Sunday, February 20, 2022


 মুনা সাপ্তাহি 
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ২০২২ 
বিশেষ সংখ্যা 


সম্পাদকের কথা

যদি প্রশ্ন করা যায়, মানব প্রজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ কোনটি, তবে নির্দ্বিধায় উত্তর আসবে - ভাষা। এই একটি ব্যাপারই মানবকে আলাদা ও উন্নততর করে তুলেছে পৃথিবীর বাকি প্রাণীদের চাইতে। 

পৃথিবীর প্রায় তিনশো মিলিয়ন মানুষ আমাদের গর্বের ও প্রাণের ভাষা বাংলাকে প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। শতাংশের হিসেবে তার পরিমাণ ৪ এবং বিশ্ব তালিকায় বাংলা রয়েছে পঞ্চম স্থানে। বাঙালিরা ছড়িয়ে রয়েছেন পৃথিবীর সর্বত্র।

প্রত্যেক ভাষাতেই অন্য ভাষার কমবেশি অনুপ্রবেশ মাথায় রেখেও ভাবতে কষ্ট হয়, আমাদের আদরের এই ভাষা আজ সত্যিই বিপন্ন। আমরা ক্রমশ ভুলছি নিজের ভাষা। আমাদের মধ্যে এমন অনেকেও রয়েছেন যারা এই ভাষায় কথা বলতেও লজ্জা পান!

নিজের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে ভুলে বা অবজ্ঞা করে আজ অবধি কিন্তু কেউই স্থায়ী হতে পারেন নি। পাশাপাশি ইতিহাস তাদেরও মনে রাখে নি, যারা অন্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষ বা বৈরী ভাব রেখেছে। 

ইতিহাসের এক অদ্ভুত সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে দিনে আমাদের আত্ম-পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু অনুষ্ঠানে বা পদযাত্রায় ভাষা দিবসকে আটকে না রেখে তার তাৎপর্য পৌঁছে যাক আমাদের সকলের মনের গভীরেই। ভাষা দিবসে এর চাইতে বড় শ্রদ্ধা আর কিছু হতে পারে না। 



মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  প্রচ্ছদ পরিকল্পনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই সাপ্তাহিক: ভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা  ২০২২







ভাষা দিবসের প্রবন্ধ 

আ_মরি প্রাণের বাংলা ভাষা তোমায় বড় ভালবাসি
বটু কৃষ্ণ হালদার

আ_মরি প্রাণের বাংলা ভাষা, অমি তোমায় বড় ভালবাসি। আমার গর্ব এই ভাষাতেই আমি মা বলে ডাকি। বাঙালির অতি প্রিয় বাংলা ভাষা বর্তমানে শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। উনিশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রেনেসাঁ শুরু হয় এই বাংলায়। এরপর বাংলাভাষাকে নিয়ে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতো মনীষীরা কাঁধে করে বাংলা ভাষা সাহিত্যকে বয়ে নিয়ে গেছে বিশ্বের দরবারে। 

ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে সমগ্র বিশ্বে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বাঙ্গালী জাতির মুন্সিয়ানা।এই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির টানে বিদেশীরা পাড়ি দেন এই বাংলায়। কিন্তু লজ্জাজনক বিষয় হলো এই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৫২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশ, ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন অন্যতম। সালটা ছিল ১৯৫২, বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অধীনে, উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণা করেন।আপামর জনসাধারণ মনে প্রাণে সেই ঘোষণা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, ভুলতে পারেনি যে উর্দু নয়, বাংলা তাদের প্রাণের প্রিয় ভাষা। শুরু হয়বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি এক অমর রঞ্জিত রক্তে রাঙা ইতিহাস হয়ে আছে। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা সে সিদ্ধান্ত জাতীয় কংগ্রেস আগে থেকে নিয়ে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কী হবে সে সম্পর্কে মুসলিম লীগ কোনো অনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণের আগে পাকিস্তানে ঠিক হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাইস চান্সলর জিয়াউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হওয়া উচিত মনে করেন। কিন্তু শাহীদুল্লা সহ ভাষাবিদগণ ও জনগণ মেনে নেন নি সেই প্রস্তাব, কারণ তাদের শিরায় শিরায় তখন বাংলা ভাষা।  কারণ জন্মের পর এই ভাষায় তারা প্রথম মা বলে ডেকেছেন। তাই তাঁরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নতে মুসলিম লীগ-এর পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব গৃহীত না হলে ও রাষ্ট্রের প্রশাসনে অবাঙালি উচ্চপদস্থ আমলাদের আধিক্যর কারণে ভিতরে ভিতরে উর্দু কে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার চক্রান্ত চালাতে থাকে।

এ চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় নতুন রাষ্ট্রে পোস্টকার্ড, এনভেলাপ, প্রভৃতিতে ইংলিশ শব্দ এর সঙ্গে উর্দু ভাষার ব্যবহার দেখে. তমদ্দুন মজলি, ১৯৪৭ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তক লিখে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন। এরপর তমদ্দুন মজলিশ বসে থাকেনি, ছাত্র শিক্ষক কর্মী সংযোগে বৈঠক করেন।এই সব কাজের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন এই মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেম। ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়াকে আহবায়ক করে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রামের পরিষদ গঠন করেন। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের আগুন। ১৯৪৮সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র লীগ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সংগঠন ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে মতদ্দুন মজলিশের অবস্থানকে সমর্থন করেন। লীগের নামকরণ  করা হয় সংগ্রাম পরিষদ। এই লীগের পক্ষ থেকে ১১ই মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা শহরের সর্বত্র বাংলা ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ চলতে থাকে। ১৯ শে মার্চ কায়েদে আজম জিন্নাহর ঢাকা সফর করার কথা ঘোষণা করা হয়। এই সফরের আগে তৎকালীন চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন পরিস্থিতি সামাল দিতে সকল দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর পর জিন্নাহ ঢাকা শহরের রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ও কার্জন হলের বিশেষ সমার্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন উর্দুতে,  এবং সেই সঙ্গে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষারমর্যাদা দান করেন। কিন্তু সেই ভাষণে ব্যপক প্রতিবাদ হয়।বিশাল জনসভায় এ প্রতিবাদ টের না পেলে ও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত কিছু তরুণ যখন ভাষা সম্পর্কে তার বক্তব্যর প্রতিবাদ জানায় তখন তিনি থমকে যান এবং বক্তব্য শেষ না করে ফিরে আসেন। পরদিন তিনি বাংলা ভাষা সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক করেন । কিন্তু উভয়েই নিজ নিজ বক্তব্যতে অবিচল থাকায় বৈঠক ভেঙে যায়।

এই ভাবে চলতে থাকে আন্দোলন, অবশেষে  ১৯৫২ সালে খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঢাকায় এসে ২৭ শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেন উর্দু ভাষায় এবং সেই সঙ্গে ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।  যে নাজিমউদ্দিন ১৯৪৮ সালে বাংলা রাষ্ট্র ভাষার দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁর এ হেন ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসতেই পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করেন, নিহত হন বাংলা ভাষা বুকের মাঝে রাখতে চাওয়া বীর সন্তানেরl রফিক, সালাম, বরকত-সহ বহু বীর সন্তানেরা। শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলো রাজপথ, আবারও লেখা হলো প্রতিবাদীদের রক্তে রঞ্জিত অভিশপ্ত ইতিহাস। শোকবহ এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শোক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। অবশেষে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আবারও  প্রমাণ হয়ে গেলো যে, আন্দোলন যদি সঠিক পথে হয় জয় লাভ হবেই হবে, প্রতিপক্ষ একদিন ঠিক পরাজয় মানবে।

