প্রবন্ধ
দর্শন ও কবিতা
কবিতার সৃষ্টিতে দার্শনিকদের প্রভাব ও রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ
সঞ্জয় সাহা /এস. সাহা
সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্যকে জানার এবং যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে দর্শন । অবশ্য দর্শনের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । আজ পর্যন্ত দর্শনে যথার্থ ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দার্শনিকরা দিতে পারেননি ।এর কারণ দর্শন এক সর্বব্যাপক শাস্ত্র,জগৎ ও জীবনের এমন এক দিক নেই যা দর্শনের আলোচ্য বিষয় নয় । দর্শনের স্বরূপ কি? প্রশ্নটি দর্শনের একটি মৌলিক প্রশ্ন । প্রশ্নটির চরিত্র থেকেই দর্শনকে জ্ঞানের অপর শাখা থেকে পৃথক করা যায় ।বিজ্ঞানের স্বরূপ কি ? এই প্রশ্ন বিজ্ঞানে তোলা হয় না বা বিজ্ঞান বিজ্ঞানের স্বরূপ আলোচনা করেনা , একজন ইতিহাসবিদও ইতিহাসের স্বরূপ কি? এই প্রশ্ন বিবেচনা করেন না।কিন্তু দর্শনে এই প্রশ্ন তোলা হয়। দর্শন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে ।
বিষয়বস্তুর বৈচিত্রের জন্য দর্শনের একটি সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । এটি দর্শনের স্বরূপগত সমস্যা । জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন দিক আছে । দার্শনিকরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন একটি দিকের ওপর গুরুত্ব দেন । বিভিন্ন দিক থেকে অদ্ভুত সমস্যা নিরূপণ করেন, সমস্যার উপর আলোকপাত করেন এবং তার ভিত্তিতে দর্শনের সংজ্ঞা দান করেন । প্লেটো বলেছেন, "বিস্ময় দর্শনের জনক "। বিস্ময় থেকে জন্ম নেয় দর্শন চিন্তা । জগৎ সম্পর্কে মানুষের মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগে ___এই জগৎ কিভাবে সৃষ্টি হল ? এই জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা আছে কি ? জগতে যে নিয়মশৃঙ্খলা দেখা যায় তার নিয়ন্ত্রণ কর্তাকে ? জগতের উপাদান কি ? ইত্যাদি । আবার এই জগতে জন্ম- মৃত্যু ,দুঃখ -কষ্ট দেখে মানুষ বিচলিত হয় । মানুষ এই ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে যেমন খুঁজেছিলেন গৌতম বুদ্ধ ।
কবিদের চিন্তাশক্তির বৈচিত্র্যের জন্য কবিতার একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । কবিতার জগতে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আছে কবিতার সংজ্ঞা বোঝাতে গিয়ে প্রাচীনের গল্পের কথা মনে পড়ে যায় গ্রিসের গল্পে এক অদ্ভুত নারীর মূর্তি দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে তুলেছিলেন এক ভাস্কর শিল্পী । তাঁর দাবি ছিল কবিতা নয়, ভাস্কর্যই শ্রেষ্ঠ শিল্প । পাথরের প্রতিটি দানা খোদাই করে অবশেষে সত্যিই যখন মূর্তিটি সম্পূর্ণ হল, ভাস্কর তখন নিজের শিল্পে নিজেই মুগ্ধ হয়ে বললেন "আহা কবিতা !"
