Monday, April 10, 2017

অনামিকা
=======
- ফিরোজ আখতার
==================                     
।। এক ।।

কাকলি রায় । বয়স ৪৭ । সহ শিক্ষিকা । চৌবানি গার্লস হাই স্কুল । বিবাহিতা কিন্তু নিঃসন্তান । অনেক চেস্টা করেছিলেন একটি সন্তানের জন্য । কোন লাভ হয় নি । তাই তাঁর অপত্যস্নেহ তিনি প্রকাশ করেন তাঁর স্টুডেন্টদের মধ্যে দিয়ে । যদিও তা প্রকাশ পায় ভিন্নরূপে । ভীষণ কড়া শিক্ষিকা তিনি । ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ গঠন করতে চান তিনি কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার ও অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে । সেখানে পান থেকে চুন খসলে ভীষণ রেগে যান তিনি । প্রতিদিন স্কুলের প্রেয়ার লাইনে সবার আগে উপস্থিত হন তিনি । তারপর প্রতি সারির ছাত্রীদের হাতের নখ থেকে শুরু করে চুলের বিনুনি পর্যন্ত কঠোরভাবে পরীক্ষা করেন । কোন ছাত্রীর কপালে টিপ দেখলে, বা কানে একটু বড় বা ঝোলা দুল দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা বাজেয়াপ্ত করেন । ছাত্রীরা তাঁকে ভীষণ ডরায় । 
শ্রেণী নবম । অনামিকা লাহা । ক্লাসে প্রথন হয় একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকে । সুন্দরী চঞ্চলা সদ্য কিশোরী । দুচোখ ভরা স্বপ্ন । ইদানীং মাঝে মাঝেই বিনা কারণে গা শিরশির করে তার । স্কুলে ঢোকার আর বার হবার সময় পাশের বয়েজ স্কুলে ছেলেগুলো যখন হাঁ করে তার দিকে চেয়ে থাকে গা টা শিরশির করে ওঠে তার । একটা অব্যক্ত ভালোলাগা বয়ে যায় শরীরমন বেয়ে । মাঝে মাঝে সেও আড়চোখে দেখে আর মুচকি হাসে । সাহসটা বরাবরই বেশি তার । 
আজ ইচ্ছা করেই কপালে একটা মেরুন টিপ আর চোখে একটু আই-ব্রাশ করে এসেছে অনামিকা । দাঁড়িয়েছে একেবারে লাইনের প্রথমে । মুখে মিটিমিটি হাসি । পেছন থেকে সেকেন্ড গার্ল সরসী আঙুল দিয়ে পিঠে একটা গোঁজা দিল । 
“কি হল রে?”, শুধায় অনামিকা ।
“মুখ ধুয়ে আয় শিগগির…। এখুনি লেডি হিটলার আসবেন । দেখতে পেলে তোর আর রক্ষে নেই…”, ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল সরসী । কাকলি ম্যাডামকে আড়ালে লেডি হিটলার বলে ডাকে সব ছাত্রী । 
“ও…!”
“তুই আজ মার খাবি মনে হচ্ছে !”
“অত ভয় খাস না । আমাকে কিছু বলবেন না দেখিস…” বলতে বলতেই কাকলি ম্যাডামের প্রবেশ । দশম শ্রেনির লাইন থেকে পাঁচজনকে লাইনচ্যুত করলেন তিনি । নবম শ্রেনির লাইনের সামনে এসেই দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি । 
“এটা কি ?”…গনগনে দৃষ্টি হানলেন অনামিকার দিকে চেয়ে ।
“কি ম্যাড্যাম ?”, মিনমিনে সুরে বলল অনামিকা ।
“চোখে কি মেখে এসেছিস ? যত্তসব ! যা, লাইনের বাইরে গিয়ে দাঁড়া ! ভালো করে মুখ ধুয়ে তারপর ক্লাসে ঢুকবি ।”
মাথা নিচু করে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো অনামিকা । ভ্রু কুঁচকে মাটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে ।
“কথা শোন…!”, রুক্ষস্বরে বললেন কাকলিদেবী ।
“তো কি হয়েছে… আমি যাব না ।”, চোখে চোখ রেখে বলল এবার অনামিকা ।
থাপ্পড়ের আওয়াজটা বোধহয় রাস্তা থেকেও শুনতে পেল পথচলতি মানুষজন । ছুটে আসলেন বড়দি । ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগটা দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি গাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে । পেছনে সরসীকে ইশারা করলেন বড়দি । সরসী অনামিকাকে ধরে ধীরে ধীরে টয়লেটের দিকে নিয়ে চলে গেলো…

                                  ।। দুই ।।
ক্লাস শুরুর ঘন্টা পড়ে গেছে । চক-ডাস্টার আর নাম ডাকার খাতা নিয়ে নবম শ্রেনীতে ঢুকলেন কাকলি দিদিমনি । চেয়ারে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন বোর্ডে কিছু লেখা আছে । চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বোর্ডের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন তিনি । বোর্ডের উপরে বামকোণে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে দুটি লাইন – 
“ লেডি হিটলারের কোন ছেলে-মেয়ে নাই,
  তাই তার মনে কোন দয়া-মায়াও নাই ।”

হাতের লেখা অত্যন্ত পরিচিত । ক্লাসের দিকে ঘুরলেন তিনি । সারা ক্লাস মাথা নিচু করে বসে আছে । চোখ দিয়ে টপটপ করে দু-ফোঁটা জল পড়ল তাঁর । ধীরে ধীরে নাম ডাকা খাতা খুললেন । নাম ডাকতে গিয়ে দুবার গলা বুজে এলো । গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করলেন গলাটা । নাম ডাকা হয়ে গেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন ক্লাসরুম থেকে ।
একটু পরে গ্রুপ ডি স্টাফ্ কমলা এসে অনামিকাকে বললেন…
“বড়দি তোমায় ডাকছেন…” ।
মুখ শুকিয়ে গেলো অনামিকার । ছলছল চোখে উঠে দাঁড়াল সে । তারপর ধীরেপায়ে বড়দির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে । ভেতরে বড়দি আর কাকলি ম্যাডাম বসে আছেন । 
“আসব ম্যাডাম ?”, কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো সে ।
“এসো”, গলদ্গম্ভীর স্বরে ডাকলেন বড়দি তাকে ।
ভেতরে ঢুকতেই কাকলি ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন । এক পা পিছিয়ে গেল সে । হঠাৎ প্রবল বেগে জড়িয়ে ধরলেন তিনি অনামিকাকে । হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন ।
“বিশ্বাস কর, আজ থেকে আর তোদের কাউকে কিছু বলবো না রে…। আর কাউকে কোনদিন বকব না । আমার ছেলেমেয়ে নেই তো কি হয়েছে ? আজ থেকে তুই আমার মেয়ে…!”, কথা জড়িয়ে গেলো শেষের দিকে । এদিকে অনামিকাও কাঁদতে লেগেছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ।

No comments:

Post a Comment