Sunday, June 2, 2024


 

গল্পে বাবা 


তর্পণ

সুজাতা কর

চার বছরের রিমি ফুল ফুল একটা ফ্রক পরে গাড়িতে উঠে বসল। মা একটা সুন্দর শাড়ি পরেছে। বাবা পায়জামা- পাঞ্জাবি। রিমি জানে না তারা কোথায় বেড়াতে যাচ্ছে। গাড়ি ছুটে চলেছে সামনের দিকে। গ্রামের পর গ্রাম। জঙ্গল, নদী। মা হাসছে। বাবা চারমিনার সিগারেট ধরিয়ে মায়ের কথায় হেসে মাথা নাড়ছে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর গাড়ি প্রবেশ করল এক নতুন শহরে। বেশ বড় শহর। অনেক দোকানপাট। একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। বাবা নেমে গেল। প্রায় আধঘণ্টা পর বাবা এসে রিমিকে কোলে তুলে নিয়ে দোকানে ঢুকল। একটা তিন চাকার নীল রংয়ের বড় সাইকেল, "এটা তোর। এটা চালিয়ে বিকেলে ঘুরবি। পেছনে তোর পছন্দের কোন বন্ধু।" রিমির পাড়ায় কারো এমন সাইকেল নেই। বাবা এতদূর এল শুধু রিমিকে একটা সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য! ছোট্ট রিমি অবোধ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

রিমি এখন সাত। বিকেলে বারান্দায় বসে আছে। পুতুলটাকে শাড়ি পরাচ্ছে। বাবা ফিরলেন অফিস থেকে। হাতে নতুন চকচকে বই। আনন্দমেলা। বাবা বললেন,"বের হলেই এখন থেকে তোর জন্য নিয়ে আসব।" রিমি হাত বাড়ায়। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা। স্বপ্নেরা অক্ষরমালা সাজিয়েছে। রিমি পাতা ওল্টায়। সন্তু আর কাকাবাবুর অভিযান। ডুবতে থাকে রিমি। তাদের ছোট জনপদ, ডোবা, খালবিল পেরিয়ে কখনো সবুজ দ্বীপ, কখনো বরফ ঢাকা পাহাড়ে লোম খাড়া করা অভিযান। প্রায়দিন বাবা ফিরতে লাগল আরও আরও বই নিয়ে। শুকতারা, চাঁদমামা, সুকুমার সমগ্র। রিমির পুতুলের আর শাড়ি পরা হয় না। রান্না- বান্না বন্ধ। রিমি স্কুল থেকে ফিরে ঢুকে যায় অজানা-অচেনা এক মায়াময় জগতে। পাড়ার বন্ধুরা অপেক্ষা করে রিমির জন্য। রিমি তখন টিনটিন, রুকু-সুকু, সন্তু আর গোগোলের সঙ্গে। ঘোর লেগে যায় রিমির। পৃথিবীতে এত কিছু আছে! এত কিছু ঘটনা ঘটছে! রিমি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,"আমার বই শেষ। আমি এখন কী নিয়ে থাকব?" বাবা হাসে, "বিকেলেই এনে দেব।"

কাজের সূত্রে বাবা বড় শহরে গেছে। মা আর রিমি বাড়িতে। বড্ড ঘন চুল রিমির। উকুন হয়েছে। মাঠ দিয়ে নাপিত যাচ্ছে। মা ডাকে, "দাদা একটু আসুন না। মেয়েটা চুল সামলাতে পারে না। উকুন হয়েছে। কেটে দিন ছোট করে। কুড়ি দিন পর এক সকালে বাড়ির সামনে রিকশার প্যা-পো। রিমি দৌড়ে যায়। বাবা রিকশা থেকে নামছে। হাতে ক্যারাম বোর্ড,"কার জন্য বাবা এটা?" 
- তোর জন্য।
রিমি অবাক হয়। তার বন্ধুদের কারো কাছে ক্যারাম বোর্ড নেই। লুডো আছে।
- কিন্তু তোর এভাবে চুল কে কেটে দিয়েছে?
-নাপিত কাকু। মাঠ দিয়ে যাচ্ছিল।
বাবার মুখ লাল হয়ে ওঠে। রিকশাওলাকে দাঁড়াতে বলে বাবা বাড়িতে ঢোকে। 
- রিমিকে এভাবে বাটি ছাঁট কে দিয়ে দিয়েছে?
মা বলে," না মানে ভীষণ উকুন হয়েছিল। তাই আমি নাপিত ডেকে কাটিয়ে দিয়েছি।"
- উকুন হয়েছিল বলে বাচ্চাটাকে তুমি এমন হাস্যকর বানিয়ে দিয়েছ? বাবার আওয়াজে সিংহের গর্জন। রিমির হাত চেপে ধরে বাবা,"এখনই চল।" রিকশায় উঠে রিমিকে বাবা নিয়ে যায় সেলুনে," ন্যাড়া করে দিন। চুলের দরকার নেই।" সেলুনের চেয়ারে বসে সামনের আয়নায় রিমি দেখে দক্ষ খুরের আঘাতে তার চুল কর্তিত হচ্ছে। তার বড় বড় চোখ, ফর্সা রং, গোলাপি ঠোঁট, মুন্ডিত মস্তক- সেকি নিমাই হতে পারবে কোনদিন? সেতো মেয়ে, তার পক্ষে নিমাই হওয়া কি সম্ভব? বাবা বলে মেয়েরা চাইলে সব পারে। স-ব।

