ঢাকা বিক্রমপুর।অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা সংলগ্ন মুনশীগঞ্জ জেলার এক ঐতিহাসিক অঞ্চল এই বিক্রমপুর বাদেও ভোগ গ্রাম।শিক্ষা সংস্কৃতি কৃষ্টি রাজনৈতিক চেতনা সবদিক দিক দিয়েই বিক্রমপুরের ইতিহাস অনেক পুরনো।আমার বাবা ও তাঁর পিতৃপুরুষরা এই বিক্রমপুরেরই আদি বাসিন্দা।আমার ঠাকুরদার নাম ছিল শ্রীতারাপদ ভট্টাচার্য ও ঠাকুমা শ্রীমতী প্রফুল্লবালা দেবী।ঠাকুরদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বাংলা ভাষায় স্নাতকোত্তর পাশ করে বিক্রমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন।বাংলার পাশাপাশি সংস্কৃত ও জ্যোতিষবিদ্যা বিষয়েও তাঁর অসামান্য দখল ছিল।পরবর্তীকালে অবিভক্ত বাংলার স্বনামধন্য ভাষাবিদ ও সুপণ্ডিত ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় বাংলা আকাদেমির সাম্মানিক দায়িত্বভার গ্রহণ করলে ঠাকুরদা তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। আমার বাবারা চারভাই ছয় বোন।ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে সারা বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে বিক্রমপুরেও তার আঁচ এসে লাগে পুরোদমে।সেই সময় থেকে পুরো পরিবার নিয়ে এদেশে এসে পড়ার প্রয়োজন বোধ করতে শুরু করেন ঠাকুরদা।
এর মধ্যেই ১৯৬৯ সালে ডঃ শহীদুল্লাহ মারা যান ও পরিবর্তিত অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবল অনিশ্চয়তার গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।ফলে জীবন জীবিকা সব দিক থেকেই বাংলাদেশের থেকে ভারতই ঠাকুরদার কাছে সে সময় অনেক বেশি নিরাপদ এবং আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।জমি জায়গা সম্পত্তি কিছুই নিয়ে আসতে না পারলেও পুরো পরিবারও এক সাথে তখন এদেশে আসতে পারেনি।ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবার বড় আমার জেঠু শ্রীবিশ্বনাথ ভট্টাচার্য সবার আগে ভারতে এসে আলিপুরদুয়ার হয়ে মালদায় গিয়ে থিতু হন আর সবার শেষে ১৯৭৫ সালে আসেন আমার ঠাকুরদা।আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বাংলা বিষয় নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়া শেষ করে ১৯৬৯ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।পাশ করে রেজাল্ট হাতে নিয়েই সত্তর দশকের শুরুতে শিলিগুড়িতে এসে শহরের শক্তিগড় হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।এখানে বছরখানেক কাটানোর পর সোজা কলকাতা গিয়ে প্রথমে হেদুয়ার স্কটিশ চার্চ কলেজে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন।তবে কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারাধীন জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে লাইব্রেরিয়ান পদে যোগদানের সুযোগ পান বাবা।এই জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় থাকাকালীনই বছরের বিভিন্ন সময় দিল্লি, নাগপুর ও নাসিকে মাস কয়েকের জন্য করে নিয়মিত ট্যুরে যাওয়া শুরু হয় তাঁর।আজ এই আশি উত্তর বয়সে এসেও তাঁর দেশ ভ্রমণের প্রতি অদম্য আকর্ষণের পেছনে তাঁর ওই যৌবনকালের যাযাবরী জীবনের যথেষ্ট অবদান আছে।এই জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে থাকাকালীনই তাঁর বিয়ে হয় এবং নানা ব্যক্তিগত কারণে যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সুদূর উত্তরবঙ্গের কোচবিহার শহরের বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান পদে যোগ দেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি প্রথমদিকে শহরের মধ্যে থাকলেও পরে সেটি শহর সংলগ্ন পুণ্ডিবাড়িতে স্থানান্তরিত হয়ে যায় এবং অবসর সময় অবধি বাবা ওখানেই কাজ করেছেন।
