প্রকাশক রীনা সাহার কলাম
" গোবরাচরণ গড়করি বনাম কবিবাজ লবি "
আপনারা তো জানেন গোবরাচরণ গড়করি আমার গো- ব্যবসায়ী কবি বন্ধু। ইধারকা গরু উধার করার পাশাপাশি সাইড এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে কবিতাও লেখেন। এই লাইনে অবশ্য আমিই ওনাকে এনেছিলাম। আমারই অনুপ্রেরণায় ওর একটা ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছিল। তাতে ওর লেখা কয়েকটা কবিতা পোস্ট করে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন যেতে না যেতেই লাইক - কমেন্টের বহর দেখে উনি এতটাই হামলে লিখতে লাগলেন যে নানান পত্রপত্রিকায় ছেয়ে গেলেন। ভুলভাল, ছাইপাশ লিখে কেমন করে যেন "কবিশ্রী" উপাধিও পেয়ে গেলেন। সেই গোবরাবাবু একদিন সকালে আমার কাছে এলেন একটা আবদার নিয়ে। আর জি কর আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে রাজ্য অনুরাগী কবি - সাহিত্যিকরা নাকি একটা মিছিল বের করবেন এবং সেই মিছিলের ব্যানারে যে লেখাটা ছাপবে সেটা আমাকে লিখে দিতে হবে। কিন্তু স্কুল টিচারদের এসব করা একেবারেই উচিত নয় বলে বললাম, `আপনিও যতটা পারবেন এসব থেকে দূরে থাকবেন দাদা।` উনি ইতস্তত করে বললেন, `আসলে এই মুহূর্তে বর্ডার সিল। গরুপাচার বন্ধ , ব্যবসাপাতিও নেই। ইদানিং কবিতা- টবিতাও তেমন পাচ্ছে না। তাই সরকারের হয়ে একটু পোতিবাদ, টোতিবাদ করে নেতাদের নেক নজরে থাকতে চাইছি। তা আপনি একেবারে জল ঢেলে দিলেন স্যার !`
এরপর বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। উনি যে অঞ্চলে থাকেন সেই গোবরাছাড়া অঞ্চলের শাসকদলের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। কবি, কবিশ্রী, গো ব্যবসায়ী আবার অঞ্চল প্রধান --- এক ব্যক্তি, অনেক পদ। তাই ওর ওপর পার্টির লোকের ক্ষার। তাছাড়া এ বছর ওনার অঞ্চলের উদ্যোগে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওই সময়ই একদিন বিকেলে গোবরাবাবুর স্ত্রী গোমতী বৌদি কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বাড়িতে ছুটে এলেন। কান্নার আওয়াজ পেয়ে আমার স্ত্রী গজগামিনী রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে আমাকে দরজা খুলতে আদেশ দিয়ে নিজে প্রায় মিনিট পাঁচ পরে এলেন। স্নেহময়ী ডান নিতম্ব আর বাম নিতম্ব হেলিয়ে দুলিয়ে যেই না তিনি এলেন আর অমনি গোমতী বৌদি ছুটে গিয়ে দুহাতের বেড়ে ওকে জড়াতে চাইলেন। কিন্তু ডাহা ফেল মেরে অগত্যা ওর বুকেই মুখ গুঁজে মরা কান্না জুড়ে দিলেন। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, আপনার গোবরাবাবুকে গতকাল রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার। ওকে নাকি সুপারি কিলার দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শাসকদলের প্রধানকে অপহরণ ! শুনে তো আমরা থ !
