গল্প
নতুন জীবন
আকাশলীনা ঢোল
১
তখন ভোর চারটে-সাড়ে চারটে হবে। পূর্ব দিগন্তে আলোর লেশমাত্র নেই। ‘ক্যামেলিয়া রিসোর্টে’র বাইরের দিকটায় কারা যেন আগুন জ্বালিয়ে গল্প করছে, মাঝে-মধ্যে ভেসে আসছে দু-একটা গানের কলিও। কাছাকাছি কোথাও থেকে শোনা যাচ্ছে দাঁতালের গর্জন। অজানা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল রিয়াঙ্কার। বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের আলো জ্বালল। বিছানায় তখন কম্বল মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে রোটন। রিয়াঙ্কা হাউসকোটের ওপর একটা শাল জড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া জড়িয়ে ধরল তার শরীর। ধীরে ধীরে রিয়াঙ্কার মনের মধ্যে জমে থাকা অবসাদটা কেটে যেতে লাগল।
আজ ইংরেজি বছরের প্রথমদিন। গতকাল, অর্থাৎ ৩১ শে ডিসেম্বর দুপুরের দিকে রিয়াঙ্কা এসে পৌঁছেছে লাটাগুড়ির এই রিসোর্টে তার আট বছরের ছেলে রোটনকে সঙ্গে নিয়ে। অবশ্য এখানে আসার জন্য তাকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। রিয়াঙ্কার বিয়ে হয়েছে দশ বছর হল, স্বামী বিদেশে চাকরি করে, রিয়াঙ্কা একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। গত দশ বছরে তার স্বামীর সঙ্গে কয়দিন দেখা হয়েছে, তা বোধহয় রিয়াঙ্কা হাতে গুণে বলে দিতে পারে। আত্মীয়- বন্ধুরা তাকে বহুবার অনুরোধ করেছে রোটনকে নিয়ে বিদেশে চলে যেতে। কিন্তু, তাদের অনুরোধ যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়নি রিয়াঙ্কার। সে বিদেশে চলে গেলে তার আর চাকরি করা হবে না, একথা কিন্তু কেউই ভাবেনি কোনওদিন। কেউ তার স্বামীকে অনুরোধ করেনি, চাকরি ছেড়ে এসে স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে, এমন উল্টো কথা তাই কি বলে কেউ? কিন্তু, দাম্পত্য-জীবনে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করে রিয়াঙ্কা। স্কুল-বাড়ি-সন্তানকে নিয়ে তার দিন কোনওরকমে কেটে যায়, কিন্তু এই জীবন থেকে সে খুঁজে পায় না বেঁচে থাকার রসদ। কোথাও বেড়াতে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, সিনেমা দেখা, এমনকি মনের কথা বলা, সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হয় সে, কারণ তার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। হাতে অর্থ আছে কিন্তু পরিবারের তরফ থেকে অনুমতি নেই একা একা অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাওয়ার, অপ্রয়োজনে আনন্দ করার। গত দশ বছর ধরে রিয়াঙ্কা সবকিছুই সহ্য করেছে মুখ বুজে। অবশেষে, একদিন স্কুল থেকে ফিরে রোটন যখন জেদ ধরে বসল, এবার বড়দিনের ছুটিতে তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতেই হবে, তখন রিয়াঙ্কার মধ্যেও জেগে উঠল এক প্রতিবাদী সত্তা। সে কাউকে কিছু না জানিয়েই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। সবাই সবকিছু জানতে পারল তার রওনা হওয়ার দিন। সঙ্গে সঙ্গে যেন হাজারটা টর্নেডো আক্রমণ করে বসল রিয়াঙ্কাকে। অনেক অশান্তি, অনেক অপমানের শিকার হল সে, কিন্তু, এবার সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, পরাজয় আর কিছুতেই স্বীকার করবে না। অবশ্য, সবার কথাই যে যুক্তিহীন তেমনটা নয়, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল