাহস। এরপরেও কি বলব না না পাওয়ার পাল্লা ভারী? প্রত্যাশা তাই আগামীকে ঘিরে প্রচুর। এরকমই হয়। বছরের শুরুতে আমাদের আশার পারদ থাকে উর্ধমুখী। এটুকুই সম্বল আমাদের। আর তো বিশেষ কিছু নেই। শুধু আশাতেই থাকা। বাকি আর যা কিছু, সব শুধু নিজস্ব ভাবনায় জারিত হওয়া। আগামী শুভ হোক, সুন্দর হোক। ফিরে আসুক মানবতা। 


 মুনা 

অনলাইন পৌষ  সংখ্যা ১৪৩১



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা

প্রচ্ছদ- মহঃ সানোয়ার     

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা  

 চিত্রা পাল, বেলা দে, শ্যামলী সেনগুপ্ত 

সুদীপ মজুমদার, গৌতমেন্দু নন্দী, কবিতা বণিক, 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, সঞ্জয় সাহা /এস. সাহা,  

মৌসুমী চৌধুরী, লীনা রায়, Bakyawala-বাক্যওয়ালা, 

মনোমিতা চক্রবর্তী, আকাশলীনা ঢোল, সুদীপা ঘোষ, 

প্রাণজি বসাক, শুভেন্দু নন্দী, অশোক কুমার ঠাকুর,

মাথুর দাস, দেবর্ষি সরকার, অমিতাভ চক্রবর্ত্তী,

তন্ময় ধর, রাজর্ষি দত্ত, প্রতিভা পাল,

সারণ ভাদুড়ী, প্রাণেশ পাল, গৌতম সমাজদার, 

কল্যানী মন্ডল, রীতা মোদক, অসীম মালিক,

মহঃ সানোয়ার, সুনন্দ মন্ডল, দীপাঞ্জন দত্ত,

আশীষ কুমার চক্রবর্তী, সুস্মিতা ঘোষ, বিজয় বর্মন,

সম্মিলিতা দত্ত, সবুজ সরকার, অপর্না ঘোষ, পম্পা ঘোষ


মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪৩১



 

প্রকাশক রীনা সাহার  কলাম 


" গোবরাচরণ গড়করি বনাম কবিবাজ লবি "


            আপনারা তো জানেন গোবরাচরণ গড়করি আমার গো- ব্যবসায়ী কবি বন্ধু। ইধারকা গরু উধার করার পাশাপাশি সাইড এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে কবিতাও লেখেন। এই লাইনে অবশ্য আমিই ওনাকে এনেছিলাম। আমারই অনুপ্রেরণায় ওর একটা ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছিল। তাতে ওর লেখা কয়েকটা কবিতা পোস্ট করে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন যেতে না যেতেই লাইক - কমেন্টের বহর দেখে উনি এতটাই হামলে লিখতে লাগলেন যে নানান পত্রপত্রিকায় ছেয়ে গেলেন। ভুলভাল, ছাইপাশ লিখে কেমন করে যেন "কবিশ্রী" উপাধিও পেয়ে গেলেন। সেই গোবরাবাবু একদিন সকালে আমার কাছে এলেন একটা আবদার নিয়ে। আর জি কর আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে রাজ্য অনুরাগী কবি - সাহিত্যিকরা নাকি একটা মিছিল বের করবেন এবং সেই মিছিলের ব্যানারে যে লেখাটা ছাপবে সেটা আমাকে লিখে দিতে হবে। কিন্তু স্কুল টিচারদের এসব করা একেবারেই উচিত নয় বলে বললাম, `আপনিও যতটা পারবেন এসব থেকে দূরে থাকবেন দাদা।`  উনি ইতস্তত করে বললেন, `আসলে এই মুহূর্তে বর্ডার সিল। গরুপাচার বন্ধ , ব্যবসাপাতিও নেই। ইদানিং কবিতা- টবিতাও তেমন পাচ্ছে না। তাই সরকারের হয়ে একটু পোতিবাদ, টোতিবাদ করে নেতাদের নেক নজরে থাকতে চাইছি। তা আপনি একেবারে জল ঢেলে দিলেন স্যার !` 

      এরপর বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। উনি যে অঞ্চলে থাকেন সেই গোবরাছাড়া অঞ্চলের শাসকদলের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। কবি, কবিশ্রী, গো ব্যবসায়ী আবার অঞ্চল প্রধান --- এক ব্যক্তি, অনেক পদ। তাই ওর ওপর পার্টির লোকের ক্ষার। তাছাড়া এ বছর ওনার অঞ্চলের উদ্যোগে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।  ওই সময়ই একদিন বিকেলে গোবরাবাবুর স্ত্রী গোমতী বৌদি কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বাড়িতে ছুটে এলেন। কান্নার আওয়াজ পেয়ে আমার স্ত্রী গজগামিনী রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে আমাকে দরজা খুলতে আদেশ দিয়ে নিজে প্রায় মিনিট পাঁচ পরে এলেন। স্নেহময়ী ডান নিতম্ব আর বাম নিতম্ব হেলিয়ে দুলিয়ে যেই না তিনি এলেন আর অমনি গোমতী বৌদি ছুটে গিয়ে দুহাতের বেড়ে ওকে জড়াতে চাইলেন। কিন্তু ডাহা ফেল মেরে অগত্যা ওর বুকেই মুখ গুঁজে মরা কান্না জুড়ে দিলেন। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, আপনার গোবরাবাবুকে গতকাল রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার। ওকে নাকি সুপারি কিলার দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শাসকদলের প্রধানকে অপহরণ ! শুনে তো আমরা থ !

      মূল ঘটনা দুটো । একটা রাসমেলা মঞ্চে কবি, সাহিত্যিক নির্বাচন নিয়ে আয়োজক কমিটির সঙ্গে গোবরাবাবুর মতানৈক্য। আর একটা বইমেলা মঞ্চে কবিতা পাঠে চান্স পাওয়া নিয়ে। রাসমেলা শুরুর দিনকয় আগে থেকেই নাকি গোবরাবাবুর বাড়িতে মিটিং চলছিল। সেখানে ঠিক হয় নতুন হোক বা পুরনো, চুলকানির আরাম অনুযায়ী কবি, সাহিত্যিক সিলেক্ট করা হবে। সেইমতো অঞ্চলে অঞ্চলে মাইকিং করা হল। কেউ ময়ূরের পালক, কেউ সরু বাঁশের কঞ্চি, কেউ পাতলা বাঁখারি , কেউ পাটকাঠি, কেউ পায়রার পালক আবার কেউ প্লাস্টিকের হাত নিয়ে রেডি। আমাদের গোবরাবাবু আবার সর্ব ঘটে বিল্বপত্র ! ওনাকেও কবিতা পড়তে হবে।  একবার বর্ডার পার করাতে গিয়ে বি এস এফের লাঠির মারে গমিত শা নামে একটা গরুর শিং ভেঙে গিয়েছিল। গমিত শা ওর অন্যতম ফেভারিট গরু। ওই শিংটাই উনি চুলকানির জন্য ট্রাঙ্ক থেকে বের করেছেন। গোরক্ষপুর থেকে নাদুসনুদুস বাছুরটা কিনে এনে বড় করেছেন। তাই ভাঙা শিংটা প্রাণে ধরে ফেলতে পারেননি।

যাহোক গোবরাবাবুর বাড়িতেই চুলকানির দিনক্ষণ ঠিক হল। বেশ ভালই চলছিল চুলকানির পালা। কিন্তু গুবলেট হয়েছে ওই শিংটার জন্য। অন্য কারও চুলকানিতে তেমন কিছু না হলেও গোবরাবাবুর শিংয়ের চুলকানি খেয়ে বেদু কাঁচি নামে আয়োজক এক কত্তা ব্যক্তি মারাত্মক ইনফেকশন হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ওকে নাকি জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিতে হচ্ছে! সেজন্য মহিলা কবিদের শিরোমণি যাদবী দাসীর এতটাই টিক্কি খাঁড়া যে গোবরাবাবু নিজের অঞ্চলের রাসমেলা মঞ্চেই কবিতা পড়ার ডাক পেলেন না।

     তবে সে যাত্রায় অল্পের ওপর দিয়ে গেলেও এবার আরও চরম ঘটনা নিয়ে গোমতী বৌদি হাজির।  বইমেলা মঞ্চে আবারও সেই নতুন- পুরনো আকচাআকচি ! এবার কম্পিটিশনের বিষয় পিঠ চাপড়ানো। যে যতো আলতো করে চাপড়াবে তার কবিতা পাঠের চান্স ততো বেশি। তাছাড়া নামকরা দুটো পুরস্কারও দেওয়া হবে। সেইমতো বইমেলা শুরুর দিনকয় আগে থেকেই কবিরা মিলে পালা করে আয়োজকদের বাড়ি গিয়ে চাপড়াতে শুরু করেছে। গোবরাবাবুও কুবীর বাউদিয়া নামে এক কেউকেটাকে চাপড়াতে গেছেন। প্রথমেই হুইস্কি খাইয়েছেন তারপর এমন চাপড়েছেন যে সেই টাল কেউকেটা দমবন্ধ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি । এর পরই নাকি গোবরাবাবু কিডন্যাপড্ ! 

পরদিন সকাল থেকে গোমতী বৌদি একবার নার্সিংহোম আর একবার বইমেলা কমিটির আয়োজকদের কাছে দৌড়ে কূলকিনারা না পেয়ে বিকেলে আমার কাছে ছুটে এসেছেন। তখনকার মতো বৌদিকে শান্ত করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরতি পথে আমার পরিচিত দু' একজন কবিকে ফোন করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারছে না দেখে থানায় যাবো ভাবতেই বৌদির ফোন। দাদা এক্ষুনি আসুন, ওকে খুঁজে পাওয়া গেছে। গিয়ে শুনি গোবরাবাবু নাকি বেজায় ভয় পেয়ে ওরই গোয়াল ঘরে লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন গমিত শা নামে গরুটার লেঙ্গি খেয়ে কোমরে চোট পেয়ে গোবর- চনায় মাখামাখি হয়ে পড়েছিলেন। হুঁশ ফিরতে শুনতে পান ওর গোয়াল ঘরের বাইরে তালা মেরে কারা যেন ফিসফাস করছে। পালাবে কোথায় মা কালি ! ব্যাটাকে এখানেই পাকড়াও করতে হবে। শাসক দলের প্রধান হয়ে গোরু পাচারের কারবার এবার ঘুচিয়ে দেওয়া হবে। হারামজাদা আবার কবিশ্রী ! 
 