মূল ঘটনা দুটো । একটা রাসমেলা মঞ্চে কবি, সাহিত্যিক নির্বাচন নিয়ে আয়োজক কমিটির সঙ্গে গোবরাবাবুর মতানৈক্য। আর একটা বইমেলা মঞ্চে কবিতা পাঠে চান্স পাওয়া নিয়ে। রাসমেলা শুরুর দিনকয় আগে থেকেই নাকি গোবরাবাবুর বাড়িতে মিটিং চলছিল। সেখানে ঠিক হয় নতুন হোক বা পুরনো, চুলকানির আরাম অনুযায়ী কবি, সাহিত্যিক সিলেক্ট করা হবে। সেইমতো অঞ্চলে অঞ্চলে মাইকিং করা হল। কেউ ময়ূরের পালক, কেউ সরু বাঁশের কঞ্চি, কেউ পাতলা বাঁখারি , কেউ পাটকাঠি, কেউ পায়রার পালক আবার কেউ প্লাস্টিকের হাত নিয়ে রেডি। আমাদের গোবরাবাবু আবার সর্ব ঘটে বিল্বপত্র ! ওনাকেও কবিতা পড়তে হবে। একবার বর্ডার পার করাতে গিয়ে বি এস এফের লাঠির মারে গমিত শা নামে একটা গরুর শিং ভেঙে গিয়েছিল। গমিত শা ওর অন্যতম ফেভারিট গরু। ওই শিংটাই উনি চুলকানির জন্য ট্রাঙ্ক থেকে বের করেছেন। গোরক্ষপুর থেকে নাদুসনুদুস বাছুরটা কিনে এনে বড় করেছেন। তাই ভাঙা শিংটা প্রাণে ধরে ফেলতে পারেননি।
যাহোক গোবরাবাবুর বাড়িতেই চুলকানির দিনক্ষণ ঠিক হল। বেশ ভালই চলছিল চুলকানির পালা। কিন্তু গুবলেট হয়েছে ওই শিংটার জন্য। অন্য কারও চুলকানিতে তেমন কিছু না হলেও গোবরাবাবুর শিংয়ের চুলকানি খেয়ে বেদু কাঁচি নামে আয়োজক এক কত্তা ব্যক্তি মারাত্মক ইনফেকশন হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ওকে নাকি জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিতে হচ্ছে! সেজন্য মহিলা কবিদের শিরোমণি যাদবী দাসীর এতটাই টিক্কি খাঁড়া যে গোবরাবাবু নিজের অঞ্চলের রাসমেলা মঞ্চেই কবিতা পড়ার ডাক পেলেন না।
তবে সে যাত্রায় অল্পের ওপর দিয়ে গেলেও এবার আরও চরম ঘটনা নিয়ে গোমতী বৌদি হাজির। বইমেলা মঞ্চে আবারও সেই নতুন- পুরনো আকচাআকচি ! এবার কম্পিটিশনের বিষয় পিঠ চাপড়ানো। যে যতো আলতো করে চাপড়াবে তার কবিতা পাঠের চান্স ততো বেশি। তাছাড়া নামকরা দুটো পুরস্কারও দেওয়া হবে। সেইমতো বইমেলা শুরুর দিনকয় আগে থেকেই কবিরা মিলে পালা করে আয়োজকদের বাড়ি গিয়ে চাপড়াতে শুরু করেছে। গোবরাবাবুও কুবীর বাউদিয়া নামে এক কেউকেটাকে চাপড়াতে গেছেন। প্রথমেই হুইস্কি খাইয়েছেন তারপর এমন চাপড়েছেন যে সেই টাল কেউকেটা দমবন্ধ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি । এর পরই নাকি গোবরাবাবু কিডন্যাপড্ !
