Friday, January 3, 2025



 





গল্প
 


উপহার
মনোমিতা চক্রবর্তী

রৌনক-- কিরে সপ্তর্ষি এত বড় লিস্ট বানিয়েছিস ! 
দেখি দেখি বলে সপ্তর্ষির থেকে ছো মেরে ডায়েরিটা নিয়ে রৌনক পড়তে থাকে।
১.মন দিয়ে পড়াশোনা করব ।
২.আগামী বছরের মধ্যে একটা চাকরি জোগাড় করবই করব।
৩. একটা রয়াল এনফিল্ড বাইক কিনব। 
৪. আর তিতলিকে এবার পটাবই পটাব।

রৌনক -- কি তিতলিকে পটাবি? এটা তোর রেজোলিউশন ?
 গোপন কথা ফাঁস হতেই সপ্তর্ষি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কারণ তিতলি যে রৌনকের ছোট বোন ।ধরা পড়ে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সপ্তর্ষি বলে-- রৌনক রৌনক ওই দেখ অংশু কি লিখছে। বলে অংশুর থেকে ছো মেরে অংশুর ডায়রিটা নিয়ে সপ্তর্ষি এবার পড়তে থাকে- 
১. এ বছরই প্রতিষ্ঠিত হব।
২. কোনদিন আর কাউকে ভালবাসবো না।
সপ্তর্ষি -- ভাই তুই এখনো রিমাকে ভুলিস নি? 
অংশু চুপ করে থাকে। 
হোস্টেলের রুমটাতে সবাই কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকার পর অংশু বলে-- এ বছরটা খুব খারাপ গেল রে আমার। রিমাকে হারালাম শুধুমাত্র গরিব বলে। অনেকটা সময়ও নষ্ট করে ফেললাম মিছিমিছি ওর পিছনে ঘুরে। 
আবারো সবাই নিশ্চুপ দেখে, পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য গলাটা খাকড়ে নিয়ে সপ্তর্ষি পরের পয়েন্টটা জোরে জোরে পড়তে থাকে।
৩. বাবাকে এ বছর যেমন করেই হোক একটা সাইকেল কিনে দিতে হবে। 
এদিকে অংশু মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে দেখে রৌনক এক ধমক দিয়ে সপ্তর্ষিকে চুপ করিয়ে অংশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-- অংশু কাকুর তো সাইকেল ছিল শুনেছি, তাহলে কাকুকে কি তুই নতুন সাইকেল গিফট করতে চাস ?
অংশু -- নারে তোরা তো জানিস আমার বাড়ির পরিস্থিতি। গত বছর পরীক্ষার ফি দিতে গিয়ে কিছু টাকা কম পড়েছিল। বাবা কিছুতেই জোগাড় করতে পারেনি বলে বাবার সাইকেলটা বিক্রি করে সেই টাকাটা দিয়েছিল ।আসলে, তোদেরকে বলাই হয়নি ব্যাপারটা। বাবা এখন পায়ে হেঁটেই সকালবেলাটা খবরের কাগজ বাড়ি বাড়ি বিলি করে ।তারপর বাবা পায়ে হেঁটেই প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে যে হোটেলটাতে কাজ করতো, সে হোটেলে যায়। দুপুর থেকে রাত অব্দি কাজ করে আবার অত রাতে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পায়ে, ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে রে । আমার খুব কষ্ট হয়। সাইকেলটা বিক্রি করাতে বাবার যে খুব কষ্ট হচ্ছে রে। তাই দুটো টিউশন বাড়িয়ে দিয়েছি। অনেকটা জমেছে টাকা।তবে আর তিন হাজার হলেই সাইকেলটা কিনতে পারব।
 সপ্তর্ষি -- এই ব্যাপার ! তা আমরা কি করতে আছি শুনি ?
 অংশু -- মানে ?
সপ্তর্ষি-- মানে হল বাবা দুদিন আগেই দেড় হাজার টাকা পকেট মানি পাঠিয়েছে, এটা তুই নে ।এটা ভরে কাকুকে সাইকেল কিনে দে অংশু। 
অংশু -- না রে, তা হয় না।
 রৌনক-- কেন হয় না শুনি ? আমার বাবাও আমাকে নিউ ইয়ারে পিকনিকের জন্য হাজার টাকা পাঠিয়েছে। এটা রাখ। সাথে গত মাসের পাঁচশো টাকা বেঁচে গেছে। এটাও রাখ। পুরোটা দিয়ে কালই একটা সাইকেল কিনে কাকুকে দিয়ে আয়। 
অংশু -- কিন্তু ?
 সপ্তর্ষি -- কিসের কিন্তু রে ? আমাদের পরিচয় বন্ধু হিসেবে দিস আর বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে দিচ্ছিস না ।
রৌনক -- অংশু আর তো মাত্র কয়েকটা মাস। এই নতুন বছরেই তো আমরা পাস আউট হয়ে চাকরি বাকরি করব। তোরও তো চাকরি প্রায় হয়েই গেছে শুধু সময়ের অপেক্ষা । তখন না হয় আমাদের টাকাটা ফেরত দিস। দেখ অংশু আরেকটা নতুন বছর,তোর সামনে হাজারো নতুন সুযোগ ঘুরে দাঁড়ানোর। যা কিছু জীবন থেকে হারিয়ে গেছে যাক, সেটা নিয়ে মন খারাপ করে অহেতুক কষ্ট পাস না ভাই।সময়, শ্রম, অর্থ ,ভালবাসা ,খারাপ সময় যা গেছে তা যাক ,বৃথা তার জন্য দুঃখ বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না অংশু।নতুন বছর নতুন করে শুরু কর। আমরা আছি তোর সাথে হাল ছাড়িস না।জানিস তো আমার মনে হয় ঈশ্বর মাঝে মাঝে আমাদের সকলকেই সুযোগ দেন ভালো কিছু করার । আর সে সুযোগটাকেই আমাদের কাজে লাগানো উচিত। ধরেনে নতুন বছর তোকে নতুন সুযোগ দিচ্ছে। এই বছরটা তুই এমন করে শুরু কর যাতে বছর শেষে তোর কোন আফসোস না থাকে। নতুনকে স্বাগত জানা, যা কিছু পুরনো তা না হয় মনেই থাক অংশু।
 
