মুজনাই
অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০
সেদিন চৈত্র মাস
স্বপন কুমার দত্ত
আবার একটা বছর হয়ে গেল শেষ। চারদিকে উদাসী মন পাগল করা হাওয়া বোধহয় বুঝিয়ে দেয় -- এখন চৈত্র মাস। শুকনো পাতা উড়িয়ে, ধূলো ছড়িয়ে, পুরোনোক সরিয়ে নতুনের আবাহনে তাই মাতোয়ারা চৈত্র মাস।
সেকারণেই বোধহয় সঠিকভাবেই কবি লিখেছিলেন,-- " সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।"
সর্বনাশের শুরুতো চৈত্রের প্রথম থেকেই। চৈত্র সেলের বড় বড় সাইনবোর্ড বক্ষ বিদীর্ণ করা লক্ষ্মণের শক্তিশেলের থেকেও আরো ভয়ঙ্কর। আপনি আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে যতই বোঝান, যে সেলের জিনিস ভালো হয়না, কোন ব্যবসায়ী অত বোকা নয়,যে লাভ ছেড়ে দিয়ে ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে মাল দেবে। ভবি ভোলবার নয়, আপনাকেই বুদ্ধু বলে অভিহিত করে একগাদা বাজার হবে সেলের হাট থেকেই। উল্টে বোঝাবে, গোটা বছরের প্রেজেন্টেশন, মাসীর শাড়ি আরও কত কী যে সস্তায় হল--তুমি
বুঝবে কোত্থেকে? ছাত্র ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে বুদ্ধিটাও করে ফেলেছ ভোঁতা! কিন্তু ওনার তখন বোধোদয় হয়, তখনতো সব শেষ! এক ধোয়ার পর? লাভের গুড় খায় পিঁপড়েয়! সেলে কেনা বারো হাতের শাড়ি ন' হাত হলে বপুতে আর কুলোয় না। আরে কলেবর হস্তীসম হলে সেলের মালের আর দোষ কি? ডাইনে টানলে বিয়ে হয়না, আর বায়ে টানলে.... সাধে কি আর বলে," বারো হাত কাপড়েও কাছা দিতে পারে না।"
চৈত্র মাসে বের হয় , গাজনের সঙ। ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে শিব পার্বতীর নাচ, হনুমানের
লম্ফঝম্ফ, মুন্ডমালিনী কালিকার ভয়াল মূর্তিসহ শোভাযাত্রা আরও কত কী! সারাবছর আমজনতা যে সঙ সেজে নেত্যসহ সংসার করে, এটা বোধহয় তারই প্রতীকী! গিন্নির মন পাবার জন্য ভেতরে চাপা রাগ থাকলেও হাসি হাসি মুখ করে প্রেমিক পতি সাজতে হয়। গাজনের সঙ এর চেয়ে এগুলো কম কিসে?
এমাসের কল্যানে আছে, সিদ্ধি,ভাঙ, গাঁজা, আফিমের নেশার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকার ঢালাও ব্যবস্থা। অবশ্য বাঘছাল পরিহিত ভোলে বাবার ঐ ব্যাকডেটেড ফর্মুলার নেশা এখন একেবারেই অচল। বরং বিশ্বায়নের কল্যানে মুক্ত বানিজ্যের ছত্রছায়ায় প্রদান করে নিয়েছে, চরস,ড্রাগস,ব্রাউন সুগার,হাসিস আর সর্বকালের প্রাণহরা সোমরস " বিপিনবাবুর কারণ সুধা!"
