গল্পে বাবা
বাবা
পাঞ্চালি চক্রবর্তী
বাবা!!!!!!!
কি হয়েছে মা?
মেয়ের পড়ার টেবিলে বসে চা খেতে -খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন অনিমেষ হালদার। অকস্মাৎ মেয়ের আর্তনাদ শুনে চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ ফেলে মেয়ের কাছে ছুটে আসেন তিনি। বাবাকে দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে তিন্নি।
“কি হয়েছে মা?খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস কিছু?”তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন তিনি।
—“তুমি আমাকে একলা রেখে কোথাও চলে যাবে না তো বাবা?”
—“না মা। আমি তোকে একলা ফেলে কোথাও যাবো না রে মা। ”
বাবা আর মেয়ে দুজনে কেঁদেই চলেছে। একজনের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অপরজন নীরবে চোখের জল ফেলছেন।
মা হারা এই তেরো বছরের কন্যাটি বাবার আশ্রয়েই বড়ো হচ্ছে। সবাই বলে তিন্নির বাবা-ই তিন্নির মা। তিন্নির মা বেঁচে থাকতেও যেমন পরিবারের বটবৃক্ষ ছিলেন তিনি—আজ তার মায়ের অবর্তমানে ও তিন্নির মাথায় তিনি এক বিরাট বড়ো ছাদ । তিন্নির যত্নের তিনি কোনো ত্রুটি রাখেন নি। দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ ও করেন নি। কেবলমাত্র তিন্নি দুঃখ পাবে ভেবে। পাড়ার লোক,আত্মীয় স্বজন তাকে অনেক বুঝিয়েছে। অনেকেই বলেছে—পুরুষ মানুষের এমনভাবে একা থাকতে নেই। তাছাড়া মেয়েটা বড়ো হচ্ছে। তাকেও তো দেখাশুনা করার জন্য কাউকে দরকার । অনিমেষের সাফ কথা। নমিতাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। নমিতার জায়গা আমি কাউকে দিতে পারব না। তাছাড়া বিয়ে হলে আবার সেই সন্তান জন্ম দেওয়ার গল্প। নতুন বউকে সময় দিতে গিয়ে আমি তিন্নিকে অবহেলা করতে পারব না।
—“তা হবে কেন অনি?আমার কথা একটু ভাববি না?আমার যে ৮৭ বছর বয়স বাবা। এই বয়সে ছেলের বউয়ের যত্ন পেতে বড়ো মন চায় রে ”—ছেলেকে দেখে আহ্লাদি গলায় বলেন কনকবালা।
তুমিই তো ছোটোবেলায় বলতে ,যে মা ছাড়া বাবা-ও আপন হয় না। তিন্নির মায়ের অভাবটা আমাকেই পূরণ করতে দাও। তিন্নিকে বড়ো করা আমার একমাত্র স্বপ্ন। ওর মায়ের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করা,তিন্নির ভালো বিয়ে দেওয়া —এসব এখন আমার অনেক বড়ো চিন্তা মা। বিয়ে একবার আমার হয়ে গেছে নমিতা সেনের সাথে। আর দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বলো না। ভালো লাগে না আমার। ছেলের প্রত্যুত্তরে মনোক্ষুন্ন হন কনকবালা।
—আচ্ছা বাবা। তুমি তো কত ভালো চাকরি করো। প্রতিবার আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্টের পর আমাকে ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াও। সারা বছর আমাকে কতো জামা কিনে দাও। আরও কতো জিনিস কিনে দাও। কিন্তু তুমি নিজের জন্য কেন কিছু কেন না বলোতো?ঐ সেই দু-একটা জামার মধ্যে ঘোরাঘুরি করেই জীবন কাটিয়ে দিলে। তোমার কি শখ-আহ্লাদ বলতে কিছুই নেই বাবা?
হো-হো করে হাসেন অনিমেষ।
—এই একই কথা তোর মা ও বলতো রে তিন্নি। আসলে কি জানিস-বাবাদের অত জিনিস লাগে না। বাবাদের কাছে তার পরিবারই সব। পরিবারের সবার হাসিমুখটাই সবচেয়ে দামী। তার জন্যই তো পৃথিবীর সব বাবা গায়ের রক্ত জল করে পয়সা আনে রে মা।
আমার কাছে তুই হচ্ছিস সবচেয়ে বড়ো শক্তি। তোর মায়ের ইচ্ছে ছিল তুই যেন বড়ো হয়ে ডাক্তার হোস। সেই স্বপ্ন পূরণ করাই আমার এখন সবচেয়ে বড়ো লক্ষ্য রে মা। বাকী সব অপ্রাসঙ্গিক আমার কাছে এখন।
—সাদা অ্যাপ্রন পড়া তিন্নিকে জড়িয়ে নমিতার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে অনিমেষ হালদার।
—নমিতা দেখো। তিন্নি আজ কতো বড়ো ডাক্তার হয়েছে। তোমার রেখে যাওয়া স্বপ্ন আমি পূরণ করেছি। তুমি খুশী তো?
—আজ আবারও বাবা-মেয়ে কাঁদছে। খুশীতে,আনন্দে আর একজনের অভাবে।
No comments:
Post a Comment