মানবতাবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ডাকঘর
সঞ্জয় সাহা
রবীন্দ্রনাথের নানান রূপ, তাই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি তাঁর কবিতা, গান আর গল্প কাহিনী প্রবল বাতাসে। অথচ মানব জীবনের বহু বিচিত্র বিষয়াদি তিনি হাজির করেছেন নাটকের ক্যানভাসে। প্রকৃতি,মানব-মন,আনন্ দ-বেদনা আর পাওয়া না পাওয়ার অনেক হিসেব হয়তো মিলবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের সংলাপে,চরিত্রের গতি অন্বেষায় ও বিকাশে।
মানুষের মানবতা বোধগুলোকে আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথের সার্বক্ষণিক যে আকুলতা,তার সরল স্বাভাবিক প্রত্যাশিত চিন্তাবলি সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে তাঁর নাটক বুননের কৌশলে আর সৃষ্ট নাটকীয়তায়।
ডাকঘর (১৯১১খ্রিষ্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। মোট তিনটি দৃশ্যে ও ৩৯৯ টি সংলাপে নাটকটি সম্পূর্ণ হয়েছে। ডাকঘর রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটকগুলির মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় যা দেশে তো বটেই,বিদেশেও অনূদিত ও অভিনীত হয়েছে।
নাটকের মূল চরিত্র অমল, সে তার পিসেমশাই মাধব দত্ত ও তাঁর স্ত্রীর কাছে থাকে। কঠিন অসুখে আক্রান্ত অমর গৃহবন্দী কবিরাজের নির্দেশে।বাইরের আলো বাতাস তার কাছে যমদূতের সমান। তবে শরীর ঘরে আটক থাকলেও তার মন উড়ে বেড়ায়,ঘুরে বেড়ায়,চলে যেতে চায় দূর দেশে সমস্ত কঠোর বাধা নিষেধকে উপেক্ষা করে। তার মনের খবর রাখেন শুধু ঠাকুরদা। একা জানালার ধারে বসে থাকা অমলকে তিনি শোনান দেশ-বিদেশের খবর, যা অমলের কল্পনাকে লাগাম ছাড়া করে দেয়। সারাদিন বসে থাকা অমলের সঙ্গে আলাপ হয় নানা চরিত্রের দইওয়ালা,রাজার প্রহরী,মোড়ল,ছেলের দল। অমলের সঙ্গে তাদের কথায় বারবার বোঝা যায় যে, অমল এর কাছে শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর তার এই বন্দিদশা। সে মুক্তভাবে দেখতে চায় পৃথিবীকে, কিন্তু বাদ সাধে তার অসুখ। অমর অপেক্ষা করে সুদিনের যেদিন তার বন্দিদশা ঘুচে যাবে। সে অপেক্ষা করে কোন এক ডাক হরকার যে নিয়ে আসবে রাজার চিঠি, যাতে থাকবে তার মুক্তির কথা। অমল কল্পনায় কখনো হয়ে যায় দইওয়ালা,এখনো প্রহরী,আবার কখনো বা ডাক হরকরা। প্রতিটি মানুষের চোখ দিয়ে অমল দেখে এইসব সম্পর্ক। কঠিন পরিস্থিতিতেও তার মন মুক্ত আর গভীর আশাবাদী, মূল নাটকের শেষে দুতের হাত ধরে অমল ধীরে ধীরে চলে যায় সেই পরম মুক্তির পথে । তার আর রাস্তার পাহারাওয়ালা হওয়া হয় না, সম্ভব হয় না সুধার সঙ্গে দেখা করা, কিন্তু এই মুক্তিতেই তো অমল প্রকৃত অর্থে মিশেছে বিশ্বের মানবতার সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথ মানবতার পূজারী ছিলেন। মানবপ্রেম তাঁর দার্শনিক চিন্তার মূল বিষয়। তিনি উপনিষদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন ।
"অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়" ।
অর্থাৎ, আমাকে অসৎ থেকে সৎ অন্ধকার থেকে আলোক এবং মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাও। উপনিষদের এই মহান বাণীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যাবতীয় কর্মের মধ্য দিয়ে জীবনের সমস্ত ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে,তাঁর সমগ্র সৃজনশীল সৃষ্টিতে বহন করেছেন।