১৯৫২সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলনের মর্যাদা রক্ষার দ্বিতীয় আন্দোলন হোল ১৯৬১ সালে ১৯ শে মে আসামের বরাক উপত্যকায় ঘটে যাওয়া ভাষা আন্দোলন।  ১৯  মে শিলচর ভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয় কারণ এই উপত্যকায় বসবাসকারি সংখ্যা গরিষ্ট বাঙালি তাদের বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে পথে নেমেছিল.. আর তাতে চলেছিল গুলিবর্ষণ, যাতে কমলা ভট্টাচার্য সহ শহীদ হয়েছিলেন এগারো জন ভাষা সৈনিক। স্বাধীনতার পর উত্তর ভারতের প্রথম ভাষা আন্দোলনের পর দক্ষিণ ভারতে ব্যপক হিন্দি আধিপত্য বিরোধী ভাষা আন্দোলনের প্রকাশ পায়। এই দেশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম হলেন শহীদ ষোড়শী কমলা ভট্টাচার্য । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল বাংলা ভাষার প্রাণ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের মাত্র কয়েক দিন পরেই এই আন্দোলন তথা শহীদ বরণ দিবস। শুধুমাত্র অসমিয়া ভাষা কে আসাম রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষণা করায় এই আন্দোলনের সূচনা হয় বরাক উপত্যকায়।  সত্যlগ্রহ আন্দোলন শিলচর শহরের রেল স্টেশন চত্বরে ঢুকে পড়ে গোটা স্টেশন দখল করে নেয়, অফিস কর্মচারীদের চেয়ারে বসে পড়ে. কর্মকর্তারা বসবার জায়গা না পেয়ে ফিরে যান, প্রশাসনকে অচল করে দেয়, ওই বছর ২৬শে মে ঈদ উৎসবের দিন সকল ধর্ম প্রাণ বাঙালি মুসলমানরা বুকে কালো ব্যাজ পরে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদে সামিল হন। সাম্প্রদায়িক ঊর্ধ্বে এক গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায় এটি। ইতিহাসে অবশেষে বাংলা ভাষা সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। মহান শিলচর এর ভাষা আন্দোলন আমাদের মতো বহু ধার্মিকদের এক বিশেষ বার্তা বহন করে, নিজ ভাষা ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের ভাষার প্রতি দেওয়া দরকার ।  ফেডারেল রাষ্ট্র নীতি হাওয়া দরকার। স্বাধীনতার আগে থেকে যে সমস্ত বাংলা ভাষা পরিচালিত স্কুলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা। তাই এগারোটি স্বীকৃতি ভাষা ছাড়া ভারতবর্ষে অন্যান্য ভাষার সার্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বুকের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিল বাংলা ভাষার মান। সেই বাংলা ভাষা বর্তমানে বিশ্বের দরবারে জয়জয়কার। ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষাকে "sweetest language in the world" হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্পানিশ ও ডাচ ভাষাকে যথাক্রমে দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আবার মার্কিন ব্যালট পেপারে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সংসদ ভবনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই বাংলা ভাষাই  এই বাংলায় আজ উপেক্ষিত। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের দাম এই বাংলা না দিলেও, বিশ্ব দরবারে তার প্রাপ্য মর্যাদা লাভ করেছে। একি কম গৌরবের কথা।

`আজ বাঙালি ভুলে গেছে বাংলা কথা বলতে/ আজ বাঙালি হয়ে গেছে অন্য ভাষার দাস/ বাংলা ভাষায় বললে কথা পড়বে তোমার লাশ।` বর্তমান সময়ে বাঙালি আজ ভুলতে বসেছে তার প্রিয় বাংলা ভাষা।কিছু রাজনৈতিক দল ১৯৫২ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ও ১৯৬১ সালের আসামের শিলচর এর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মুছে দিতে চাইছে। বাঙালির অতি প্রিয় বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে সমাজের তরুণ-তরুণীরা বুকে বুলেটের চিহ্ন এঁকে ছিল। সেই ইতিহাস অনেকে  ভুলে গেলেও বৃহত্তর সমাজ কিন্তু ভুলে যায়নি। আজও এই দুই বাংলায় যথার্থ সম্মানের সঙ্গে ভাষা দিবসের শহীদদের কথা স্মরণ করে ভাষা দিবস পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সম্মানার্থে তাদের বেদীতে মাল্যদান করেন। তাই যতদিন বাঙালি বিশ্বের বুকে থাকবে ততদিন তারা বাংলা ভাষাকেই নিজেদের প্রিয় ভাষা রূপে বরণ করবেন। প্রয়োজনে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে আবারো বাঙালি সমাজ মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত হবে। উর্দু ভাষাকে নয়।



ভাষা দিবসের নিবন্ধ 

জগাখিচুড়ি শব্দে বাংলা ভাষার নাভিশ্বাস

গৌতম চক্রবর্তী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে স্থান করে দিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার এনে। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের তৃতীয় ভাষা রূপে স্বীকৃতি আদায় করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ইউনেস্কো'-র তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষা ‘সুইট ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে যথাযথ লালন আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি? পারলে কতটা পারছি? প্রশ্নটা কিন্তু ক্রমশ বড় হচ্ছে। এটা ঠিক যে, বাঙালি জাতি মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিতে পারে, সেই জাতি নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে পারি। জাতির আশা-ভরসা অনেকটাই নির্ভর করে তার সংস্কৃতি ও ভাষার সম্মান রক্ষার উপর। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের চিরস্মরণীয় গ্রন্থগুলির বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভের ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। মানব ইতিহাসে বিভিন্ন ভাষা নানা কারণে প্রাণ হারায় এবং বিশ্বায়ন, নব্য উপনিবেশিকতাবাদের প্রভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভাষা অন্য ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য বহু ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। সেরকম বাংলা ভাষাও আজ কঠিন রোগে আক্রান্ত। জীবন পরিবর্তনশীল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সৌজন্যে সুখের আঙিনায় হচ্ছে নব নব সংযোজনসেইসঙ্গে ভাষাতেও জুড়ে যাচ্ছে নিত্যনতুন শব্দ কিছুদিন আগেও সাধারণ মানুষের জীবনে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এইসব শব্দগুলো অলীক কল্পনা মাত্র ছিল কিন্তু হালের বাংলায় মুঠোফোন বহুল ব্যবহৃত শব্দ এমনকি 'মিসকল, কলব্যাক, নাম্বার, মেসেজ' ইত্যাদি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবদের মত বাংলাই হয়ে উঠেছে। ফলে জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বাংলা শব্দচিঠিপত্র আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে হারিয়ে যেতে বসেছে পূজনীয়, শ্রদ্ধেয়, প্রিয়বরেষু, শ্রীচরনেষু, শ্রীচরণকমলেষু থেকে শুরু করে ইতি পর্যন্ত অসংখ্য শব্দমালা চিঠি শব্দটা নিজেই বিলুপ্তির পথেলোকে এখন মেল করে মেসেজ পাঠায়, 'লেটার' লেখে, কিন্তু চিঠি আর লেখে নাচিঠি লেখার সাধের ফাউন্টেন পেন' উধাও হয়ে গেছে। কলমের কালি, কালির দোয়াত এইসব শব্দগুলো আজকের প্রজন্ম জানেই না।

