Monday, August 14, 2017















বুনো রামনাথ 
দিলীপকুমার মোহান্ত 

আঠারো শতকের শেষপাদ। রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত নবদ্বীপের নগর প্রান্তে বনের মধ্যে টোল খুললেন। তিনি কৃষ্ণনগরের রাজার কাছ থেকে সে যুগেও টোল খোলার জন্য কোনো অর্থ সাহায্য নিলেন না। বরং রাজা স্বয়ং তাঁকে  অর্থ সাহায্য করতে চাইলে রামনাথ তা সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন।  টোলের ছাত্ররা একদিন রামনাথ পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করল, “ পণ্ডিত মশায় ! আপনি বনজঙ্গলের মধ্যে পর্ণকুঠীর নির্মাণ করে অতীব দারিদ্রের মধ্যে আছেন, অথচ কৃষ্ণনগরের রাজা শিবচন্দ্রের পণ্ডিতসম্মাননার দান নিলেন না কেন?” এর উত্তরে রামনাথ পণ্ডিত বললেন, --  তবে শোন!  রাজন্য অনুগ্রহের বড় হ্যাপা। রাজার অনুগ্রহ একবার নিলে দুঃখ আর ছাড়ে না। ক্ষমতার স্বভাবই এমন!  রাজনৈতিক শক্তিই সেরা শক্তিও বটে। এই শক্তির আশ্রয় পেলে বাইরে থেকে  আপনার চাকচিক্য দেখে লোকজন মোহিত হবে। কিন্তু আপনি নিজে জানবেন কত শক্তিহীন আপনি! সেই শক্তিহীনতা তিলে তিলে আপনাকে দুর্বল করবে। যেকোন সময় বিনা কারণে আপনার শক্তি কেড়ে নেওয়া হতে পারে । এজন্যই রাজা শিবচন্দ্রের বৃত্তি গ্রহণ করতে পারি নি বাবা! রাজন্য আশ্রয়ের ফলে স্বাধীন চিন্তায় ছেদ পড়তে বাধ্য।সকল সময়ই কেবল মনে হতে থাকবে, ‘এই বুঝি রাজা রুষ্ঠ হলেন’!  ‘এই বুঝি রাজা রুষ্ঠ হলেন’! রাজারা তো আর যুক্তি-ন্যায়-অন্যায় -- এসবের ধারও ধারেন না। রাজন্যের মর্জিই ন্যায়। অর্থ দিয়েই রাজন্য সকলকে দাস করে রাখে। মনে নেই মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় সভাঘরে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি তাবড় তাবড় নীতিবাগীশ রাজপুরুষেরা কেমন নীরব দর্শক হয়ে ছিলেন! এরা সকলেই রাজন্য অনুগ্রহের দাস, অর্থের দাস। ‘অর্থ’ কারো দাস নয়।     
 আরো শোন বাপু—‘রাজন্য আশ্রয়ের ফলে না ঘুমিয়েও অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায়ও দুঃস্বপ্নদর্শন হতে পারে।  গাছে বা পাহাড়ে না চড়েও সব সময় মারাত্মক পতনের ভয় হতে পারে। বার্ধক্যহীন অবস্থায়ও কম্প হতে পারে শরীরে—জরা ধরল না, যুবকমানুষ, গায়ে শক্তি আছে,  তবু হাত পা কাঁপছে—এসবই রাজন্য অনুগ্রহের ফল।  অন্ধকার নেই, তবু ভয়ে গা ছম্‌ ছম্‌ করতে পারে । অস্ত্রের কোন আঘাত নেই, তবু আঘাত জনিত দুঃখ হতে পারে । কোন শেকল নেই, অথচ  সব সময় বন্ধনজনিত ভয় হতে পারে। বেঁচে থেকেও মৃত ব্যক্তির মত নিজেকে মনে হতে পারে।’  কবি রুজ্যক আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন সেই কবে প্রথম জীবনে ।  
 এবার বুঝলে তো বাপু!  কেন রাজন্য অনুগ্রহের গলগ্রহকে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি।"

No comments:

Post a Comment