নারীর নিরাপত্তা নিয়ে। রিয়াঙ্কার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল, তার মনে হচ্ছিল ভারতবর্ষ আদৌ কি কোনওদিনস্বাধীন হয়েছিল? তাহলে, এদেশে আজ পরাধীনতার গ্লানি কেন সহ্য করতে হয় মানুষকে? কেন আজও এত অভাব নারীর নিরাপত্তার? যে দেশ একদিকে নারীকে মা বলে পুজো করে, সেই দেশই কি অপরদিকে নারীকে মানুষের পর্যায়ে ফেলে না? নাকি এটা কেবল একটা দেশের নয়, একটা পৃথিবীরই নিয়ম? হাজার একটা চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল রিয়াঙ্কা, চিন্তায় ছেদ পড়ল অজানা এক পাখির ডাকে। চিন্তা-ভাবনায় কখন যেন কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়, পূব-আকাশে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে, সূর্য উঠতে এখনও কিছুটা দেরি। ঘরে ঢুকে রিয়াঙ্কা দেখে রোটন তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে।
২
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রিয়াঙ্কা। কলকাতা থেকে এতদূরে একা একা সে প্রথমবার এসেছে। অজানা-অচেনা জায়গা, ভয় যে প্রথমটা লাগেনি তেমনটা নয়, বিশেষ করে ‘ক্যামেলিয়া রিসোর্টে’র কর্মচারী বিশুবাবুর হাবভাব একদমই ভাল লাগেনি রিয়াঙ্কার, লোকটি বড্ড বেশি যেন গায়ে পড়া। কিন্তু, রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর যখন রোটন অসুস্থ হয়ে পড়ল, তখন বিশুবাবুই অত রাতে বাইক নিয়ে বনজঙ্গল পেরিয়ে শহর থেকে ডাক্তার ডেকে আনে, ওষুধ এনে দেয় রোটনের জন্য, রিসোর্টের ওপর এক কর্মী সন্ধ্যা এসে বারবার খোঁজ নিয়ে যায়। রিয়াঙ্কার মনে হতে থাকে পৃথিবীতে ভাল মানুষের অভাব বোধহয় এখনও হয়নি। এভাবেই রাত কেটে যায়। কুয়াশার আচ্ছাদনটা সরে যাওয়ায় ঠাণ্ডার দাপট বাড়তে থাকে। নিজেকে আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে ঢেকে নেয় রিয়াঙ্কা। দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখে সন্ধ্যা হাজির, সন্ধ্যাকে রোটনের পাশে বসিয়ে ধীরে ধীরে রিসোর্টের বাইরে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় মূর্তি নদীর দিকে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, পাতা ঝরার শব্দ আর পাহাড়ি নদীর কুলকুল ধ্বনি, মুগ্ধ করে দেয় রিয়াঙ্কার চিত্তকে। কিছুক্ষণ নদীর ধারে বসে থাকার পর, রিয়াঙ্কা যখন ফেরার পথ ধরে, তখন পূব-আকাশে নতুন বছরের নতুন সূর্য তাকে যেন ডাক পাঠাচ্ছে নতুন জীবন আরম্ভ করার। অবশ্য, এখন থেকে তো রিয়াঙ্কার জীবনে আরম্ভ হবে এক নতুন অধ্যায়। যে মানুষগুলো তার জীবনে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছিল, তাদের মুখ সে আর দেখতে চায় না, ফিরতে চায় না সেই বন্দী জীবনে। রিয়াঙ্কা এও জানে যে, সামান্য কারণে শ্বশুরবাড়ির দরজা তার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে, রিয়াঙ্কাও ছক কষে নিয়েছে মনে মনে, নতুন জীবন শুরু করার ছক। সেই জীবনে থাকবে কেবল রিয়াঙ্কা আর রোটন। পুরনো স্মৃতিকে হৃদয়ে স্থান দিয়েই তারা হেঁটে যাবে নতুনের পথে, নতুনকে জানাবে স্বাগত। স্মিতমুখে হাঁটতে হাঁটতে রিয়াঙ্কা মনে মনে গুনগুনিয়ে ওঠে- ‘এখন বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর- আমাদের যাত্রা হল শুরু...’
No comments:
Post a Comment