Sunday, June 2, 2024


 



আজও তিনি নির্বাক প্রেরণায় 


 আমার বাবা 

রক্তিম লস্কর 

আমার বাবা স্বর্গীয় বারীন্দ্রকুমার লস্কর। তিনি ছিলেন কোচবিহার জেঙ্কিন্স স্কুলের শিক্ষক। স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি তিনি খেলাধুলো ভালবাসতেন। সব ধরনের খেলা রমাঠেই তাঁর ছিল অবাধ গতিবিধি।এছাড়া তিনি পছন্দ করতেন লেখালেখি।

 উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনপ্রিয় খবরের কাগজের খেলার পাতায় তাঁর কলমের গতিবিধি ছিল অবাধ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন স্নেহশীল পিতা, আমার বাবা। ছোট থেকে এই বাবাকে দেখেই আমি বড় হয়েছি।

 

আমরা দুই ভাইবোন। দিদি আমার থেকে বছর তিনেকের বড়। আমরা ছোট থেকেই দেখতাম, সারাদিন বাবা নানা কাজে খুব ব্যস্ত থাকতেন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাজার যাওয়া,  তারপর বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে বাবা বেড়িয়ে যেতেন স্কুলে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাঁর বিকেল হয়ে যেত। আর স্কুলে কোন খেলা বা কাজ পড়ে গেলে আরও দেরী হত। বাড়ি ফিরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বাবা আবার বের হয়ে যেতেন নানা কাজে। সেই সাথে চলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খেলাধুলো নিয়ে বাবার লেখালেখি। তবে ছোটবেলায় আমরা বাবাকে বেশ ভয় পেতাম। কারণ দুষ্টুমি করলে আমাদের কপালে জুটতো কান মলা বা থাপ্পড়। 

 

স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি বাবা খেলাধুলো নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। খেলার মাঠ তাঁকে যেন বিশেষভাবে টানত। বাবার সাথে গিয়ে কোচবিহার স্টেডিয়ামে জেলা স্তরের কত যে ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। ফুটবল ক্রিকেটের বাইরে বাবার প্রিয় খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন। শীতকালে সন্ধ্যাবেলায় বাবা চলে যেতেন ব্যাডমিন্টন কোর্টে। সেখানে তিনি ছিলেন একধারে খেলোয়াড় ও কোচ। তখন কোচবিহারে ইনডোর স্টেডিয়াম ছিল না, তাই ব্যাডমিন্টন খেলা হত সন্ধ্যাবেলায় আলো জ্বালিয়ে। আর সন্ধ্যায় পড়াশুনো নষ্ট করে আমাদের খেলা দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তবে কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠলে বাবা আমাদেরভাইবোনকে নিয়ে যেতেন। তখন আমাদের কাজ ছিল ট্রফি জেতার পরে সেগুলো আগলে বাড়িতে নিয়ে আসা।

 

এক সময় আমিও ভর্তি হলাম সেই জেঙ্কিন্স স্কুলে। তখন বাবা হয়ে গেলেন আমার শিক্ষক। স্কুলে আমার এক নতুন পরিচয় হল – বারীনবাবুর ছেলে। সেটা হল আমার আরেক সমস্যা। স্কুলে দুষ্টুমি করে পার পেতাম না, সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে যেত বাবার কাছে; আর কপালে জুটতো শাস্তি। তবে স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি, খেলাধুলো হোক বা সরস্বতী পুজো, সবেতেই বাবা ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। সেই কারণে স্কুলে ছাত্রদের সাথে সাথে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদেরমধ্যেও বাবা ছিলেন সমান জনপ্রিয়।

 

ছোট থেকে আমাদের পড়াশোনা দেখতেন মা।  কিন্তু একটা সময় পরে আমার একা পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সপ্তম শ্রেণীতে উঠতে না উঠতেই বাবা আমাকে পড়াতে শুরু করলেন। আমার পড়াশোনার ভিতটা তখন বাবার হাতেই তৈরি হয়েছিল। তবে কখনও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে তিনি সন্তুষ্ট হতেন না, বলতেন সামনের বার আরও ভালো করতে হবে। সেটা যে আমাকে আত্মতুষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা সেটা অনেকপরেবুঝতে পেরেছি। পড়াশুনো ছাড়া আর একটা বিষয়ে তিনি আমাকে উৎসাহ দিতেন – সেটা হল খেলাধুলো।

 

আমার জীবনটা বদলে গিয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে। সেই সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বাবা আমাকে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছিলেন গৌহাটি থেকে জলপাইগুড়ি ও কলকাতা।সবশেষে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখনও আমার পাশে রয়েছেন সেই বাবা। সেই সময় চেনা জায়গা,আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ছেড়ে শহর কলকাতায় আমাকে পাঠানোর জন্য বাবার উপর যে আমার একটু অভিমান হয়েছিল সেটা অস্বীকার করবো না। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা তিনি করেছিলেন আমার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য।

 

ইউনিভার্সিটির চূড়ান্ত বর্ষে একটা চাকরির পরীক্ষার জন্য আমাকে দিল্লী যেতে হয়েছিল। তখনও আমার পাশে ছিলেন বাবা। কিন্তু দিল্লী থেকে ফেরার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর দীর্ঘ সাত বছর ধরে বাবা অসুস্থ ছিলেন। কিডনির অসুখের জন্য বাবাকে প্রাণাধিক প্রিয় কোচবিহার শহর ও জেঙ্কিন্স স্কুল ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। নিজের প্রিয় শহর, স্কুল, আত্মীয়স্বজন, প্রিয় ছাত্র ও পরিচিতদের থেকে একপ্রকার বিদায় নিয়ে তাঁকে চলে আসতে হয়ে ছিল এই শহরে।কলকাতায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন বিধাননগর গভর্নমেন্ট স্কুলে। নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে, নতুন ছাত্রছাত্রী ও সহশিক্ষক/শিক্ষিকাদের পেয়ে তিনি আবার নতুন করে পরিচিতি গড়ে তোলেন।অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি কখনো নিজের উপর বিশ্বাস হারাননি, সকলকে নিয়ে চলার আত্মবিশ্বাস তাঁকে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছা জাগিয়েছিল। সেই সময় জাতীয় শিক্ষক কল্যাণ সংস্থা থেকে তিনি সুদীর্ঘ শিক্ষক জীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ সর্বোচ্চ পুরস্কার পান।

 

প্রায় আঠারো বছর হয়ে গেল বাবা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে যাত্রা করেছেন। কিন্তু এখনও তিনি স্বমহিমায় বিরাজ করছেন আমাদেরমনে। আমার অনেক বন্ধু আছে, যাকে পরিচিতরা “অমুকের ছেলে” বলে ডাকলে মনে মনে ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পরেও আমাকে কেউ যদি “বারীনবাবুরছেলে” বলেডাকে তাহলে মন খারাপ হয় না;বরং এই ভেবে গর্বে বুক ফুলে ওঠে যে লোকে এখনও আমার মধ্যে বাবাকে মনে রেখেছেন।জীবনে চলার পথে আমি আজ যতটুকু এগোতে পেরেছি তাতে আমার বাবার অবদান অনেকটাই। আজও কোন প্রাপ্তিযোগ হলেমনে হয়, বাবা যেন আমার কানে কানে বলছেন, “বব, এখানেই থেমে থাকিস না; তোকে আরও ভালো করতে হবে।“

 

 


 

 

 

No comments:

Post a Comment