গল্প
রেজিগনেশান
মৌসুমী চৌধুরী
" যত্তসব! তোদের যত রাত দখল, ভোর দখল, দ্রোহের চিৎকার সব কেমন মিইয়ে যায় ওই ভার্গবদের পকেটের কাছে! ডিজগাস্টিং! ... কি হল শেষ পর্যন্ত! সমাজ তোলপাড় করে আন্দোলনে নামলি। সবাই আমরা ভাবলাম এবার হয় এস্পার, না হয় ওস্পার হবে। জেগে উঠেছে নারীশক্তি! সমাজ থেকে চিরতরে ভার্গবরা এইবার নির্মূল হবে। একটা নব জাগরণ আসতে চলেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কিচ্ছুটি হল না। কিচ্ছুই না। সব শূন্য...বিগ জিরো!"
—আপন মনে হতাশায় গজর গজর করছিলেন মিঃ সেন।
মিঃ সেন মানে " কনস্টেলেক গার্মেন্ট হাউস" এর পি.আর.ও মিঃ সুপ্রতীক সেন। এ কোম্পানির সমস্ত ক্লায়েন্ট ডিল, অ্যপয়েন্টমেন্ট লেটার, প্রোমোশান লেটার, টার্মিনেশান লেটার এবং এমনকি স্যাক লেটারও তিনিই রেডি করেন এবং সমস্ত কর্মীদের রেজিগনেশান লেটারও তাঁকেই জমা দিতে হয়। পেশাগত কারণেই জীবনের ওঠা-পড়া জলছবি হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর চোখের সামনে।
গত মাসেই ওই মেয়েটা নতুন জয়েন করেছে তাঁদের এই অফিসে। নামখানা বেশ বাহারি — সেঁজুতি! মেয়েটার চেহারায় নিম্ন মধ্যবিত্তের ছাপ রয়েছে। তবে মুখে এই বয়সেই বেশ একটা রাশভারী ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে আর একটা আলগা শ্রীও লেপ্টে আছে শ্যামলা পানপাতার মতো কচি মুখখানা ঘিরে। পিঠের ওপর যেন কালো মোটা ময়াল সাপের মতো ঝুলছে একটা জেদী বিনুনি। সে়ঁজুতির এক মাসের কাজের খতিয়ান দেখে মিঃ সুপ্রতীক সেন ঠিক বুঝতে পেরেছেন যে, কাজে সে বেশ এফিসিয়েন্ট। কিন্তু এই অফিসের এম.ডি. কুষান ভার্গবের পি.এ. হতে গেলে শুধু তো কাজে এফিসিয়েন্ট হলেই চলবে না, আরও কিছু দেওয়া চাই-ই চাই। মেয়েটা হয়তো সেসব জেনেশুনেই ঢুকেছে এ চাকরিতে!... যত্তসব!!!
কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে মিঃ সেন দেখলেন ফাইল হাতে নিয়ে রামদীন দাঁড়িয়ে আছে।
— " একা একা কি সোব বাত করছিলেন, সেন বাবু? সিরিয়াস কুছু হয়েছে নাকি?"
—" না না। কি আর আবার হবে? বল, কি বলবে।"
ফাইলটা বাড়িয়ে দেয় রামদীন,
— "এই ফাইলটা জলদি রেডি কোরতে হোবে। এই ফাইল আর সেঁজুতি ম্যাডামকে নিয়ে বড় সাহাব কাল সামকো ক্লায়েন্ট মিট কোরবেন। এক বড়া বিদেশি ক্লায়েন্ট আসছেন ..."
— "ওহ্। বুঝেছি বুঝেছি ... তাই আজ সন্ধেতে নতুন পি.এ. মিস সেঁজুতির সঙ্গে বড়সাহাবের বিশেষ মিটিং আছে, তাই তো?"
মোটা গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে চলে যায় রামদীন।
ওপেন সিক্রেট! মিঃ ভার্গব আজ বিছানায় এক নতুন শিকার তুলবেন। এই অফিসের সব্বাই সবকিছু জানে। কিন্তু কেউ কিছুতেই মুখ খোলে না। পেট বড় বালাই যে! মিঃ সেনও কি কিছু বলতে পারেন? নাহ্ ... সামনের বৈশাখে তাঁর মেজো মেয়েরটির বিয়ে। মেজোর নিচে আরও দুটি মেয়ে রয়েছে। তারাও দ্রুত বেড়ে উঠছে। মেজ মেয়ে রুবি কিছুদিন হল একটি প্রাইভেট সেক্টারে চাকরি পেয়েছে। মাইনে খুব একটা বেশি নয়। তবু বাবার বুড়ো হাড়ে একটু বাতাস লেগেছে আর কি। কিন্তু রুবির অফিসেও নাকি একজন মূর্তিমান মিঃ ভার্গব আছেন। তাঁকে খুশি করতে না পারলে চাকরি টিঁকিয়ে রাখা নাকি মুশকিল হয়ে যাবে। একটা গভীর অসহায়তা উথাল-পাথাল করে মিঃ সেনের বুকে!
কিন্তু তোরা মেয়েগুলোই বা কেমন রে! প্রতিবাদ করে চাকরিটা টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করবি না ? তোদের ওই রাত দখল-ভোর দখল ইত্যাদি সবকিছু কি একেবারেই বৃথা গেল? এমন গণ আন্দোলন কি তোদের কিচ্ছুই শিখিয়ে গেল না? তোদের শিরদাঁড়া শক্ত করবার শিক্ষাটুকুও কি দিল না?... তখনই তাঁর ফোনটা বেজে উঠতে চমকে ওঠেন মিঃ সেন। তাঁর মেজ মেয়ে রুবির গলা,
— " বাবা, চাকরিটা আজ ছেড়েই দিলাম। বসের সঙ্গে কোম্পানির গেস্ট হাউসে একটা রাত কাটান আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়। রেজিগনেশান লেটারটা মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছি।"
হঠাৎ মিঃ সেন দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেঁজুতি। মুখে মৃদু হাসি! বিরক্ত লাগে মিঃ সেনের। ওঃ মুখে হাসি যেন আর একেবারে ধরছে না! বিরক্তি চেপে জিজ্ঞেস করেন,
— " কি ব্যাপার?"
উত্তরে একটা চিঠি মিঃ সেনের হাতে ধরিয়ে দেয় সেঁজুতিও ।
No comments:
Post a Comment