 আমরা যখন স্কুল কলেজে পড়তাম বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিফিন খরচ বাঁচিয়ে বিভিন্ন বাংলা বই কিনতাম। এক সময় পাঠক-পাঠিকারা ভালো বই কিনতেন ও পড়তেন। আজ গ্রন্থাগারগুলিতে সেরকম পাঠক-পাঠিকার ভিড় নেই। গ্রন্থাগারিক ও গ্রন্থাগার কর্মীদের সংখ্যা কমছে। কোনও কোনও গ্রন্থাগার আবার রাজনীতির আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। উঠতি কবি-লেখকদের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে ঠিকই, ক্রেতা-পাঠকের সংখ্যাও কমছে। যার একটি বড় কারণ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি বড়ো অংশের পিতা-মাতারা নিজেদের পুত্র-কন্যাদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িয়ে তাদের কেরিয়ার গঠন করতে চাইছেন। বাংলা বইয়ের দিকে তাই আজকালকার ছেলেমেয়েদের কোনও লক্ষ্য নেই, তাদের সময়ও নেই। তাই সেই বইয়ের প্রতি তাদের কোনও ভালোবাসা বা টানও নেই। ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক প্রয়াসে আমাদের ইংরেজী বিদ্যালয়ে পড়া সন্তানদের অভিভাবকদের এই বিষয়ে যে যত্নশীলতার প্রয়োজন ছিল আমরা কি সেই ভূমিকা পালন করি? ভাষা সৈনিকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এখন চারদিকে যেভাবে ভাষা বিকৃতির মহোৎসব চলছে তাতে বাংলা ভাষার প্রতি আমরা কতটা যত্নশীল সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। অত্যন্ত রুচিহীনভাবে বাংলা ভাষাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন, হোর্ডিং, সাইনবোর্ড ও অন্যান্য বিশেষ কিছুর মাধ্যমে। অনেকের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দির মিশ্রণে তৈরি নতুন ধরনের ভাষা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রজন্মের জন্য আধুনিকতার তকমা লাগিয়ে বাংলা ভাষার বিকৃত উপস্থাপনার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যাটা যদিও শুধুমাত্র ইংরেজি বা হিন্দি ভাষা প্রয়োগের নয়। যদি কেউ সম্পূর্ণ মনের ভাব ইংরেজিতে বা হিন্দিতে নির্ভুলভাবে প্রকাশ করতে পারে তাহলে অতি উত্তম। কারণ মাতৃভাষা ছাড়া যদি কেউ অন্য একটি ভাষা রপ্ত করতে পারে তাহলে আপত্তি কোথায়! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নিজের ভাষায় মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা-দুটো ইংরেজি বা হিন্দি শব্দের প্রয়োগ বড়ই বেমানান। তখন নিজেদের বড় দায়হীন মনে হয়।

'টেলিগ্রাফ' উঠে গিয়ে নতুন প্রজন্মের শব্দকোষ থেকে 'টেলিগ্রাম' মুছে দিয়েছে আজকাল কারোর রান্নাঘরে উনান অথবা চুলো নেইআছেওভেন'। রান্নাঘর কারোর বাড়িতেই নেইআছেকিচেন'মাংস এখন কেউ রাধে নারান্না করেচিকেন', মাটন' 'পর্ক' অথবা 'বিফ'শাকসবজি খেতে ভীষণ অনীহা। তাইভেজিটেবল' হলে কোন ক্ষতি নেইঝোলেরস্ট্যাটাস'গ্রেভিতে' রূপান্তরিত হয়েছেআলুভাজার চাইতেপটেটো চিপস' বাফ্রেঞ্চ ফ্রাই' অনেক বেশী সুস্বাদুআর ভাত খায় যতসব সেকেলে গ্রাম্য লোকেরাবদলেস্টিমড রাইস' খুবই জনপ্রিয় যামডার্ণ' শহুরে মানুষেরা খায়কলা, বেদানা, আম, পেয়ারা, গাজর, কপি, আলু, লঙ্কা এসব ফল ও শাকসবজির বাংলা নাম আজকের কচিকাঁচারা হয়তো অনেকেই জানে না। জানে ব্যানানা, ম্যাঙ্গো, পটেটো ইত্যাদি। অনাদিকাল থেকে অভিজাতদের কাছে ব্রাত্য থাকা যব এবং ভুট্টার মত সস্তার দানাশস্য শুধুমাত্র নাম পাল্টে রাতারাতি অমূল্য হয়ে উঠেছে। 'স্ট্যাটাস' পাল্টে তাদের নাম হয়েছে 'বেবিকর্ন', 'সুইট কর্ণ', 'কর্নফ্লেক্স', এমনকি যব 'ওটস' নাম নিয়ে দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেতাই আজকাল আমরা আর বাজার করি না। শপিং' করি বা মার্কেটিং' করিআমরা এখন গাড়ি থাকলেও 'প্রাইভেট কারে' চড়ি উড়োজাহাজেরা অনেকদিন আগেই মেঘের আড়ালে ভ্যানিশ হয়ে গেছেকিছুদিন আগে এরোপ্লেন' ছিলএখন শুধুই ফ্লাইট'সাহেবদের দৌলতে পেয়ালা, কেদারা, পালঙ্ক এসব শব্দগুলো আগেই পিছু হটেছেএখন দেশলাই, কলম, জলের বোতল, থালা, বাটি, ঘটি, পাখা, পোশাক, শোবার ঘর, বসার ঘর, স্নানঘর, শৌচালয়, একতলা, দোতলা ইত্যাদিও কোণঠাসাবাট, ফ্রেন্ড, আঙ্কেল, আন্টি, শেয়ার, এক্সচেঞ্জ, বিজি ইত্যাদি শব্দগুলি আকছার প্রয়োগ করা হচ্ছে। পরানুকরণপ্রিয় বাঙালির এ এক আত্মদৈন্য। অথচ বাংলা বিশ্বের মিষ্টতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু ওই যে এক মানসিকতা। ইংরেজি বা হিন্দি শব্দ প্রয়োগ না করলে মানুষ নাকি অশিক্ষিত ‘আনস্মার্ট’ ভাববে। শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাঙালিও কি নানাভাবে বিপন্ন হচ্ছে না? বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা, বিবেকানন্দের মূর্তিকে ঘূণ্যভাবে নোংরা করাও কি বাঙালি জাতির অভিভাবকদের প্রতি চরম আঘাত হানা নয়? এই মনীষীদের মাহাত্ম্যে যদি আঘাত হানা হয় বর্বর কিছু মানুষের চেষ্টায়, তাহলে বাংলা ভাষা বা বাঙালি ভালো থাকবে কী করে!

