ঘন কুয়াশা (৩)
শীলা ঘটক
আজ সকালের ফ্লাইটে মা অফিসের কাজ নিয়ে ব্যঙ্গালোর গেছে।
বাড়িতে আমি আর রাধেশ্যাম। দুপুরে ভাত খেয়ে শুতেই চোখটা জুড়ে গেছিল-----
খোকা ওঠো--- দরজায় টোকা দিয়ে রাধেশ্যামের ডাকে ঘুম ভেঙে
গেল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিলাম।
চা নিয়ে এসেছে, টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, রাতে কি খাবে
বলো? বৌদি তো বলে গেছে তোমাকে চিকেন করে
দিতে, ফ্রিজে রাখা আছে। চিকেন আর রুটি। বেশ, তাই করো---- কিন্তু কাল আবার চিকেন
করোনা, কাল বাজার যাবে, ছোট মাছ আর সবজি নিয়ে আসবে। রাধেশ্যাম মাথা নেড়ে চলে গেল।
চা খেয়ে উঠে পড়লাম। অনেকটা দেরি হয়ে গেল, সন্ধ্যে হতে
চলেছে। বেরিয়ে পড়লাম কাজে।
...............
সকালটা বেশ ঝলমল করছে আজ, সারা বাড়িতে এদিকওদিক প্রচুর
ফুলগাছ লাগিয়েছে রাধেশ্যাম, ওর এসবে খুব
শখ। খাটতেও পারে মানুষটা! অপরাজিতা, টগর, জুঁই, কামিনী, গন্ধরাজ, আরও কত ফুলের
গাছ--- অনেক গাছ আমি চিনিই না। সম্পর্কের দূরত্ব মায়ের সঙ্গে আমার যতটা, ঠিক ততটা
আত্মিক সম্পর্ক আমার সঙ্গে রাধেশ্যামের। পর যে কখন আপন হয় আর আপন যে কখন পর হয় বলা বড়
কঠিন!
সারাদিনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে বেশ কয়েকবার ফোন আসে
রাধেশ্যামের---- খোকা খাবার সময় হয়ে গেছে বাড়ি এসো। খাবো তো একবার-- তার আগে ফোন আসবে অন্তত পাঁচ/ছয় বার। আজ দুদিন
হয়ে গেল মা ব্যাঙ্গালোর গেছে, একটাও ফোন করার দরকার মনে করে না। যেটুকু দরকার
রাধেশ্যামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে! সবকিছুই বড় অদ্ভুত লাগে! আমার প্রতি মায়ের এই অবহেলাই হয়তো আমার সঙ্গে রাধেশ্যামের সম্পর্কটা এতো মজবুত
করেছে। একদিকে ভালই হয়েছে---- রাধেশ্যাম বিয়ে করেনি, দেশে তার কোন পরিবার নেই।
বিয়ে করেনি—নাকি এইবাড়ির জন্য তার বিয়ে করা হয়নি , কে জানে!!!
কাজের চাপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় তিনটে হয়ে গেল। বেল
বাজাতেই রাধেশ্যাম দরজা খোলে--- সেই কোন সকালে কি একটু সামান্য খেয়ে বেরিয়েছ, আর
এই ফিরলে? (এই শাসনগুলো বেশ লাগে) --- বললাম, তুমি খেয়েছ? মাথা নাড়ে ও, কেন
খাওনি? প্রশ্ন করি---
সেটা হয়না, আজ অব্দি তোমায় না খাইয়ে আমি খেয়েছি একদিন হয়েছে যে আজ খাবো? যাও
যাও তুমি স্নান করো আমি খাবারগুলো গরম করি।
রাধেশ্যাম চলে গেল। ওর বয়স এখন মনে হয় ষাট এর বেশীই হবে, বুঝি না ঠিক। চিরকাল তো একরকম দেখছি, ধুতি আর হাফ হাতা শার্ট।
এই মানুষটির আন্তরিক টান মনে করিয়ে দেয়
বাড়ি ফেরার কথা।
দুপুরের খাবার পর ঠিক করলাম আজ আর বের হব না, বাড়িতেই
থাকবো আর ওর কাছে জানতে চাইবো আমার অতীত।
বাড়িতে মা না থাকার জন্য রাধেশ্যামকেও
বেশ স্বাচ্ছন্দ্য মনে হচ্ছিল আজ। বিকেলে
ফুলগাছগুলো জল দিচ্ছিল রাধেশ্যাম। ডাকলাম আমি----- নীচ থেকে সাড়া দিল, যাই খোকা।
ঘরে এসে চেয়ারে বসে বলল, বলো ডাকছিলে কেন?