     সেই থেকে গোয়াল ঘরেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন গোবরাবাবু। গোমতী বৌদিকে ডেকে যে বলবেন তালা ভেঙে বের করতে সেটাও পারছিলেন না। তবে ওর এইসব কিত্তিকান্ডে বৌদি বেজায় চটেছেন। একেবারে থার্ড ডিগ্রির হুমকিতে বলে দিয়েছেন, অনেক হয়েছে, এবার কবিতা লেখা বন্ধ। গোরুর ব্যবসা করলেও পাচার করা চলবে না। এসব ভিমরতি না ছাড়লে বৌদি নাকি  লালমনিরহাট চলে যাবেন। বাপের বাড়ি থেকে আর কখনও ফিরবেন না। আসলে বৌদির বাবা গোবরাবাবুর ব্যবসার পার্টনার ছিলেন। সেই সুবাদেই বৌদির সঙ্গে প্রেম। একবার গোরু বেচে ফিরে আসবার সময় ওই ক্যান্টারেই বৌদিকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছিলেন।এপারে এসে একেবারে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে খবর দিয়েছিলেন। 

বৌদির হুমকিতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গোবরাবাবু মিনমিন করে বললেন, এই সময় বাংলাদেশে যেও না, এক্কেরে কোতল হয়ে যাবে। বৌদি আমার জন্য চা করতে গেছিলেন। তা না করে রান্নাঘর থেকে বেলনা নিয়ে ছুটে এলেন , শোনো এটা কিন্তু তোমার কবিতা পাঠের মঞ্চ নয়, আমার বাড়ি। এখানে চুলকানি, চাপড়ানি চলবে না। একেবারে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবো।
 
বেচারা আমি তখন গোবরাবাবুর গোরুর খাঁটি দুধের চা খাওয়ার লোভে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মধ্যস্থতা করছি আর বিষ্ণুমাতাকে ডাকছি। আর উনি আমাকে ঢাল করে ফুট কেটে চলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ কবিতার কি বুঝবে ! ওরা তো কবিতাও আমদানি করে !

তারপর আমাকে বললেন , স্যার আমার জন্য আপনার মাঝে মাঝেই খুব ভোগান্তি হয়। এবার থেকে চুলকানি, চাপড়ানি সব বাদ। শুধু কাঠি করবো। যা বুঝলাম কবিতা পাঠে চান্স পাওয়ার ওই একটাই রাস্তা, কাঠি করা। আমার এত বছরের গরু কেনাবেচার অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝলাম, চুলকানি,চাপড়ানি এসব নতুন টেকনিক। বেশিদিন চলবে না স্যার। চলবে ওই বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা কাঠিবাজি। 

আমি আর কি বলি ! গোরু কেনাবেচার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বৈদিক যুগের মেলবন্ধন ! কোনোমতে হাসি চেপে স্বগতোক্তি করলাম, কাঠিবাদ জিন্দাবাদ। সামনে বললাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে দাদা। গজগামিনী নিউ ইয়ারের কেনাকাটা করতে যাবে। ওকে আবার গার্ড দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। পাড়ার কয়েকটা কুকুর নাকি ওকে দেখলেই পেছন ধরে !



 


স্মরণ 


শতবর্ষে মোহিত ঘোষ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

"এই জীবনের ঘুর্ণিপাকে কাটিয়ে দিলাম জীবনটাকে।"

কালজয়ী এই কবি ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ২০২১ সালে তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হয়।

সাদা ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত, সদালাপী, সদাহাস্যজ্বল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছড়াকার, অমৃতলোকে যাত্রার কয়েক ঘন্টা আগে এই এস ত্রম এস বার্তাটি লিখে পাঠিয়েছিলেন,বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক উমেশ শর্মার মোবাইলে। জীবনের ঘূর্ণাবর্তে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সম্মৃদ্ধ করে শেষ কয়েকটি দিন চিকিৎসার কারণে জলপাইগুড়ির একটি বেসরকারী নার্সিং তিনি  হোমে ভর্তি ছিলেন।  তিনি কেমন আছেন জানতে চাইলে সিলিং ফ্যানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, " এই ফ্যানে ভাতে আছি। " অর্থাৎ  মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে আর নিচে বিছানায় ভাতের থালা নিয়ে  বসে তিনি ভাত খাচ্ছেন।  প্রতিদিনই অগণিত গুণমুগ্ধ মানুষ তাঁকে দেখতে আসছেন। কিন্তু তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। তার টেম্পল স্ট্রিটের বাড়ির চিত্রটাও একই রকম ছিল। 

অত্যন্ত সদালাপী,  আলোকময় মানুষ ছিলেন। এমন ব্যাতিক্রমী মানুষ আমি জীবনে দেখি নি। সদাই ছন্দের জগতে তাঁর বিচরণ। তিনি তার কলমে বাংলার সাহিত্য ভান্ডারকে আমৃত্যু সম্মৃদ্ধ করে গেছেন। তার লেখা ছড়া গুলো এইরকম। 

" আমাদের বাড়ি বাপু জলপাইগুড়ি 
শীত বুড়ি শুয়ে থাকে দিয়ে লেপ মুড়ি। "

"শালিকপাখি শালিকপাখি তুই আকাশের মালিক নাকি ? 
মেলে দিয়ে রঙিন ডানা,চষে বেড়াস আকাশ খানা।"

"সিঙ্গাড়ারে সিঙ্গাড়া, তোর যে দেখি সিং খাড়া।
গা'টা বেজায় খসখসে, হাঁটু মুড়েই রোস বসে।"

"ডালপুরি চাই ডালপুরি 
টাকায় বিকোয় এককুড়ি।"

"টিং টিং বাজে বেল
ওই চলে সাইকেল। 
চাকা দুটো ঘুর ঘুর 
নিয়ে যায় বহুদূর। "

"ঢুকতে বাড়ির ভেতর দিকে
খুব হুশিয়ার কুকুরটিকে। "

"ছড়া বনাম ছড়া বুনন
চলে বটে যখন তখন।"

"পাখিদের মধ্যে কোকিল 
মানুষের মধ্যে উকিল 
দুইয়েরই খুব নড়ে ঠোঁট 
দু'টির গায়ে কালো কোট।"

"হাঁচিতে হাঁচিতে গেছিনু কাশিতে
একটি বছর আগে
কাসিতে কাসিতে আসিনু কাশিতে
সাহিত্য অনুরাগে।"

"হয় অকাজে নয় বা কাজে 
টিপলে বোতাম ঘন্টা বাজে।"

"আসতে যেতে মনের ভুলে 
রেখো না কেউ গেটটি খুলে। "

"ছড়া অত সস্তা নাকি
রেশন চালের বস্তা নাকি 
দিস্তা খানেক কাগজ নিয়ে 
তিস্তা নদীর পারে গিয়ে 
কলম খুলে ভাবলে পরে
তবেই ছড়ার ছররা ঝরে। "

"ফুলঝুরি ফুলঝুরি 
আঘাতেতে সুড়সুড়ি 
ছোটো ছোটো ফুলকি
সোনা রঙা উলকি।"

"এবার পুজোয় শুনছি দাদা
আছে জবর খবর 
শান্তিটাকে কবর খুঁড়ে
দিচ্ছে কারা কবর।"

তার বাড়ির গেটে, ফুলবাগানে, ঘরে ঢোকার মুখে, লেটার বক্সে এবং বিভিন্ন স্থানে এক একটা ছোট ছোট সাইনবোর্ডে লেখা দু'লাইন চার লাইনের মজাদার ছড়া সকল দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করত।

এককথায় মাটির মানুষ ছিলেন কবি মোহিত ঘোষ। সদাই ছন্দের জগতে তার বিচরণ। ১৯৯৭ সালে দিল্লি থেকে কর্মসুত্রে জলপাইগুড়ি এসেছিলাম। নতুন পাড়ায় থাকবার সুবাদে সেখান কার কয়েকজন শিক্ষাব্রতী দের পরিচালিত "শিশু বিদ্যা মন্দির" নামে একটা শিশুদের স্কুল ছিল। সেই স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি ছিলেন কবি মোহিত ঘোষ। শিশু বিদ্যা মন্দিরের সব সভাতেই তিনি উপস্থিত থাকতেন। ১৯৯৮ সালে  শিশু বিদ্যা মন্দিরের বার্ষিক সাধারণ সভাতেই তাঁর সাথে আমার আলাপ।

সাদা ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত সদা হাস্যময় এই মানুষটিকে দেখলেই জাগতিক সব দু:খ কষ্ট লাঘব হয়ে যেত। সময় পেলেই তাঁর টেম্পল স্ট্রিটের বাড়ি "ছন্দবীথি" র কাঠের গেট খুলে তাঁর বসবার ঘরে বসতাম। তিনি বলতেন, "জীবনের সব কিছুতেই হ্যাঁ বলতে পারলেই,সব ছন্দে চলবে, না বললেই ছন্দপতন ঘটবে।"  সারাজীবন ধরে তিনি তাঁর সব লেখাতেই সদর্থক ইতিবাচক বার্তা দিয়ে গেছেন।

প্রাতঃস্মরণীয় এই কবিকে দেখলেই বোঝা যেত তিনি ছন্দের জগতে বিচরণ করছেন। জাগতিক দু:খ কষ্টের বাইরে থাকা এক অসাধারণ কল্পনার জগতে তাঁর সদা বিচরণ ছিল।  এই জগতের ঘূর্ণিপাক থেকে দূরে থাকা এই মানুষটিকেও জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর প্রিয় সাধের নীড় "ছন্দবীথি" এখন আর নেই। সেখানে নির্মীয়মান বহুতলের সামনে দাঁড়ালে বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে।


