স্মরণ
শতবর্ষে মোহিত ঘোষ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
"এই জীবনের ঘুর্ণিপাকে কাটিয়ে দিলাম জীবনটাকে।"
কালজয়ী এই কবি ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ২০২১ সালে তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হয়।
সাদা ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত, সদালাপী, সদাহাস্যজ্বল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছড়াকার, অমৃতলোকে যাত্রার কয়েক ঘন্টা আগে এই এস ত্রম এস বার্তাটি লিখে পাঠিয়েছিলেন,বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক উমেশ শর্মার মোবাইলে। জীবনের ঘূর্ণাবর্তে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সম্মৃদ্ধ করে শেষ কয়েকটি দিন চিকিৎসার কারণে জলপাইগুড়ির একটি বেসরকারী নার্সিং তিনি হোমে ভর্তি ছিলেন। তিনি কেমন আছেন জানতে চাইলে সিলিং ফ্যানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, " এই ফ্যানে ভাতে আছি। " অর্থাৎ মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে আর নিচে বিছানায় ভাতের থালা নিয়ে বসে তিনি ভাত খাচ্ছেন। প্রতিদিনই অগণিত গুণমুগ্ধ মানুষ তাঁকে দেখতে আসছেন। কিন্তু তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। তার টেম্পল স্ট্রিটের বাড়ির চিত্রটাও একই রকম ছিল।
অত্যন্ত সদালাপী, আলোকময় মানুষ ছিলেন। এমন ব্যাতিক্রমী মানুষ আমি জীবনে দেখি নি। সদাই ছন্দের জগতে তাঁর বিচরণ। তিনি তার কলমে বাংলার সাহিত্য ভান্ডারকে আমৃত্যু সম্মৃদ্ধ করে গেছেন। তার লেখা ছড়া গুলো এইরকম।
" আমাদের বাড়ি বাপু জলপাইগুড়ি
শীত বুড়ি শুয়ে থাকে দিয়ে লেপ মুড়ি। "
"শালিকপাখি শালিকপাখি তুই আকাশের মালিক নাকি ?
মেলে দিয়ে রঙিন ডানা,চষে বেড়াস আকাশ খানা।"
"সিঙ্গাড়ারে সিঙ্গাড়া, তোর যে দেখি সিং খাড়া।
গা'টা বেজায় খসখসে, হাঁটু মুড়েই রোস বসে।"
"ডালপুরি চাই ডালপুরি
টাকায় বিকোয় এককুড়ি।"
"টিং টিং বাজে বেল
ওই চলে সাইকেল।
চাকা দুটো ঘুর ঘুর
নিয়ে যায় বহুদূর। "
"ঢুকতে বাড়ির ভেতর দিকে
খুব হুশিয়ার কুকুরটিকে। "
"ছড়া বনাম ছড়া বুনন
চলে বটে যখন তখন।"
"পাখিদের মধ্যে কোকিল
মানুষের মধ্যে উকিল
দুইয়েরই খুব নড়ে ঠোঁট
দু'টির গায়ে কালো কোট।"
"হাঁচিতে হাঁচিতে গেছিনু কাশিতে
একটি বছর আগে
কাসিতে কাসিতে আসিনু কাশিতে
সাহিত্য অনুরাগে।"
"হয় অকাজে নয় বা কাজে
টিপলে বোতাম ঘন্টা বাজে।"
"আসতে যেতে মনের ভুলে
রেখো না কেউ গেটটি খুলে। "
"ছড়া অত সস্তা নাকি
রেশন চালের বস্তা নাকি
দিস্তা খানেক কাগজ নিয়ে
তিস্তা নদীর পারে গিয়ে
কলম খুলে ভাবলে পরে
তবেই ছড়ার ছররা ঝরে। "
"ফুলঝুরি ফুলঝুরি
আঘাতেতে সুড়সুড়ি
ছোটো ছোটো ফুলকি
সোনা রঙা উলকি।"
"এবার পুজোয় শুনছি দাদা
আছে জবর খবর
শান্তিটাকে কবর খুঁড়ে
দিচ্ছে কারা কবর।"
তার বাড়ির গেটে, ফুলবাগানে, ঘরে ঢোকার মুখে, লেটার বক্সে এবং বিভিন্ন স্থানে এক একটা ছোট ছোট সাইনবোর্ডে লেখা দু'লাইন চার লাইনের মজাদার ছড়া সকল দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করত।
এককথায় মাটির মানুষ ছিলেন কবি মোহিত ঘোষ। সদাই ছন্দের জগতে তার বিচরণ। ১৯৯৭ সালে দিল্লি থেকে কর্মসুত্রে জলপাইগুড়ি এসেছিলাম। নতুন পাড়ায় থাকবার সুবাদে সেখান কার কয়েকজন শিক্ষাব্রতী দের পরিচালিত "শিশু বিদ্যা মন্দির" নামে একটা শিশুদের স্কুল ছিল। সেই স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি ছিলেন কবি মোহিত ঘোষ। শিশু বিদ্যা মন্দিরের সব সভাতেই তিনি উপস্থিত থাকতেন। ১৯৯৮ সালে শিশু বিদ্যা মন্দিরের বার্ষিক সাধারণ সভাতেই তাঁর সাথে আমার আলাপ।
সাদা ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত সদা হাস্যময় এই মানুষটিকে দেখলেই জাগতিক সব দু:খ কষ্ট লাঘব হয়ে যেত। সময় পেলেই তাঁর টেম্পল স্ট্রিটের বাড়ি "ছন্দবীথি" র কাঠের গেট খুলে তাঁর বসবার ঘরে বসতাম। তিনি বলতেন, "জীবনের সব কিছুতেই হ্যাঁ বলতে পারলেই,সব ছন্দে চলবে, না বললেই ছন্দপতন ঘটবে।" সারাজীবন ধরে তিনি তাঁর সব লেখাতেই সদর্থক ইতিবাচক বার্তা দিয়ে গেছেন।
প্রাতঃস্মরণীয় এই কবিকে দেখলেই বোঝা যেত তিনি ছন্দের জগতে বিচরণ করছেন। জাগতিক দু:খ কষ্টের বাইরে থাকা এক অসাধারণ কল্পনার জগতে তাঁর সদা বিচরণ ছিল। এই জগতের ঘূর্ণিপাক থেকে দূরে থাকা এই মানুষটিকেও জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর প্রিয় সাধের নীড় "ছন্দবীথি" এখন আর নেই। সেখানে নির্মীয়মান বহুতলের সামনে দাঁড়ালে বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে।
No comments:
Post a Comment