Sunday, June 2, 2024


 


আজন্ম ঋণ যাঁর 


ভরসার আকাশে কখনও মেঘ কখনও রৌদ্র

গৌতমেন্দু নন্দী 


  "পিতা", 'জনক' 'বাবা"----‌আপাত ছোট্ট শব্দ বন্ধ হলেও এই  প্রতিশব্দ গুলো 'দায়িত্ব,' কর্তব্য' র মতো শব্দ-বন্ধের আচ্ছাদনে সীমা, পরিসীমা, ব্যাপকতা ও

গভীরতা নির্ণায়ক মানদন্ডের ঊর্ধ্বে । "পিতা" তাই নির্দিষ্ট অর্থে সীমাবদ্ধ নয়---কখনও বটবৃক্ষের ছায়া, কখনও অভাব, অনটন, দুঃখ-কষ্টের "গুমোট গরম"এ পালকের ভূমিকায় ঝড়ো বাতাসের মতো। বিপদ,আপদে তিনিই ত্রাতা, আঘাত,যন্ত্রণায়  তিনিই "সান্ত্বনা"। তাইতো পিতা মানে----
                 চিন্তাশীল,নিরুচ্চার উদ্বেগের এক মুখ
                 আপাত রাগী, গম্ভীর সামলে সুখ-দুখ।
 এবং পিতা মানে----
          চারদেয়ালের মাঝে কঠোর অনুশাসন
           উন্নত শির, অকুতোভয় হৃদয়ে তাঁর আসন।

    আমার পিতা আমার কাছে "বাবু" ছিলেন। তাঁকে  বাবা নয়, তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে "বাবু"ই বলে ডেকেছি।  "বাবা"দের আপাত গম্ভীর, কঠোর অনুশাসনের কোন বেড়াজাল, অযথা ভয়-ডরের অদৃশ্য কোন প্রাচীর  তিনি আমাদের ভাই-বোনদের সামনে কোনো দিনই তৈরি হোতে দেন নি। 
    
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাহিত্যিক, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব এবং রসবোধ ছিল উল্লেখযোগ্য। সংগীত জগতেও তাঁর সাবলীল বিচরণ। নিজের কথা ও সুরে বহু গানও রচনা করেছেন এবং গেয়েছেন। বিশিষ্ট ভাষাবিদ, আঠারোটি ভাষা জানা  প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব , সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার প্রাপ্ত প্রয়াত জ্যোতি ভূষণ চাকী ছিলেন সম্পর্কে আমার বাবার আপন ভাগ্নে আর আমার আপন পিসতুতো দাদা। দেশভাগের আগে  দিনাজপুরে আমার বাবাদের বাড়ি "নন্দী কুটির"এ জ্যোতি ভূষণ চাকীর জন্মের সূত্রে প্রায় পিঠাপিঠি আমার বাবা ও জ্যোতিদা অর্থাৎ মামা-ভাগ্নের বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা। দিনাজপুরে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বাবা।          

দিনাজপুর কলেজে পড়াকালীন সাহিত্য পত্রিকা নিয়মিত সম্পাদনা করেছেন। সেই সময়ে প্রচুর গল্প, কবিতাও লিখেছেন। বাবার কাছে জ্যোতি ভূষণ চাকীর সংগীতের হাতেখড়ি। পরবর্তীকালে জ্যোতিদা আকাশবাণী কলকাতার একজন বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার হয়ে উঠেছিলেন। জ্যোতিদার অনুজ সুপ্রকাশ চাকী সংগীত জগতে একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। 

           কালের কপোল তলে দেশভাগের পরে  সাম্প্রদায়িক বিভেদ যন্ত্রণা নিয়ে আমার পিতৃদেবকে চলে আসতে হয়  পূর্ব দিনাজপুর থেকে এপার বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সদর শহর বালুরঘাটে এবং ভাগ্যের চাকা তখন থেকেই বদলে গিয়ে শুরু হয় অভাব-অনটনের সংগ্রামী সাংসারিক জীবন। কিন্তু সাহিত্য, সংগীত চর্চা সেই আর্থিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অটুট ছিল।
 
   মনে পড়ে সেই শৈশবে!  বাবা একদিন আমাকে সাইকেলের সিটের সামনে রডে বসিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে সুনির্মল বসুর লেখা ছন্দবদ্ধ কবিতা/ছড়া বলে চলেছেন--------
     "ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং, সবে স'রে যাও না
 চড়িতেছি সাইকেল, দেখিতে কি পাও না?
 ঘাড়ে যদি পড়ে বাপু ,প্রাণ হবে অন্ত
 পথ মাঝে রবে পড়ে ছিরকুটে দন্ত....."