আমার আর আমার বোনের গোটা ছোটবেলাটা কেটেছে কোচবিহারেই।বাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ ছিল পুরোদস্তুর। মা ছিলেন শিক্ষিকা ও বাবা গ্রন্থাগারিক।মনে আছে সারা বছর ধরে স্যাম্পলের জন্য কলকাতার বড় বড় প্রকাশকের তরফ থেকে তাঁর লাইব্রেরিতে পাঠানো নমুনা বইয়ের নানা রঙবেরঙের মনভরানো বাতিল হয়ে যাওয়া মলাট বাড়িতে নিয়ে আসতেন তিনি।আমাদের ছোটবেলার খাতা বা বইয়ে আমরা বরাবর সেই মসৃণ চিকন ঝকঝকে মলাট ব্যবহার করতাম।অজানা অচেনা দেশিবিদেশি নানা ফল ফুল কি গাছের সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা থাকত তাতে।প্রতি বছরের শুরুতে অধীর আগ্রহে এই মলাটগুলির জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম আমরা দুই বোন।এছাড়াও ঝরঝরে বাংলা অনুবাদে বহু ভাল বিদেশি, মূলত রাশিয়ান, রূপকথার গল্পেরবা কমিকস বই পড়েছি সে সময় যেগুলো এখন আর চোখেই পড়ে না।ইংরাজী ব্যাকরণ শেখার খুব পাতলা পাতলা কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক অসাধারণ বইও বাবা আনতেন তখন লাইব্রেরি থেকে যেগুলোও আজ অবধি আর কোথাও দেখিনি আমি।মা যেমন সেই ছোটবেলায় আমাদের রোজকার পড়াশোনা আর সংস্কৃতিগত চর্চার বিষয়টা ধরে রেখেছিলেন, বাবার হাত ধরে এর পাশাপাশি আবার আমাদের পাঠ্য জগতের বাইরের এক বিশাল অজানা পৃথিবীর সাথে পরিচয় ঘটছিল।আসলে শিক্ষার এই খোলামেলা আবহটা আমাদের বাবার পরিবারের তরফে চিরকালই ছিল।আমার বাবার পরিবারের সবাই অর্থাৎ আমার জেঠু কাকা ও পিসিরা সকলেই কৃতবিদ্য ছিলেন এবং সেটা ছিলেন সম্পূর্ণ নিজ নিজ চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারাই। নিজেদের ভাগ্যকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় জয় করেছিলেনতাঁরা।ফলে তাঁদের সকলেরই মানসিক প্রসারতা ও উদারতা ছিল দারুণ।গরম বা পুজোর ছুটিতে যখনই মালদায় গেছি, পড়ার বইয়ের বাইরের এক বিপুল বিচিত্র সম্ভারের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি নিয়মিত।আমার প্রথম কালিদাস সমগ্র বা বঙ্কিমচন্দ্র পড়া এই মালদার বাড়ির ধুলো পড়া বিশাল বিশাল বই আলমারির তাক ঘেঁটেই।শিক্ষাগত মানসিক প্রসারতা, চর্চা ও বিকাশের ধারা বংশানুক্রমিকভাবে আমাদের পরিবারে বাবার দিক থেকেই প্রবাহিত হয়েছিল।এছাড়া আরেকটি যে ভীষণ বিরলগুণ এই পরিবারে আমরা ছোট থেকেই লক্ষ্য করেছি তা হল যে কোনও ভালো মন্দ পরিস্থিতিতে নিজের পরিবারের মানুষগুলোর পাশে নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়ানো।সময় বিশেষে নিজেদের মধ্যে যত গভীর মনোমালিন্যই হয়ে যাক না কেনো, পরিবারের কোনও মানুষ যদি বিপদে পড়ে তাহলে বাকি সকলে মুহূর্তে সেইসব পূর্বকথা অক্লেশে ভুলে যেত।যে কোনও মূল্যেই তখন পরিবার সবার আগে।এই বিশেষ চারিত্রিক গুণটি আমার মতে পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন।
আমরা ছোট থেকেই মোটের ওপর এক স্বচ্ছল পরিবার ছিলাম।কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার বাবা চিরকালই খুব মিতব্যয়ী মানুষ ছিলেন।আজ অবধি নিজের ব্যক্তিগত শখ আহ্লাদ পূরণে একটি পয়সাও তাঁকে অযথা ব্যয় করতেদেখিনি।সবসময়ই সব অবস্থাতেই তিনি দারুণ তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট।ছোটবেলাতে আমাদের সব আবদার বা ইচ্ছে ও বাস্তববাদী ও যুক্তিপূর্ণ না হলে মিটত না।পরবর্তীকালে বড় হয়ে কখনও সখনও ইচ্ছে পূরণের জন্য কোনও বেহিসেবী খরচ করে ফেললেও পারিবারিক আয়ব্যয়ের একটা রাশ চিরকালই ধরা থাকত বাবার হাতেই, আর, এই তথ্যটুকুই কিন্তু আসলে চিরকাল আমাদের নিশ্চিন্ত হয়ে যাবতীয় জরুরি অজরুরি ইচ্ছেপূরণে সাহস জুগিয়েছে।যত ওপরেই উড়ি না কেনো, সামলানোর মতো একটা নিশ্চিত আশ্রয় যে সবসময়ই আছে এটাই আমাদের উড়ানে হাওয়া ভরে চলেছে চিরকাল।এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে পেছন ফিরে তাকালে তাই মনে হয় আসলে বাবারা বোধহয় সবসময়ই একটা বিশাল বটগাছের মতো, যাঁরা তাঁদের পরিবারের মাথার ওপর সর্বক্ষণ একটা সুশীতল ছায়া ধরে থাকেন।আমাদের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি প্রয়োজনে তাঁদের সবসময় হয়তো সামনে দেখা যায় না, কিন্তু ওই ছায়াটুকু সরে গেলেই কঠিন প্রখর বাস্তবের ঝাপটা নিমেষে গায়ে এসে লাগে, আর, জীবনে মানুষটার অমোঘ উপস্থিতির প্রকৃত মূল্য বোঝা যায়।বয়সজনিত নানাবিধ কারণে শরীর আজকাল আর তেমন ভাল না থাকলেও ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদে আমার বাবা যে এখনও আমাদের মধ্যেই আছে এটা আশ্চর্যভাবে আজও অনিশ্চিত কঠিন সব পরিস্থিতিতেই মনে অপরিসীম বল যোগায়, নির্ভয় হয়ে সামনে এগোতে সাহস দেয়।যতদিন ঈশ্বরের এইকৃপা থাকবে, এই নিশ্চিন্তি বজায় থাকবে।নশ্বর তার নিয়ম মেনে পরিস্থিতি বদলে গেলেও জীবন চলবে জানি, কিন্তু নিঃশব্দে বদলে যাবে অনেক কিছুই, আর এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে আমাদের জীবনে পিতার উপস্থিতির চিরকালীন পরমমূল্যটি।
No comments:
Post a Comment