গল্প
উন্নয়ন
সুদীপ মজুমদার
মাথায় বড় ঝুড়িটা নিয়ে এত জোরে হাঁটছিল শিবানী যে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে প্রায় দৌড়াচ্ছে। কাঁঠাল গাছের নীচে ভজার চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছিল সুবল। শিবানীকে দেখে বলল, "আস্তে যা। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে সব নষ্ট।" শিবানী বলে, "কাকা ট্রেনের টাইম তো হয়ে গেছে, এখনি এসে পড়বে। স্টেশন এখনও দশ মিনিটের পথ।"
গ্রামের নাম রানীনগর। রেল স্টেশনের নাম রানীনগর জলপাইগুড়ি। এত বড় নাম কেউ বলে না, রানীনগর-ই বলে। গত দু`সপ্তাহ থেকে এই স্টেশনটার চেহারাই পাল্টে গেছে। না কোনো বাড়তি প্ল্যাটফর্ম বা নূতন নির্মাণ হয়নি। হয়েছে একটা নূতন ট্রেন। নাম তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস। কোলকাতার শিয়ালদা স্টেশন থেকে ছেড়ে এই রানীনগরে এসে এটা দুভাগ হয়ে যায়। তিস্তা অংশটা কেটে জলপাইগুড়ি শহরে চলে যায় আর বাকি ট্রেনটা তোর্সা নাম নিয়ে আলিপুরদুয়ারে যায়। বিকেলে আবার তিস্তা এসে অপেক্ষা করে তোর্সার জন্য। আলিপুরদুয়ার থেকে তোর্সা এসে এই রানীনগরে তিস্তার সঙ্গে জোড়ে। এইসব কর্মকাণ্ড সারতে প্রায় একঘন্টা এই স্টেশনে গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে এখানে চা খায়।
শিবানীকে ঐ ভাবে ছুটতে দেখে সুবলের হরিদার কথা মনে পড়ে। হরিদা সুবলের থেকে কিছুটা বয়সে বড় হবে। সুবলকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখত। গতবছর হঠাৎ করে মারা যাবার আগে পর্যন্ত সুবলের সঙ্গে খুবই সখ্য ছিল। আমবাড়ীর কাছে হরিদার কিছু ধানী জমিও ছিল। সবসময় দেখাশোনা করতে হতো না। আধিয়ার দেবেশ্বর খুবই সৎ ও বিশ্বাসী মানুষ ছিল। দেবেশ্বর মারা যাবার পর ওর ছেলে নিরীক্ষণ একদমই সুবিধার ছিল না। তখন সুবলকে নিয়ে হরিদা মাঝে মাঝে আমবাড়ীতে জমিজমা তদারকি করতে যেত। হরিদারই একমাত্র মেয়ে এই শিবানী। ছোটবেলা থেকেই অপূর্ব সুন্দর দেখতে। গ্রামের সবাই ওকে ভীষন ভালোবাসতো। শিবানীর ব্যবহারও ছিল চমৎকার, এই জন্যই সবাই ওকে আরও পছন্দ করতো। সুবলদের চোখের সামনে শিবানী ছোট থেকে বড়ো হয়ে উঠলো। সেই একটা দিনের কথা সুবলের এখনো মনে আছে। হরিদার সঙ্গে একসাথে ট্রেনে মালদা যাচ্ছিল সুবল। হরিদার কোলে ছোট্ট শিবানী। ঐ কামরায় একজন আর্মি অফিসার ছিলেন। গল্প করতে করতে উনি শিবানীকে কয়েকটা চকোলেট দিলেন। হরিদাকে বললেন - এই মেয়ে বড়ো হয়ে আপনাকে খুব জ্বালাবে। অবাক হয়ে হরিদা জানতে চেয়েছিলেন যে উনি কেন এরকম বলছেন। ভদ্রলোক বললেন - মেয়ের এখন রূপ লাগছে, এরপর যৌবন লাগবে। ওকে খুব সাবধানে রাখবেন।
শিবানীকে নিয়ে হরিদার অনেক স্বপ্ন ছিল। বলতো - ওকে অনেক লেখাপড়া শেখাবো। ভালো বিয়ে দেব, এইসব। হরিদা যখন মারা যায় শিবানী তখন ক্লাস এইটে পড়ে। গ্রামের স্কুল সকালে হয়। এরপর নাইনে উঠলে শহরের বড় স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করার কথা ছিল। সেটা হলোনা। হরিদা মারা যাবার পরে ওদের সংসারে উপার্জন করার আর কেউ ছিলনা। সব দায়িত্ব সুবলের ওপর এসে গেল। সুবল প্রায়ই হরিদার বাড়িতে যেত। একদিন বৌদি চায়ের সঙ্গে বাড়িতে বানানো ভাঁপা পিঠে সুবলকে খেতে দিলো। আর তখুনি সুবলের মাথায় আইডিয়াটা এলো। বলল,"বৌদি এত ভালো ভাওয়া পিঠা বানাইছেন, একটু বেশি করে বানাইলে শিবানী স্টেশনে গিয়া বিক্রি করতে পারবে।" সেই শুরু। তিস্তা তোর্সা দু`বেলা একঘন্টা করে দাঁড়াতো। ঐ সময় শিবানীর কাছে ভাঁপা পিঠে খাবার লাইন পড়ে যেত। একঝুড়ি পিঠে নিমেষে শেষ হয়ে যেত। শিবানীর মা পিঠে বানাতে হিমিশিম খেয়ে যেত। নাইনে আর পড়া হলো না শিবানীর। তবে সংসারে টানাটানিটা আর থাকলনা। এভাবেই চলছিল অনেক বছর। তারপরে হঠাৎ করেই আবার ওদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল অন্য একটা ঘটনায়।
সরকারি সিদ্ধান্তে দার্জিলিং মেল নিউজলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলো আর সেই সঙ্গে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস জলপাইগুড়ি না এসে সোজা আলিপুরদুয়ার অবধি যেতে লাগল। তিস্তার অংশ জলপাইগুড়ি না আসায় রানীনগর স্টেশনের গুরুত্বও কমে গেল, এমনকি ওখানকার স্টপেজও উঠে গেল। শিবানীর চোখের সামনে দিয়ে রানীনগরে না দাঁড়িয়ে ট্রেন ঝমঝম করে দুবেলা চলে যায়।
সুবল ভাবে উন্নয়নের খবর ফলাও করে টিভিতে প্রচার হয়, খবরের কাগজে বের হয়; কিন্তু উন্নয়নের ফলে শিবানীদের মতো কিছু সংসার যে পথে বসে যায় তার খবর কোথাও নেই।
হঠাৎ করে একদিন সস্ত্রীক সুবল হরিদার বাড়ি গিয়ে বৌদি ও শিবানী কে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। হরিদার একটা স্বপ্ন পূরণ করার মানে শিবানীর একটা ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়।
No comments:
Post a Comment