সম্পাদকের কথা
দীর্ঘ উৎসব শেষে আবার ফেরা নিত্য জীবনে। আসলে স্থায়ী নয় কিছুই জীবন প্রবাহ ছাড়া। তাই আবারও শুরু দৈনন্দিনতা।
উৎসবের আবহে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য দেখেছি তা যদি সারা বছর ধরে পারি, তবে নিজেরাই লাভবান হব।
খারাপ লাগে এই আনন্দঘন মুহূর্তেও পরিবেশ নিয়ে আমাদের উদাসীনতা। দেশের রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দূষণের সম্মুখীন। জানিনা কবে আমাদের বোধ জাগবে, কবে আমরা বুঝতে শিখব।
তবু হেমন্তের এই সময়ে, নবান্নের এই দেশে একটিই আশা যে, একদিন সুদিন আসবে।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪২৬
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
ইমেল ঠিকানা- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
ব্যক্তিগত গদ্য
হেমন্ত বাতুলতা
শ্যামলী সেনগুপ্ত
কিছুদিনের জন্য একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়ে ছিল৷খুব মশার উৎপাত৷মশারি টাঙানোর জন্য ঘরের দেওয়ালে পেরেক পোঁতার দরকার৷ মিস্তিরি এলো,তুরপুন চালিয়ে দেয়াল ফুটো করার প্রস্তুতি চললো৷চেয়ারে বসে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম৷প্লাগ পয়েন্ট থেকে তার ছড়িয়ে আছে মেঝের ওপরে,খসে পড়ছে চুনসুরকিবালির মিশ্রণ৷একঘেয়ে দাঁত শিরশিরানি শব্দের সঙ্গে সহবাসের সময়পঞ্জী সামান্য হলেও আমার মনশ্চক্ষে তৈরি হলো অন্য রূপ৷ততক্ষণে মেঝের ওপর জমে উঠেছে অষ্টগন্ধার ছোট্ট ঢিপি ...মানে ঐরকম একটা বোধ হল৷তুরপুন ঘুরে চলেছে আর একটা অদ্ভুত শব্দের অনুরণন আমার মাথা জুড়ে , সেই শব্দে কেমন যেন ঘোরলাগা ভাব৷ ছিদ্রগুলি চক্রাকার৷ ঐ চক্রের দিকে তাকিয়ে আছি আর চোখের সামনে ভিড় করছে কুলকুন্ডলিনী,ষট্চক্র,ইড়া,পিঙ্ গলা৷ কিরকির শব্দ, যেন কুন্ডলিনীর ঘুম ভাঙিয়ে মেরুদন্ড ধরে তাকে উপরে ওঠানো হচ্ছে ৷ কুন্ডলিনী কি রূপক! আর ঐ যে তারটি তুরপুনের প্রান্তে লাগানো ওটাই কি সুষুম্নাকাণ্ড! ছোটবেলা জেঁকে বসে৷ কালী ঠাকুরের রক্ত পানের দৃশ্যে দুই দিকে দুটি লাল নলী,যা গিয়ে ঠেকেছে মুখ গহ্বরে, মনে হতো ঐ দুটিই বোধহয় ইড়া পিঙ্গলা! আরও আগে ইড়াপিঙ্গলা শুনলেই ভাবতাম ডাকিনী-যোগিনী৷মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে এসব দেখতে দেখতে স্নায়বিক উত্তেজনা হতো প্রখর,তৈরি হতো illusion, রাতে স্বপ্নের ঘোরে অদ্ভুত সব অবয়ব ভিড় করতো৷ ছোটবেলায় এমন illusion হতো হেমন্তের ফসলক্ষেত দেখলে৷দূর থেকে মনে হতো সোনার মাঠ, রাশি রাশি সোনা! সোনা সম্পর্কে তেমন লোভ গজায়নি তখনও,সোনার মূল্যায়নও শেখা হয় নি বরং তুলনাত্মক ছিলো সোভিয়েত দেশের পাতায় দেখা ইউক্রেনের গমক্ষেত৷একটা সামনে একটা মনে, অসম্ভব সুন্দর চিত্র যেন দুটোই দেখছি৷ শেষে এমন হতো সামনে ধান না গম সেটাই বুঝতে পারতাম না৷ এটাও ঠিক ওটাও ঠিক৷চোখের সামনে যেটা দেখছি সবসময় সেটা ঠিক ঐ জিনিসটা না ও হতে পারে৷ কুন্ডলিনী আর মূলাধারচক্রের স্বরূপ যেন তাদের দরজাগুলো খুলতে লাগলো এতদিন পরে কালীপার্কের ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরটিতে।
(২)