 

প্রবন্ধ 


মই পূজা

শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

আমাদের বাংলার প্রতিটি মাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নানান লোক সংস্কার ,উৎসব।এই উৎসবগুলো পুরোনো বছর থেকে নতুন বছরে বহমান। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলের এমনই একটি লোকৎসব মই পূজা।এটি অনুষ্ঠিত হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। কৃষকেরা জমিতে হল কর্ষণের পর জমির মাটি পাট করার জন্য বাঁশের তৈরি সাত/ আট ফুট লম্বা মই,লাঙল খুলে বলদের সঙ্গে জুতে দেন,এরপর কৃষক সেই মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে দুই বলদের পিঠে হাত রেখে চালাতে থাকেন এবং এইভাবে আস্তে আস্তে ক্ষেতের উঁচু নীচু সমান হয়।

                    এই উৎসবের কেন্দ্রে থাকে মই,আর কোনো দেবদেবীর মূর্তি এক্ষেত্রে পুজিত হয়না। ধান ঝাড়াই হয়ে গেলে সেখানে  গর্ত খুঁড়ে একটি মইকে পোঁতা হয়পৌষ সংক্রান্তির ভোরে।এই মইয়ের তলায় থাকে গরু বাছুরের চিত্রের আলপনা দেওয়া কাঠের পিঁড়ি।এরপর সেই পিঁড়িতে তুষ গোবর দিয়ে দুটি গোল নাড়ুর মতন  তৈরি করে বসিয়ে দেওয়া হয়।এই নাড়ুগুলির  উপর মূলো বা সর্ষে গাছের ফুল গুঁজে দেওয়া হয়।এই তুষগোবরের নাড়ু সদৃশ মূর্তিগুলোকে লক্ষ্মীদেবীর বারমূর্তি বলে।প্রধান দেবতা মইয়ের সঙ্গে অঙ্গ দেবতা হিসেবে থাকে দা কাটারি,দড়ি, ধামা ,কুলো,লাঙল ইত্যাদি।

                  এর কিছু আগে  ধানকাটার দিনের সঙ্গে যুক্ত হয় শুক সারি পূজা। গৃহকর্তা পুজোর দিন ভোরে স্নান সেরে ধান ক্ষেতের ঈশান কোণ থেকে ৩/৪ টি পাকা ধানের গোছ কেটে চুলের মতন বিনুনি করে সেগুলি মাথার উপর রেখে মৌনতা অবলম্বন করে বাড়িতে নিয়ে এসে ধানের গোলার গায়ে রেখে দেন।এর নাম হয় শুকপুরী। ধান কাটার শেষদিনে গৃহকর্তার জন্য বিশেষভাবে রেখে দেওয়া কয়েকটি পাকা ধানের গোছ কেটে এনে গৃহকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে ধান কাটার সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং এই বিনুনির মতন গুচ্ছ নাম হয় সারী। পৌষ সংক্রান্তির এই মই পুজো উপলক্ষ্যে শুক সারীর মিলনোৎসবও পালিত হয়। শুক সারীরূপী আলাদা দুটি বিনুনির মতন ধানের গুচ্ছকে ঐ মইয়ের সঙ্গে বেঁধে পূর্বোল্লিখিত পিঁড়ির উপর দাঁড় করানো হয়। এরপর সিঁদুর চন্দন ফুল দিয়ে সাজিয়ে পুজোর বিশেষ শুভক্ষণের জন্য অপেক্ষা করা হয়। এই অপেক্ষার সময়কাল দীর্ঘায়িত হতে পারে। দূর বনের মধ্যে থেকে শেয়ালের ডাক শোনা গেলে পুজো শুরু হয়। এক্ষেত্রে শেয়াল ক্ষেত্রদেবতা  আর শুকসারী সুখের প্রতীক।মই দেবতাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে পুজো শুরু হয়। পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় নতুন চালের চিঁড়া আর খেঁজুরের গুড়, এছাড়া থাকে আদা ও কিছু ফলমূল, যেমন পাকা কলা, রাঙ্গালু, কুল ইত্যাদি। 

এই উৎসবটির সঙ্গে তুষ তুষালি ব্রতের ছড়া যুক্ত হতে দেখা যায়। যেমন-  তুষলী গো‌ রাই/ তুষলী গো মাই / তোমায় পুজিয়া আমি কি বর পাই / অমর গুরু বাপ চাই/ ধন সম্ভারে মা চাই / রাজেশ্বর স্বামী চাই/ সভা আলো জামাই চাই/সভা পন্ডিত ভাই চাই/দরবার সভা বেটা চাই/ সিথের সিঁদুর দপদপ করে/ হাতের নোয়া ঝকঝক করে/ আলনায় কাপড় দলমল করে/ ঘটি বাটি ঝকমক করে/ সিঁথির সিঁদুর মরাইয়ের ধান/ সেই যুবতী এই বর চান ইত্যাদি। 


 

প্রবন্ধ 


দর্শন ও কবিতা 

 কবিতার সৃষ্টিতে দার্শনিকদের প্রভাব ও রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ 

                                    সঞ্জয় সাহা /এস. সাহা 


সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্যকে জানার এবং যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে দর্শন । অবশ্য দর্শনের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । আজ পর্যন্ত দর্শনে যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দার্শনিকরা দিতে পারেননি ।এর কারণ দর্শন এক সর্বব্যাপক শাস্ত্র,জগৎ ও জীবনের এমন এক দিক নেই যা দর্শনের আলোচ্য বিষয় নয় । দর্শনের স্বরূপ কি? প্রশ্নটি দর্শনের একটি মৌলিক প্রশ্ন । প্রশ্নটির চরিত্র থেকেই দর্শনকে জ্ঞানের অপর শাখা থেকে পৃথক করা যায় ।বিজ্ঞানের স্বরূপ কি ? এই প্রশ্ন বিজ্ঞানে তোলা হয় না বা বিজ্ঞান বিজ্ঞানের স্বরূপ আলোচনা করেনা , একজন ইতিহাসবিদও ইতিহাসের স্বরূপ কি? এই প্রশ্ন বিবেচনা করেন না।কিন্তু দর্শনে এই প্রশ্ন তোলা হয়। দর্শন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে ।

   বিষয়বস্তুর বৈচিত্রের জন্য দর্শনের একটি সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । এটি দর্শনের স্বরূপগত সমস্যা । জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন দিক আছে । দার্শনিকরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন একটি দিকের ওপর গুরুত্ব দেন । বিভিন্ন দিক থেকে অদ্ভুত সমস্যা নিরূপণ করেন, সমস্যার উপর আলোকপাত করেন এবং তার ভিত্তিতে দর্শনের সংজ্ঞা দান করেন । প্লেটো বলেছেন, "বিস্ময় দর্শনের জনক "। বিস্ময় থেকে জন্ম নেয় দর্শন চিন্তা । জগৎ সম্পর্কে মানুষের মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগে ___এই জগৎ কিভাবে সৃষ্টি হল ? এই জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা আছে কি ? জগতে যে নিয়মশৃঙ্খলা দেখা যায় তার নিয়ন্ত্রণ কর্তাকে ? জগতের উপাদান কি ? ইত্যাদি । আবার এই জগতে জন্ম- মৃত্যু ,দুঃখ -কষ্ট দেখে মানুষ বিচলিত হয় । মানুষ এই ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে যেমন খুঁজেছিলেন গৌতম বুদ্ধ ।

     কবিদের চিন্তাশক্তির বৈচিত্র্যের জন্য কবিতার একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । কবিতার জগতে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আছে কবিতার সংজ্ঞা বোঝাতে গিয়ে প্রাচীনের গল্পের কথা মনে পড়ে যায় গ্রিসের গল্পে এক অদ্ভুত নারীর মূর্তি দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে তুলেছিলেন এক ভাস্কর শিল্পী । তাঁর দাবি ছিল কবিতা নয়, ভাস্কর্যই শ্রেষ্ঠ শিল্প । পাথরের প্রতিটি দানা খোদাই করে অবশেষে সত্যিই যখন মূর্তিটি সম্পূর্ণ হল, ভাস্কর তখন নিজের শিল্পে নিজেই মুগ্ধ হয়ে বললেন "আহা কবিতা !"

    এই যে অসাধারণ সব শিল্প মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতার মত মনে হওয়া কবিতায় যেন এক নিরন্তন উত্তর খোঁজার প্রয়াস । আমরা আমাদের অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশকে আমরা কবিতার সঙ্গে তুলনা করেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই । এই কারণে রবীন্দ্রনাথ হয়তো তার কবিতায় শিল্পপ্রয়াসকে মানুষের অন্তর্লোকের সর্বাধিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং মানব প্রকৃতির সঙ্গে বিশ্ব প্রকৃতির সংযোগ স্থাপনে সম্যক সচেষ্ট হয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর "রিলিজিয়ন অফ ম্যান" গ্রন্থটিতে সর্বমানবের জীবনদেবতার কথা বলেছিলেন । মানুষের সঙ্গে মানুষের যে যোগাযোগ তা কোন দেশ-কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখতে পারে না । যেখানে বিশ্ব মানব মনের স্পর্শ সেখানে বিশ্ব মানবতাবাদ মূর্ত হয় এবং তা বাস্তবে হয় বিশুদ্ধ সত্যের উপলব্ধি ।

