নারী: তুমি জননী জায়া দুহিতা
জয়তী ব্যানার্জী
আমাদের রবি ঠাকুর -আমার ছোটবেলার রবি কবি।কৈশোরের লেখনী আর যুবতীর না বলা কথার আশ্রয়স্থল।সেই রবিবাবু তার উর্বশী কবিতায় নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবেই ব্যবহার করেননি। তার ভাষায়_____
"নহমাতা নহ কন্যা
নহবধূ সুন্দরী রূপসী
হে নন্দনবাসীনি উর্বশী,"
ভারতীয় নারী শব্দটি নিয়ে অনেকেই অহংকার প্রকাশ করে থাকেন। ভারতীয় নারীর আদর্শ মাফিক আপন আপন পরিবারের নারীদের নিয়ন্ত্রণের মহতি প্রচেষ্টা অনেকেই করে থাকেন ।ভারতীয় নারী বলতে বোঝায় কতগুলি বিশেষ গুণে ভূষিতা নারী ।আজ একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এই ভারতীয় নারী নামক ধ্যান ধারণার স্রষ্টা ।এর পশ্চাতে হিন্দু পুনরুত্থান বাদী চেতনাও ক্রিয়াশীল।
সুকুমার রায়ের "বাবুরাম সাপুড়ে "যেমন যেকোনো সাপের নয়, বিশেষগুণ সম্পন্ন সর্পের রসদদার ;তেমনি জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষীয়রা যে কোনো রমণী নন, বিশেষ গুন সম্পন্ন রমনীর সমঝদার। আদর্শ ভারতীয় নারী নাকি সীতার মতো সহনশীল হবে, সাবিত্রীর মত হবে পতিব্রতা আবার দ্রৌপদীর মত হবে রন্ধন কুশলী। তারা পরিবার-পরিজনদের জন্য প্রশ্নহীনভাবে শ্রম দান করবে, কোন বিপরীতে প্রশ্ন উচ্চারণ করবে না, এমন কি সহনশীলারা যদি সংহার মূর্তি ধারণ করেন তাহলেও পুরুষদের মতামত নিতে হবে । মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গা পুরুষ দেবতাদের অস্ত্রে সজ্জিতা। অসুর নিধানান্তে তিনি পতিগৃহে সংসার কার্যেও যোগ দেন। বঙ্কিমচন্দ্র প্রফুল্ল কে দেবী চৌধুরানী করেন বটে তবে পরিশেষে দেবীকে প্রফুল্লে রূপান্তর করণে এতটুকু দ্বিধাও করেননি।
তাইতো কবির ভাষায় বলা যায় 'হিন্দু নারী মহিমার পূর্ণরূপ প্রকট তোমায়'। -আদর্শ জননী জায়া কন্যা ভগিনী আচার্যা- মায়ায় মহাদেবী- মানবীর বেশে দেশকাল পাত্র-পাত্রী জাতি ধর্ম নির্বিশেষে-সকলেরে বাসিয়াছো ভালো।
'তব স্নেহ ছায়া তলে কত খ্রিস্ট বৌদ্ধ জৈন অহিন্দুর জীবন জুড়ালো, খ্রিস্টান তোমার মধ্যে দেখিয়াছে মেরি মাতার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি; বৌদ্ধ স্বামীজীর যশোধারা দেবী; বৈষ্ণবের তুমি বিষ্ণুপ্রিয়া; একহাতে বর আরেক হাতে অভয় বহিয়া আসিয়াছো বিশ্বধামে প্রচারিতে মায়ের মহিমা'।______ এই হলো ভারতীয় নারী _সত্যের পরকাষ্ঠা; আধুনিকা--, যিনি জগতের শ্রী শ্রী মা, যার চরিত্র পাঠ গীতা বেদ সংহিতা পাঠের সুফল প্রদান করে। সর্বগ্লানি ঘুচিয়ে জীবন সার্থক করে। তাই তো আধুনিক মা মূর্ত গীতা স্বাহা: গৌরী স্ব:ধা গঙ্গা হিমাদ্রি দুহিতা।
এদিকে ঋতুরাজ বসন্ত যে জানান দিয়েছে, আমি এসেছি তোমার ই দুয়ারে, রুদ্ধ কেন দ্বার-- তাইতো আমরাও তৈরি- আমাদের কন্যাকে ভুবন মোহিনী রূপে বরণ করে নিতে, আমি নারী ---চিত্রাঙ্গদা!