দক্ষিণ ২৪ পরগণার গড়িয়া৷ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই ৪৫/বি বাস টার্মিনাস ৷ ছাতেরও ছাত থাকে, সেখানে উঠলে দেখা যায় ঝমঝম করে মেট্রোরেল চলে যাওয়ার আলো আলো খোপ৷ চারিদিকের আলোর তীব্রতায় অন্ধকার স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ,বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা মেট্রোরেলের শব্দ কানে যায়৷ এমন অবস্থানে একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম৷ হঠাৎই চোখ চলে যায় বিপরীত দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের মা -কালীর ছবিতে৷ ধক্ করে ওঠে বুকের ভেতরে৷ ছেলের অফিস রাতে৷ আমি একা টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে৷অনেক চেষ্টা করি চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার, অনেক চেষ্টা করি চোখ বন্ধ করতে৷পারছিলাম না৷মা-কালীর নরমুন্ড মালাটি কেমন খলবল করছে৷,জবার মালা থেকে ঝলসে উঠছে আগুনের গোলক৷খাঁড়ার রক্তের দাগ থেকে কি গড়িয়ে পড়ল দু'ফোঁটা রক্ত! Is there any body there?নাহ্! কোনও স্বর বেরলো না৷ আমার শরীর অবশ, হাত-পা নাড়াতে পারছি না, চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছি না৷মনে হচ্ছিল সমস্ত শরীরে টপ টপ করে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ছে, উষ্ণ আঁশটে গন্ধযুক্ত৷ হঠাৎই স্পাইনালকর্ডের নীচের দিক থেকে এক তীব্র অনুভূতি! খ্যাটাশ শব্দে ব্রহ্মতালু ফুঁড়ে কিছু বেরিয়ে গেল যেন আর মুহূর্তেই চোখের একেবারে সামনে কালো কুচকুচে একটি মুখ,লাল জবার মতো চোখ,বিশাল জিভ...আমি ভয় পেয়েছিলাম খুব৷ এই কি মূলাধারচক্র , সমস্ত যুক্তি দিয়েও যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না৷ আসলে শতদলচক্র কে নিয়ন্ত্রণ করবেই বা কে!সে তো টিমলিডার , হাইপোথ্যালামাস৷ গোটা শরীরকে চালনা করে যে শতদলচক্র, সেদিন কি সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা! ডোপামিন আর সেরাটোনিন কি ভারসাম্যের সূক্ষ্মতা অতিক্রম করেছিল সেদিন৷ জানি না৷ তবে এটুকু জানি হেমন্তের অপরাহ্ন থেকে তারা আমাকে ঘিরে রাখে,তারা আসলে নেই কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করি তাদের অস্তিত্ব ৷সন্ধ্যায় যখন ক্ষেত থেকে চাষীরা ঘরে ফেরে, যখন শহরের বাতিওয়ালারা ট্রান্সফর্মারে যাদুকাঠি ছুঁইয়ে জ্বেলে দেয় আলো, তখন তাদের জন্য আমিও জ্বেলে দিই তেল জড়ানো সলতেগুলি,জ্বলে ওঠে প্রদীপ,তাদের পথ দেখায়,তৈরি করে আলোর সরণী ৷
(৩)
হেমন্ত নবান্নের মাস৷হেমন্ত মানে চাষীর ঘরে সোনা কিন্তু হেমন্ত আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায় পেছনে, স্রোতের উৎসমুখে৷ নবান্নের চালমাখা রেখে আসি ছাদের আলসের এক কোণে,অপেক্ষায় থাকি ওরা আসবে বায়স রূপে, ঠোঁটে তুলে নেবে চালের নতুন স্বাদ,ঘাড় কাত করে টলটলে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেবে, পরিতৃপ্ত ডানায় আমি ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান শুনি...বড় মধুর, বড় মায়াময় সেই ধ্বনি ৷
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪২৬
No comments:
Post a Comment