ব্যক্তিগত গদ্য
আমার বাবা
ত্রিদিবেশ রায়
আমার বাবা একজন অতি সাধারণ নির্বিরোধী স্বভাবের শান্ত মানুষ ছিলেন। তাকে আমরা কখনো উচ্চকণ্ঠে কিছু বলতে শুনিনি। খুলনা জেলার মানুষ ছিলেন। সেখানকার দৌলতপুর হিন্দু এ্যাকাডেমী থেকে বি.এ পাশ করেন। ইতিমধ্যে তার বিবাহ হয়ে গেছিল। গ্র্যাজুয়েশনের পর জীবিকার সন্ধানে এপার বাংলায় চলে আসেন। রাজ্য সরকারের চাকরি নিয়ে শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার হিসেবে মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন ব্লকে চাকরি করতে থাকেন। ততদিনে তার সংসার বেড়েছে। আমরা চার বোন এবং একমাত্র পুত্র সন্তান আমি। সেসব সময়ে বিডিও দের ছিল অসীম প্রতিপত্তি। ডি.এম, এসডিও রা থাকেন জেলা সদরে সুতরাং সর্বেসর্বা হলেন বিডিও।যেখানেই যেতাম লোকজন কিভাবে খাতির যত্ন করবে কোথায় বসাবে তার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। কিন্তু উচ্চ পদস্থ সরকারি আধিকারিক হওয়া সত্ত্বেও বাবার ভিতর কোনো অহং বোধ মাথা তোলেনি। সাধারন হাফহাতা বুশশার্ট আর ফুলপ্যান্ট পরেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই বাবার লেখালেখি র শখ ছিল। উই দংশিত সেসব কবিতার খাতা এখনও রাখা আছে। তখন ছিল ঘোরতর রবীন্দ্র যুগ। যে যাই লিখুক না কেন রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া ছিল অসম্ভব। বাবাও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। তাজমহল নাম দিয়ে একটি কবিতা লিখে বাবা সেটি রবীন্দ্রনাথ কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেটি পড়ে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হয়ে একটি পোস্টকার্ডে তার মনোভাব ব্যাক্ত করে পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবত চিঠি টি এখনো আছে তবে অনুসন্ধান সাপেক্ষ। পরবর্তী কালে বাবাকে আর লেখা লিখি করতে দেখিনি। বোধকরি রবীন্দ্রনাথের অপ্রসন্নতা তাকে নিরুৎসাহ ও ব্যাথিত করেছিল। ততদিনে বাবা বদলী হয়ে এসেছেন কলকাতায় খাদ্য দফতরের সহকারী কমিশনার হয়ে। নতুন পদ, দিদি দের বিবাহ এবং সর্বোপরি ছোটোবোনের পায়ের হাড়ের এক জটিল ব্যাধির চিকিৎসায় বাবা খুবই ব্যাতিব্যাস্ত। বাবার হাতের লেখাটিও ছিল চমৎকার। সেখানেও রাবিন্দ্রিক শৈলী র অনুকরণ ছিল। বোধহয় তৎকালীন সব শিক্ষিত বাঙালিই রবীন্দ্রনাথ কে অনুকরণ করার সযত্ন চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকতেন। অবশ্য লম্বা দাড়ি আর আপাদ লুণ্ঠিত জোব্বা ছাড়া। যাইহোক, গ্রাম গঞ্জে র নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে এসে কলকাতার এই কোলাহল মুখরিত ব্যাস্ত আধুনিক জীবন যাত্রা বাবার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি।উনি জীপগাড়ি চড়া জীবন থেকে এসে অনেকটা পায়ে হেঁটে অফিস যাবার জন্য বাস ধরতেন। আমাদের মত কথায় কথায় রিকশা চড়ার বাতিক ওনার ছিলনা। গুরুজন দের জমায়েতে সবসময়ই উনি ছিলেন নিরব শ্রোতা। কথা খুবই কম বলতেন। তাই ওনার বকুনিও আমাদের খেতে হয়নি। মায়ের অত্যন্ত কড়া শাসনের মরুভূমি তে বাবাই ছিলেন আমাদের মরুদ্যান। যে কোন খেলা দেখতে বাবা খুব ভালোবাসতেন। বাবার হাত ধরেই আমার কলকাতা ময়দানের ঘেরা মাঠে যাবার শুরু। একবার বাবা আমাকে নিয়ে গেছিলেন সিনেমা দেখতে। অত্যন্ত সাধারণ মানের একটি কমেডি ফিলম। তো যথারীতি কমিক দৃশ্য গুলিতে বাবার অট্টহাসি তে হলে প্রায় ভূমিকম্প হবার জোগাড়। দর্শক রা পিছন ফিরে সেই হাসির উৎস খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল।আমি তো লজ্জা য় অধোবদন। সেই অট্টহাসি আজও আমার কানে ভেসে আসে। কলকাতায় আসার পর বাবা আমাকে নিয়ে গেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তির জন্য। সেখানে আমাকে লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। পরীক্ষার পর প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমার খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বাবাকে বলেছিলেন আপনার ছেলেকে আমরা নিচ্ছি কিন্তু ওর পরীক্ষা ভালো হয়নি। একথা শুনে লেখাপড়ায় খুবই ভালো আমার বাবা ভীষণ সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজও তার সেই সংকোচ ভরা দৃষ্টি আমাকে পীড়া দেয়।
বহু দিন হল বাবা চলে গেছেন। তবু আজকাল বাবার নাম লেখার সময় বিনোদ বিহারী রায়ের আগে Late শব্দ টি লিখতে বড়ো কষ্ট হয়।
No comments:
Post a Comment