    কবিতা প্রথম থেকেই সামান্য থেকে অসামান্যের অভিলক্ষে নিজেকে চালিত করেছে । যা কিছু সাধারণ ____যেমন পথের ধারে সারিবদ্ধ ভাবে জারুল গাছ ,সবুজ ঘাস ,ঘাসের ওপর ফড়িং ,জলে গাছের ছায়া ,ছায়ার মত মানুষ --এরকম হাজারো সাধারণ মানুষের দুচোখ মিলে দেখায় দৃষ্টি দিয়ে সে অসাধারণ হতে চেয়েছে । রবীন্দ্রনাথ 'মানবসত্য' প্রসঙ্গে বক্তব্য করেছেন , আমাদের জন্মভূমির তিনটি রূপ রয়েছে । তিনটি রূপ আবার একত্রে জড়িত । প্রথমটি হলো পৃথিবী যেখানে আমরা বসবাস করি । দ্বিতীয় কি হল 'স্মৃতিলোক' যেখানে সমস্ত মানবজাতির কথা লুকিয়ে থাকে । আর তৃতীয়টি হল 'আধ্যাত্মিক লোক 'যাকে বলা যেতে পারে সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ । এই মানবচিত্তের মহাদেশে মানুষের সত্যের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে আসে, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের বিপদে-আপদে ঝাপিয়ে পড়ে । মানুষের কল্যাণমুখী চিন্তাধারা সর্ব মানুষের চিত্তের দিকে প্রসারিত করে বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মানুষের আধ্যাত্মিক যোগাযোগের দার্শনিক চেতনায় বিকশিত করে কবিতায় প্রতিফলিত হয় । তাই আমরা কোভিদ ভাষায় বলতে শুনে _____

  "হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি 
        জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি ।
ধরায় আছে কত মানুষ শত শত 
আসিছে প্রাণে মোর হাসিছে গলাগুলি" ।
                   ( প্রভাত- উৎসব --রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

সমগ্র বিশ্বে একটাই আকাশ তার নিচে পৃথিবীতে আছে মানবজাতি । সেখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি হবে ভাব বিনিময় । পরস্পর পরস্পরকে উপলব্ধি করার মানসিক প্রবণতা থাকবে । সখ্যতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা হবে মানবতার দর্শন । মানুষে মানুষে জাতিগত বিদ্বেষ থাকবে না,বর্ণগত বৈষম্য স্থান পাবে না , ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামির জায়গা থাকবে না । ক্ষুদ্র স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকলে মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না । বৃহত্তর সীমানা এসে দাঁড়ালে মহামানবের মিলনভূমিকে পষ্টভাবে বোঝা যায় । মানুষকে সেবা করে, ভালবাসার মধ্য দিয়ে, হৃদয় দিয়ে কাছে টানা যায়। তখন দূর হয়ে যায় নিকট , অপরিচিত হয়ে যায় পরিচিত, সংকীর্ণতা সরে গিয়ে ব্যাপক সর্বমানবিক সত্তার উন্মেষ ঘটে । সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না । আবদ্ধতার বেড়াজালকে না টককালে পরম সত্যকে উপলব্ধি করা যায় না । 
      

    " হে মোর চিত্ত , পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে 
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।
হেথায় দাঁড়িয়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে ,
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্ধন করি তাঁরে ।
ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর , নদী-জবমালা ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে 
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে" ।।
                         (ভারততীর্থ-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় মানবতাবাদ বোঝায় মানবকল্যাণ । সকল মানুষের মঙ্গল চিন্তায় মানবিক আদর্শ । জীবনের পরম মূল্য এই মানবতার মধ্যে নিহিত । রবীন্দ্রনাথের এই মানব ধর্ম একপ্রকার আত্মপ্রকাশ ,আত্মঅনুসন্ধান ,ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে উত্তরণ । 'জীবনে জীবনে যোগ করা , না হলে কৃত্রিম পণ্যে পরিণত হয় গানের পশরা' । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ",দর্শনে যে সগুণ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হল 'মানব ব্রহ্ম। তাই তাঁর জগৎ মানব জগৎ, মানবিক সত্তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যে নৈব্যক্তিক জাগতিক সত্তা , তাঁকে প্রিয় বলা বা কোন কিছু বলার কোন অর্থ নেই" ।
 
কবিতার সৃষ্টি কি দর্শন থেকে ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,কবিতা প্রাচীনকাল থেকে আজও রহস্য হয়ে রয়েছে । কবি কে বা কি তার আত্মকথা ,এই নিয়ে তর্ক আজও অব্যাহত । কিভাবে কবিতার সৃষ্টি হল তা নিয়েও বিতর্ক প্রশ্নাতীত । কবিতা কি এ কথা কারুর পক্ষে বোধহয় বলা সম্ভব নয় , বরং এ কথা বলা অনেকটা সহজ যে কবিতা কি নয় ।
তবে কবিতার স্বরূপ,প্রকরণ ,সৌন্দর্য এইসব নিয়ে তর্কের বুঝি কোন শেষ নেই । এই সৌন্দর্য কে নিয়ে সকল শিল্পীর খেলা । কবি ও একজন শিল্পী ,সুতরাং কবিদের সৃজনশীলতা শিল্পশাখায় সূক্ষ্মতম নিদর্শন । সুন্দর আর অসুন্দর কে নিয়ে শিল্পীর এই খেলা চিরকালের । এই কারণেই কথায় কথায় কোন জিনিসকে তুলনা করার সময় বলা হয় তা কবিতার মত হয়ে উঠেছে ।

কবিতা তুমি সৃষ্টি মুখর অতীত হৃদয়ের এক বহিঃ প্রকাশ,
জাতির স্বপ্ন সাধনায় বেড়ে ওঠা এক প্রতিফলিত বাস্তবতার রূপ |
কবিতা তোমার আহ্বানে আমি খুঁজে পাই সম্প্রীতির এক গৌরব সুষমা |
কবিতা, তুমি মনের আয়নায় ও জীবনের ভাব ধারায় উৎজ্জীবিত রূপ 
তুমি সমগ্র কর্মধারার এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি |
 
দার্শনিকদের মত কবিরাও সৌন্দর্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন প্রাচীনকাল থেকেই । খ্রিস্টপূর্বকালের দার্শনিক প্লেটও বলেছিলেন , "সৌন্দর্য স্বর্গীয় "। স্বর্গীয় সুন্দর যথার্থ সুন্দর অর্থাৎ পরম সুন্দর । বস্তুত জাগতিক সুন্দরকে সেই পরম সুন্দর নিজের দিকে আকর্ষণ করে । প্লে তো বলেছিলেন , "Deformed is always inharmoniou with the devine, and the beautiful harmonious ."। আবার প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টোটলের মত ছিল ভিন্ন তিনি সৌন্দর্যকে নিরস্তক মনে করতেন না । বিশৃঙ্খলা ,সামঞ্জস্য ও ব্যস্ততা তাঁর মতে সৌন্দর্যবোধের উৎস বলে মনে করতেন । তাঁর অভিমত হলো ---- দর্শন এমন এক সত্তা যা সত্তাকে নিয়ে আলোচনা করে ---- সত্তাকে বিশুদ্ধ সত্তা হিসেবে দেখে , সত্তার বিভিন্ন আংশিক দিক নিয়ে আলোচনা করে না ( philosophy is the science of being , quabeing of being as such or pure being,) তিনি সৌন্দর্যকে নিরস্তক মনে করতেন না । তাঁর মতে সৌন্দর্যের তিনটি উপাদান আছে । যথা -- শৃঙ্খলা,সামঞ্জস্য ও স্পষ্টতা । আবার নিওপ্লেটোনিকের কেউ কেউ প্রেমানুভূতিকে সৌন্দর্যবোধের উৎস বলে মনে করতেন । এ নিয়ে বিভিন্ন তর্ক বিতর্ক থাকলেও এ কথা সত্য যে শিল্প হিসেবে অসার্থক ও অসুন্দর সৃষ্টিকে কোন সচেতন সাহিত্যরসিকই মেনে নেননি । প্রায় প্রত্যেক সাহিত্যিক সুন্দরকে কামনা করতেন শিল্পের প্রয়োজনে। সুতরাং সৌন্দর্য শব্দটি ভাববাদী বা বস্তুবাদীরা যে মতেই ব্যাখ্যা করুন না কেন , অসুন্দর ও অসার্থক সৃষ্টিকে শিল্প সাহিত্যের রাজত্বে স্বীকৃতি দেন নি কেউই । এই শিল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ টে উল্লেখযোগ্য কথা বলেছিলেন -- 
"যে কাঠ জ্বলে নাই, তাহাকে আগুন নাম দেওয়া যেমন যে মানুষ আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশের মত নীরব হইয়া থাকে তাহাকেও কবি বলা সেই রূপ । অতএব শিল্পীকে হতে হয় রূপকার আর কবি হলো শিল্পের কারিগর । রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে রাজা তার প্রিয়তমা রানী সুদর্শনাকে বলেছিলেন , তাঁকে দিনের আলো না দেখাতে । কারণটি কী? রাজার ভয়ানক রূপ সুদর্শন আর সইতে পারবেন না। কিন্তু সুদর্শনা তা মানতে চাননি । ভেতরে ভেতরে তাঁর যে ব্যাকুলতা, সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সাধনা । সাধনার কঠিন রূপের পুজোর বাসনায় পুষ্প নিবেদন ছাড়া হয়তো কবিতা তৈরি হয় না । কবিতা যেমন রসের সামগ্রী , ঠিক তেমনি দৃষ্টিরও বস্তু । এমনকি একটু বাড়িয়ে ছাড়িয়ে তাকে আমরা বলতে পারি যে , হৃদয় মথিত রক্তদগারের অকুণ্ঠিত প্রকাশ । এবার কথা হল , হৃদয় কার নেই? সকল মানুষেরই হৃদয় আছে । সকল মানুষই তার হৃদয়ের কথাকে শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চায় । তাহলে এখন প্রশ্ন হল মানুষের হৃদয়ের কথাকে শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করাতকেই কি কবিতা বলা যেতে পারে ? তাহলে তো সকলেই কবি হয়ে যেত । রাশি রাশি কবির ভিড়ে সত্যিকারের কবিকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না । হয়তো সেজন্যই যে কোন আবেগের বা অনুভবের তাৎকালিক উচ্চারণ কবিতা তৈরি হয় না । গালিব একবার তাঁর কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন , "একদিকে সীমাহীন কাতরতা ,অন্যদিকে নির্বিকার নিশ্চুপতা "। একথা গালিব প্রেমিক বা আল্লাহু বা ঈশ্বর যার উদ্দেশ্যেই বলুন না কেন, এই সীমাহীন কাতরতার প্রকাশ নিয়ে কিন্তু কবিতার জগৎ তৈরি হয়। আর অন্যদিকে সীমাহীন নিশ্চুপতা আছে বলেই একজন কবি এগিয়ে চলেন , যে মুহূর্তে কার তৃপ্তি জাগবে , সেই মুহূর্তেই খন্ডিত হয়ে যাবে তাঁর কবিতার ভুবন।               


 

স্বাগত নতুন 


পুরনোকেই স্মরণ ক'রে "নতুন"কেই বরন করি.... 