এই যে অসাধারণ সব শিল্প মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতার মত মনে হওয়া কবিতায় যেন এক নিরন্তন উত্তর খোঁজার প্রয়াস । আমরা আমাদের অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশকে আমরা কবিতার সঙ্গে তুলনা করেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই । এই কারণে রবীন্দ্রনাথ হয়তো তার কবিতায় শিল্পপ্রয়াসকে মানুষের অন্তর্লোকের সর্বাধিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং মানব প্রকৃতির সঙ্গে বিশ্ব প্রকৃতির সংযোগ স্থাপনে সম্যক সচেষ্ট হয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর "রিলিজিয়ন অফ ম্যান" গ্রন্থটিতে সর্বমানবের জীবনদেবতার কথা বলেছিলেন । মানুষের সঙ্গে মানুষের যে যোগাযোগ তা কোন দেশ-কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখতে পারে না । যেখানে বিশ্ব মানব মনের স্পর্শ সেখানে বিশ্ব মানবতাবাদ মূর্ত হয় এবং তা বাস্তবে হয় বিশুদ্ধ সত্যের উপলব্ধি ।
কবিতা প্রথম থেকেই সামান্য থেকে অসামান্যের অভিলক্ষে নিজেকে চালিত করেছে । যা কিছু সাধারণ ____যেমন পথের ধারে সারিবদ্ধ ভাবে জারুল গাছ ,সবুজ ঘাস ,ঘাসের ওপর ফড়িং ,জলে গাছের ছায়া ,ছায়ার মত মানুষ --এরকম হাজারো সাধারণ মানুষের দুচোখ মিলে দেখায় দৃষ্টি দিয়ে সে অসাধারণ হতে চেয়েছে । রবীন্দ্রনাথ 'মানবসত্য' প্রসঙ্গে বক্তব্য করেছেন , আমাদের জন্মভূমির তিনটি রূপ রয়েছে । তিনটি রূপ আবার একত্রে জড়িত । প্রথমটি হলো পৃথিবী যেখানে আমরা বসবাস করি । দ্বিতীয় কি হল 'স্মৃতিলোক' যেখানে সমস্ত মানবজাতির কথা লুকিয়ে থাকে । আর তৃতীয়টি হল 'আধ্যাত্মিক লোক 'যাকে বলা যেতে পারে সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ । এই মানবচিত্তের মহাদেশে মানুষের সত্যের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে আসে, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের বিপদে-আপদে ঝাপিয়ে পড়ে । মানুষের কল্যাণমুখী চিন্তাধারা সর্ব মানুষের চিত্তের দিকে প্রসারিত করে বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মানুষের আধ্যাত্মিক যোগাযোগের দার্শনিক চেতনায় বিকশিত করে কবিতায় প্রতিফলিত হয় । তাই আমরা কোভিদ ভাষায় বলতে শুনে _____
"হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি
জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি ।
ধরায় আছে কত মানুষ শত শত
আসিছে প্রাণে মোর হাসিছে গলাগুলি" ।
( প্রভাত- উৎসব --রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
সমগ্র বিশ্বে একটাই আকাশ তার নিচে পৃথিবীতে আছে মানবজাতি । সেখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি হবে ভাব বিনিময় । পরস্পর পরস্পরকে উপলব্ধি করার মানসিক প্রবণতা থাকবে । সখ্যতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা হবে মানবতার দর্শন । মানুষে মানুষে জাতিগত বিদ্বেষ থাকবে না,বর্ণগত বৈষম্য স্থান পাবে না , ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামির জায়গা থাকবে না । ক্ষুদ্র স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকলে মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না । বৃহত্তর সীমানা এসে দাঁড়ালে মহামানবের মিলনভূমিকে পষ্টভাবে বোঝা যায় । মানুষকে সেবা করে, ভালবাসার মধ্য দিয়ে, হৃদয় দিয়ে কাছে টানা যায়। তখন দূর হয়ে যায় নিকট , অপরিচিত হয়ে যায় পরিচিত, সংকীর্ণতা সরে গিয়ে ব্যাপক সর্বমানবিক সত্তার উন্মেষ ঘটে । সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না । আবদ্ধতার বেড়াজালকে না টককালে পরম সত্যকে উপলব্ধি করা যায় না ।