শুধুমাত্র ইংরেজি নয়, হিন্দিকেও নিউ জেনারেশন এভাবেই মেশাচ্ছে মাতৃভাষার সঙ্গে। কিছুদিন আগে একটি বাড়িতে একটি দশ বছরের ছোট মেয়ের মুখে শুনলাম এটা আমার ফর্জ। ওর কাছে জানতে চাইলাম ‘ফর্জ’ কেন বললে? ও বলল, ওটাই নাকি ভালো শোনায়। প্রতিনিয়ত শুনতে পাওয়া যায় ‘ফ্রেন্ডের বার্থ ডে মানালাম’। পালন করলাম কথাটা এখন উঠেই গেছে। এও বাঙালির হিন্দি ও ইংরেজি প্রীতির জগাখিচুড়ি এক দৃষ্টান্ত। আজকাল ছেলেমেয়েরা 'দোস্তি' করে 'ফ্রেন্ডশিপ' পাতায়। কিন্তু বন্ধুত্ব করতে খুব কমই শোনা যায়। প্রেম নয়, হৃদয়ে এখন 'প্যায়ার'। ধুতি এখন 'ধোতি', রুটি কে বলি 'রোটি' সিঙ্গারা হয়েছে 'সামোসা', লেডিকেনির বদলে এসেছে দেশি 'গুলাবজামুন'প্রদীপ অনেকদিন আগেই রাতারাতি দিয়া' হয়ে গেছে ধূপকাঠি 'আগরবাতি' হয়ে জ্বলে পুড়ে মরছে বসন্ত উৎসব হয়তো কেবলমাত্র শান্তিনিকেতনেই পালন করা হতোবাদবাকি আমরা সবাই হোলি'তেই মেতে উঠেছি। চুন্নি, মেহেন্দি, বিন্দি, চোলি, বেনিয়ান গোপনে প্রবেশ করেছে বাংলার অন্দরমহলেবিনোদন এবং বিজ্ঞাপনে বাংলার হাল দেখলে মনে হয় বাংলা ভাষা নয়, হিন্দি বা ইংরেজির শব্দ ও বাক্যের গঠন পর্যন্ত এক রেখে আক্ষরিক আনাড়ি তর্জমা, শব্দের যথেচ্ছ বিকৃতিকরণ থেকে শুরু করে বাংলার ভেতর ইংরেজি এবং হিন্দির ভেজাল মিশিয়ে যে বকচ্ছপ তৈরি করা হচ্ছে তাতে 'চালে কাঁকড় না কাঁকড়ে চাল' মেশানো হচ্ছে সেটাই বোঝা মুশকিল তবু বাংলা আছে বারোআনা কাঁকড়ে চার আনা চাল হয়ে টিকে আছে। আসলে বাংলা আর বাংলাতে থাকছে না, বাংরেজি অর্থাৎ আরও শুদ্ধ করে বললে বলতে হয় বাং-হিংলিশ হয়ে গেলআসলে শব্দে শব্দে নানান রং লেগেছে যেসব শব্দ টিকে আছে সেগুলোরও একটা বিরাট অংশ রঙিন সমাজের রং, রাজনীতির রং, সত্যের রং, মিথ্যার রং, ভালো রং, খারাপ রং সব মিলেমিশে একাকার। নানা বর্ণে চিত্র বিচিত্র শব্দের কেউ কেউ অর্থ হারিয়েছে, কেউ নতুন অর্থ পেয়েছে, কেউ পুরনো ও নতুন দুইই ধরে রেখেছেরবি ঠাকুরকেও কি ছেড়ে কথা বলেছে নাকি বাঙ্গালী? নোবেলের মতো ঠাকুর পদবীও হারিয়েছেন কবিগুরু বাঙ্গালীও তাঁকে 'টেগোর' বলেই 'স্ট্যাটাস' 'মেনটেন' করে

'হাউএভার, মুজনাই, বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজের 'প্রেজেন্ট স্টেটাস' নিয়ে অনেক 'বকোয়াস' হল। 'ডোন্ট মাইন্ড'। 'মা কসম'। 'ল্যাংগুয়েজ'টা বিরিয়ানি, ফ্রাইড রাইস নয়, একেবারে খিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে। এতে 'ভাটের' কি হচ্ছে সেটা বলা 'ডিফিকাল্ট' 'বস'। কারণ এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে নানা রঙে বিভক্ত বাঙালিরা এত 'পরিশান' নয় 'অবভিয়াসলি বেঙ্গলিরা রিচ' হচ্ছে অন দি আদার হ্যান্ড, ল্যাংগুয়েজটার কন্ডিশন' কিন্তু 'ব্রাদার' বড়ই শোচনীয়


" ও আমার মাতৃভাষা, সোনা রোদের গান"

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা  দিবসে  বিশ্বের  সব মায়েদের মুখের ভাষা কে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই। কবি  লিখেছেন  মায়ের ভাষা  সোনা  রোদের মতোই  উপভোগ্য  একটি  বিষয়।  একটি শিশু জন্মানোর পর "মা" একটা শব্দ আপনা আপনি শিখে যায়। ধীরে ধীরে  সে সব কথা  শিখে যায়, যার  বেশিটাই অনুকরণে এবং মা-বাবা, আত্মীয় -পরিজনের  প্রচেষ্টায়।  কবিগুরু  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, " শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান "।

জলপাইগুড়ি  জেলায় ৩৬ টি জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস  করেন।    এই ৩৬ টি  জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও আলাদা আলাদা,  আবার একটি মাতৃভাষার  কথ্য  রূপও  (Dialect)   এলাকা বিশেষে  আলাদা।  বোড়ো এবং  রাজবংশী ভাষায় ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি খুব বেশী প্রত্যক্ষ করি। চা  বলয়ে  বিপুল  সংখ্যক  মানুষ সাদরি ভাষায় কথা বলেন।

সাম্প্রতিক  কালে UNESCO  বাংলা ভাষা কে বিশ্বের  মধুরতম  ভাষা  হিসেবে  আখ্যায়িত করেছেন।  এক কথায়  আমরা  খুশি কিন্তু কোনো  একটি  জনগোষ্ঠীর  মানুষের  সাথে দীর্ঘদিন বসবাস করলে বুঝতে পারি তাদের মাতৃভাষাও খুবই মিষ্টি।  সাদরি এবং রাজবংশী মানুষের সাথে দীর্ঘদিন থাকবার পর আমি নিজে ব্যাক্তিগত ভাবে এই দুটি ভাষাকে হিন্দি, পাঞ্জাবি, অসমীয়া ভাষার মতোই বলবার চেষ্টা করি, মিষ্টতার কারণে। SSK এবং MSK এর শিক্ষক শিক্ষিকারা সেই জনগোষ্ঠীভুক্ত হলে বা একই ভাষাভাষীর মানুষ হলে প্রাথমিক এবং প্রাক প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থার আরও প্রসারিত হবে।

ত্রিপুরা সরকার ৯০ হাজার জনগণের ভাষা "বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী" ভাষার মাধ্যমে  সেই রাজ্যের প্রাথমিক স্তরে পঠন পাঠনের ব্যাবস্থা করলেও,  আমাদের রাজ্যের দীর্ঘ দিনের  দাবি  রাজবংশী ভাষাকে অষ্টম তপশিলে স্থান দেন নি। এটা আশার বিষয় সরকারি বদান্যতা ছাড়াও মিষ্টি রাজবংশী ভাষায় অসংখ্য কবিতা প্রবন্ধ এবং উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আগামী দিন গুলোতে কুরুক, সাদরি, বোড়ো, টোটো, মেচ, রাভা প্রতিটি ভাষায় গান কবিতা সরকারি মান্যতার সাথে সাথে জনপ্রিয়তা লাভ করবে আশাকরি।  সাম্প্রতিক কালে ইংল্যান্ড এ বাংলা ভাষা কে সেই দেশের দ্বিতীয় ভাষার স্থান দিয়েছেন, এটা খুবই ভালো লাগা একটা বিষয়। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের জানাই প্রণাম, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।


