প্রবন্ধ
মই পূজা
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
আমাদের বাংলার প্রতিটি মাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নানান লোক সংস্কার ,উৎসব।এই উৎসবগুলো পুরোনো বছর থেকে নতুন বছরে বহমান। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলের এমনই একটি লোকৎসব মই পূজা।এটি অনুষ্ঠিত হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। কৃষকেরা জমিতে হল কর্ষণের পর জমির মাটি পাট করার জন্য বাঁশের তৈরি সাত/ আট ফুট লম্বা মই,লাঙল খুলে বলদের সঙ্গে জুতে দেন,এরপর কৃষক সেই মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে দুই বলদের পিঠে হাত রেখে চালাতে থাকেন এবং এইভাবে আস্তে আস্তে ক্ষেতের উঁচু নীচু সমান হয়।
এই উৎসবের কেন্দ্রে থাকে মই,আর কোনো দেবদেবীর মূর্তি এক্ষেত্রে পুজিত হয়না। ধান ঝাড়াই হয়ে গেলে সেখানে গর্ত খুঁড়ে একটি মইকে পোঁতা হয়পৌষ সংক্রান্তির ভোরে।এই মইয়ের তলায় থাকে গরু বাছুরের চিত্রের আলপনা দেওয়া কাঠের পিঁড়ি।এরপর সেই পিঁড়িতে তুষ গোবর দিয়ে দুটি গোল নাড়ুর মতন তৈরি করে বসিয়ে দেওয়া হয়।এই নাড়ুগুলির উপর মূলো বা সর্ষে গাছের ফুল গুঁজে দেওয়া হয়।এই তুষগোবরের নাড়ু সদৃশ মূর্তিগুলোকে লক্ষ্মীদেবীর বারমূর্তি বলে।প্রধান দেবতা মইয়ের সঙ্গে অঙ্গ দেবতা হিসেবে থাকে দা কাটারি,দড়ি, ধামা ,কুলো,লাঙল ইত্যাদি।
এর কিছু আগে ধানকাটার দিনের সঙ্গে যুক্ত হয় শুক সারি পূজা। গৃহকর্তা পুজোর দিন ভোরে স্নান সেরে ধান ক্ষেতের ঈশান কোণ থেকে ৩/৪ টি পাকা ধানের গোছ কেটে চুলের মতন বিনুনি করে সেগুলি মাথার উপর রেখে মৌনতা অবলম্বন করে বাড়িতে নিয়ে এসে ধানের গোলার গায়ে রেখে দেন।এর নাম হয় শুকপুরী। ধান কাটার শেষদিনে গৃহকর্তার জন্য বিশেষভাবে রেখে দেওয়া কয়েকটি পাকা ধানের গোছ কেটে এনে গৃহকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে ধান কাটার সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং এই বিনুনির মতন গুচ্ছ নাম হয় সারী। পৌষ সংক্রান্তির এই মই পুজো উপলক্ষ্যে শুক সারীর মিলনোৎসবও পালিত হয়। শুক সারীরূপী আলাদা দুটি বিনুনির মতন ধানের গুচ্ছকে ঐ মইয়ের সঙ্গে বেঁধে পূর্বোল্লিখিত পিঁড়ির উপর দাঁড় করানো হয়। এরপর সিঁদুর চন্দন ফুল দিয়ে সাজিয়ে পুজোর বিশেষ শুভক্ষণের জন্য অপেক্ষা করা হয়। এই অপেক্ষার সময়কাল দীর্ঘায়িত হতে পারে। দূর বনের মধ্যে থেকে শেয়ালের ডাক শোনা গেলে পুজো শুরু হয়। এক্ষেত্রে শেয়াল ক্ষেত্রদেবতা আর শুকসারী সুখের প্রতীক।মই দেবতাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে পুজো শুরু হয়। পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় নতুন চালের চিঁড়া আর খেঁজুরের গুড়, এছাড়া থাকে আদা ও কিছু ফলমূল, যেমন পাকা কলা, রাঙ্গালু, কুল ইত্যাদি।
এই উৎসবটির সঙ্গে তুষ তুষালি ব্রতের ছড়া যুক্ত হতে দেখা যায়। যেমন- তুষলী গো রাই/ তুষলী গো মাই / তোমায় পুজিয়া আমি কি বর পাই / অমর গুরু বাপ চাই/ ধন সম্ভারে মা চাই / রাজেশ্বর স্বামী চাই/ সভা আলো জামাই চাই/সভা পন্ডিত ভাই চাই/দরবার সভা বেটা চাই/ সিথের সিঁদুর দপদপ করে/ হাতের নোয়া ঝকঝক করে/ আলনায় কাপড় দলমল করে/ ঘটি বাটি ঝকমক করে/ সিঁথির সিঁদুর মরাইয়ের ধান/ সেই যুবতী এই বর চান ইত্যাদি।
No comments:
Post a Comment