গৌতমেন্দু নন্দী


" পুরনো মানে যা কিছু ছিল 

         চিরকালের ধন
         নতুন, তুমি এনেছ তাই
         করিয়া আহরণ...."

    বার্ষিক গতির নিয়মে পৃথিবী সূর্যকে সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫.২৭ দিন অর্থাৎ  সময়ের হিসেবে একটি বছর। এই বৈজ্ঞানিক সত্য কালের বিচারে চিরকালীন। এই আবর্তনেই যুগ যুগ ধরে বছর আসে বছর যায়। এই ধারাবাহিক আবর্তন "সংখ্যা তত্ত্ব"এর হিসেবে "নতুন "বলে গন্য হয় আমাদের,এই মনুষ্য কৃত"ক্যালেন্ডার "এর পাতায়। প্রতি বছর সেই ক্যালেন্ডারের পাতা ৩০/৩১ দিন পর পর বদল হতে হতেই ১২ মাস অর্থাৎ ৩৬৫ দিন পর আসে পরবর্তী বছরের হিসাব। 
       
সময়ের সাথে সাথে ধারাবাহিক এই বাৎসরিক  বদলই "নতুন"এর রূপ ধ'রে আসে, কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক সত্যের সত্যি কি "নতুন" বা "পুরনো" বলে কিছু থাকে? মাথার উপর একটাই আকাশ, সারাবছর ধরে প্রবহমান নির্দিষ্ট অসংখ্য নদী, হিমালয় পর্বতের কোলে সেইসব নির্দিষ্ট পাহাড়-পর্বত,পৃথিবী জুড়ে অপরিবর্তিত নিসর্গতা, সেই প্রকৃতি! এ সবকিছুই তো চিরকালীন। তাকে কি "নতুন" "পুরনো"তে চিহ্নিত করতে পারি বা করা যায়?

          আসলে আমাদের ইচ্ছে, অঙ্গীকার, সাফল্য, ব্যর্থতা, অন্যায়, অপরাধ, মনুষ্যত্ব বোধ, মূল্যবোধ
-----যাবতীয় মানবিক দিকগুলো, যেগুলো এই ভুখন্ডে সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মানদন্ডে নির্ধারিত হয়,তারই নিরীখে আমাদের প্রত্যাশা নিয়েই আগত ও বিগত বছরকেই আমরা যথাক্রমে  "নতুন" এবং "পুরনো"তে সংজ্ঞায়িত করি।

                  নতুন অংকে সময়টাকেই 
                  সাজিয়ে নিই নতুন সাজে 
                  পুরনো সুর হৃদয় বীণায়
                   ছিল যেমন তেমনিই বাজে---

                   পুরনোকেই লালন করি
                   এই জীবনের যাপনে 
                   একই জীবন , হয়না বদল
                   "নতুন" বছর পালনে......

       পুরনো কে সত্যি সত্যি আমরা বিদায় জানাতে পারি কি? বিশেষ করে সেইসব বিগত ঘটনা যা আমাদের মনুষ্যত্ব বোধকে প্রশ্ন চিহ্নের সামনে  দাঁড় করায়। আমরা কি ভুলতে পারব, আমরা কি বিদায় জানাতে পারব বিগত বছরের আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া আর জি কর হাসপাতালে তরুনী  চিকিৎসকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কে? " We want  justice"--এই স্লোগান কি আমরা বছর শেষের  সাথে সাথেই বিস্মরণ হব? আমাদের আগত বছরের সামনে সেই বিচারের দাবি নিয়ে কি দাঁড়াব না? 
     
অতীত আর বর্তমানের, "পুরনো" আর "নতুন"-এর  মেলবন্ধনেই ব্যর্থতা/সাফল্যের, শুদ্ধিকরণের পাঠ নিয়ে উত্তোরণের পথে এগিয়ে যেতে হয়। "পুরনো" ই শেখাবে আগামী "নতুন"এর শপথ নিতে। "পুরনো"র "আত্মসমালোচনা" নির্মাণ করবে উন্নততর মানবতাবোধ। "পুরনো "বছরের কুসংস্কার, অশিক্ষার অন্ধকারের উৎসারিত আলোয় আলোকিত হবে "নতুন" বছর। এইভাবেই পুরনো হৃদয় বীণায় বেজে উঠবে "নতুন"এর সুর---- তাই আমরা উচ্চারণ করতেই পারি------

      " পুরনো কে মনে রেখেই "নতুন" স্বাগত 
      "নবাগত"র সঙ্গেই রাখব তোমায়--" বিগত".…..



 


স্বাগত নতুন 



 সূর্যাস্তের পর হয় সূর্যোদয়
 কবিতা বণিক


 সুর্যাস্তের নিয়মে আলোর বিদায় হয় আরও এক উজ্জ্বল নুতন সুর্যোদয়ের জন্য। সুর্যোদয়ের নুতন আলোকচ্ছটায় প্রকৃতি উদ্ভাসিত হয়। বিগত দিনের সূর্যাস্তের মোহময়ী সৌন্দর্য বন্দী হয় মনের মণিকোঠায়। সূর্যাস্তের রক্তিম আলোক বর্ণের দিগন্ত জোড়া ওড়না মাথায় সূর্য সোনার টিপ পড়ে সাগর জলের নীল ঘাগরায় সেজে অথবা বনভূমির সবুজ শাড়িতে সেজে ঘুমিয়ে পড়ে যেই মেয়ে ! সে যেন সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে সবার হৃদয়ে স্মৃতি হয়ে। আবার জেগে ওঠে সোনার কাঠি ছুঁয়ে নুতন আশার সোনালি আলো নিয়ে, যাকে সূর্যোদয় বলে - “ প্রতিদিন আমি, হে জীবন স্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।” হ্যাঁ, কর্ম চঞ্চল প্রতিটি দিন এমনি ভাবেই আসবে যাবে। বরণের মালা পরে যেমন আসে প্রতিদিন, প্রতি মাস , প্রতি বছর! ঠিক তেমনি ভাবেই মালা খুললেই সে কথা, সে দিন, সেই ক্ষণ স্মৃতি হয়ে থাকে নিজের মনে। মনের কথ বোঝার বয়স আসে শৈশব থেকে কৈশোর তারপর যৌবন পার হয়ে প্রৌঢ়াবস্হার পর বৃদ্ধাবস্হা পার হয়ে আসে মৃত্যুর দুয়ার। ব্যক্তির কাছে মৃত্যুর আগে পর্যল্ত সব স্মৃতি হয়ে থাকে তার কাছে, মৃত্যুর পর তো সবই স্মৃতি হয় অন্যদের কাছে। এই তো প্রকৃতির নিয়ম। 

              প্রকৃতির নিয়মে পর্ণমোচীদেরও ঝরে পরার উৎসব হয় দেখি। নুতনদের স্বাগত জানাতে তাদের এই উৎসব। জীবনের শেষে ঝরে যাওয়ার সময় রঙীন স্বপ্নে বিভোর করে রাখে প্রকৃতিকে। রঙীন পাতার গালিচা বিছানো পথ ধরে আসে কিশলয়েরা। রঙীন প্রকৃতি তখন সেজে ওঠে সবুজের রঙে। রঙীন প্রকৃতি তখন স্মৃতি হয়ে মনে গেঁথে থাকে। সবুজের সাথে পরিচিত হতে আসে কত ফুল, পাখী , ভ্রমরেরা। সে ,আর এক আনন্দ। 

             মানুষের জীবনেও আসে নুতন প্রাণ। এই আগমন বার্তায় কত না আনন্দ, কত না উৎসবের আয়োজন। সংসারে পূর্ণ বয়স্ক মানুষের জীবনের যখন শেষ হয়, ওদিকে দেখা যায় হয়ত কোন নুতন জীবনের শুরু। এ যেন “ তোমার হল শুরু আমার হল সারা। / তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা।’”পুরোন যা কিছু, সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নুতনকে বরণ করে তাদের আরও উন্নত করে তৈরি করা। এই ভাবেই দেখা যায় তাদের দ্বারা কত নুতন জিনিসের আবিস্কার হয়। সনাতনী ধারায় এমন ভাবেই পেলাম বসিষ্ঠদেবের পুত্র শক্তিকে। তাঁর পুত্র পরাশরকে। তাঁর পুত্র ব্যাসদেবকে। ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব মহারাজকে। এনারা পাঁচ পুরুষ ভারতবর্ষের প্রাণ পুরুষ স্বরূপ। এনারা প্রত্যেকেই বেদ, পুরাণ, তন্ত্র শাস্ত্র , স্মৃতি শাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে উজ্জ্বল স্বাক্ষরতার প্রমাণ রেখেছেন। ব্যাসদেব তো বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ভাগবত প্রণেতা হয়েও আজও সন্ন্যাসীদের সার্বভৌম গুরু। এখান থেকে বোঝা যায় পুরাতনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নুতনের পালন পোষনের প্রয়োজনীয়তা কতখানি সার্থক করে তোলা যায়। 

             পুরোন কে মনে রেখে নুতনকে সার্থক করে তোলার নামই জীবন। আবারও মনে হয় ‘ রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে ‘। মনের ভিতরের মণি মুক্তো দিয়ে নবীনের সবসময় স্বাগত জানানোর মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। তাই তো কবি বলেন “ আমার ছুটি জাগাও তুমি , ওইখানে মোর জিত। “


 