বাংলা ভাষার এখন তখন 

আকাশনীলা ঢোল 

কথায় বলে ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’। অর্থাৎ যার যা মাতৃভাষা, তা-ই তার কাছে অমৃতের সমান। বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাও ঠিক সেইরকম কারণ বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাতেই আমরা খুঁজে পাই আমাদের মাকে। তবে, বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই মনে পড়ে কিছু অন্য কথা, একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কিছু মর্মান্তিক দৃশ্য, ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু আর তীব্র আর্তনাদ, একুশে ফেব্রুয়ারি। এই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, যে দিনটি এখন গোটা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে, সেই দিনটির মাতৃভাষা দিবস হয়ে ওঠার পেছনেও রয়েছে বাংলা ভাষার অবদান। একদা এই ভাষাকে একটা দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যই তো প্রাণ দিয়েছিল বাঙালি, ঘটে গিয়েছিল খাণ্ডবদহন, বয়ে গিয়েছিল রক্তগঙ্গা। সেই যে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত’। ভাষাও তো আমাদের মা, তাই সেই মায়ের কথা মনে রেখেই হয়তো প্রাণ দিয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সংগ্রামীরা। সেই থেকেই তাঁদের স্মরণে ভাষা দিবস পালিত হয়ে থাকে। বাংলা ভাষা তখন বাঙালির কাছে ছিল একটা আবেগ, মায়ের স্নেহ ও ভালবাসার বিষয়। দুই বাংলার বাঙালিই বাংলাকে ভালবেসে সৃষ্টি করেছিল অগুন্তি সাহিত্য, যা সমাদর লাভ করেছিল বিশ্বের দরবারেও। বর্তমানে এই ধারা যে আর বজায় নেই তেমনটা হয়তো বলা যায় না, কিন্তু বাংলা ভাষার এখন আর তখন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ইদানীং কালে মনে হয়, বাংলা ভাষাটারই বুঝি এখন-তখন অবস্থা। আজও বাংলায় অনেক প্রতিভা রয়েছে, তাঁদের হাত ধরে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য সাহিত্যের, সঙ্গীতের, চলচ্চিত্রের, শিল্পকলার। তবু, আজকের অনেক বাঙালিরই তাদের মাতৃভাষার সঙ্গে একটা বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। অনেকেই আজকাল বাংলা বলতে চায় না, বাংলা শেখাতে চায় না তাদের সন্তানদেরও। তবে কি মাতৃদুগ্ধসম মাতৃভাষা আজ তাদের কাছে অবাঞ্ছিত? বা মা-ই কি তাদের কাছে আজ অযাচিত বলে বোধ হয়? আজকাল অনেক বাঙালি শিশুর ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা ইংরেজি বা হিন্দি অনেক শব্দ জানে যার বাংলা অর্থ তারা বোঝে না অর্থাৎ তাদের শিক্ষার শুরুই হয় কোনও বিদেশি ভাষা বা মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোনও ভাষা দিয়ে। এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কে শিশুদের এহেন অজ্ঞতায় অনেক অভিভাবকই কিন্তু গর্ব বোধ করেন। আবার এমনও দেখা যায়, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা হয় না সেখানেও ভাষা দিবস পালিত হয় কিন্তু তারা ভাষা দিবসের ইতিহাসটাই জানেনা। এমনকি সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে বাঙালি একদিন ভাষার জন্য পূর্ববঙ্গের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে সমর্থন করেছিল, সেই বাঙালির কাছেই বাংলা যেন দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। অন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা থাকা ভাল কিন্তু, নিজের ভাষাকে অবহেলা করে অন্যের ভাষাকে কি সত্যিই শ্রদ্ধা করা যায়? নিজের ভাষা বলতে না পারার মধ্যে কি সত্যিই কোনও কৃতিত্ব রয়েছে? একটা মিষ্টি-মধুর-সহজবোধ্য ভাষাকে মৃতপ্রায় করে তোলার মধ্যে সত্যিই কি কোনও গৌরব রয়েছে? কিন্তু, এমনটাই ঘটে চলেছে বর্তমানে। অবিলম্বে এর প্রতিকার প্রয়োজন, তবেই হয়তো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি নতুবা একদিন হয়তো বাঙালির সকল গৌরব সঙ্গে নিয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এই ভাষা। 



ভাষা দিবসের ভাবনা 


আ মরি বাংলা ভাষা 

মোদের গরব মোদের আশা 

চিত্রা পাল                                   

মোদের গরব মোদের আশা/ আমরি বাংলা ভাষা। সত্যি এর কোন তুলনা নেই।আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের সবচেয়ে মধুর ভাষা এমনও শুনেছি। মাগো বলে যখন ডাকি সে মা জননীকেই ডাকি,বা দেশমাতৃকাকেই ডাকি, বা জগত্‌জননীকেই ডাকি একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই সে ডাক, সে আহ্বান আসে, মায়ের কাছে সমর্পিত হয়ে। এমন মধুর ভাষা দুটি দেশের মাতৃভাষা। একটি স্বাধীন দেশের সরকারি ভাষাও। সে তো সহজে হয়নি। কত প্রাণের বিনিময়ে কত ত্যাগের বিনিময়ে হয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা আমাদের মাতৃভাষার জন্য এক স্বাধীন দেশের জন্ম  হলো। আর রক্তাক্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি ঘোষিত হলো সারা পৃথিবীর সবার মাতৃভাষা দিবসের সম্মান রূপে।  

 এমন করে ভালোবেসে যে ভাষাকে আমরা আন্তরিক মর্যাদা দিয়েছি, সম্মান দিয়েছি, তার ভালোবাসাতে  ঘাটতিও কিছু কম হচ্ছে না আজকাল। পথে ঘাটে সাধারণ বাক্যালাপে প্রবলবেগে মিশে যাচ্ছে ইংরেজী হিন্দী এসব ভাষা।  শুদ্ধ বাংলায় সাধারণ কথাবার্তা বলার লোকের সংখ্যা বেশ বিরল। এভাবে আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাক তাও যে আমরা চাই না। আমরা চাই আমাদের গর্ব হয়েই থাকুক আমাদের মাতৃভাষা। সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে আমাদেরই।                

 

চির আশা•• মাতৃভাষা!

অলকানন্দা দে

বোধের আধারে অক্ষরে অক্ষরে গাঁটছড়া বেঁধে যে শব্দ তৈরী হয় তা সাদা পাতার নজর কাড়ে প্রতিনিয়ত। বিনম্র কলম তাকে অভ্যর্থনা জানায় একাগ্র মনে। ছুটে আসে ভাষা অতিবর্ণময় চেতনাবিশ্ব হতে! আলতো টানে আঁকা হয় না-জানি কত পটভূমিপাতা জুড়ে! ভাষা দেয় বাড়িয়ে হাত! মনের যত বায়না আছে সামলাবে সে একে একে! ঘুরঘুর করা চিন্তাদের আশ্বস্ত করে বলে, “ নেমে এসো আমার হাত ধরে পৃষ্ঠার পাড়ে!” তাই হয়, উদ্বেগের অক্ষররা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মুক্তি পেয়ে। সুখের তো কথাই নেই! ভাষার অতলে দিয়ে ডুব সহচরী শব্দদের সাজিয়ে তৈরী করে

 প্রাণবন্ত সুখ-বসতি! কবিতা গান গল্প উপন্যাস প্রবন্ধের পঞ্চব্যাঞ্জনে আমাদের ভাষার বাড়বাড়ন্ত সংসার! ভাববার কথা এই যে, ভাষা না থাকলে নাজেহাল হোত মনের রাজ্য। কিভাবে প্রকাশ পেত শত শত ভাব ছোট ছোট অনুভূতিরা! ভাষার ধারাপাতেগুণীর অস্তিত্ব অমরতা পায়। কথার পৃষ্ঠে কথারা রসদপূর্ণ সাম্রাজ্যের গল্পে করে রাখে বুঁদ আমাদের। আমরা পড়ি সঁপে দিয়ে মন, ফিরে ফিরে আসে তৃপ্তি! তাই ভোর থেকে রাত ইস্তক ভাষাই মেটায় যাবতীয় চাহিদার উল্লাস! এভাবেই তৈরী হতে থাকে ইতিহাস অযুত নিযুত বছর ধরে।

