নববর্ষ, দিন বদলের গল্প কথা
অনিতা নাগ
নববর্ষ মানেই তো নতুন জামা, মন্দিরে পূজো দেওয়া, বাড়ীতে ভালো ভালো রান্না, মজা হুল্লোড়। বিকেলে বাবার হাত ধরে দোকানে হালখাতার নেমন্তনে যাওয়া, রঙিন সরবত, মিষ্টির বাক্স, বাংলা ক্যালেন্ডার। নববর্ষ বললে এই স্মৃতিগুলো অনামিকাকে আচ্ছন্ন করে আজও। তখনো নিশ্চয় জীবনে অনেক সমস্যা ছিলো। কিন্তু ছোটরা তা টের পেতো না। বড়রা অশুভকে আড়াল করে রাখতেন। নববর্ষের আগে নীলষষ্ঠী থেকেই উৎসবের সূচনা হতো। এমন সহজ ছন্দে ছোটবেলাটা দিব্যি কেটেছে। নববর্ষের আরেক আকর্ষণ চৈত্র সেল। সে বড্ড মজার ব্যাপার। সবকিছুতেই সেল এর লেবেল লাগিয়ে হাতিবাগানের ফুটপাতে যেনো মেলা বসতো। এখনো সেল চলে। মনে পড়ে এইসময়টায় মা অনেক কেনাকাটা করতেন। প্রবাসে থাকতে এই চৈত্র সেল বড্ড মিস করতো অনামিকা। তবে নতুন জামা, মন্দির, ভালো রান্না এ’ গুলোতে ছেদ পড়ে নি কখনো। ঠাম্মা বলতেন বছরের প্রথম দিন যেমন চলবে সারাবছর তেমন কাটবে। তাই খুব চেষ্টা থাকতো দিনটাকে বিশেষ করে তোলার। এখন তো অনলাইনের যুগ। কয়েকবছর আগে অনামিকাও সেলে কতো কিছুই কিনতো। এখন তো মুঠোফোনেই সব নাগালে পাওয়া যায়। তবু আজও সেলে কিছু কেনাকাটা করে অনামিকা। গড়িয়াহাটের ফুটপাতে সেলের ট্যাগ লাগিয়ে যারা পসরা সাজিয়ে বসেন, এটাই তাদের রুজি রুটি। তাই প্রয়োজন না থাকলেও কিছু কেনাকাটা হয়েই যায়। আবাসনের গন্ডির ভেতরে তো ফেরিওয়ালা আসে না। তাই বেড়িয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে। চার দেওয়ালের বাইরের জীবনটা বড্ড টানে। মাঝে মাঝে বাসে, অটোতে বেড়িয়ে পরে অনামিকা। বাইরের জগতের একটা অন্যরকম ছন্দ আছে। জ্যাম, ভীড়, হকারদের হাঁকাহাঁকি, পড়ন্ত সূর্যের আলো, ফুচকার গন্ধ। বেশ লাগে অনামিকার। তবে সবাই ছুটছে। সকলেরই গন্তব্যে পৌঁছোনোর তাড়া। সেখানে অপেক্ষা নেই। শুধু পিছিয়ে পড়ার ভয় আর আক্ষেপ।
নতুন বছর, ১৪৩২ ঠিক সময় মতো এসে পড়লো। সাথে খর বৈশাখের তপ্ত প্রবাহ। কিন্তু মনে কোনো আনন্দ নেই অনামিকার। তেমন করে বৈশাখকে আহ্বান করতে পারলো না। বলতে পারলো না এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কষ্ট। বিনা নোটিশে কর্মহারা শিক্ষকদের হাহাকার, তাদের চোখের জলে ঝাপসা আজ নববর্ষের আনন্দ। যোগ্য অযোগ্য বিচার করবে কারা! উত্তর জানা নেই। চারদিকে নেই নেই রবটা এতো প্রখর যে সব আনন্দই কেমন ম্লান হয়ে যায়। নিয়ম মেনে ঠাকুরের আসনে নতুন কাপড় পেতেছে অনামিকা। গোপাল, জগন্নাথকে নতুন সাজে সাজিয়েছে। ফুলের অর্ঘ্য দিয়েছে। প্রদীপের আলোয় সব অন্ধকার মুছে যাক সকলের জীবন থেকে, অন্ধকার মুক্ত হোক সকলের জীবন। এ’ তার নিত্যদিনের প্রার্থণা। কিন্তু অন্ধকার যেনো আরো নিবিড় হচ্ছে ক্রমশঃ। অভয়া হত্যার বিচারহীন দীর্ঘ সময় ক্রমশঃ দীর্ঘতর হচ্ছে। নানান ঘটনার স্রোতে সবাই হয়তো ভুলতে বসেছে মেয়েটাকে। অনামিকা ভুলতে পারেনা ক্ষমাহীন এই অপরাধকে। কিন্তু কিচ্ছু করার ক্ষমতাও তার নেই। তাই বলে সময়ের চাকা থেমে থাকে না। সময় এগিয়ে চলে আপন ছন্দে। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়াকে তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার ডালে ডালে লাল, হলুদের ছোঁয়া। আবার বছর পার করে পলাশ, শিমুলের দেখা মিলবে। প্রকৃতির আবর্তন চলে আপন ছন্দে। কিন্তু আমাদের জীবন থেকে যারা হারিয়ে যায় তারা আর ফিরে আসে না। তাদের আর ফিরে পাওয়া যায় না। শুধু স্মৃতিগুলো থেকে যায়। বিকেলে কর্তার সাথে একটু বেড়িয়েছিলো। দোকানে দোকানে হালখাতার ভীড়। তবে রঙিন সরবতের জায়গায় ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। ক্যালেন্ডার, মিষ্টিমুখ, আছে সবই। শুধু একটা বদল এসেছে। বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো অনামিকার। বিয়ের পর কখনো নববর্ষে কলকাতায় থাকলে বাবা নাতি নাতনিদের নিয়ে হালখাতা করতে যেতেন। রঙিন সরবতের জন্য বাচ্চাগুলোও সারাদিন অপেক্ষায় থাকতো। এই অপেক্ষাটা মিস করে অনামিকা। এমন করে আজকাল আর অপেক্ষা করতে হয় না। রঙিন সরবত রূপ বদলে বোতল বন্দী হয়ে এসে যায়। সবই যেনো নাগালের বড্ড কাছে। শুধু নাগাল পাওয়া যায় না আপনজন গুলোর। তাদের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম, এই তিন নেই এর চক্করে বেশীরভাগ ছেলে মেয়েরা নয় প্রবাসী, নয় বিদেশ বাসী। অনামিকার মতো কতো বাবা মা বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে দিন কাটায় তার হিসেব কে রাখে! দিনান্তে একটা ফোনকল, সপ্তাহে কয়েকবার ভিডিও কল, এই নিয়েই দিন কাটানো। নববর্ষের দিন বাড়ীতে কতোরকম রান্না হতো। সেও করতো। এখন আর করে না। ছেলেমেয়ের পছন্দের রান্নাগুলো আর করে না। কষ্ট হয়। কিন্তু বলার উপায় নেই। ওরাও তো সখ করে ঘর ছেড়ে বাইরে নেই। জীবনযুদ্ধে টিঁকে থাকার এই লড়াইয়ে তারাও দৌড়চ্ছে। মনে মনে একটাই প্রার্থণা ধীরে ধীরে চল আর পথ ভুল করিস না। পথটা বড্ড কঠিন। চোখের জল মোছে অনামিকা। সে হারতে ভালোবাসে না। দু’বেলা ঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বেলে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। প্রার্থণা করে লক্ষ, কোটি শিখা হয়ে তুমি সারা বিশ্বকে অন্ধকার মুক্ত করো। আগামী প্রজন্ম এই অন্ধকারের গ্রাস থেকে মুক্ত হোক। প্রার্থণা করে নিজের জন্য। অন্ধকারের মধ্যে থেকে আলো খুঁজে নেওয়ার শক্তিটুকু যেনো জীবনের শেষ দিন অবধি আগলে রাখতে পারে। দিন বদলের পালায় নতুন ভাবে নববর্ষ বাঁধা পড়ুক সকলের জীবনে। আগামী প্রজন্ম গুগল হাঁতড়ে সনাতন নববর্ষের ইতিহাসকে জানুক। জীবনের পড়ন্ত বেলায় অনামিকা সতাতন ও বর্তমানের বদলে যাওয়া নববর্ষকে আগলে রাখে সোহাগে আর ভালোবাসায়। মনের তারে একটা সুর বেজে চলে অবিরত
‘ যা হারিয়ে যায় তা আগলে ব’সে রইবো কত আর?’
No comments:
Post a Comment