স্বাগত নতুন 


আসছে নতুন বছর

Bakyawala-বাক্যওয়ালা

এই যে বছরের শেষ দিনে এসে কত কিছু মনে পড়ছে ; একসাথে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরা, কফি-কাপ, নন্দন, প্রিন্সেপ ঘাটে বসে তোমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার সেই সব সময় গুলো দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো, আজকের দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতই খুব সাধারণ একটা দিন, তেমন বিশাল কিছু পার্থক্য নেই। তবু কোথাও না কোথাও কেমন যেন একটু আলাদা আজকের দিনটা। শেষ বিকেলের বিষন্ন মেঘ জমা আকাশের মতই ভয়ংকর সুন্দর।

কাল থেকে বছরটা বদলে যাবে, বদলাবে না শুধু আমাদের গল্প গুলো।বছরের শুরুতে আমরা কিছু কথা মাথায় রাখবো গত বছরে যে ভুলগুলো আমরা করেছি তা শুধরে নেবো। নতুন করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। বছরের প্রতিটা দিন যেমন সমান যাবে না, তেমনি বছরের প্রতিটা দিন খারাপও যাবে না। কিছু ভালো, কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বছরের শুরু হয় এবং সেই বছরটা শেষও হয়ে যায়। আজ সেই শেষ দিনটা। 

প্রতিদিনের মতো কালকে ও সকাল হবে কিন্তু কালকে ২০২৪ এর জায়গায় ২০২৫ লেখা হবে। তেমন বিরাট কিছু পরিবর্তন হবে না তবু ক্যালেন্ডারটার পরিবর্তন তো হচ্ছে। মৃত্যুর দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছি। অন্ধকার না থাকলে যেমন আলোর মর্মটাই বোঝা যায় না ঠিক তেমনি খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা না হলে অথবা ব্যর্থ না হলে সাফল্যের জন্য নিজেকে তৈরিও করা যায় না। তাই ব্যর্থতায় ভয় পেলে চলবে না।

কেউ আপনাকে বিশ্বাস করলে, সেই বিশ্বাসটা রাখার চেষ্টা করুন। কারোর বিশ্বাস ভাঙার মধ্যে কোনো মহত্ব নেই বরং বিশ্বস্ত থাকাটা অনেক অনেক কঠিন কাজ যেটা সবাই পারে না। বিশ্বাস জিনিসটাই এই রকম খুব নরম বা কাঁচ জাতীয় একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগানো যাবে না। জোড়া লাগানো গেলেও একটা দাগ রয়ে যাবে।

খুব ভালোভাবে নতুন বছর শুরু হোক আর বছরের প্রথম দিনেই প্রতিজ্ঞা করুন যে কাজগুলো কমপ্লিট করা হয়নি সেই কাজগুলো আগামী বছরে কমপ্লিট করবেন। আর চেষ্টা করবেন মানুষের প্রতি একটু বেশি মানবিক হওয়ার। অকারণে কাউকে কষ্ট দেবেন না আপনার কাজ, ব্যবহার বা কথার মাধ্যমে, তাতে আপনার ওপর দিকের মানুষটার মন ভেঙে যাবে।


 

গল্প 


উন্নয়ন 
সুদীপ মজুমদার 

মাথায় বড় ঝুড়িটা নিয়ে এত জোরে হাঁটছিল শিবানী যে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে প্রায় দৌড়াচ্ছে। কাঁঠাল গাছের নীচে ভজার চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছিল সুবল। শিবানীকে দেখে বলল, "আস্তে যা। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে সব নষ্ট।"  শিবানী বলে, "কাকা ট্রেনের টাইম তো হয়ে গেছে, এখনি এসে পড়বে। স্টেশন এখনও দশ মিনিটের পথ।"

গ্রামের নাম রানীনগর। রেল স্টেশনের নাম রানীনগর জলপাইগুড়ি। এত বড় নাম কেউ বলে না, রানীনগর-ই বলে। গত দু`সপ্তাহ থেকে এই স্টেশনটার চেহারাই পাল্টে গেছে। না কোনো বাড়তি প্ল্যাটফর্ম বা নূতন নির্মাণ হয়নি। হয়েছে একটা নূতন ট্রেন। নাম তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস। কোলকাতার শিয়ালদা স্টেশন থেকে ছেড়ে এই রানীনগরে এসে এটা দুভাগ হয়ে যায়। তিস্তা অংশটা কেটে জলপাইগুড়ি শহরে চলে যায় আর বাকি ট্রেনটা তোর্সা নাম নিয়ে আলিপুরদুয়ারে যায়। বিকেলে আবার তিস্তা এসে অপেক্ষা করে তোর্সার জন্য। আলিপুরদুয়ার থেকে তোর্সা এসে এই রানীনগরে তিস্তার সঙ্গে জোড়ে। এইসব কর্মকাণ্ড সারতে প্রায় একঘন্টা এই স্টেশনে গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে এখানে চা খায়।

শিবানীকে ঐ ভাবে ছুটতে দেখে সুবলের হরিদার কথা মনে পড়ে। হরিদা সুবলের থেকে কিছুটা বয়সে বড় হবে। সুবলকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখত। গতবছর হঠাৎ করে মারা যাবার আগে পর্যন্ত সুবলের সঙ্গে খুবই সখ্য ছিল। আমবাড়ীর কাছে হরিদার কিছু ধানী জমিও ছিল। সবসময় দেখাশোনা করতে হতো না। আধিয়ার দেবেশ্বর খুবই সৎ ও বিশ্বাসী মানুষ ছিল। দেবেশ্বর মারা যাবার পর ওর ছেলে নিরীক্ষণ একদমই সুবিধার ছিল না। তখন সুবলকে নিয়ে হরিদা মাঝে মাঝে আমবাড়ীতে জমিজমা তদারকি করতে যেত। হরিদারই একমাত্র মেয়ে এই শিবানী। ছোটবেলা থেকেই অপূর্ব সুন্দর দেখতে। গ্রামের সবাই ওকে ভীষন ভালোবাসতো। শিবানীর ব্যবহারও ছিল চমৎকার, এই জন্যই সবাই ওকে আরও পছন্দ করতো। সুবলদের চোখের সামনে শিবানী ছোট থেকে বড়ো হয়ে উঠলো। সেই একটা দিনের কথা সুবলের এখনো মনে আছে। হরিদার সঙ্গে একসাথে ট্রেনে মালদা যাচ্ছিল সুবল। হরিদার কোলে ছোট্ট শিবানী। ঐ কামরায় একজন আর্মি অফিসার ছিলেন। গল্প করতে করতে উনি শিবানীকে কয়েকটা চকোলেট দিলেন। হরিদাকে বললেন - এই মেয়ে বড়ো হয়ে আপনাকে খুব জ্বালাবে। অবাক হয়ে হরিদা জানতে চেয়েছিলেন যে উনি কেন এরকম বলছেন। ভদ্রলোক বললেন - মেয়ের এখন রূপ লাগছে, এরপর যৌবন লাগবে। ওকে খুব সাবধানে রাখবেন।

শিবানীকে নিয়ে হরিদার অনেক স্বপ্ন ছিল। বলতো - ওকে অনেক লেখাপড়া শেখাবো। ভালো বিয়ে দেব, এইসব। হরিদা যখন মারা যায় শিবানী তখন ক্লাস এইটে পড়ে। গ্রামের স্কুল সকালে হয়। এরপর নাইনে উঠলে শহরের বড় স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করার কথা ছিল। সেটা হলোনা। হরিদা মারা যাবার পরে ওদের সংসারে উপার্জন করার আর কেউ ছিলনা। সব দায়িত্ব সুবলের ওপর এসে গেল। সুবল প্রায়ই হরিদার বাড়িতে যেত। একদিন বৌদি চায়ের সঙ্গে বাড়িতে বানানো ভাঁপা পিঠে সুবলকে খেতে দিলো। আর তখুনি সুবলের মাথায় আইডিয়াটা এলো। বলল,"বৌদি এত ভালো ভাওয়া পিঠা বানাইছেন, একটু বেশি করে বানাইলে শিবানী স্টেশনে গিয়া বিক্রি করতে পারবে।" সেই শুরু। তিস্তা তোর্সা দু`বেলা একঘন্টা করে দাঁড়াতো। ঐ সময় শিবানীর কাছে ভাঁপা পিঠে খাবার লাইন পড়ে যেত। একঝুড়ি পিঠে নিমেষে শেষ হয়ে যেত। শিবানীর মা পিঠে বানাতে হিমিশিম খেয়ে যেত। নাইনে আর পড়া হলো না শিবানীর। তবে সংসারে টানাটানিটা আর থাকলনা। এভাবেই চলছিল অনেক বছর। তারপরে হঠাৎ করেই আবার ওদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল অন্য একটা ঘটনায়।

সরকারি সিদ্ধান্তে দার্জিলিং মেল নিউজলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো আর সেই সঙ্গে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস জলপাইগুড়ি না এসে সোজা আলিপুরদুয়ার অবধি যেতে লাগল। তিস্তার অংশ জলপাইগুড়ি না আসায় রানীনগর স্টেশনের গুরুত্বও কমে গেল, এমনকি ওখানকার স্টপেজও উঠে গেল। শিবানীর চোখের সামনে দিয়ে রানীনগরে না দাঁড়িয়ে ট্রেন ঝমঝম করে দুবেলা চলে যায়।

সুবল ভাবে উন্নয়নের খবর ফলাও করে টিভিতে প্রচার হয়, খবরের কাগজে বের হয়; কিন্তু উন্নয়নের ফলে শিবানীদের মতো কিছু সংসার যে পথে বসে যায় তার খবর কোথাও নেই।

হঠাৎ করে একদিন সস্ত্রীক সুবল হরিদার বাড়ি গিয়ে বৌদি ও শিবানী কে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। হরিদার একটা স্বপ্ন পূরণ করার মানে শিবানীর একটা ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়।


 