খেলার মাঠে রিমি দেখল ঘন কালো মেঘগুলো তীব্র বেগে আকাশে ছোটাছুটি করছে। মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের ঝলক কালো মেঘকে ফালাফালা করে দিচ্ছে। সবাই বলল," বাড়ি যা রিমি। কালবৈশাখী আসছে। দৌড়ো দৌড়ো।" রিমি দৌড়ে বাড়ি আসে। কিন্তু ঘরে ঢোকে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড় দেখতে তার ভালো লাগে। ভয় করে না। তুমুল বেগে হাওয়া যখন গাছপালা- বাড়িঘর সবকিছুকে আন্দোলিত করতে থাকে, তখন রিমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। কীভীষণ! কীপ্রবল! কী নিদারুণ! শুরু হল শিলা বৃষ্টি। মোটা মোটা বরফের খন্ড আকাশ থেকে পড়ছে। বাবা বেরিয়ে এল একটা বালতি হাতে,"তুই এখানে দাঁড়িয়ে! কী দারুণ না? চল শিল কুড়োই। মাথা বাঁচিয়ে কিন্তু।" দুই শিশু দৌড়োতে থাকে বাড়ির সামনে। সঙ্গে হো হো হাসি। বালতি ভর্তি হতে থাকে বরফে। দুজনেই জানে যে এ বরফ কোনো কাজে লাগবে না। কিন্তু এ মুহূর্ত, এ আনন্দ ভাস্বর হয়ে থাকবে মহাকালের নোটবুকে।

কলকাতায় বাবার বন্ধু দীপক কাকুর বাড়িতে রিমিরা উঠেছে।  সারা কলকাতা বেড়াবে এক সপ্তাহ ধরে। দীপক কাকুর বসার ঘরে বইয়ের আলমারি। সারি সারি বই। রিমির চোখটানে পাতলা কতগুলো বই। সবগুলোর লেখক স্বপনকুমার। কে এই স্বপনকুমার? রিমি নাম শোনেনি। সে আলমারি থেকে বের করে নেয় বইগুলো। খুন- জখম- রাহাজানি। রহস্য- রোমাঞ্চে ভরা শিরশিরে অনুভূতির গল্প। গোগ্রাসে গিলতে থাকে রিমি। বাবা এসে সামনে দাঁড়ায়,"তৈরি হয়ে নাও, গাড়ি এসে গেছে। ভিক্টরিয়া যাব আজ।" রিমি মিনতির চোখে তাকায়," বাবা প্লিজ আমায় বাদ দাও। আমি স্বপনকুমারের সঙ্গে সময় কাটাতে চাই। আমি যাব না।"
- পরে পস্তাবি নাতো? বাবা হাসে।
- না, না, একদম না। কাকিমা তো থাকছেন। আমি বাড়িতেই থাকব।
স্বপনকুমারের হাত ধরে সিডনি শেলডনে পৌঁছনো। পেছনে বাবা। সব সময় আস্কারা। অন্যের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে মেয়ের ইচ্ছাপূরণ।

সেবার বড় দুটি দল এসেছে ফুটবল ম্যাচ খেলতে। সাংঘাতিক উত্তেজনা সমস্ত এলাকায়। সব জায়গায় দল দুটিকে নিয়ে আলোচনা। রিমিদের বাড়িও বাদ নেই। বাবা ফুটবল ভালোবাসে। সকালে টিকিট কাটতে যাওয়ার আগে বাবা রিমিকে জিজ্ঞেস করল, "যাবি দেখতে?" রিমি মাথা নাড়ে, সে যেতে চায়। সে খুব ভালো বোঝে না কিন্তু বোঝার চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। খেলার দিন রিমি বাবার সঙ্গে মাঠে গেল। কাতারে কাতারে লোক। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। রিমি আর বাবা গিয়ে দাঁড়াল। সারা মাঠ দেখা যাচ্ছে। রিমি চরম বিস্ময়ে আবিষ্কার করল সারা মাঠে সে একা মেয়ে।


ক্লাস নাইনের রেজাল্ট আউট হয়েছে। খুব ভালো হয়নি রিমির। দুপুরে খেতে বসেছে বাবার সঙ্গে। মা খাবার পরিবেশন করছে আর বকে চলেছে, "এই তোমার পড়াশোনার ছিরি! তুমি এবার ক্লাস টেনে উঠলে, সামনে মাধ্যমিক। আর তোমার রেজাল্ট এ বছরই খারাপ! তুমি প্রথম তিনজনে নেই। ফোর্থ হয়েছ। সারাদিন টিভি আর গল্পের বই। এভাবে চললে তোমার মাধ্যমিকে কী হবে বুঝতে পারছ?" বাবা রেগে থালাটাকে সামনে ঠেলে দেয়, "মেয়েটাকে খেতে দেবে? খাওয়ার সময়ই তোমার যত বকবকানি শুরু হলো? আগে খেয়ে নিক তারপর যা বলার বলো। খাওয়ার সময় একদম কিছু বলবে না। ও যেমন পেরেছে, করেছে।" রিমির চোখে জল আসে। সে বয়ঃসন্ধিতে। চারিদিকে ডাক। গোপন চিঠি, নরম দৃষ্টি আর অজানা আকর্ষণ। সে জানে সে প্রায়ই দিকভ্রষ্ট হয়। আর না। রিমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। 

মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। মা জড়িয়ে ধরে। বাবার সারা মুখে জ্যোতি। বাড়িটা নাচছে, গাইছে। পরদিন সকালে বাইরে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং। রিমি বেরিয়ে দেখে বাবা একটা নতুন লাল রঙের লেডিস সাইকেলে বসে। সারা মুখে উজ্জ্বল হাসি, "তোর জন্য।" রিমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের ছোট্ট জনপদে সাইকেল চালানো মেয়ে চোখেই পড়ে না। রিমি বাবার চোখের দিকে তাকায়। বাবা বলে, "এগিয়ে যাও রিমি। মেয়ে হিসেবে নয়। মানুষ হিসেবে। পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে।``

No comments:

Post a Comment