ভাষার জন্যে বিপ্লব, ভাষার জন্যে যুদ্ধ মেঘ-ভাঙা রোদের মতো প্রেরণা দেয়! কতটা ভালোবাসা থাকলে আপন প্রাণকে তুচ্ছ ভাবাযায় ভাষার খাতিরে! অপমানের বিষদাঁত ভেঙে দিতে মরিয়া ইতিহাস আজও চিল-চিৎকারে জানায় ভাষার অপমানেভিসুভিয়াসের মত গর্জে উঠতে দ্বিধা নয়! নিজ নিজ ভাষাকে ধমনী শিরা মজ্জায় মিশিয়ে এগিয়ে চলবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।আমার মনের সাথে আমার ভাষার যে রসায়ন তাতেই তৈরী হতে পারে হাজার পঙক্তির কবিতা যা আলোড়ন তুলতে পারেপৃথিবীর এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত জুড়ে! অস্তিত্বকে সমৃদ্ধ করতে হলে ভাবনাবিশ্বে মাতৃভাষার আরাধনা নিরন্তর হতে হয়। সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মবোধের অনুভব ও তাকে নিজের ভাষায় উচ্চারণ ঋদ্ধ করে সত্তা! আত্মগরিমা এই, আমি মাতৃভাষার পূজারী! এক এক শতাব্দীপেরোতে হবে ভাষা সৈনিকের সহজ ছন্দে, দৃপ্ত ভঙ্গিমায়, না থেমে! ভাষার এটাই দাবি একনিষ্ঠ ভাষাপ্রেমিকের কাছে!



ভাষা দিবসের গল্প 

মায়ের আঁচল

মৌসুমী চৌধুরী 


— " সামনের সপ্তাহে তো তোমার পুজো, তাই না মা?"

হাতের নখে নেলপলিশ লাগাতে লাগাতে বলে ওঠে দিয়া।

—" কেন রে? সামনের সপ্তাহে কি তিথি ? "

— " ওমা সেকী! মনে করতে পারছ না?"

মুখে যেন একটু ব্যাঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে দিয়ার।

— "প্রতি বছর ওই দিনটিতেই তো তুমি তোমার গানের ঘরে তোমার ঠাকুরের বেদীটিকে প্রতি- দিনের চেয়ে আলাদা করে সাজাও। ফুল দিয়ে নানারকম ডেকোরেশন কর। ধুপ-দীপ জ্বেলে দাও। সাদা খোলের শাড়ি আর মাথায় ফুল গুঁজে সাবেকী সাজে তোমার ফ্রেন্ডরা সব আসেন। কী আবেগী কন্ঠে তোমারা ন্যাকা ন্যাকা সব কবিতা একটার পর একটা আবৃত্তি করে যাও! গান গাও। আরে ওই যে তোমাদের রবি ঠাকুরের জন্মদিন ওইদিন। ওইদিন যে তোমাদের কবি পুজোর দিন। যাই বল, গানগুলোর সুর কিন্তু বড় একঘেয়ে লাগে।"

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দিয়া।

   

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের চলে যাওয়া দেখতে

থাকে জয়ন্তী। মেয়েটা আজকাল দিন কে দিন কেমন যেন হয়ে উঠছে! রাতদিন তার বাংলা- ভাষাপ্রীতি নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করে যায়। মাঝে মাঝে বড্ড অসহ্য ঠেকে! সুধীন যেন শুনেও শোনে না এসব! অভিমানে গলা বুজে আসে জয়ন্তীর। কিচ্ছুটি বলবে না মেয়েকে! সে অভিযোগ করলেই বলবে, 

— "ওকে ওর স্বাধীন চিন্তাধারা নিয়ে বড় হতে দাও না, জয়ী ।"

— " তাই বলে নিজের মাতৃভাষার প্রতি একটা শ্রদ্ধা থাকবে না?"

— " ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের মতো ওর আলাদা ফিলিংস তো না থাকারই কথা, বল।"

    চুপ করে যায় জয়ন্তী। মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবার ইচ্ছে আদৌ তার ছিল না। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়িতে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সবাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, এই অজুহাতে সুধীন দিয়াকেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই ভর্তি করল। যদিও বাংলা তার সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, তবু সারাজীবন চেষ্টা করেও বাংলার প্রতি দিয়ার কোন ভালোবাসা জাগাতে পারেনি জয়ন্তী! আশ্চর্য! যত যাই হোক মানুষের একদম নিজের একটা ভাষা, একটা সংস্কৃতি  থাকবে না? যে ভাষা আর সংস্কৃতির আঁচলে সে দু'দন্ড জিরিয়ে নিতে পারবে। যেখানে সে তার দুঃখভার আশ্লেষে নামিয়ে রাখতে পারবে।  

— "কাম্ অন মা, পৃথিবীটা গ্লোবালাইজড্ হয়ে

গেছে। মাতৃভাষা নিয়ে প্যানপ্যানানি আর ঠিক মানায় না। সেই ভাষার জন্য রক্তারক্তি কান্ড! ওহ্ সীট!"

প্রায়ই বিরক্তি প্রকাশ করে দিয়া।

— "শোন, সমস্ত পৃথিবী যেদিন মুখ ফিরিয়ে নেয় সেদিন কিন্তু মায়ের দুয়ারেই দাঁড়াতে হয়। তাঁর আঁচলের তলায়ই নিঃশর্ত ঠাঁই মেলে আমাদের, বুঝলি?"

    জয়ন্তীর কথায় পাত্তা না দিয়ে কাঁধ নাচিয়ে সেখান থেকে সরে যায় দিয়া। 

      বি.টেক পাশ করবার পর আই.টি সেক্টরে চাকরি পেয়েছে দিয়া। সম্প্রতি সেখানকার  সহকর্মী একটি অবাঙালি ছেলের সঙ্গে প্রেমের  সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে সে। মাথায় আরও রক্ত চড়ে যায় জয়ন্তীর। রাতদিন খালি ইংরেজি ও হিন্দিতে বকবকানি আর হা হা হি হি! শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায়! উইক-এন্ডে পার্টি, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, পিকনিক এনজয়মেন্টের যেন অন্ত নেই! এদের কাছে প্রেম মানে কি এসবই?  মাথায় ঢোকে না জয়ন্তীর! 

  আরও অবাক হয় সুধীন যেন এসব দেখেও কী  ভীষণ নির্বিকার!

— " আরে ওকে ওর মতো জীবন বেছে নিতে দাও না৷ ও সুখী হোক এটাই তো আমরা চাই, তাই না?"

    মনে পাথর ভার চেপে থাকে। দুপুরগুলোতে 

গল্প, উপন্যাসের পাতায় আর মন বসে না জয়ন্তীর। একটি মাত্র সন্তান তাদের। কেন এমন হয়ে যাচ্ছে!