       পিতৃদেবের লেখা অসংখ্য ছড়া/কবিতায় সুনির্মল বসুর সেই "স্টাইল " আজ স্পষ্ট খুঁজে পাই। তাঁর রসবোধ ছিল তারিফ করার মতো।  একবার বাংলা নববর্ষের আগের রাতে আমাদের  এক আত্মীয়কে সপরিবারে নববর্ষের দিন দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে কাগজে লিখে দিলেন--

         " শুরু হবে কাল নতুন বর্ষ
           কেটে গেলে আজ রাত
         তোমরা সবাই এসো মোর গৃহে
            খেয়ো দুটো ডাল-ভাত..."

  এছাড়াও একসময় পাড়ায় নব বিবাহিত"দাদা-বৌদি" দের জন্য প্রায় নিয়মিত ছন্দ-ছড়ায় লিখে দিতেন হাস্যরস সমৃদ্ধ শুভেচ্ছা বার্তা।
        
অবিভক্ত দিনাজপুরে মালঞ্চ গ্রামের ধনী কন্যা আমার পিতৃদেবের মা, আমার ঠাকুমা রাধারানী নন্দী
ছিলেন একজন বিদুষী, যিনি গীতা ও পুরাণ নাকি মুখস্থ বলতে পারতেন। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র আমার 
পিতা প্রয়াত পূর্ণেন্দু নন্দী। 

      দিনাজপুর থেকে ভাগ্নে জ্যোতি ভূষণ চাকীর  পিত্রালয় পাবনায় একসাথে যাতায়াতের সূত্রেই পাবনার গয়েশপুর গ্রামে এক পুকুর ঘাটে অপূর্ব সুন্দরী ষোড়শী কন্যাকে একদিন মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন আমার পিতৃদেব। সেই কন্যাই মধ্য চল্লিশে অকাল প্রয়াত আমার মা। সেই শোক সহ্য করতে না পেরে বাবাও প্রায় অকালে চলে গেছেন।
      
বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকা থেকে পাবনার গয়েশপুরের সেই পুকুর পাড়ে---সময়ের আগাছা-জঙ্গল ঘেরা সেই পুকুর পাড়ে, যেখানে দুটো সম্পর্কের সূচনা ও পরিণতি। সেই সময়কে খুঁজতেই ছুটে গিয়েছিলাম স্মৃতি বিজড়িত সেই নির্জনতায়।  ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শুধুই জনক, জননীর পদচিহ্নের সাক্ষী হোতে। সেদিন অবচেতনে ক'ফোটা চোখের জল হয়তো মিশে গিয়েছিল পুকুরের জলে। ওর বাবাও প্রায় অকাল প্রয়াত ---মধ্য পঞ্চাশে।
           
আমার বাবার পিত্রালয় দিনাজপুরের সেই কাঞ্চন, পুনর্ভবা নদীর পাড়ে যেখানে দাঁড়িয়ে একসময় মামা-ভাগ্নে , আমার বাবা আর পিসতুতো দাদা জ্যোতি ভূষণ চাকী সূর্যাস্ত দেখতেন, স্মৃতির টানে হয়তো একদিন সেখানেও ছুটে যাব পিতৃদেবের  চরণ চিহ্ন খুঁজতে। 
     
বাবার স্মৃতি বিজড়িত তাঁর ঝকঝকে হাতের লেখার রবীন্দ্র সংগীতের সত্তর বছরের পুরনো খাতা এবং হাতে লেখা তাঁরই গল্পের সংকলন আজও আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে।
      
তাঁর সৃজনশীলতার প্রভাব ও আশীর্বাদ নিয়ে  আজও তাঁকেই অনুসরণ করে চলেছি। 

           পিতৃ তর্পনের কোন নির্দিষ্ট কাল থাকে কি?
 তাই সবসময় উচ্চারিত হোক ------
             " ওঁ , পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ
         এই  পিতাহি পরমং তপঃ
        পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা..."

No comments:

Post a Comment