Monday, March 20, 2017

"বিয়ে বিয়ে খেলা"
প্রশান্ত কুমার ঘোষ 

সমগ্র পৃথিবীটা একটা মঞ্চ-ইংল্যান্ডের "জাতীয় কবি" এবং "বার্ড অব অ্যাভন"
শেক্সপিয়ারের এই মন্তব্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই  আমরা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে চলেছি।আমরা প্রত্যেকেই সময়ের স্রোতে নায়ক,নায়িকা,ভিলেন,কমেডিয়ান ইত্যাদি নানান ভূমিকায় অবতীর্ণ।পেঁয়াজ ছাড়াতে থাকলে যেমন কোন অস্তিত্ব থাকে না,তেমনি আমরা এই ধরাতে অভিনয়ের উপর অভিনয় তার উপর অভিনয় তার উপরেও অভিনয় করেই চলেছি।

              শিশুর বিকাশ গত পরিবর্তন তার মধ্যে চাহিদার সৃষ্টি করে এবং সেই চাহিদাগুলির দরুন শিশুর মধ্যে আচরনের সৃষ্টি করে।শিশুর মানসিক বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন চাহিদার পাশপাশি মানসিক চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে।এই সব চাহিদা গুলির তাড়নায় তারা বয়স্কদের সমকক্ষ ভাবতে থাকে।তারা অনুকরণ করতে থাকে তার পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীদের।পুনরাবৃত্তির চাহিদাই শিশুর মধ্যে অনুকরণের চাহিদা সৃষ্টি করে।নিজের দেখা অন্যের কোন কাজকে বারবার অনুকরণের মধ্য দিয়ে এবং পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শিখতে ও আনন্দ লাভ করতে চাই।

               ভান্ডারিয়া ছোট গ্রাম।গ্রামটি লতাপাতায় মোড়া।গ্রামের মাঝে কেয়া গাছের ভিড়।শোনা যায় ঐ কেয়া বনে গরু ডুকে গেলে বেরতে পারত না,খুঁজে পাওয়া যেত না,তারপর গরুটি খাবার জন্য শকুনির ঢল নামলে বুঝতে পারা যেত।গন্ধে কয়েকদিন নাভিশ্বাস।তবে আজ কেয়া গাছ অবলুপ্ত।গ্রামের মাঝে সরু খাল।পাশের তারাজুলি নদীতে মিলিত হয়েছে।খালের দুই তীরে বেড়া কলমির জামাটি আড্ডা।আম,জাম,তাল,বাঁশ বনে ঘেরা এই ছোট গ্রামটিকে ঈশ্বর যেন নিজের বৈঠক খানা বানিয়েছেন।

              খালের দুই তীরে দুই পাড়া,ঘোষ পাড়া ও ঘোষাল পাড়া।উভয় পাড়াতে আট দশ ঘর পরিবারের বাস।দুই পাড়ার ছেলেরা ঘোষাল পুকুরের পাড়ে এসে খেলা করে পশ্চিমে সূর্য হেলে পড়লে।কালু,রাজু,ঝন্টু,প্রশান্ত,শ্রীকান্ত,সমীরণ,ঝুমা,অসীমা,প্রদীপ,অরুণ,রান্টি,তাপস,মানস,ইলা,শিলা,লাল্টু,অজিত,মণি আরও পাঁচ থেকে পনের বছরের বালক-বালিকা,কিশোর-কিশোরী সমবেত হয়ে খেলা করে।

            একদিন হল বিয়ে বিয়ে খেলা। সমস্ত ছেলে দুই পরিবারে বিভক্ত হল।প্রতিটি পরিবারে দাদু,ঠাকুমা,বাবা,মা,কাকু,কাকিমা ,ভাই ,বোন,নাতি নাতনি ইত্যাদি বিভিন্ন সম্পর্কে আবদ্ধ হল।যারা সাজলো দাদু ঠাকুমা তারা মানান সই পোশাক পরলো,কোমর বাঁকিয়ে লাঠি ধরে গালে ভাঁজ ফেলে কথা বললে।দুই পরিবারের নাম হল ঘোষ পরিবার ও ঘোষাল পরিবার।পুকুরের উত্তর পাড়ের পশ্চিম কোণে ঘোষাল পরিবার,আর পূর্ব কোণে ঘোষ পরিবার।বাড়ি তৈরি হল কঞ্চির খুটি গেড়ে,উপরে চট দিয়ে।


