মৌসুমী চৌধুরী
ওরা থাকে এই মহা নগরে। ঐশী, শিঞ্জিনী, সৌপ্তিক, ঋতম, এষা, সাগ্নিক ,লাবণ্য, ঋজু। এ নগরের সবচেয়ে নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সবাই। অন্যায়ের প্রতিবাদে "হোক কলরব" জিগির তোলে। সবাই ওরা উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান। ওদের কথায় "ওনলি চাইল্ড"। ওরা বাংলা বলে বটে, তবে অবলীলায় তাতে মিশে যায় ইংরাজি। এ নগরের নামকরা ইংরাজি মাধ্যম বিদ্যালয়- গুলিতে ওদের প্রাথমিক পড়াশোনা। রবীন্দ্র কবিতা ওরা শুধু মাত্র জানে সিলেবাসে আছে বলেই। কেউ কেউ বেশ কায়দা করে উচ্চারণ করে, "আই লাইক টেগোর'স পোয়েমস্।"
এ নগরের সংস্কৃতির পীঠস্থান "নন্দন" চত্তরে ওদের ঠেক। ওরা সবাই ইংলিশ রক ব্যান্ড "বিটলস্" এর ভক্ত। প্রায়ই গিটার হাতে ওদের গুনগুনাতে দেখা যায় জন লেনন বা জর্জ হ্যারিসন। তবে ওরা লালনগীতি, ফোক, ভাটিয়ালি, কীর্তন সবই প্রাণ খুলে গায়। স্মার্ট ফোনে চোখ রেখে স্মার্ট ঝকঝকে এই প্রজন্ম জাতীয় ও বিশ্ব রাজনীতির উত্থান-পতনে ভাবিত হয়। সত্যজিৎ, ঋতুপর্ণ, শ্যাম বেনেগাল, মনি রত্নম, স্পিলবার্গ নিয়ে ওরা চায়ের কাপে তোলে তুফান। ওদের আড্ডায় স্থান পায় ক্রিকেট-ফুটবল থেকে সিনেমা, ফ্যাসান, কেরিয়ার থেকে শেয়ার মার্কেট, রাজনীতি মায় জি.এস.টি, 2G স্ক্যাম, কালা-ধনের চর্বিত চর্বণ সবকিছুই।
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, ওদের জীবনেও আসে ২৫ শে বৈশাখ-২২শে শ্রাবণ। এক ২৫ শে বৈশাখের বিকেলে ওদের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। "অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস"-এর সামনে একটা ফ্লেক্স টানিয়ে বিটলস্-ভক্তরা রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করছে। গিটার হাতে নিয়ে ওদের একজন কপি-রাইট- উঠে-যাওয়া স্টাইলে গাইছে,
----"আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে...।"
কৌতুহল ভরে ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
------"আচ্ছা সাগ্নিক, তোমাদের জীবনে গুরুদেব সারা বছরে কখনও কি উঁকি দেন? নাকি শুধুই এই জন্মদিনে?"
খানিক উদাস স্বরে সাগ্নিক উত্তর দিয়েছিল,
----------"বাবা যেদিন মাকে ছেড়ে পামেলা আন্টির সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন, সেদিন বাড়ি ফিরে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। সেদিন একা একা ছাদে উঠে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ইউ-টিউবে শুনেছিলাম, 'জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে /বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে'।"
গিটার হতে তখন সাগ্নিকের বন্ধু গেয়ে চলেছে--- "জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো/ সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীত সুধা রসে এসো।"
No comments:
Post a Comment