       কিন্তু কিছুদিন পর জয়ন্তী লক্ষ্য করল দু'দিনের ট্যুর সেরে বাড়ি ফিরে আসবার পর থেকে মেয়ে যেন একটু মনমরা। সব সময় মুখ ভার করে আছে। খাবার টেবিলে খাবার নাড়াচাড়া করে না খেয়েই উঠে পড়ছে। অফিস থেকে ফিরে আসার পর কানে ইয়ার-ফোন গুঁজে বারান্দায় বসে গান শুনছে। আর মাঝে মাঝে চোখ মুছছে। বিপাকে পড়ে যায় জয়ন্তী। হলটা কি মেয়েটার! উইক-এন্ডের পার্টি নেই, সাজগোজ নেই! আড্ডা- বন্ধুবান্ধব সব উবে গেল নাকি!

     ব্যাপারখানা কি? জানার জন্য উসখুস করতে লাগল মায়ের মন। মনে যে কুচিন্তাই বেশি আসছে! আজ মেয়ে অফিসে যায়নি। খাবার সময়টুকু ছাড়া সারাদিন ঘর থেকেও বেরোয় নি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর

কাজ সেরে বাতাসী চলে যেতে বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। জয়ন্তী গুটি গুটি ঢোকে মেয়ের ঘরে। আজ চেপে ধরতেই হবে। কি হয়েছে জেনেই তবে ছাড়বে। ঘরে ঢুকে দেখে দিয়া ঘরে নেই। বাথরুম থেকে জল পড়ার শব্দ ভেসে আসছে।  বিছানার ওপর ল্যাপটপ আর একটা ডাইরি খোলা। কৌতুহল বশে ডাইরিটা হাতে নিয়ে তাজ্জব হয়ে যায় জয়ন্তী! গোটা গোটা বাংলা হরফে লেখা—"আজ রীতেশ আর মিঃ সিংহানিয়ার মেয়ের এনগেজমেন্ট।  সাতদিন হয়ে গেল রীতেশ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি রীতেশকে ভালোবাসি। তাই খুব খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। বুকের ভিতরটা যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে! এবারই অফিস ট্যুরে গিয়ে রীতেশ আমাকে জানায় যে, তার বাবা সিংহানিয়া গ্রুপের বিজনেস টাইকুনের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছে। বাবার মতকে সে অমান্য করতে পারবে না। যদিও বিয়ের পরেও আমার সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক রাখতে আপত্তি নেই তার। রীতেশের এই প্রস্তাবে ঘৃণায় ভিতরটা কুঁকড়ে গেছে আমার। আর আশ্চর্য! এ কষ্ট আমি আমার নিজের মাতৃভাষা বাংলার বুকেই উগড়ে দিতে পারছি। মা ঠিকই বলে সমস্ত পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিলেও মায়ের আঁচল ছায়ায়ই মেলে উপশম, নিঃশর্ত আশ্রয়। ...কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে আমার... ভালোবাসা কি এমনই যাতনাময়?... তাই কি মায়ের ঠাকুর লিখেছিলেন — "সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?..." 

                ঝাপসা চোখে জানালার বাইরে তাকায় জয়ন্তী। কৃষ্ণচূড়া গাছটায় এবারও ঝেপে লাল ফুল এসেছে। এটা কবিগুরুর জন্মমাস যে।



মায়ের ভাষা গর্বের ভাষা

মনোমিতা চক্রবর্তী


অরণ্য ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছে সাথে তার বন্ধু সন্দীপ আর অভিনবও এসেছে। শহুরে এবং সাহেবি আদব কায়দায় বড় হওয়া সন্দীপ ও অভিনব অরন্যের মুখে গ্রামের সৌন্দর্যের কথা শুনে তার সাথে গ্রামে চলে আসে; ছুটিতে কয়েকদিন অরণ্যদের গ্রামে কাটাবে বলে। অরণ্যের সাথে তারা গ্রামের পুকুর, নদী, পথ_ ঘাট ,সরষেখেত তথা গ্রামের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় ।শুধুমাত্র গ্রামের মানুষদের সাথে অরণ্যের কথোপকথন এবং অরণ্যের মা-বাবা ঠাকুমার সাথে অরণ্যের কথোপকথন শুনে ,অভিনব মুচকি মুচকি হাসে ।সন্দীপ অভিনব কে বারণ করে হাসতে তবুও অভিনব হাসি থামাতে পারেনা । 
সকালে চা খেতে খেতে যখন অরণ্যের বাবা প্রদীপবাবু সন্দীপ আর অভিনব কে জিজ্ঞেস করলেন _"তা বাবা আমাগো গেরাম খান তোমাগো ক্যাম্বা লাগলো কও দেহি? "
এই শুনে অভিনব বলল _"আংকেল আপনাদের গ্রামের সবকিছুই সুন্দর, শুধুমাত্র আপনাদের ভাষা বাদে । প্রদীপ বাবু_" কেন?"
 অভিনব _"আসলে আপনাদের ভাষা আমি ঠিক বুঝতে পারি না ।কেমন যেন বোকা বোকা আর বিরক্ত লাগে। হাসিও পায় আমার.
 আচ্ছা আমি তো শুনেছি আপনি  ইংলিশ টিচার।  তাহলে আপনি তো আমাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন।আমি ইংলিশেই বেশি কমফোর্ট ফিল করি।
 এছাড়া বাড়ির বাকিরা যেমন আন্টি,গ্রানমা ,অরণ্য এদের সাথে তো আপনি অন্তত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন। কিন্তু তা না করে এরকম ভাষায় কথা বলেন আপনারা ।আমিতো অরণ্যকে বহুবার বলেছি ।'"
প্রদীপ বাবু _"ও আচ্ছা এই ব্যাপার।তোমার পুরো নাম কি?"
 অভিনব _"অভিনব দাস।"
 প্রদীপ বাবু_" আচ্ছা তুমি তো বাঙালি?"
অভিনব_" বাট আই হেট বেঙ্গলি !কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। আমি ছোট থেকে ইংরেজী মিডিয়ামে পড়েছি ।বাংলা পড়িনি ।বাংলা ভাষায় কুল ব্যাপারটাই নেই ।তাই না?"
প্রদীপবাবু _"তা বাবা তোমার সাথে না হয় এখন আমি শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলছি কেমন ?তবে কি জানো আমি আমার মাতৃভাষাকে খুব সম্মান করি এবং ভালোবাসি। অরণ্যও ভালোবাসে এবং সম্মান করে মাতৃভাষাকে।  কারণ মাতৃভাষা আমাদের মায়ের ভাষা ।তোমার বাবাও নিশ্চয়ই তোমার ঠাকুমার ভাষা শিখেছেন জন্মের পর থেকে তাইনা ?দেখো তুমিও বাঙ্গালী আমিও বাঙ্গালী আমরা সবাই বাঙ্গালী। অঞ্চলভেদে, এলাকাভেদে আমরা আলাদা আলাদা ভাষায় কথা বলি শুধু ।শুদ্ধ ভাষা,ইংরেজি ভাষা সব ভাষাই আমাদের শেখা উচিত ।কাজের জন্য এই ভাষাগুলো আমাদের প্রয়োজন ।কিন্তু তাই বলে মাতৃভাষাকে অবমাননা করা বা মাতৃভাষার জন্য লজ্জা বোধ করা উচিত না। কারণ বাংলাভাষাই একমাত্র ভাষা যে ভাষা পৃথিবীর বুকে  ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ।আমরা তো জানি এই মাতৃভাষার জন্যই বাঙালিরা কম আন্দোলন করেনি ।কত প্রাণের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে আমাদের মাতৃভাষার সম্মান আমরা ফিরে পেয়েছি বলো ?তোমাদের হাতেই তো দেশের ভবিষ্যৎ। তোমরা যদি প্রত্যেকে মাতৃভাষাকে সম্মান না করো,তাহলে তোমাদের দেখে ছোটরাও মাতৃভাষাকে সম্মান করবে না ।তুমি নিশ্চয়ই এটা জানো যে দক্ষিণ ভারতের প্রত্যেকটি রাজ্যের লোকেরা কিন্তু  নিজেদের মাতৃভাষাতেই কথা বলে। তারা মাতৃভাষাকে ভীষণ সম্মান করে। আজ আমাদের বাঙালির যে অবক্ষয় হচ্ছে , সেজন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। বাঙালিরাই  এই অবক্ষয় নিজেরাই করেছে। 
এমন সময় প্রদীপ বাবুর ছাত্র সমিরন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রভাতফেরী করতে বেরিয়ে মাস্টারমশাইকে নিতে এসেছেন অনুষ্ঠানে শামিল করার জন্য। প্রদীপবাবু অভিনব আর সন্দীপের সাথে সমিরনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন _"এই দ্যাহ !আমার ছাত্র সমিরন আমেরিকায় থাহে। ইঞ্জিনিয়ার তবুও ঐহানে থাইক্যা ওয় বাংলা ভাষায় কবিতা ল্যাহে, গান ল্যাহে ।ছুটিতে গ্রামের বাড়ি আইস্যা ভাষা দিবস পালন করব ।আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি ,আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আসলে কি জানো অভিনব, আমাদের জীবনের দাম আমাদের কাছে অনেক বেশি।অথচ ভাষা আন্দোলন কারীদের কাছে জীবন ছিল তুচ্ছ, নিজের মাতৃভাষার কাছে ।তেনারা ভাষার জন্য কত্ত কি করলো আর আমরা আমাদের মাতৃ ভাষায় কথাটা বলতে পারবোনা এটা হয় নাকি।
তার থেকে বরং চলো মাতৃভাষা দিবসে আমরা সবাই মিলে প্রত্যেকের মাতৃভাষাকে সম্মান জানাই ।শ্রদ্ধা নিবেদন করি।শ্রদ্ধা নিবেদন করে সেই শ্রদ্ধা আমরা প্রত্যেকের বুকের মাঝে করে নিয়ে আসি ।
অভিনব, মাতৃভাষাকে আমাদের অন্তরে রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষা শেখাতে হবে । তবে আমাদের উন্নতি সম্ভব কি বল ?"
চোখ খুলে যায়  অভিনবর। সে বুঝতে পারে কারোর মাতৃ ভাষাকে অসম্মান করা ঠিক না।সমীরণ বাবু কত্ত বড়ো ব্যক্তি।দেশে বিদেশে কত্ত নাম ওনার।কই উনি তো কারো ভাষা নিয়ে হাসাহাসি করেন না।
অভিনব প্রদীপ বাবুকে বলে _" হ্যাঁ আংকেল আমি সব বুঝেছি। আমি আর অন্যের মাতৃভাষা নিয়ে ইয়ার্কি করব না ।আমি যাবো আপনাদের সাথে অনুষ্ঠানে, মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং সেই শ্রদ্ধা সেখানেই ছেড়ে আসবো না। বাংলা ভাষাকে বুকের মাঝে নিয়ে আসব এবং বুকের মাঝেই বাংলা ভাষাকে রাখবো। নাহলে যে আমার দেশের,আমার ভাষার,আমার জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।"