তোমাকে আজ সব জানাতে হবে, আমার জীবনের কথা যা তুমি জানো।
রাধেশ্যাম বলল, সে তো অনেক কথা বললে শেষ হবে না। আমি জোর
করলাম ওকে, না তোমায় এখনই বলতে হবে......
একটু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ও বলতে শুরু করলো------
দাদাবাবু মানে তোমার বাবা তখন সদ্য বিয়ে করে বৌদিকে নিয়ে
উড়িষ্যার কটকে গেছেন। রেল কোম্পানিতে বড়
পোস্টে কাজ করতেন দাদাবাবু। বৌদি দেখতে কি
সুন্দরীই ছিলেন তখন! খুব ভালো ছিল দুজনে। জানো,
ছুটিতে দুজনে এদিক ওদিক ঘুরতে যেত। আমি
রেলে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করতাম, এই দাদাবাবুর ফাইফরমাশ আর কি। এছাড়া কোয়ার্টারেও কাজ করতাম আমি, দাদাবাবু-
বৌদি দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসতো! বলতে
বলতে ওর চোখদুটো চিক্ চিক্ করে উঠলো...... আমি বললাম তারপর----
এইভাবে কাটল দুবছর, (চুপ করে মাথা নীচু করে আঙুল খুঁটতে
লাগলো) তুমি কিন্তু বৌদিকে কিছু বলতে পারবে না খোকা, বৌদি শুনলে আমাকে তাড়িয়ে
দেবে। আমি বললাম আরে না না, তোমার বৌদি আজ
পর্যন্ত আমাকে তার ছেলে মনেই করতে পারল
না, মনে করলে সে নিজেই বলতো!!---- চমকে উঠলো রাধেশ্যাম, বলল, তুমি কেন বললে এই কথা? আমি বললাম মায়ের ব্যবহার দেখে, যাইহোক তুমি বলো।
তারপর...... তারপর কি হোল?? তর সয় না আমার--- আবার বলতে শুরু করলো, রেলের এক কনট্রাক্টরের সঙ্গে দাদাবাবুর খুব
বন্ধুত্ব হোল।
কি নাম তার? প্রশ্ন করলাম—
চন্দ্রশেখর নন্দী।
তারপর----
তিনজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। পরে পরে দাদাবাবু –
বৌদি একা নয় যেখানে যেত চন্দ্রশেখরদা ও ওদের সঙ্গে যেত। সে কি হাসি- ঠাট্টা- গল্প
হোতো তোমায় কি বলবো! একসঙ্গে খাওয়া, বেড়ানো, ঘোরা, বাজার- হাট ------ (বুকের ভেতর
থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয় এলো) বললাম,
তারপর----
তারপর দাদাবাবুর কাজের চাপ বাড়ল, অফিসের কাজ নিয়ে এই রাজ্যে, ওই রাজ্যে প্রায়ই যেতে হোতো, কাজে
ভীষণভাবে জরিয়ে পড়ল দাদাবাবু, এদিকে চন্দ্রদা (চন্দ্রশেখর) প্রায় দিন আসতো, বৌদি কে
নিয়ে বাইরে যেত, অনেক রাতে ফিরত বৌদি। কোয়ার্টারের সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। সব কিছু দেখেও
দাদাবাবু কে কোনদিন কিছু বলিনি। দাদাবাবু
না থাকলেও বেডরুমে বসে সে কি গল্প !! একদিন দাদাবাবুর দিল্লী যাবার জন্য বের হয় অফিসের কাজে। তারপর সন্ধ্যের সময় চন্দ্রদা এলো, বাইরে থেকে
খাবার কিনে নিয়ে এলো, আমাকে বলল, তোকে
রান্না করতে হবে না, তুই যা বেটা, আজ তোর ছুটি। আমি ভাবলাম, কাজ করি দাদাবাবুর
ওনার কোথায় কেন যাব? যাব না----- রান্নাঘরে কাজ করতে গেলাম। প্রায় তখন রাত দশটা
হবে--- দেখি অফিসের গাড়ি থেকে দাদাবাবু নামছেন, রান্নাঘরের জানলা থেকে দেখে আমার
বুকটা ধড়াস করে উঠলো। চন্দ্রদা ঘরে বসে কথা বলছে বৌদির সঙ্গে দাদাবাবু কিভাবে নেয় কে জানে!! দরজা বন্ধ ছিল--- দাদাবাবু দরজায় টোকা
দিলেন----
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment