গল্প
শুরু
লীনা রায়
ছেলে, বৌমা দুজনেই চাকুরে। সাড়ে আটটায় বেরিয়ে যায়। নাতি স্কুল থেকে ফেরে তিনটের সময়। তাকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তার ছুটি। এখন বিকেল চারটে। তখনই প্রতিভা খানিকক্ষণ সময় পান। মোবাইল ফোন নিয়ে বসেন।মেসেজ দেখেন। ছেলেবেলার বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। দীর্ঘ দিন যোগাযোগ না থাকলেও, শেষ বয়েসে আবার সবাই একসঙ্গে। সকাল থেকে অনেক মেসেজ জমা হয়ে থাকে। এই সময় তিনি সব খুঁটিয়ে পড়েন। উত্তর দেন। বড় ভাল লাগে। এই সময়টা তার নিজের ছেলেবেলায় ফিরে যাওয়ার।
আজ মেসেজে দেখলেন মৌসুমীর চল্লিশতম বিবাহ বার্ষিকীর নিমন্ত্রণ। সক্কলে খুব খুশি। অনুষ্ঠান, সঙ্গে বন্ধুদের দেখা হওয়া – সবাই বেশ উত্তেজিত। সবার কমেন্টেই খুশির ছোঁয়া। প্রতিভাও লিখলেন।
ফোনটা রেখে বালিশে মাথা রাখলেন। অনুষ্ঠান, উপহার সব কিছু নিয়ে ভাবছিলেন। বুকলুর স্কুলে যাবার পথে একটা বুটিক আছে। সেখানকার শাড়ি, পাঞ্জাবি বেশ চোখ টানে। সেখান থেকেই ওদের জন্য উপহার কিনবেন ঠিক করলেন।
রাতে খাবার সময় ছেলে বৌমাকে মৌসুমীর বিবাহ বার্ষিকীর কথা জানালেন। ওদের জন্য গিফট কিনতে হাজার পাঁচেক দরকার সেটাও বললেন। আর এরপরেই টেবিল- আড্ডায় ছন্দপতন। সব কথা, গল্প হঠাৎ নীরবতায় বদলে গেল। বৌমা খানিকটা খাবার খেয়ে উঠে গেল। ছেলে চুপচাপ খাবার খেয়ে মুখ ধুতে চলে গেল। প্রতিভা টেবিলে একা। খাবার জুড়িয়ে যাচ্ছে।কিন্তু খাবার আর মুখের দূরত্ব যেন হাজার মাইল। হাতে পায়ে সাড় নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। কত সময় পার হল খেয়াল নেই। শেষ পর্যন্ত উঠলেন।
আজ আর ওষুধ খেলেন না। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলেন। হাবিজাবি কত ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবনের প্রথম লিপস্টিক হারিয়ে যাওয়া, মাধ্যমিকের জন্য গান শেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া.... আরও কত কী! কত দীর্ঘ মন খারাপের সময় একা একা লুকিয়ে কেঁদেছেন। আজও কাঁদলেন। বালিশ ভেজালেন। খানিক হালকা হলেন।
পরদিন আবার সব আগের মত। প্রতিভার ব্যস্ততা , নাতির সঙ্গে খুনসুটি সব সব আগের মত। শুধু রাতে ঘুমের সময়টা খানিক পিছিয়ে গেল।
অবশেষে সেই দিন এলো।ছেলে, বৌমা অফিসে বেরিয়ে গেল। সামান্য প্রসাধন, কাঁথা স্টিচের মভ সিল্কের শাড়ি পরে তৈরি হলেন। এগারোটায় বাড়ি থেকে বের হলেন।
মৌসুমীর বাড়িতে পৌঁছে দেখেন হাসি, গান , আড্ডায় জমজমাট পরিবেশ। দুপুরের খাবার পর্ব মিটে গেলে আর এক পর্ব আড্ডা শুরু হল। সঙ্গে সঙ্গে গিফট দেখা। জুয়েলারি, শো পিস কত কী। একসময় প্রতিভার গিফট খোলা হল। হাতের কাজের দুটো শাল, দুজনের জন্য। হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতে লাগল ওর উপহার। সবাই যখন জানতে পারে প্রতিভা নিজে তৈরি করেছে, অবাক হয়ে যায়। প্রশংসায় ভরিয়ে দেয় ।
এরপর যা হল তারজন্য প্রতিভা তৈরি ছিলেন না। অতিথিদের মধ্যে থেকে দশ জন শালের অর্ডার দিলেন। প্রতিভার বারবার মানা করা সত্বেও তারা জোর করেই অ্যাডভান্স গুঁজে দিল তার হাতে। বান্ধবীরাও খুব খুশি। ফেরার সময় অ্যাডভান্সের টাকা থেকে মালা নিয়ে এলেন।
বাড়ি ফিরে স্বামীর ছবিতে মালা পরিয়ে দিলেন। ফিস ফিস করে বললেন, ‘ তোমার ইচ্ছে ছিল আমার হাতের কাজের শাল গায়ে বিকেলে দুজনে হাঁটতে যাব। তোমার ইচ্ছে পূর্ণ করতে পারিনি। তুমি সময় দাওনি। কিন্তু তোমার এনে দেওয়া শালের কাপড় আর সুতোয় নতুন অধ্যায় শুরু করলাম। পাশে থেকো ।'
No comments:
Post a Comment