গল্প 


রেজিগনেশান

মৌসুমী চৌধুরী 

     " যত্তসব! তোদের যত রাত দখল, ভোর দখল, দ্রোহের চিৎকার সব কেমন মিইয়ে যায় ওই ভার্গবদের পকেটের কাছে! ডিজগাস্টিং! ... কি হল শেষ পর্যন্ত! সমাজ তোলপাড় করে আন্দোলনে নামলি। সবাই আমরা ভাবলাম এবার হয় এস্পার, না হয় ওস্পার হবে। জেগে উঠেছে নারীশক্তি! সমাজ থেকে চিরতরে ভার্গবরা এইবার নির্মূল হবে। একটা নব জাগরণ আসতে চলেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কিচ্ছুটি হল না। কিচ্ছুই না। সব শূন্য...বিগ জিরো!"   
 —আপন মনে হতাশায় গজর গজর করছিলেন মিঃ সেন।
       মিঃ সেন মানে " কনস্টেলেক গার্মেন্ট হাউস" এর পি.আর.ও মিঃ সুপ্রতীক সেন। এ কোম্পানির সমস্ত ক্লায়েন্ট ডিল, অ্যপয়েন্টমেন্ট লেটার, প্রোমোশান লেটার, টার্মিনেশান লেটার এবং এমনকি স্যাক লেটারও তিনিই রেডি করেন এবং সমস্ত কর্মীদের রেজিগনেশান লেটারও তাঁকেই জমা দিতে হয়। পেশাগত কারণেই জীবনের ওঠা-পড়া জলছবি হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর চোখের সামনে। 

          গত মাসেই ওই মেয়েটা নতুন জয়েন করেছে তাঁদের এই অফিসে। নামখানা বেশ বাহারি — সেঁজুতি! মেয়েটার চেহারায় নিম্ন মধ্যবিত্তের ছাপ রয়েছে। তবে মুখে এই বয়সেই বেশ একটা রাশভারী ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে আর একটা আলগা শ্রীও লেপ্টে আছে শ্যামলা পানপাতার মতো কচি মুখখানা ঘিরে। পিঠের ওপর যেন কালো মোটা ময়াল সাপের মতো ঝুলছে একটা জেদী বিনুনি। সে়ঁজুতির এক মাসের কাজের খতিয়ান দেখে মিঃ সুপ্রতীক সেন ঠিক বুঝতে পেরেছেন যে, কাজে সে বেশ এফিসিয়েন্ট। কিন্তু এই অফিসের এম.ডি. কুষান ভার্গবের পি.এ. হতে গেলে শুধু তো কাজে এফিসিয়েন্ট হলেই চলবে না, আরও কিছু দেওয়া চাই-ই চাই। মেয়েটা হয়তো সেসব জেনেশুনেই ঢুকেছে এ চাকরিতে!... যত্তসব!!! 
   কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে মিঃ সেন দেখলেন ফাইল হাতে নিয়ে রামদীন দাঁড়িয়ে আছে। 
— " একা একা কি সোব বাত করছিলেন, সেন বাবু? সিরিয়াস কুছু হয়েছে নাকি?"
—" না না। কি আর আবার হবে? বল, কি বলবে।"
    ফাইলটা বাড়িয়ে দেয় রামদীন, 
— "এই ফাইলটা জলদি রেডি কোরতে হোবে। এই ফাইল আর সেঁজুতি ম্যাডামকে নিয়ে বড় সাহাব কাল সামকো ক্লায়েন্ট মিট কোরবেন। এক বড়া বিদেশি ক্লায়েন্ট আসছেন ..." 
  — "ওহ্। বুঝেছি বুঝেছি ... তাই আজ সন্ধেতে নতুন পি.এ. মিস সেঁজুতির সঙ্গে বড়সাহাবের বিশেষ মিটিং আছে, তাই তো?"
   মোটা গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে চলে যায় রামদীন। 
       ওপেন সিক্রেট! মিঃ ভার্গব আজ বিছানায় এক নতুন শিকার তুলবেন। এই অফিসের সব্বাই সবকিছু জানে। কিন্তু কেউ কিছুতেই মুখ খোলে না। পেট বড় বালাই যে! মিঃ সেনও কি কিছু বলতে পারেন? নাহ্ ... সামনের বৈশাখে তাঁর মেজো মেয়েরটির বিয়ে। মেজোর নিচে আরও দুটি মেয়ে রয়েছে। তারাও দ্রুত বেড়ে উঠছে। মেজ মেয়ে রুবি কিছুদিন হল একটি প্রাইভেট সেক্টারে চাকরি পেয়েছে। মাইনে খুব একটা বেশি নয়। তবু বাবার বুড়ো হাড়ে একটু বাতাস লেগেছে আর কি। কিন্তু রুবির অফিসেও নাকি একজন মূর্তিমান মিঃ ভার্গব আছেন। তাঁকে খুশি করতে না পারলে চাকরি টিঁকিয়ে রাখা নাকি মুশকিল হয়ে যাবে। একটা গভীর অসহায়তা উথাল-পাথাল করে মিঃ সেনের বুকে! 

   কিন্তু তোরা মেয়েগুলোই বা কেমন রে! প্রতিবাদ করে চাকরিটা টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করবি না ? তোদের ওই রাত দখল-ভোর দখল ইত্যাদি সবকিছু কি একেবারেই বৃথা গেল? এমন গণ আন্দোলন কি তোদের কিচ্ছুই শিখিয়ে গেল না? তোদের শিরদাঁড়া শক্ত করবার শিক্ষাটুকুও কি দিল না?... তখনই তাঁর ফোনটা বেজে উঠতে চমকে ওঠেন মিঃ সেন। তাঁর মেজ মেয়ে রুবির গলা,
— " বাবা, চাকরিটা আজ ছেড়েই দিলাম। বসের সঙ্গে কোম্পানির গেস্ট হাউসে একটা রাত কাটান আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়। রেজিগনেশান লেটারটা মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছি।"

            হঠাৎ মিঃ সেন দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেঁজুতি। মুখে মৃদু হাসি! বিরক্ত লাগে মিঃ সেনের। ওঃ মুখে হাসি যেন আর একেবারে ধরছে না! বিরক্তি চেপে জিজ্ঞেস করেন,
— " কি ব্যাপার?"
উত্তরে একটা চিঠি মিঃ সেনের হাতে ধরিয়ে দেয় সেঁজুতিও ।


 

গল্প 


শুরু 

লীনা রায় 

ছেলে, বৌমা দুজনেই চাকুরে। সাড়ে আটটায় বেরিয়ে যায়। নাতি স্কুল থেকে ফেরে তিনটের সময়। তাকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তার ছুটি। এখন বিকেল চারটে। তখনই প্রতিভা খানিকক্ষণ সময় পান। মোবাইল ফোন নিয়ে বসেন।মেসেজ দেখেন। ছেলেবেলার বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। দীর্ঘ দিন যোগাযোগ না থাকলেও, শেষ বয়েসে আবার সবাই একসঙ্গে। সকাল থেকে অনেক মেসেজ জমা হয়ে থাকে। এই সময় তিনি সব খুঁটিয়ে পড়েন। উত্তর দেন। বড় ভাল লাগে। এই সময়টা তার নিজের ছেলেবেলায় ফিরে যাওয়ার।

       আজ মেসেজে দেখলেন মৌসুমীর চল্লিশতম বিবাহ বার্ষিকীর নিমন্ত্রণ। সক্কলে খুব খুশি। অনুষ্ঠান, সঙ্গে বন্ধুদের দেখা হওয়া – সবাই বেশ উত্তেজিত। সবার কমেন্টেই খুশির ছোঁয়া। প্রতিভাও লিখলেন।

     ফোনটা রেখে বালিশে মাথা রাখলেন। অনুষ্ঠান, উপহার সব কিছু নিয়ে ভাবছিলেন। বুকলুর স্কুলে যাবার পথে একটা বুটিক আছে। সেখানকার শাড়ি, পাঞ্জাবি বেশ চোখ টানে। সেখান থেকেই ওদের জন্য উপহার কিনবেন ঠিক করলেন।

    রাতে খাবার সময় ছেলে বৌমাকে মৌসুমীর বিবাহ বার্ষিকীর কথা জানালেন। ওদের জন্য গিফট কিনতে হাজার পাঁচেক দরকার সেটাও বললেন। আর এরপরেই টেবিল- আড্ডায় ছন্দপতন। সব কথা, গল্প হঠাৎ নীরবতায় বদলে গেল। বৌমা খানিকটা খাবার খেয়ে উঠে গেল। ছেলে চুপচাপ খাবার খেয়ে মুখ ধুতে চলে গেল। প্রতিভা টেবিলে একা। খাবার জুড়িয়ে যাচ্ছে।কিন্তু খাবার আর মুখের দূরত্ব যেন হাজার মাইল। হাতে পায়ে সাড় নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। কত সময় পার হল খেয়াল নেই। শেষ পর্যন্ত উঠলেন।

     আজ আর ওষুধ খেলেন না। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলেন। হাবিজাবি কত ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবনের প্রথম লিপস্টিক হারিয়ে যাওয়া, মাধ্যমিকের জন্য গান শেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া.... আরও কত কী! কত দীর্ঘ মন খারাপের সময় একা একা লুকিয়ে কেঁদেছেন। আজও কাঁদলেন। বালিশ ভেজালেন। খানিক হালকা হলেন।

      পরদিন আবার সব আগের মত। প্রতিভার ব্যস্ততা , নাতির সঙ্গে খুনসুটি সব সব আগের মত। শুধু রাতে ঘুমের সময়টা খানিক পিছিয়ে গেল। 

অবশেষে সেই দিন এলো।ছেলে, বৌমা অফিসে বেরিয়ে গেল। সামান্য প্রসাধন, কাঁথা স্টিচের মভ সিল্কের শাড়ি পরে তৈরি হলেন। এগারোটায় বাড়ি থেকে বের হলেন। 

