মুজনাই
অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪৩০
সতীমায়ের মেলা
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
নদীয়া জেলার চাকদহ থানার ঘোষপাড়া গ্রামে দোল পূর্ণিমাতে অনুষ্ঠিত উৎসব ও মেলা হচ্ছে সতী মায়ের মেলা। এই মেলা প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। প্রায় কুড়ি বিঘা জমির উপরে এই মেলা বসে। হুগলি বর্ধমান কলকাতা নদীয়া মেদিনীপুর বাংলাদেশ ২৪ পরগনা বাঁকুড়া পুরুলিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের ভিড় হয়। পূর্ব রেলপথের শিয়ালদহ রানাঘাট শাখায় কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে 8 কিলোমিটার দূরে ঘোষপাড়া বৈষ্ণব সমাজের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র অর্থভাজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউজা দেহ রক্ষা করার পর তার ২২ জন মন্ত্র শিষ্যের মধ্যে ঘোষপাড়ার রামশরণ পাল গুরুপদ লাভ করেন। এখনো রামশরণের বংশধররাই এই সম্প্রদায়ের পরিচালক। রামশরণের সহধর্মিনী কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কাছে সতীমা নামে খ্যাত হয়। ভক্তদের কাছে সতী বা পরমা প্রকৃতি যোগমায়া। সতীমার পুণ্য স্মৃতি স্মরণ করতে প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় ঘোষপাড়া সতীমার উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সতীমার কোন মন্দির বা মূর্তি নেই। কর্তা রামশরণের আদি ভিটায় ভক্তগণের কাছে অতি পবিত্র বলে বিবেচিত। ভিটায় সতীমার সিদ্ধিলা ক্ষেত্র ডালিমতলা, রামশরণ ও পরবর্তী কর্তাদের কুটির, তাদের ব্যবহার শয্যা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি বর্তমান। কর্তামা সতীমার বাসগৃহ এবং তার সমাধিস্থান অবস্থিত। ভিটার পিছনে হিমসাগর নামে এক বৃহৎ অগভীর দিঘির জল ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র ও সর্ব রোগ ঘরে ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বা মাটির ঘর বেঁধে মানসিক করে থাকে। এবং গাছ তলায় সতীমার উদ্দেশ্যে চিঁড়ে মুড়কি, বাতাসা ,কদমা ও চিনির মঠের ডালা নিবেদন করেন।
দোলের আগের রাত থেকে উৎসব শুরু হয়। সারারাত ধরে চলে। দোলের দিন খুব সকালে '' অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ভক্তদের মধ্যে দোল খেলা শুরু হয় এই দোল খেলায় কেবল আবিরই ব্যবহৃত হয় এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান সকলেই এই দোল উৎসবের অংশগ্রহণ করেন কর্তাভজা দলের অনুগামীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কীর্তন গান করেন, প্রসাদ বিতরণের পর এই দিনে উৎসব শেষ হয়।