নাম
ডালিয়া রায়চৌধুরী

বিদ্যালয় প্রবেশের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাষার সবুজে ঘেরা খোলা মাঠের দিকে নজর পড়ল। সবুজ সতেজ ঘাস গুলির উপর শিশিরবিন্দু ,সূর্যের আলো পড়ে ,মুক্তোর মত চকচক করছে।
                     ভাষা চক্রবর্তী কলকাতার একটি নামি বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষিকা। এই ধরনের নামকরণে অনেকেই অবাক হন। হ্যাঁ ভাষার বন্ধুরাও ছোটবেলায় তার নাম নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা করেছে। এতে তাঁর কোনো হেলদোল ছিলনা। এই নামটার প্রতি তার একটা ভালোবাসা অসম্ভব ভাবে ছিল।
                     খুব ছোটবেলায় ভাষা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল," বাবা, আমার নাম ভাষা দিয়েছো কেন?" উত্তরে বাবা বলেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি তার জন্মদিন, সেই দিনটি 'ভাষা দিবস' হিসেবে পরিচিত তাই তার নাম ভাষা।
                     পরবর্তীকালে বিদ্যালয়, সেখান থেকে উচ্চ বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা সমস্ত জীবনটাই বাবার কাছে সে 'ভাষা' নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুনেছে। সেই মতো শ্রেণীতে যারা, বাংলা ভাষাকে একটু ভয়ের চোখেই দেখে সেই সমস্ত ছাত্রীদের বোঝাতে চেয়েছে এই ভাষার মর্ম। বাবা বলেছিলেন ভাষা হল পরস্পরের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। আদিম কালে মানুষেরা বনের ফলমূল আর শিকার ধরে ,মাংস খেয়ে বেঁচে থাকত, পরিষ্কার কথা বলতে পারতো না, তখনো তারা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ ও ভাব বিনিময় করার জন্য নিজেদের মতো করেই ভাষার সৃষ্টি করেছিল।ক্রমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে লাগল ভাষা ও তার রূপ। কালের নিয়মে ভাষায় এসেছে রূপ বদল।

            বাংলা ভাষার ইতিহাসের পাতা উল্টে 'ভাষা' অনেক দূর নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছে তার জীবনে। বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে তার ই সূত্র ধরে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয়।১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করেন এবং তাদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রফিক, জব্বার ,শফিউল ,সালাম, বরকত সহ অনেকেই।তাই ৫ঐ আগষ্ট ২০১০ খ্রী: জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত।
            শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথেই সব ছাত্রীরা বলে উঠলো 'শুভ জন্মদিন দিদিমনি'। ভাষা তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্রহণ করার পর তাদের জিজ্ঞেস করেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি আর কিসের জন্য বিখ্যাত। অনেকেই কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিন সমস্ত সময় সে বাংলা ভাষার রূপ নিয়ে ছাত্রীদের সাথে গল্পের ছলে আলোচনা করেছিল। বলেছিল, বাংলা ভাষার কথ্য রূপের কিছু প্রভেদ থাকলেও বাংলা ভাষায় লিখিত রূপ সাহিত্য, ইতিহাস, সংবাদপত্র, গান ইত্যাদিতে এই ভাষা ব্যবহারকারীকে বাঙালি বলে পরিচয় দেন। মাতৃভাষার জন্য আলাদা অস্বাদ, অনুভূতি তৈরীর চেষ্টা করে, সে ছাত্রীদের মধ্যে। অন্যান্য দিবস এর মত একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসকেও পালন করতে উৎসাহ যোগায় 'ভাষা'। পরবর্তী বাংলা ক্লাসে তারা দিদিমনির কাছে বাংলা ভাষা কিভাবে আবিষ্কার হলো তার ইতিহাস শুনবে বলে আর্জি জানায়। 'ভাষা 'তার নামের সার্থকতা তখনই খুঁজে পায়। পায়ে-পায়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আনমনে গেয়ে ওঠে-" মোদের গরব মোদের আশা
                                 আ মরি বাংলা ভাষা।"



মুজনাই সাপ্তাহিক: ভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২২


No comments:

Post a Comment