                   ঘোষ পরিবারের কর্তা কালু।বড় নাতি শ্রীকান্ত।দাদু নাত বৌ দেখতে চায়।নাতির পাত্রী দেখা শুরু ।লাঠি হাতে করে মেয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে ।ঘোষাল পরিবারে হাজির।গিয়ে বলে এতটা রাস্তা আসতে বয়স্ক মানুষ অনেক কষ্ট পেলাম।ঘোষাল বাড়ির কর্তা প্রদীপ।প্রদীপ বলে আরে দাদা যে।গরীবের বাড়িতে এমন হেলানো বেলায় কি মনে করে?এসো দাদা।খড় কুটো দিয়ে বলে বসো দাদা।বাড়ির গিন্নিরা ঘোমটা টেনে পা ধোয়ার জল দিল। ডুমুর গাছের পাতাই প্লেট। প্লেটে করে কাদার সন্দেশ,রসগোল্লা ইঁট গুঁড়োর লাল মিষ্টি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে অতিথি আপ্যায়ন।চাকুম চুকুম শব্দ করে কয়েকটা খেয়ে নিয়ে কালু বলে বয়স হয়েছে এত মিষ্টি খেতে পারবো না,বাচ্চাদের দিয়ে দে।কালু বলে আরে তোর বড় নাতনি মণি কোথায়?প্রদীপ বলে বাড়িতেই আছে,আরে মণি?মণি কোথা গেলিরে দিদি ভাই?মণি বলে দাদু ডাকছো আমায় ?প্রদীপ বলে হ্যাঁ দিদি ভাই,তোমাকে দেখতে চায় তোমার ঘোষ দাদু ভাই।মণি বেশ পরিপাটি করে সেজেছে।কালু দাদু কে প্রণাম করে তার কাছে গিয়ে বসে।কালু বলে বেশ ভদ্র,নম্র তোর নাতনি।যদি কিছু মনে না করিস,তাহলে একটা কথা বলি।প্রদীপ বলে কি যে বলেন দাদা!আপনি বলবেন আর আমি শুনব না?বলুন দাদা।আরে তোর নাতনিকে আমি নাত বৌ করতে চায়।প্রদীপ বলে এতো নরুনের বদলে নাক।তুমি অনুগ্রহ করলে দাদা.....।


            বিবাহ শুরু।শ্রীকান্তকে তাল পাতার আংটি,কলা পাতার টোপর,ঘাঁটু ফুলের থোকা নিয়ে কলা গাছের আঁশ দিয়ে গিঁটিয়ে মালা করে পরিয়ে বর সাজানো হল।গামছা কে গিঁট দিয়ে পঞ্জাবি করে পরানো হল,গামছা কে করা হল ধুতি।সকলে উল্লাস।বাজনা বাজছে।বাঁশ খোলকে কঞ্চি দিয়ে বাজানো চলছে,বাজছে তাল পাতার বাঁশি।পলি ব্যাগকে মুখে করে ফুলিয়ে চলছে বম ফাটানো।

                        এদিকে কনে সেজেছে মহাসমারোহে।ইঁট গুঁড়া করে টুক,পলি মাটিকে চন্দনের মত করে পরানো হয়েছে। লতানো নূপুর গাছকে সুন্দর ভাবে মানানসই করে হাতের,কানের,গলায় গহনা পরানো হয়েছে ।


         বর এসে পৌঁছেছে।উলফা মুঠিতে মুখ লাগিয়ে শঙ্খ ধ্বনি মেয়ের বাড়ির।শাশুড়ি মা জামাই কে মিষ্টি মুখ করালেন।শালীদের ঠকানোতে নেই কোন ঘাটতি।বরযাত্রীর দুষ্টুমি চলছে পুরোদমে।কনে কচু পাতায় মুখ ডেকে বরের চারপাশে ঘুরানো হল।মালা বদল হল।মাটি গুঁড়োর সিঁদুর পরানো হল।হাতের বেড়ি দিয়ে শালী শালারা বাসর ঘর আটকালে শ্রীকান্ত পকেট থেকে টাকা(গাছের পাতা )দিল।বরযাত্রী খেতে বসলো।কাদা চেপে নানান খাবার,ধুলো হল ভাত,ঘোসিম হল মাংস,নানান গাছের পাতা তরকারি সব মিলিয়ে দারুন আয়োজন।কোন ত্রুটিই রাখেনি কনের বাড়ি।

               এরপর কন্যা বিদায়।একটি মালাতে জল,দূর্বা,ফুল রাখা হল।বাড়ির বয়স্করা ফুল-দূর্বা সহযোগে জলের ছিটা দিয়ে হাতে টাকা(গাছের পাত),কেউ গহনা (লতা গাছ বা নরম মাটিতে তৈরি)আশীর্বাদ করলেন।কোণে কেঁদে চলেছে,বাড়ির মহিলারাও হাউ হাউ করে কাঁদছে।কনের বাবা ও মা জামাইয়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে বলে বাবা,আমার মেয়ে কে একটু দেখো,মেয়েকে বলে সব কিছু মানিয়ে নিস।

            দুই জনে হাতে হাত রেখে তৈরি হয় পালকি,পাশপাশি দুই জন করে চার জন হাতে হাত ধরে পালকি তে চাপিয়ে বর কনে কে বাড়িতে আনা হল,সঙ্গে বাজনা ও নাচ চলছে।বেয়ারা গান করছে পালকি চলে ....।

           অবশেষে বাড়িতে অসলো বৌমা।করা হল বরন,মিষ্টি ও জল খাইয়ে দেয়া হল,নাম পালানো হল।প্রীতিভোজে কনেযাত্রী কে খাওয়ানো হল বসিয়ে মহাসমারোহে।

           অবশেষে ফুলশয্যা।কঞ্চি পুঁতে ছাদে ত্রিপল দিয়ে তৈরি হয়েছে শয়ন কক্ষ,সাজানো হয়েছে নানান বুনো ফুল ও লতাপাতায়।থলির ভিতরে অল্প লতা পাতা রেখে মুখ আটকে করা হয়েছে গদি,খড়ের আঁটি শক্ত করে পাশ বালিশ ও মাথার বালিশ করা হয়েছে।বর-কনেকে বসিয়ে দেয়া হল,ঠাকুমা গাইলেন মন খুশ করা গান,বয়স্করা তখন দূরে।ঠাকুমা নাতির কোলে নাতবৌ কে বসিয়ে বললে সাবধানে........................।

No comments:

Post a Comment