সতীমার উৎসব উপলক্ষে এখানকার আমবাগানে সপ্তাহব্যাপী এক বিরাট মেলা বসে। মেলাটি ঘোষপাড়ার মেলা নামে প্রসিদ্ধ। এখানকার আম বাগানে সৃষ্টি সম্বন্ধে শোনা যায় যে যেসব দূরাগত যাত্রী বংশ পরম্পরায় এই উৎসবে আসতেন তারা গাছের ছায়ায় প্রাণ লাভের জন্য একটি করে আমগাছ রোপন পড়ে যেতেন। তাদের পরিবার পরিজনেরা আজো মেলায় এলে নিজের নিজের নির্দিষ্ট বৃক্ষতলেই অবস্থান করেন। এখানেই রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া করে থাকে। যদি কোন গাছ মরে যায় তাহলে সেই জায়গায় তারা আরেকটি চারা রোপণ করে যান। মেলায় বিভিন্ন ধরনের লোক আসে সতী মায়ের মহিমা কীর্তন করতে। রোগগ্রস্তরা ডালিম তলার মাটি মেখে হিমশায়রের জলে স্নান করে দন্ডি কাটেন ।সাধারণ দর্শনার্থীরা আসেন মেলা দেখতে, সন্ন্যাসীর দল উপার্জনের আশায় আসে। মেলায় প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা গেছে মহিলাদের সংখ্যা পুরুষদের চাইতে বেশি। গাগঞ্জে সংস্কার আচ্ছন্ন মহিলারা সন্তান কামনা মুখ সন্তানের মুখে কথা ফোটানো রোগব্যাধির প্রতিকার ইত্যাদির উদ্দেশ্যে ভিড় করেন। বিকৃত মস্তিষ্ক সন্তানহীনা ,রোগগ্রস্ত, বোবা অন্ধ ,খোঁড়া, বৃদ্ধ ,নারী পুরুষ সকলে দন্ডী কাটেন। বোবা ছেলের মায়ের দন্ডী কাটা শরীরের ওপর বোবা ছেলেকে শুইয়ে দেওয়া হয়। বোবা ছেলেকে মন্দিরের পান্ডারা চড় মারতে মারতে বলে' কথা বল কথা বল। মা বল বল মা'। লোকো বিশ্বাস ডালিম তলার মাটি মেখে হিমশায়ারে স্নান করলে সতীমার কৃপায় সন্তানহীনা মায়ের সন্তান হয়, বোবা কথা বলে, অন্ধদৃষ্টি পায় খোঁড়া চলৎশক্তি পায় নিরাময় হয়। ভক্ত ও উপাসকরা পরম বিশ্বাসে সতীমার সমাধিতে নোয়া সিঁদুর দেয়।
কিংবদন্তি আছে এক পান বরজে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু পরবর্তীকালে সাধনার সিদ্ধিলাভ করে আউলচাঁদ নামে খ্যাত হন। লোকবিশ্বাস তিনি নবদ্বীপের নিমাই। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁর মর্ত্যলীলা। 'কৃষ্ণচন্দ্র গৌর চন্দ্র আউলে চন্দ্র তিনিই এক একে তিন'। নানা রকম অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডে তিনি পারঙ্গম ছিলেন। একবার তিনি কমন্ডলুতে গঙ্গাকে ভরে দিলেন। রামচরণ পালের মুমূর সুশ্রী সরস্বতী দেবীকে বাঁচিয়েছিলেন তার কমন্ডলুর জলে। একবার একটি মরা গরুর গায়ে হাত বুলিয়ে তিনি গরুটিকে জীবন দিয়েছিলেন। এই গরুটির মালিক ছিলেন রামশরণ বাবু এত উপকারে কৃতজ্ঞ রামশরণ ও সরস্বতী যখন আউলচাঁদ কে স্থায়ীভাবে কামনা করেন, তখন আউলচাঁদ তাদের পুত্ররূপে জন্মাবার অঙ্গীকার করেন। পরবর্তীকালে সরস্বতী দেবীর গর্ভে আসেন দুলাল চাঁদ তিনিও আবার বলা হয় দুলাল চাদি নদের নিমাই আর সরস্বতী দেবী শচীমাতার অবতার সতী মা। এই সতীমা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব করতেন। আজও লোকে তাই পরম আবেগে বলে 'কলিকালে বলে দুলাল চাঁদের জয়/ হিমসায়রে স্নান করিলে মরা মানুষ জ্যান্ত হয়/ জয় সতী মা, জয় মা।'
এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ আউল বাউলের গান মেলায় সমবেত বাউলেরা ছোট ছোট আসরে বিভক্ত হয়ে সারা রাত গান করে থাকেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমার একবার এই মেলা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফাদার দ্যাঁতিয়েন । সেই সময় প্রচুর মহিলা বাউল এর দেখা পেয়েছিলাম। সারারাত ধরে বাউল গান শুনে সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। আজও সতী মায়ের মেলা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
No comments:
Post a Comment