১৯৩০ সালে Oxford এর Manchester college এ হির্বাট টাস্ট যে বক্তৃতার আয়োজন করেছিলেন, তাতে রবীন্দ্রনাথ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন । সেই ভাষণের ভিত্তিতে তিনি 'Religion of Man' বা "মানুষের ধর্ম 'গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে মানব ধর্মকেই মানুষের একমাত্র ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। গ্রন্থটির মুখবন্ধে তিনি আরও বলেছিলেন, আমাদের অন্তরে এমন কেউ আছেন যিনি মানব অথচ তিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে- "সদা জানানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ"- তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায়,ভাবে,কর্মে,সার্বজনী নতায় অমল চরিত্রটির আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন । এই চরিত্রের মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে,মানুষের উপলব্ধির বিকাশ মানুষের আপন জীবসীমা অতিক্রম করে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় । আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছিলেন,
"অমল ও মানবতার প্রতীক,বন্ধনই আত্মার পীড়া । অমলের পীড়া শারীরিক কোন বিকার মাত্র নহে,ইহা মনের অস্তিত্ব অবস্থা,চারিদিকের বন্ধন হইতে অস্বস্তির জন্ম,এই বন্ধন হইতে মুক্তিই আত্মার চিরন্তন কাম্য একমাত্র মৃত্যুর মধ্য দিয়াই এ মুক্তি সম্ভব হইয়া থাকে ।"
রবীন্দ্রনাথের এই নাটকের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো,মানুষের নিজের অন্তরের মধ্যে যে পরম সম্পদ নিহিত রয়েছে তার আবিষ্কার ও সেই সম্পদ যে অন্যের মধ্যেও সুপ্ত রয়েছে, সেই বোধ থেকে মানবপ্রীতি,প্রেম,নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও সেবার প্রকাশ ঘটানো । এই মানব প্রেমে উচ্চ-নীচ,ধনী-দরিদ্র,হিন্দু-অহি ন্দু প্রভৃতি বর্ণভেদ ও জাতিভেদের কোন স্থান নেই । মানুষের একটি পরিচয় তার কাছে বেশি মূল্য পেয়েছে যে,সে মানুষ । আর এই মানুষকে ভালবাসার মন্ত্র আজীবন জব করেছিলেন বলেই তিনি বলতে পেরেছিলেন,
"মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমারই লোক"।
আসলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনায় মানুষের মধ্যে প্রেম- ভালোবাসা-মানবতা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে । তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন যে,সেবা ও ত্যাগের মহান মন্ত্রের দ্বারা মানবজাতির কল্যাণ সাধন সম্ভব । আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান ভারতবর্ষের মহান ব্রত হল সেবা, ত্যাগ ও তপস্যা । এই ঐতিহ্যের যোগ্য উত্তরসূরী হলেন ঋষি-কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ । তাইতো তিনি মানবকল্যাণের ভাবনাকে তার অন্তরের অন্তস্থলে সর্বদা এক প্রেরণা হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন । তার গভীর অন্তর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল যে মানুষের মধ্যেই পূর্ণব্রহ্ম বা পরমব্রহ্ম বিরাজমান। মানুষের অন্তরে এই পরম,অনন্ত সত্তাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই মানবকল্যাণের ভাবনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। নিজের কল্যাণ ও মঙ্গলের ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলে তাকে মনুষ্যোচিত ভাবনা বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথ 'চিত্রা' কাব্যে বলেছিলেন,
"স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে
সে কখনো শেখেনি বাঁচতে"।
প্রাণ ধর্ম ও জড় ধর্মের সামগ্রিক দ্বন্দ্বই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে তাঁর ডাকঘর নাটকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। আরে এই নাটকের বিষয়বস্তু অমল নামে একটি ছয় সাত বছরের ছেলের মধ্যে ক্ষয়,অবসন্নতা ও মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শারীরিক বদ্ধতার মধ্যে, ক্লান্তি ও অসহায়তার মধ্যে, তার মনটি কেমন উজ্জ্বল চঞ্চলতায় দেশ-বিদেশের পরিক্রমায় ছুটে যেতে চাইছে, এই দ্বন্দ্ব সমগ্র পরিসর জুড়ে ফুটিয়ে তোলেন লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
No comments:
Post a Comment