Saturday, November 2, 2024


 

এই সময় 


বাংলার গরিমা কথা 

    কবিতা বণিক



বাংলা ভাষার ওপর লেখা গ্রন্থের  খোঁজ করছিলেন  রাজেন্দ্র লাল মিত্র নামে এক ব্যক্তি।  সে সময়  বাংলার আবহাওয়া , তুর্কী  আক্রমণ নানান সমস্যার কারণে পুঁথি সংরক্ষণ অসম্ভব থাকার কারণেই তিন বছরের প্রচেষ্টার পর  নেপাল থেকে বেশ কিছু বাংলায়  লিখিত পুঁথি আবিস্কার করেন।  ১৮৮২ সালে  সে সব পুঁথির  এক ক্যাটালগ তৈরি করেন।  রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর, তৎকালীন বৃটিশ সরকার  হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর এই দায়িত্ব তুলে দেন। ১৯০৭ সালে সেখানে `চর্যাপদ` গ্রন্থের খোঁজ পান।  চর্যাপদ হল বাংলা ভাষায় রচিত  বৌদ্ধ গান ও দোঁহা নামে গ্রন্থের  চব্বিশ জন সিদ্ধাচার্যের  রচনা করা  ছেচল্লিশটি গান। এতে বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় সাধন প্রণালী,দর্শন তত্ব নানা রূপকের মাধ্যমে আভাসে  ইঙ্গিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এর সাহিত্যের মূল্যের সাথে  সাথে তখনকার  বাঙলার সমাজের  চিত্র কেমন ছিল তা জানা  যায়।  এই চর্যাপদ রচনা হয়েছে তারও অনেক আগে নিশ্চয়ই। ১৯০৭ সালে চর্যাপদ পাওয়ার পর  এর রচনা কালনিয়ে যে গবেষণা শুরু হয়েছিল ,  সেই গবেষণা শতবর্ষ পার করেও আরও গবেষণার পর  দেখা যায় এই চর্যাপদ রচিত হয়  খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে। লিখিত পদ্যের এই রকম নিদর্শনের জন্যও বেশ কয়েক শত বছরের  প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়।   আরও একটি  তথ্য পাওয়া যায় অষ্টম শতকে  লি ইয়েন  নামে এক চৈনিক ভদ্রলোক  সংস্কৃত - চীনা ডিকশনারি তৈরি করেন। তিনি মারা গেছেন ৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে।  অষ্টম শতাব্দী  শেষ হওয়ার  আগেই তিনি মারা যান।  অভিধান সংকলিত হয় তার আগেই। চীন দেশেই এই অভিধান সংকলিত হয়েছিল। এই ডিকশনারিতে যে লিপিতে চীনা হরফ লেখা হয়  সে লিপি পড়ার লোক এখন নেই।  সংস্কৃত লেখা হয় সিদ্ধম  লিপিতে।  এর থেকে পরবর্তীতে  সিদ্ধ মাতৃকায় বাংলা লিপি তৈরি হয়েছিল।  মজার কথা এই অভিধানে ৫২ খানা বাংলা শব্দ পাওয়া গেছে। যে অভিধান সংস্কৃত- চীনা ভাষায় সংকলিত  হয়েছে চীনে অর্থাৎ ভারতের বাইরে। এই শব্দ গুলোর মধ্যে — ভাতার, মাংস, আইসো, বইসো ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার  প্রভাব ছিল বলেই  অষ্টম শতকে ভরতের বাইরে  সংস্কৃত ও চীনা ভাষায়  রচিত অভিধানেও বাংলাভাষা তার মধ্যে স্হান করে নিয়েছে।  বাংলার প্রাচীনতা বলতে অবিভক্ত বাংলাদেশ অবশ্যই ধরতে হবে। সেইমত প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়  বগুড়া জেলার মহাস্হানগড় ইন্সটিটিউশনে। সেখানেই প্রথম ‘ বঙ্গ ‘ নামটা লিখিত আকারে পাওয়া যায়। সেখানে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ইতিহাস পাওয়া গেছে।   আমরা জানি অতীশ দীপঙ্কর ও বাঙালী ছিলেন।  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উঃ চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপায়  খনা- মিহিরের যে ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায় সেখানে যে সভ্যতা গড়ে ছিল তা ছিল খ্রীষ্ট পূর্ব অষ্টম শতাব্দীর। 

 2004 সালে  ভারত সরকার বিভিন্ন ভাষাকে ক্ল্যাসিক্যাল তকমা দেওয়ার জন্য  একটা স্কিম তৈরি করেন।   তার কিছু শর্ত -- যেমন-                                                                                               

১ নং -   লিপিবদ্ধ নথির ইতিহাস ১৫০০ - ২০০০ সালের পুরোন হতে হবে। 
২নং--    সাহিত্যের নমুনা প্রাচীন কাল থেকে  বর্তমান ও ভবিষ্যতেও তার স্বীকৃতি থাকবে।
৩নং--    কাব্য ও খোদাই করা নমুনা ছাড়াও জ্ঞান মূলক রচনা, বিশেষ করে গদ্য রচনা থাকবে।
৪নং--     ভাষার পরিবর্তন হলেও এখনও সমান প্রাসঙ্গিকতা থাকা প্রয়োজন। 