পরদিন সকাল থেকে গোমতী বৌদি একবার নার্সিংহোম আর একবার বইমেলা কমিটির আয়োজকদের কাছে দৌড়ে কূলকিনারা না পেয়ে বিকেলে আমার কাছে ছুটে এসেছেন। তখনকার মতো বৌদিকে শান্ত করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরতি পথে আমার পরিচিত দু' একজন কবিকে ফোন করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারছে না দেখে থানায় যাবো ভাবতেই বৌদির ফোন। দাদা এক্ষুনি আসুন, ওকে খুঁজে পাওয়া গেছে। গিয়ে শুনি গোবরাবাবু নাকি বেজায় ভয় পেয়ে ওরই গোয়াল ঘরে লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন গমিত শা নামে গরুটার লেঙ্গি খেয়ে কোমরে চোট পেয়ে গোবর- চনায় মাখামাখি হয়ে পড়েছিলেন। হুঁশ ফিরতে শুনতে পান ওর গোয়াল ঘরের বাইরে তালা মেরে কারা যেন ফিসফাস করছে। পালাবে কোথায় মা কালি ! ব্যাটাকে এখানেই পাকড়াও করতে হবে। শাসক দলের প্রধান হয়ে গোরু পাচারের কারবার এবার ঘুচিয়ে দেওয়া হবে। হারামজাদা আবার কবিশ্রী !
সেই থেকে গোয়াল ঘরেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন গোবরাবাবু। গোমতী বৌদিকে ডেকে যে বলবেন তালা ভেঙে বের করতে সেটাও পারছিলেন না। তবে ওর এইসব কিত্তিকান্ডে বৌদি বেজায় চটেছেন। একেবারে থার্ড ডিগ্রির হুমকিতে বলে দিয়েছেন, অনেক হয়েছে, এবার কবিতা লেখা বন্ধ। গোরুর ব্যবসা করলেও পাচার করা চলবে না। এসব ভিমরতি না ছাড়লে বৌদি নাকি লালমনিরহাট চলে যাবেন। বাপের বাড়ি থেকে আর কখনও ফিরবেন না। আসলে বৌদির বাবা গোবরাবাবুর ব্যবসার পার্টনার ছিলেন। সেই সুবাদেই বৌদির সঙ্গে প্রেম। একবার গোরু বেচে ফিরে আসবার সময় ওই ক্যান্টারেই বৌদিকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছিলেন।এপারে এসে একেবারে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে খবর দিয়েছিলেন।
বৌদির হুমকিতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গোবরাবাবু মিনমিন করে বললেন, এই সময় বাংলাদেশে যেও না, এক্কেরে কোতল হয়ে যাবে। বৌদি আমার জন্য চা করতে গেছিলেন। তা না করে রান্নাঘর থেকে বেলনা নিয়ে ছুটে এলেন , শোনো এটা কিন্তু তোমার কবিতা পাঠের মঞ্চ নয়, আমার বাড়ি। এখানে চুলকানি, চাপড়ানি চলবে না। একেবারে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবো।
বেচারা আমি তখন গোবরাবাবুর গোরুর খাঁটি দুধের চা খাওয়ার লোভে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মধ্যস্থতা করছি আর বিষ্ণুমাতাকে ডাকছি। আর উনি আমাকে ঢাল করে ফুট কেটে চলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ কবিতার কি বুঝবে ! ওরা তো কবিতাও আমদানি করে !
তারপর আমাকে বললেন , স্যার আমার জন্য আপনার মাঝে মাঝেই খুব ভোগান্তি হয়। এবার থেকে চুলকানি, চাপড়ানি সব বাদ। শুধু কাঠি করবো। যা বুঝলাম কবিতা পাঠে চান্স পাওয়ার ওই একটাই রাস্তা, কাঠি করা। আমার এত বছরের গরু কেনাবেচার অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝলাম, চুলকানি,চাপড়ানি এসব নতুন টেকনিক। বেশিদিন চলবে না স্যার। চলবে ওই বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা কাঠিবাজি।
আমি আর কি বলি ! গোরু কেনাবেচার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বৈদিক যুগের মেলবন্ধন ! কোনোমতে হাসি চেপে স্বগতোক্তি করলাম, কাঠিবাদ জিন্দাবাদ। সামনে বললাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে দাদা। গজগামিনী নিউ ইয়ারের কেনাকাটা করতে যাবে। ওকে আবার গার্ড দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। পাড়ার কয়েকটা কুকুর নাকি ওকে দেখলেই পেছন ধরে !
No comments:
Post a Comment