এরপর চরকের বনবন পাক খাওয়া। পাক খাওয়ার শুরুতো জন্মের আগে থেকেই। মাতৃজঠরে থাকবার সময়েই ডাক্তারের কাছে পাক খাওয়া! পাক খেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েও নেই নিস্তার। এরপর স্কুলে ভর্তির জন্য শুরু হয় পাক খাওয়া। সেও দারুণ রকমারী। মার ইন্টারভিউ, বাবার পারসোনালিটি টেষ্ট ,তারপর অবোধ
শিশুটির লটারির পাক খাওয়ার পর বরাত ভালো হলে ছিড়বে ভর্তির শিকেয়। পাক খাওয়ার শেষ হয়না সহজে। পাশ করে চাকরির জন্য অবিরাম পাক খাওয়া। দরজায় জানালায় পাক খেতে খেতে কপালের জোর থাকলে ঘুচতে পারে বেকার নামের বদনাম। হল এবার চাকরি, এবার চাই নারী। অর্থাৎ বিয়ে, সেখানেও পাক খাওয়া। ছাদনাতলায় না ছ্যাদা হবার তলায় - একেবারে গুণে গুণে সাতটি পাক খেয়ে
তবে আপনার মোক্ষলাভ! সবথেকে হালকা শোলার টোপর পড়িয়ে দিয়ে পরে বিরাশি সিক্কা ওজনের মাল বহনের উপযুক্ত করবার জন্যই বোধহয় চোখকান বুঁজে সাতপাক খাওয়ানোর ব্যবস্থা!
এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে হাত পাক ঘোরাবার সময় লেগে গেল ধুন্দুমার কান্ড। পাত্রপক্ষের বক্তব্য , সাতপাক হয়ে গিয়েছে।অথচ কন্যাপক্ষ মানতে নারাজ, তাদের নাকি হয়েছে ছ' পাক। কেউ রাজি নয়, এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে। অগত্যা আমাকেই নামতে হয় ময়দানে। বন্ধুকে বলি, " ডরো মত্, তুমিতো এখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছ সূর্যের মতো, তোমার চারদিকে পাক খাচ্ছে তোমার অর্ধাঙ্গিনী। যাহা সাত,তাহাই আট। ওতে কিছু যায় আসে না। এরপর তোমার প্রিয়তমা থাকবেন ঠাঁয় বসে আর তুমি বেকুব তার চারপাশে পাক খেয়ে মরবে লাট্টুর মতো। মুখে ' রা ' কাড়বার থাকবেনা ক্ষমতা। সর্বদাই
মোলায়েম করে বলতে হবে," দেহি পদপল্লব মুদারম"! বিয়ে বাড়ীর লোকজন সব হাসিমুখে আর একপাক ঘুরিয়ে হন ক্ষান্ত।
এরপরতো জীবনের অন্তিম কাল পর্যন্ত শুধু পাক খাওয়ার পালা। প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা, ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে, সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অবিরাম একই পাক খেয়ে চলা। পিঠে বড়শি সেঁধিয়ে চরকের খুঁটিতে ঝুলিয়ে মানুষের পাক খাওয়ানোটা তাইতো সংসার আবর্তে পাক খাওয়ার সমার্থক। বেঁচে থাকবার লোভে মানুষতো আগেই টোপ লাগানো বড়শি গিলে বসে আছে। টোপ ও যায়না খোলা আবার বড়শিও যায়না খোলা। এ এক আজব" খুড়োর কল"!
সংসারী মানুষই যে শুধু পাক খাওয়ার যন্ত্রণায় বিদ্ধ তা নয়, সংসার বিবাগী রামপ্রসাদ ও ওই বেদনায় দীর্ণ। তাইতো তিনি গেয়েছিলেন, " মা আমায় ঘোরাবি কত, কলুর চোখ ঢাকা
বলদের মতো।"
তবুও আসে চৈত্র মাস, আসে চৈত্র সেলের বাজার, বাজে গাজনের ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি, চলে গাজনের সঙ। মন আনচান করা এলোমেলো হাওয়ায় গাছের পুরোনো পাতা ঝরিয়ে চৈত্রমাস ঘোষণা করে নতুন বছরের আগমন বার্তা। পুরোনোকে সরিয়ে তবেইতো জায়গা নেবে নতুন।
No comments:
Post a Comment