     মৌসুমীর বাড়িতে পৌঁছে দেখেন হাসি, গান , আড্ডায় জমজমাট পরিবেশ। দুপুরের খাবার পর্ব মিটে গেলে আর এক পর্ব আড্ডা শুরু হল। সঙ্গে সঙ্গে গিফট দেখা। জুয়েলারি, শো পিস কত কী। একসময় প্রতিভার গিফট খোলা হল। হাতের কাজের দুটো শাল, দুজনের জন্য। হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতে লাগল ওর উপহার। সবাই যখন জানতে পারে প্রতিভা নিজে তৈরি করেছে, অবাক হয়ে যায়। প্রশংসায় ভরিয়ে দেয় ।

       এরপর যা হল তারজন্য প্রতিভা তৈরি ছিলেন না। অতিথিদের মধ্যে থেকে দশ জন শালের অর্ডার দিলেন। প্রতিভার বারবার মানা করা সত্বেও তারা জোর করেই অ্যাডভান্স গুঁজে দিল তার হাতে। বান্ধবীরাও খুব খুশি। ফেরার সময় অ্যাডভান্সের টাকা থেকে মালা নিয়ে এলেন।

      বাড়ি ফিরে স্বামীর ছবিতে মালা পরিয়ে দিলেন। ফিস ফিস করে বললেন, ‘ তোমার ইচ্ছে ছিল আমার হাতের কাজের শাল গায়ে বিকেলে দুজনে হাঁটতে যাব। তোমার ইচ্ছে পূর্ণ করতে পারিনি। তুমি সময় দাওনি। কিন্তু তোমার এনে দেওয়া শালের কাপড় আর সুতোয় নতুন অধ্যায় শুরু করলাম। পাশে থেকো ।'



 





গল্প
 


উপহার
মনোমিতা চক্রবর্তী

রৌনক-- কিরে সপ্তর্ষি এত বড় লিস্ট বানিয়েছিস ! 
দেখি দেখি বলে সপ্তর্ষির থেকে ছো মেরে ডায়েরিটা নিয়ে রৌনক পড়তে থাকে।
১.মন দিয়ে পড়াশোনা করব ।
২.আগামী বছরের মধ্যে একটা চাকরি জোগাড় করবই করব।
৩. একটা রয়াল এনফিল্ড বাইক কিনব। 
৪. আর তিতলিকে এবার পটাবই পটাব।

রৌনক -- কি তিতলিকে পটাবি? এটা তোর রেজোলিউশন ?
 গোপন কথা ফাঁস হতেই সপ্তর্ষি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কারণ তিতলি যে রৌনকের ছোট বোন ।ধরা পড়ে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সপ্তর্ষি বলে-- রৌনক রৌনক ওই দেখ অংশু কি লিখছে। বলে অংশুর থেকে ছো মেরে অংশুর ডায়রিটা নিয়ে সপ্তর্ষি এবার পড়তে থাকে- 
১. এ বছরই প্রতিষ্ঠিত হব।
২. কোনদিন আর কাউকে ভালবাসবো না।
সপ্তর্ষি -- ভাই তুই এখনো রিমাকে ভুলিস নি? 
অংশু চুপ করে থাকে। 
হোস্টেলের রুমটাতে সবাই কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকার পর অংশু বলে-- এ বছরটা খুব খারাপ গেল রে আমার। রিমাকে হারালাম শুধুমাত্র গরিব বলে। অনেকটা সময়ও নষ্ট করে ফেললাম মিছিমিছি ওর পিছনে ঘুরে। 
আবারো সবাই নিশ্চুপ দেখে, পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য গলাটা খাকড়ে নিয়ে সপ্তর্ষি পরের পয়েন্টটা জোরে জোরে পড়তে থাকে।
৩. বাবাকে এ বছর যেমন করেই হোক একটা সাইকেল কিনে দিতে হবে। 
এদিকে অংশু মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে দেখে রৌনক এক ধমক দিয়ে সপ্তর্ষিকে চুপ করিয়ে অংশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-- অংশু কাকুর তো সাইকেল ছিল শুনেছি, তাহলে কাকুকে কি তুই নতুন সাইকেল গিফট করতে চাস ?
অংশু -- নারে তোরা তো জানিস আমার বাড়ির পরিস্থিতি। গত বছর পরীক্ষার ফি দিতে গিয়ে কিছু টাকা কম পড়েছিল। বাবা কিছুতেই জোগাড় করতে পারেনি বলে বাবার সাইকেলটা বিক্রি করে সেই টাকাটা দিয়েছিল ।আসলে, তোদেরকে বলাই হয়নি ব্যাপারটা। বাবা এখন পায়ে হেঁটেই সকালবেলাটা খবরের কাগজ বাড়ি বাড়ি বিলি করে ।তারপর বাবা পায়ে হেঁটেই প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে যে হোটেলটাতে কাজ করতো, সে হোটেলে যায়। দুপুর থেকে রাত অব্দি কাজ করে আবার অত রাতে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পায়ে, ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে রে । আমার খুব কষ্ট হয়। সাইকেলটা বিক্রি করাতে বাবার যে খুব কষ্ট হচ্ছে রে। তাই দুটো টিউশন বাড়িয়ে দিয়েছি। অনেকটা জমেছে টাকা।তবে আর তিন হাজার হলেই সাইকেলটা কিনতে পারব।
 সপ্তর্ষি -- এই ব্যাপার ! তা আমরা কি করতে আছি শুনি ?
 অংশু -- মানে ?
সপ্তর্ষি-- মানে হল বাবা দুদিন আগেই দেড় হাজার টাকা পকেট মানি পাঠিয়েছে, এটা তুই নে ।এটা ভরে কাকুকে সাইকেল কিনে দে অংশু। 
অংশু -- না রে, তা হয় না।
 রৌনক-- কেন হয় না শুনি ? আমার বাবাও আমাকে নিউ ইয়ারে পিকনিকের জন্য হাজার টাকা পাঠিয়েছে। এটা রাখ। সাথে গত মাসের পাঁচশো টাকা বেঁচে গেছে। এটাও রাখ। পুরোটা দিয়ে কালই একটা সাইকেল কিনে কাকুকে দিয়ে আয়। 
অংশু -- কিন্তু ?
 সপ্তর্ষি -- কিসের কিন্তু রে ? আমাদের পরিচয় বন্ধু হিসেবে দিস আর বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে দিচ্ছিস না ।
রৌনক -- অংশু আর তো মাত্র কয়েকটা মাস। এই নতুন বছরেই তো আমরা পাস আউট হয়ে চাকরি বাকরি করব। তোরও তো চাকরি প্রায় হয়েই গেছে শুধু সময়ের অপেক্ষা । তখন না হয় আমাদের টাকাটা ফেরত দিস। দেখ অংশু আরেকটা নতুন বছর,তোর সামনে হাজারো নতুন সুযোগ ঘুরে দাঁড়ানোর। যা কিছু জীবন থেকে হারিয়ে গেছে যাক, সেটা নিয়ে মন খারাপ করে অহেতুক কষ্ট পাস না ভাই।সময়, শ্রম, অর্থ ,ভালবাসা ,খারাপ সময় যা গেছে তা যাক ,বৃথা তার জন্য দুঃখ বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না অংশু।নতুন বছর নতুন করে শুরু কর। আমরা আছি তোর সাথে হাল ছাড়িস না।জানিস তো আমার মনে হয় ঈশ্বর মাঝে মাঝে আমাদের সকলকেই সুযোগ দেন ভালো কিছু করার । আর সে সুযোগটাকেই আমাদের কাজে লাগানো উচিত। ধরেনে নতুন বছর তোকে নতুন সুযোগ দিচ্ছে। এই বছরটা তুই এমন করে শুরু কর যাতে বছর শেষে তোর কোন আফসোস না থাকে। নতুনকে স্বাগত জানা, যা কিছু পুরনো তা না হয় মনেই থাক অংশু।
 
পরের দিন অংশু সকাল সকাল বাড়ি পৌঁছে দেখে তার বাবা উঠোনের এক কোনায় উনুন ধরিয়ে আগুনের গরম ওম নিচ্ছে।অংশুর মনে পড়ে ছোটবেলায় অংশুর বাবা হোটেলে কাজ করে বছর শুরুর রাতে বিরিয়ানি নিয়ে আসত।কি খুশিটাই না হতো অংশু !
আসলে প্রত্যেক বছর নিউ ইয়ারে হোটেল মালিক হোটেল কর্মীদের বকশিশ দিত এক প্যাকেট বিরিয়ানি।যা অংশুর বাবা নিজে না খেয়ে ছেলের হাতে দিয়ে বলতো -- তোর নিউ ইয়ার গিফ্ট।
 নতুন বছরের গভীর রাতে ওই বিরিয়ানির গন্ধে কি খুশি টাই না হতো মা হারানো অংশু ।

অংশুকে ওভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অংশুর বাবা অবাক হয়ে বলে -- আরে অংশু কখন এলি? কি ভাবছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ? এদিকে আয়। 
 অংশু এবার দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার হাতে সাইকেলের চাবিটা দিয়ে বলে -- এই নাও বাবা তোমার নতুন বছরের উপহার। 
অংশুর বাবা অবাক হয়ে বলেন -- এটা কিসের চাবি রে অংশু ?
 অংশুর বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলে -- তোমার নিউ ইয়ার গিফ্ট বাবা ।টিউশনের টাকা জমিয়ে আর কিছুটা বন্ধুদের থেকে লোন নিয়ে একটা সাইকেল কিনেছি তোমার জন্য ।আজ নতুন বছর শুরু বাবা ,হ্যাপি নিউ ইয়ার ।এতদিন তুমি অনেক কষ্ট করেছ বাবা । এ বছর আমার চাকরিটা হয়ে গেলে আর তুমি কোন কাজ করবে না কিন্তু। 

চোখে আনন্দের জল নিয়ে অংশুর বাবা বলেন -- রান্না ঘরে যা ,তোর নতুন বছরের গিফ্ট রয়েছে।
  মুহূর্তেই অংশুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে গেল, এক মুখ হাসি নিয়ে অংশু বলল -- বিরিয়ানি না বাবা ? এবারও তুমি খাওনি ? 
অংশুর বাবা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা ,অংশুও নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা দুজনই দুজনকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের অশ্রুতে ভাসতে থাকে।