পরের দিন অংশু সকাল সকাল বাড়ি পৌঁছে দেখে তার বাবা উঠোনের এক কোনায় উনুন ধরিয়ে আগুনের গরম ওম নিচ্ছে।অংশুর মনে পড়ে ছোটবেলায় অংশুর বাবা হোটেলে কাজ করে বছর শুরুর রাতে বিরিয়ানি নিয়ে আসত।কি খুশিটাই না হতো অংশু !
আসলে প্রত্যেক বছর নিউ ইয়ারে হোটেল মালিক হোটেল কর্মীদের বকশিশ দিত এক প্যাকেট বিরিয়ানি।যা অংশুর বাবা নিজে না খেয়ে ছেলের হাতে দিয়ে বলতো -- তোর নিউ ইয়ার গিফ্ট।
 নতুন বছরের গভীর রাতে ওই বিরিয়ানির গন্ধে কি খুশি টাই না হতো মা হারানো অংশু ।

অংশুকে ওভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অংশুর বাবা অবাক হয়ে বলে -- আরে অংশু কখন এলি? কি ভাবছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ? এদিকে আয়। 
 অংশু এবার দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার হাতে সাইকেলের চাবিটা দিয়ে বলে -- এই নাও বাবা তোমার নতুন বছরের উপহার। 
অংশুর বাবা অবাক হয়ে বলেন -- এটা কিসের চাবি রে অংশু ?
 অংশুর বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলে -- তোমার নিউ ইয়ার গিফ্ট বাবা ।টিউশনের টাকা জমিয়ে আর কিছুটা বন্ধুদের থেকে লোন নিয়ে একটা সাইকেল কিনেছি তোমার জন্য ।আজ নতুন বছর শুরু বাবা ,হ্যাপি নিউ ইয়ার ।এতদিন তুমি অনেক কষ্ট করেছ বাবা । এ বছর আমার চাকরিটা হয়ে গেলে আর তুমি কোন কাজ করবে না কিন্তু। 

চোখে আনন্দের জল নিয়ে অংশুর বাবা বলেন -- রান্না ঘরে যা ,তোর নতুন বছরের গিফ্ট রয়েছে।
  মুহূর্তেই অংশুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে গেল, এক মুখ হাসি নিয়ে অংশু বলল -- বিরিয়ানি না বাবা ? এবারও তুমি খাওনি ? 
অংশুর বাবা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা ,অংশুও নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা দুজনই দুজনকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের অশ্রুতে ভাসতে থাকে।

No comments:

Post a Comment