" হে মোর চিত্ত , পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।
হেথায় দাঁড়িয়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে ,
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্ধন করি তাঁরে ।
ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর , নদী-জবমালা ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে" ।।
(ভারততীর্থ-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় মানবতাবাদ বোঝায় মানবকল্যাণ । সকল মানুষের মঙ্গল চিন্তায় মানবিক আদর্শ । জীবনের পরম মূল্য এই মানবতার মধ্যে নিহিত । রবীন্দ্রনাথের এই মানব ধর্ম একপ্রকার আত্মপ্রকাশ ,আত্মঅনুসন্ধান ,ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে উত্তরণ । 'জীবনে জীবনে যোগ করা , না হলে কৃত্রিম পণ্যে পরিণত হয় গানের পশরা' । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ",দর্শনে যে সগুণ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হল 'মানব ব্রহ্ম। তাই তাঁর জগৎ মানব জগৎ, মানবিক সত্তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যে নৈব্যক্তিক জাগতিক সত্তা , তাঁকে প্রিয় বলা বা কোন কিছু বলার কোন অর্থ নেই" ।
কবিতার সৃষ্টি কি দর্শন থেকে ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,কবিতা প্রাচীনকাল থেকে আজও রহস্য হয়ে রয়েছে । কবি কে বা কি তার আত্মকথা ,এই নিয়ে তর্ক আজও অব্যাহত । কিভাবে কবিতার সৃষ্টি হল তা নিয়েও বিতর্ক প্রশ্নাতীত । কবিতা কি এ কথা কারুর পক্ষে বোধহয় বলা সম্ভব নয় , বরং এ কথা বলা অনেকটা সহজ যে কবিতা কি নয় ।
তবে কবিতার স্বরূপ,প্রকরণ ,সৌন্দর্য এইসব নিয়ে তর্কের বুঝি কোন শেষ নেই । এই সৌন্দর্য কে নিয়ে সকল শিল্পীর খেলা । কবি ও একজন শিল্পী ,সুতরাং কবিদের সৃজনশীলতা শিল্পশাখায় সূক্ষ্মতম নিদর্শন । সুন্দর আর অসুন্দর কে নিয়ে শিল্পীর এই খেলা চিরকালের । এই কারণেই কথায় কথায় কোন জিনিসকে তুলনা করার সময় বলা হয় তা কবিতার মত হয়ে উঠেছে ।
কবিতা তুমি সৃষ্টি মুখর অতীত হৃদয়ের এক বহিঃ প্রকাশ,
জাতির স্বপ্ন সাধনায় বেড়ে ওঠা এক প্রতিফলিত বাস্তবতার রূপ |
কবিতা তোমার আহ্বানে আমি খুঁজে পাই সম্প্রীতির এক গৌরব সুষমা |
কবিতা, তুমি মনের আয়নায় ও জীবনের ভাব ধারায় উৎজ্জীবিত রূপ
তুমি সমগ্র কর্মধারার এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি |
দার্শনিকদের মত কবিরাও সৌন্দর্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন প্রাচীনকাল থেকেই । খ্রিস্টপূর্বকালের দার্শনিক প্লেটও বলেছিলেন , "সৌন্দর্য স্বর্গীয় "। স্বর্গীয় সুন্দর যথার্থ সুন্দর অর্থাৎ পরম সুন্দর । বস্তুত জাগতিক সুন্দরকে সেই পরম সুন্দর নিজের দিকে আকর্ষণ করে । প্লে তো বলেছিলেন , "Deformed is always inharmoniou with the devine, and the beautiful harmonious ."। আবার প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টোটলের মত ছিল ভিন্ন তিনি সৌন্দর্যকে নিরস্তক মনে করতেন না । বিশৃঙ্খলা ,সামঞ্জস্য ও ব্যস্ততা তাঁর মতে সৌন্দর্যবোধের উৎস বলে মনে করতেন । তাঁর অভিমত হলো ---- দর্শন এমন এক সত্তা যা সত্তাকে নিয়ে আলোচনা করে ---- সত্তাকে বিশুদ্ধ সত্তা হিসেবে দেখে , সত্তার বিভিন্ন আংশিক দিক নিয়ে আলোচনা করে না ( philosophy is the science of being , quabeing of being as such or pure being,) তিনি সৌন্দর্যকে নিরস্তক মনে করতেন না । তাঁর মতে সৌন্দর্যের তিনটি উপাদান আছে । যথা -- শৃঙ্খলা,সামঞ্জস্য ও স্পষ্টতা । আবার নিওপ্লেটোনিকের কেউ কেউ প্রেমানুভূতিকে সৌন্দর্যবোধের উৎস বলে মনে করতেন । এ নিয়ে বিভিন্ন তর্ক বিতর্ক থাকলেও এ কথা সত্য যে শিল্প হিসেবে অসার্থক ও অসুন্দর সৃষ্টিকে কোন সচেতন সাহিত্যরসিকই মেনে নেননি । প্রায় প্রত্যেক সাহিত্যিক সুন্দরকে কামনা করতেন শিল্পের প্রয়োজনে। সুতরাং সৌন্দর্য শব্দটি ভাববাদী বা বস্তুবাদীরা যে মতেই ব্যাখ্যা করুন না কেন , অসুন্দর ও অসার্থক সৃষ্টিকে শিল্প সাহিত্যের রাজত্বে স্বীকৃতি দেন নি কেউই । এই শিল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ টে উল্লেখযোগ্য কথা বলেছিলেন --
"যে কাঠ জ্বলে নাই, তাহাকে আগুন নাম দেওয়া যেমন যে মানুষ আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশের মত নীরব হইয়া থাকে তাহাকেও কবি বলা সেই রূপ । অতএব শিল্পীকে হতে হয় রূপকার আর কবি হলো শিল্পের কারিগর । রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে রাজা তার প্রিয়তমা রানী সুদর্শনাকে বলেছিলেন , তাঁকে দিনের আলো না দেখাতে । কারণটি কী? রাজার ভয়ানক রূপ সুদর্শন আর সইতে পারবেন না। কিন্তু সুদর্শনা তা মানতে চাননি । ভেতরে ভেতরে তাঁর যে ব্যাকুলতা, সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সাধনা । সাধনার কঠিন রূপের পুজোর বাসনায় পুষ্প নিবেদন ছাড়া হয়তো কবিতা তৈরি হয় না । কবিতা যেমন রসের সামগ্রী , ঠিক তেমনি দৃষ্টিরও বস্তু । এমনকি একটু বাড়িয়ে ছাড়িয়ে তাকে আমরা বলতে পারি যে , হৃদয় মথিত রক্তদগারের অকুণ্ঠিত প্রকাশ । এবার কথা হল , হৃদয় কার নেই? সকল মানুষেরই হৃদয় আছে । সকল মানুষই তার হৃদয়ের কথাকে শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চায় । তাহলে এখন প্রশ্ন হল মানুষের হৃদয়ের কথাকে শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করাতকেই কি কবিতা বলা যেতে পারে ? তাহলে তো সকলেই কবি হয়ে যেত । রাশি রাশি কবির ভিড়ে সত্যিকারের কবিকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না । হয়তো সেজন্যই যে কোন আবেগের বা অনুভবের তাৎকালিক উচ্চারণ কবিতা তৈরি হয় না । গালিব একবার তাঁর কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন , "একদিকে সীমাহীন কাতরতা ,অন্যদিকে নির্বিকার নিশ্চুপতা "। একথা গালিব প্রেমিক বা আল্লাহু বা ঈশ্বর যার উদ্দেশ্যেই বলুন না কেন, এই সীমাহীন কাতরতার প্রকাশ নিয়ে কিন্তু কবিতার জগৎ তৈরি হয়। আর অন্যদিকে সীমাহীন নিশ্চুপতা আছে বলেই একজন কবি এগিয়ে চলেন , যে মুহূর্তে কার তৃপ্তি জাগবে , সেই মুহূর্তেই খন্ডিত হয়ে যাবে তাঁর কবিতার ভুবন।