Thursday, April 4, 2024


 

মুনা 

অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০




শতবর্ষের আলোকে অমিয়ভূষণ মজুমদার
সঞ্জয় এস. সাহা

১৯১৮ সালের ২২ শে মার্চ, কোচবিহার শহরে মাতুলালয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। পিতার নাম অনন্তভূষণ মজুমদার, মাতা ছিলেন জ্যোতিবিন্দু দেবী। পৈতৃক নিবাস ছিল পাবনা জেলায় সারা থানায় পাকুরিয়া গ্রামে। তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল মা- দিদিমার কাছে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প শুনে। লেখাপড়ায় তার বাবা সেকেলের ছিলেন। তাকে কলকাতায় ভর্তি হয়ে অসুস্থতার কারণে ফিরে আসতে হয়। ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে । অল্প বয়সেই চাকরিতে যোগ দেন। বাইশ বছর বয়সে বিবাহ করেন গৌরীদেবীকে। স্ত্রীর ভূমিকা তাঁর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অমিয়ভূষণের সাহিত্য রচনার প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন তিনি এবং সমস্ত লেখার প্রথম পাঠিকাও তিনি। নিজের সাহিত্য সৃষ্টির সম্পর্ক অমনীয় পোষণ বলতেন, "আমি কি উপন্যাস লিখতে চাই তা এখনও লেখা হয়নি। অর্থাৎ  আমি যাকে উপন্যাস বলে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবো না তেমন উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে থাকি। হয়তো তা কোনদিনও লেখা হবে না, লেখা হলেও ছাপা হবে না, কিন্তু সেগুলি আমার জাগ্রত ও নিদ্রার আনন্দ। এই আনন্দ ছাড়া আমার চলে না, এমন নেশা ধরেছে যখন লিখি না তখন ছবি আঁকি। আমার ছবি কোন exhibition - এ পাঠাবো কিনা তাও জানিনা। কিন্তু তুলির টানে। ফলকে রং তুললে মনে হয় মস্তিষ্কে সহস্রদল পদ্ম থেকে মধুস্রাব হচ্ছে। আমার যে উপন্যাস ছাপা হবে তা লিখতেও এমন হয়।"

সঞ্জয় ভট্টাচার্যের "পূর্বাশা" পত্রিকায় প্রথম অমিয়ভূষণ মজুমদারের গল্প প্রকাশিত হয়। এছাড়া "চতুরঙ্গ", "গণবার্তা", "ক্রান্তি" পত্রিকায় তিনি লেখা পাঠান। ১৯৫৭ সালে "গড় শ্রীখন্ড" তার প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ১৩৬০ সাল থেকে ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৬১ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে "পূর্বাশা" পত্রিকায় কালপর্বে প্রকাশিত হয়। এটি ধারাবাহিক প্রকাশকালে লেখক পরিচিতি হিসেবে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদকীয় মন্তব্য করলেন, " তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত অমিয়ভূষণ মজুমদারই এমন একজন লেখক যিনি বহুবিধ কোণ থেকে জীবনকে দেখতে জানেন । তাঁর রচিত গল্প ইতিপূর্বে সাহিত্য পিপাসুদের তৃপ্তি দান করেছে। 'গড় শ্রীখন্ড' তাঁর প্রথম উপন্যাস আমাদের আশা আছে-- এ রচনাটি তাঁকে বাংলা উপন্যাসের আসরে একটি সম্মানের আসন দান করবে ।" এই ভবিষ্যৎ বাণী যে কতটা সত্য তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। একে একে তাঁর উপন্যাস গুলি হল--''নয়ন তারা'', "দুখিয়ার কুঠি", "নির্বাস", "মধু সাধুখা", "রাজনগর","ফ্রাইডে  আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ  ও তাহার পর" , "মহিষকুড়ার উপকথা", "বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবী", "সোদাল", "মাপচক হরিণ", "হলোং মানসাই উপকথা", "চাঁদবেনে" প্রভৃতি। তিনি অসংখ্য ছোট গল্প লিখেছিলেন । তাদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে "প্রমীলার বিয়ে", "তাঁতি বউ", "সুনীতি", "দীপিতার ঘরে রাত্রি", "দুলারহিনদের উপকথা", "সাদা মাকড়সা", "অধ্যাপক মোহিত স্যানের উপাখ্যান", "শীলতার দ্বীপ", "সাইমিয়া ক্যাসিয়া" প্রকৃতি গল্প যেন তাঁর ভিন্ন ভিন্ন  পরিবেশন।

অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রধান পরিচয় তাঁর কথাসাহিত্যিক হিসেবেই। 'গড় শ্রীখন্ড', 'রাজনগর', 'মহিষকুড়ার উপকথা', বা 'ফ্রাইডে আইল্যান্ড'-- এর মতো ভিন্ন পথের সৃষ্টির জন্যই পাঠকের কাছে আজও সমাদৃত। তবু একথাও নিঃসন্দেহে বলা যায় তিনি সাহিত্যিক হিসেবে বাঙালির কাছে যথেষ্টই উপেক্ষিত।  বাঙালি আর বিস্মৃতি শব্দ দুটি প্রায়শ হাত-ধরাধরি করে চলে, তা যে সম্পূর্ণ সত্য, এ কথা বলা হয়তো একটু বাহুল্য হয়ে যাবে, তবু অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি পান না তাঁর যথাযথ সম্মান, আবার অনেকক্ষেত্রেই তা বর্ষিত হয় অযোগ্য কারও উপর। এর কোন ধরাবাঁধা ফর্মুলা নেই। অমিয়ভূষণ মজুমদার  বহু পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও অনাদৃত ।  তবু কোনও উপলক্ষ এলে, অল্প কয়েকজন হলেও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন, মলিন আলোকচিত্র থেকে সরানো হয় ধুলোর আস্তরণ। অমিয়ভূষণ মজুমদারের শতবর্ষ তেমনই এক আয়োজন-সম্ভাবনার মুহূর্ত। তাঁর "প্রবন্ধসংগ্রহ" ধরে নেওয়া যায়, সেই উদযাপনেরই ফসল । ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এগারোটি প্রবন্ধ নিয়ে একটি সংকলন---"লিখনে কি ঘটে", প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স, পরে তা ঠাঁই পায় অমিয়ভূষণ মজুমদারের "রচনাসংগ্রহ" -তে । আলোচ্য সংগ্রহ -তে সেইসব প্রবন্ধের পাশাপাশি রয়েছে অগ্রস্থিত প্রবন্ধ এবং কিছু চিঠিও, যা ভাবনার গভীরতা এবং মৌলিকতায় হয়ে উঠেছে প্রবন্ধ। শিল্প-সাহিত্যই অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রবন্ধের মূল বিষয়, কিছু নিবন্ধন আত্মজৈবনিক। অবশ্য সাহিত্যভাবনাতেও স্বাভাবিকভাবেই এসেছে নিজস্ব বক্তব্য। রাজনৈতিক মতামতও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন লেখক।

No comments:

Post a Comment