Friday, May 2, 2025


 

ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছবি 
রাজর্ষি দত্ত 

বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ভাবনা ও মনন তাঁর বিভিন্ন ছবিতে ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। তাঁর উচ্চবংশীয় রক্ত, শিক্ষা ও ব্যক্তিত্ব কখনই উচ্চকিতভাবে কিছু আরোপ করে না - কিন্তু সিনেমার ভাষায় জোরালো বক্তব্যটির কোন খামতি বা স্বচ্ছতার অভাব ঘটেনি। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে শিল্পের শর্তকে অক্ষুণ্ন রেখে!

আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছি তাতে ব্যবহারিক ও মনস্তাত্বিক জগতে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, রাজনীতি, ধর্মরাজ্য, কালচার - এই ধরণের বিবিধ শব্দের শ্রবণ ও প্রয়োগে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সম বিষয়কে মাথায় রেখে সত্যজিতের চিন্তাধারাকে, তাঁর কাজের মাধ্যমে বিশ্লেষণের অক্ষম প্রয়াস করা যেতেই পারে। শুরু করা যাক শেষ ছবি 'আগন্তুক' থেকে। একটি দৃশ্যে মনমোহন প্রশ্নের উত্তরে জানান- "যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, তাকে আমি মানি না, Religion এটা করেই, আর Organised Religion তো বটেই, সেই একই কারণে আমি জাতও মানি না।...."
যেহেতু আগন্তুক ছবির গল্প, চিত্রনাট্য সবটাই পরিচালকের, তাই এইভাবে তিনি মনমোহনের মুখ দিয়ে নিজের মত ও বিশ্বাসকে পেশ করেছেন - এ কথা অনেকেই বলেন!
আবার অন্যের লেখা গল্প নিয়ে ফিল্ম বানাতে গিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন এমন কিছু কাহিনী যা ধর্মীয় গোঁড়ামির উপর তীব্র কষাঘাত করে। যেমন 'দেবী'। মানুষের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস নিয়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ রায়। বৃদ্ধ কালীকিঙ্কর - কে মাত্র দোষারোপ না করে ঊনবিংশ শতকের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে চরিত্রের কালী প্রীতির সুতীব্র বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করলেন। যার প্রভাবে শ্বশুরমশাই-এর স্বপ্নাদেশ প্রথমে না মানতে পারলেও পরে নায়িকা নিজেকেও দেবী রূপে বিশ্বাস করে ফেলেন। ধর্মের এই প্রভাবকে চূড়ান্ত আখ্যা দিয়ে সত্যজিৎ এক সাক্ষাতকারে বলেন " I once made a film Debi, the goddess. It dealt with religious dogmatism. It didn't attack religion as such - it attacked dogmatism - the extreme form of religion..." আর এই "extreme form" টাই এখন সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। এতে করেই দেশনায়করা জনগণের বরমালা পান। মনে হয় সবদেশের মানুষই আসলে উত্তেজনা ভালবাসে। একপেশে, জমকালো বিবর্জিত, মূল্যবোধে আবর্তিত, সরলরৈখিক জীবন বোধহয় কিছু অ-প্রকৃত সংখ্যালঘুদের মধ্যে বর্তায় - বেশিরভাগের নয়।মহাপুরুষ ছবিটি সংস্কারচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ। ধর্মকে আশ্রয় করে ভন্ডামি এবং ধুরন্ধর ধর্মগুরুদের ব্যবসার জাল মানুষকে কিভাবে সম্মোহিত করে, রাজশেখর বসুর লেখা অবলম্বনে সিনেমাটি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। একই পুনরাবৃত্তি দেখা যায় ' জয় বাবা ফেলুনাথ ' - এ মছলি বাবাজির মুখোশ খুলে ফেলায় - রহস্য উন্মোচনের মোড়কে। 

কিন্তু এইসব ছায়াছবিগুলিতে ধর্মের সাথে রাজনীতি জড়ায় নি, যা এসে পড়ে 'গণশত্রু'  চলচ্চিত্রে। ধর্মের সথে ব্যবসা আর সেই ব্যবসায় রাজনীতি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং একজন যুক্তিবাদী চিকিৎসককে কিভাবে কোণঠাসা করে দিতে পারে সমাজে এই ছবি টা প্রমাণ। ইবসেনের নাটক "An enemy of the people" - এর বাংলা সংস্করনে মন্দির প্রাঙ্গণে জীবাণুযুক্ত sacred চরণামৃত গ্রহণে ভক্ত সাধারণ মানুষের জন্য হিতকর্মটি আদপে কোন কাজে লাগে না।

জ্ঞানের আলোকে কুসংস্কার হয়তো অনেকটা দূর হয়েছে কিন্তু সেই শিক্ষা যা ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিপন্থী, সেটা আজকের দিনে বড়ই অভাব। সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেই এর অভাব দেখা যাচ্ছে। আসলে বিজ্ঞানের প্রভাব একশ দেড়শো বছরের বেশি নয়, কিন্তু বাল্যকাল থেকে শিখে আসা সামাজিক রীতিনীতির বয়স হাজার বা দু হাজার। তাই বিজ্ঞানচেতনার উপর ভরসা কম - ছাপিয়ে যায় প্রাচীন ভাবধারা। তাই বিপ্লবী হয় ওঠেন না কেউ। আন্দোলন কিছুটা এগিয়েও থেমে যায়।

এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে মানুষের বিবেক জাগ্রত করা ও কোন গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার জন্য উল্লেখিত ছবিগুলি যেমন দেখা প্রয়োজন তেমনি মহাপুরুষ বা গণশত্রুর মত সিনেমাও তৈরি হয় দরকার।

যদিও একটি সিনেমা জনমানস তথা সমাজকে রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে একথা কখনই ভাবতেন না প্রসিদ্ধ পরিচালক সত্যজিৎ রায়।

No comments:

Post a Comment