এই সমস্ত গবেষণার  উপর বিশেষ যে দল কাজ করেছেন তারা হলেন—

 ভাষা বিজ্ঞান ছাত্র -           শ্রী রাজীব চক্রবর্তী।
বাংলার গবেষণার প্রধান — শ্রী অমিতাভ দাস।
আর্কিওলজিস্ট  —  -            শ্রী রজত স্যান্যাল।
তরুন গবেষক -                   শ্রী সোমনাথ চক্রবর্তী।
সংস্কৃত ছাত্র গবেষক —   -     শ্রী সায়ক বসু।

এদের সাথে সাহায্য করেছেন- ডঃ শ্রীমতী স্বাতী গুহ। তিনি  ইনস্টিটিউট অফ  স্টাডিজ এণ্ড ল্যাঙ্গুয়েজ এণ্ড রিসার্চের অধিকর্তা।  তিনিই সরকারের  সাথে  যোগাযোগের মূল জায়গা তৈরি করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সহায়তাও  উল্লেখযোগ্য।  গবেষণা লব্দ্ধ তথ্য দিয়ে ২০০০ পাতার একটি নথি তৈরি করে  কেন্দ্রের কাছে  বাংলা ভাষা যে সাহিত্য নির্ভর , ২০০০ বছরের পুরোন ভাষা তাই  তারা এই ভাষা        `ধ্রুপদী` সম্মান পাওয়ার  জন্য দাবি  রাখেন। এই দাবী জানিয়েছেন অনেকেই। তার মধ্যে আমার জানা মুর্শিদাবাদের অধীর চৌধুরী, আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা ও সমিতির  শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি শাখার  শ্রীযুক্ত সজল কুমার গুহ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি। 

                  ধ্রুপদী কাকে বলে?  ধ্রুপদ হল রাগ সংগীতের একটি  পুরোন ধারা। এটি দীর্ঘ স্হায়ী ব্যবহার হয়। ধ্রুবপদ  থেকেই হয়ত এই শব্দটা এসেছে। ধ্রুব অর্থাৎ  সত্য - যা ছিল, আছে, থাকবে। পদ হলো বাণী। যা সত্যবাণী তাই  ধ্রুপদ।প্রাচীন কালে ধ্রুপদ গাওয়া হত শুধুই মন্দিরে। রাজা মহারাজাদের জয়জয়কার , ঈশ্বর লীলা লেখা হত।  প্রবন্ধের একটাছোট্ট সংস্করণে সুর, তাল, লয় সহ যে পদ ,তাই হলো ধ্রুপদ।

                  ধ্রুপদী ভাষা বলতে বোঝায়  ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরোন ভাষা। যে ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রচার বেশবড়।  যাদের প্রাচীন সাহিত্যের ঐতিহ্য স্বাধীন ও স্বাবলম্বী ভাবে গড়ে ওঠে , যে ভাষা  প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত এবং মূল্যবোধ, স্বতন্ত্র, সাহিত্যিক ঐতিহ্য সম্বলিত  ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা বলা হয়।   এর কিছু শর্ত আছে। 

  ভাষার লিপিবদ্ধ নথির ইতিহাস ১৫০০ থেকে ২০০০ পুরোন হতে হবে। 
  সাহিত্যের নমুনা প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান  ও ভবিষ্যতেও  তার স্বীকৃতি থাকবে।
  কাব্য ও খোদাই করা নমুনা ছাড়াও জ্ঞানমূলক রচনা বিশেষ করে গদ্য রচনা থাকা উচিত। 
  সেই ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক ভাষার ফারাক থাকতে পারে। ভাষার পরিবর্তন হলেও এখনও সমান প্রাসঙ্গিক হওয়া চাই। 

  ধ্রুপদী তকমা পাওয়া অর্থাৎ  সরকারী স্বীকৃতি পাওয়া।  এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সেই ভাষার পঠন পাঠনের  একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।  এছাড়া নানান সাংস্কৃতিক যে উপাদানগুলি  ভাষার সাথে লগ্ন হয়ে থাকে  তার একটা সংগ্রহশালা, সংরক্ষণ,  তা নিয়ে গবেষণা , তার জন্য বরাদ্দ অর্থ থাকবে, সরকারী, বেসরকারী সমস্ত  ক্ষেত্রে  সেই ভাষাও গুরুত্ব পাবে।  আমাদের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দী, ইংরেজির সাথে এখন থেকে  বাংলায়ও লেখা থাকবে। আমি আমেরিকায় সর্বত্র দেখেছি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ ভাষায়  লেখা থাকে।   প্রত্যেক গবেষকদের  জন্য অনেক  অনেক শুভেচ্ছা  রইল, আমাদের লেখক, কবিদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি আজ আমাদের  সত্যিই গর্বের দিন, আমাদের ভালবাসার বাংলা ভাষা এভাবেই এগিয়ে চলুক। 

No comments:

Post a Comment