আমরা বড় হয়ে উঠি সেই মাতৃত্বের আবরণ ভেঙে -সেখানে নেই কোন আত্মম্ভরিতা ,আছে শুধু গড়ে নেওয়ার মানসিকতা, নেই, ভেঙে দেবো গুঁড়িয়ে দেব-র মনোভাব।
বারবার করে মনে পড়ে,
আমি যেদিন এলেম,
সেদিন দীপ জ্বলে না ঘরে।
বহুদিনের শিখার কালি,
আঁকা ভিতের প'রে।
সত্যিই কি তাই, বোধ হয় না, আজ আমরা মুক্তবিহঙ্গ কিন্তু এক অদৃশ্য বাহুডোরে বন্দী মোরা । নারীদের পূর্ণ প্রকাশ বোধ হয় মাতৃত্বের বন্ধনে আবৃত। মা হওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা ----এক অব্যক্ত অনুভূতি যেন তৈরি হয়ে যায় মাতৃজঠরে পরিপোষিত হওয়ার জন্য। সেই স্বপ্ন আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে আর মনের কোণে উঁকি দেয়___
'হাজার তারা আলোয় ভরা,
চোখের তারা তুই-
স্বপ্ন দিয়ে সাজাই তোরে,
কান্না দিয়ে ধুই।'
সেই নারী কিন্তু অসুর দলনী আবার সর্বং সহা জননী। দেবী দুর্গাকে যদি আমরা নারী শক্তির পরকাষ্ঠা ধরি তাহলে কি আমরা প্রস্তুত। তাকে দেবীরূপে কল্পনা না করে আমাদের সংসার জীবনে নামিয়ে আনতে পেরেছি কি? তার রিপু দলনী শক্তিকে আমাদের মধ্যে জাগাতে।
না পারিনি।তাই তো আজও আমরা অবলা পুরুষদের হাতের পুতুল ।কিন্তু মা যে নারী শক্তির প্রতীক, তিনি যে অসুর দলনী সর্বং সহা ।আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দেবী দুর্গা যে চন্ডী রুপিনী, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে সুদূরের পিয়াসী করে তোলে ।আমিও যে আনমনে তারই আশায় চেয়ে থেকেছি সকলেরই মত মুক্ত বাতায়নে । প্রতিটি মুহূর্তেই সালমা আজাদের কবিতা টি মনে করিয়ে দেয় ভবিষ্যতের নারীর মিষ্টি অস্তিত্বকে,
তুই যে আমার ঘরের শোভা
জাদু সোনা ময়না
হাটি হাটি করে
ধরিস শত বায়না।
তবু অসুররূপী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী শক্তিকে খর্ব করার যে প্রচেষ্টা।তা কিন্তু আজও থেমে নেই ,আমার তোমার সকলের রবি ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন___
"কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল."
এর পেছনেও কি নেই সুক্ষ এক আত্মম্ভরিতার স্পর্শ।ভালোবাসার দাবীকে ছাপিয়ে যায় নাকি পুরুষ সিংহের দাপট ।গার্গী মৈত্রী লোপামুদ্রার দেশে আজও কিন্তু থেমে নেই অন্যায় অত্যাচার। সেখানে কমলা রমলার মত মেয়েরা হচ্ছে নির্যাতিতা নিপীড়িতা ।আজকের নারী এভারেস্ট বিজয়ী, আজকের নারী মহাকাশচারিনী কিন্তু তবুও যে সে নারী। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় সে যে অবলা, শরৎ বাবুর ভাষায় বাবুদের চরিত্র হরণের চাবিকাঠি।
তর্কের খাতিরে বলা যায, আজকের মেয়েরা মানে আমরা স্বাধীন তবু যেন অদৃশ্য শেকল পরানো ,আমাদের পায়ে। উনিশ শতকে গড়ে তোলা এই পুরুষতান্ত্রিক পরিবার কেন্দ্রিক এক চোখা আদর্শবাদের কি অবসান হয়েছে? আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য হয়েছে তলিয়ে দেখলে টের পাওয়া যায়_____ নানা রূপে আদর্শ তন্ত্র এখনো বর্তমান। স্কুল-কলেজে শিক্ষিকারা তাদের পছন্দমতো সুবিধার অবশ্যই শালীনতা সম্পন্ন বেশভূষা পড়ে গেলে শার্ট প্যান্ট পরিহিত পুরুষ সমাজ রে রে করে ওঠে, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীলা মহিলা দিনের শেষে ঘরে ফিরলে দশভূজা উপাধি প্রদান করে ভারতীয় পরিবার তাকে পাক শালে ঠেলে পাঠান। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারী অবসন্নতা দূরীকরণের জন্য একা একা পানভোজন করতে গেলে মহিলাদের পানাধিকার নিয়ে কথা ওঠে। বিশেষত রক্ষণশীল দের বক্তব্য --এসব নাকি ভারতীয় নারীদের সাজে না এটি সম্পূর্ণই অপযুক্তি তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা কি উচ্চস্বরে বলতে পারি? আমরা আধুনিক____
সেই আধুনিকতা কি শুধুমাত্র আমাদের পোশাকেই,আমরা কি পেরেছি সত্যিকারের আধুনিক হতে ?পুরুষ সমাজ ঠিক যতখানি ছাড়ে বা যতটুকু দেখে তারা নিজেদের পৌরুষত্বকে জাহির করতে পারে আমরা ঠিক ততটুকুই আধুনিক ।আজও কি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ইভটিজিং ,শ্লীলতাহানি ,কন্যা ভ্রুণ হত্যা ---আমরাই তো ছোটবেলায় শিশু কন্যার হাতে তুলে দিই রান্না বাটি পুতুল খেলার সামগ্রী। এগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তারাও ভাবে যে তারা বোধ হয় সংসারের পুতুল।
তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবস একদিন নয় এ যে প্রতিদিনের দিবস। শেষে রবিবাবুর অমিত'র সাথে গলা মিলিয়ে না বললেই নয়
"ভালো জিনিস পৃথিবীতে যত কম হয় ততই ভালো" তাই তার অস্তিত্ব কম।
No comments:
Post a Comment