বেরঙ্গিন
দেবর্ষি সরকার
মানভঙ্গ রোডের উপর দিয়ে কোথাও যেতে হলে বা কোথা থেকে আসবার সময় মানভঙ্গ রোড ধরে যদি আসতে হয় তবে দেখতে পাওয়া যায় সেই রোডের একেবারে পূর্বপ্রান্তে একটি শিমুল গাছ আছে। বছরের বাদবাকি সময় টা গাছটি প্রায় সমভূমিতে ঠিক বৈচিত্রের স্মারক রূপে থেকে যায়। গ্রীষ্ম চলে যায় আপন খেয়ালে, বর্ষাও চলে যায় তার বিদ্যুতের ঢালী উজাড় করে দিয়ে, শরৎ এসে চলে যায় তার পেজা তুলোর মত মেঘকে সঙ্গী করে, হেমন্ত আসে, তবে ঠিক কর্পূরের গন্ধের মতন তার স্বভাব। তার স্পর্শ প্রত্যেক মানব তথা মানবী অনুভব করে ওঠার আগেই সে এসে চলে যায়। শীত কিন্তু বেশ জমকালো ভাবেই আসে। তখন বাদবাকি গাছগুলোর সাথে ওই শিমুল গাছটিও তার সমস্ত শুকনো হয়ে যাওয়া পাতা ঝেড়ে ফেলে শুকনো ডাল গুলিকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকে। তখন দেখলে মনে হয় গাছটির অন্তর আত্মা যেন ওই শুকনো ডালগুলিতেই সীমাবদ্ধ আছে। কিন্তু বর্তমান যুগে হঠাৎ বিদ্যা থেকে প্রেমের দেবী হয়ে পড়া বা সরস্বতী যখন তার সাদা রাজহাঁসে চেপে মর্তে আসেন ঠিক সেই সময় থেকেই যেন এ ধরনির প্রত্যেক নর,প্রত্যেক নারী,প্রত্যেক শিশু,প্রত্যেক জীবানু,প্রত্যেক কীট,প্রত্যেক পতঙ্গের পাশাপাশি প্রত্যেক গাছপালাও তাদের সমস্ত পুরাতন জরাজীর্ণতা ও রুক্ষতাকে ঝেরে ফেলে নতুন করে সজীবতায় স্নাত হয়। এ কেবল জলের ধারায় গাত্রখান নয়। প্রেম, রস, মাধুর্য ,সরসতা প্রভৃতি দ্রবাদির ধারায় স্নান। ঠিক সেই সময় হতেই ওই শিমুলগাছটিও আবার কচি পাতার সাথে বিন্দু বিন্দু রক্তবর্ণ শিমুলের কুড়িকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমরণ বসন্ত পর্যন্ত।
সেই শিমুল গাছটির হেলে পরা ডালটি যেখানে প্রায় মাটিতে মিশবে মিশবে করেও এখনো অধীর আগ্রহে বসে আছে ঠিক সেইখানেই তিন তলা প্রাসাদসম এক গৃহস্থের বাড়ি।বাড়িটি যত বড়ই হোক না কেন তাকে ভোগ করে কেবল মাত্র দুটি প্রানী। আসলে হয়তো আজকালকার ওই দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান নির্ভরতা, প্রযুক্তি নির্ভরতা ও সহজ কৌশল কে প্রেম এইসব কারণেই মানুষ অন্য মানুষের প্রতি কেমন যেন বিতৃষ্ণা পরায়ণ হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন মানুষ নিজেকে এতটাই স্বাধীন ও স্বাবলম্বী ভেবেছে যে তাদের জীবনে অন্য কোন ব্যক্তিকে তারা স্বীকার করার তো দূরের কথা আপন মানুষরূপে গণ্য করা তাদের কাছে এক মস্ত অপরাধের সমান হয়ে পড়ে।
ওই বাড়িটির বাসিন্দা রক্তিম আর সুচেতনার মধ্যেও এমনটাই হয়েছিল বলা চলে। রক্তিম এর বাবা মারা গেছে আজ তার মোট মাট তিন বছর পূর্তি হল। রক্তিমের মা রক্তিম এর জন্ম দিতে গিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাই জন্ম হতে কোনদিন ওই মাতৃসুখ মন দিয়ে প্রাণ দিয়ে উপভোগ করা রক্তিমের কপালে জোটেনি ।তার ভাই বা বোন একটিও ছিল না। সেই ছোট থেকে যে মানুষটিকে মা ও বাবা উভয় চরিত্রে সে সব থেকে বেশি পেয়েছে সেই মানুষটি আজ থেকে তিনটি বছর আগে এমন এক বসন্তের রাতে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় ।ঠিক তারপর থেকেই প্রায় একাই হয়ে ওঠে সে।সকালে উঠে মুখ ধুয়ে কোনদিন চা খেতো আবার কোনদিন চা না খেয়ে ছুটে অফিস চলে যেত। অফিস ছুটির সন্ধ্যা তে হয়ে গেলেও বিনা কারণে রাত পর্যন্ত কোনদিন সমস্ত শহরটা ঘুরে অথবা কোনদিন গঙ্গার ধারে আত্মমগ্ন হয়ে বসে থেকে শেষ রাতে বারোটা বা একটা নাগাদ বাড়িতে এসে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিত বিছানায়। সেই সময় তাকে একটু যত্ন করা ,তার একটু খাতির করা, তাকে খেতে দেওয়া, তার সাথে দু একটি কথা বলার মত কোন মানুষ ছিল না। এইভাবে প্রায় দু বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর গত এক বছর হলো রক্তিম তার সেই সময়ের সব থেকে কাছের বন্ধু অফিসের কলিক স্বর্ণের একমাত্র বোন সুশিক্ষিত ,রুপশ্রী, শান্ত, ধীর অথচ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিজীবী সুচেতনাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। সুচেতনা আসবার পর রক্তিমের হারিয়ে যাওয়া জীবনের সুখ ও শান্তি যেন পুনরায় ফিরে এসেছে। রক্তিম আজকাল সকালে উঠে না খেয়ে অফিসে যায় না ।অফিস থেকে সোজা বাড়িতে আসে। দুই বেলা ঠিকঠাক ভাবে খাদ্য খাবার গ্ৰহন করে ।সুচেতনা রক্তিমের ভেঙে যাওয়া সংসারটিকে পুনরায় যেন জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে।
কাল বসন্ত উৎসব। সুচেতনা ফেসবুক থেকে খোঁজ পেয়েছে যে তাদের বাড়ির কাছেই নাকি ওই তেমাথার মোড়ে যে মাঠটি আছে সেখানে নাকি এবার পৌরসভা থেকে প্রথমবারের জন্য বসন্ত উৎসব করতে চলেছে। তাই সকালবেলা রক্তিম অফিসে যাওয়ার সময় যখন নিজের জুতোতে পা গলাতে ব্যস্ত ছিল সেই সময় রক্তিম কে দেখতে পেরে সুচেতনা তাকে বলে ওঠে, শুনছিলাম কাল বসন্ত উৎসব আছে। তাই বলছি কি আমরা যদি যাইই সেই উৎসবে তাহলে কোন অসুবিধা হতে পারে তোমার? না মানে, আমি তো যাইনি কোনদিন এই সব উৎসবে তাই যদি নিয়ে যাও তাহলে একটু ভালো লাগতো।
রক্তিম ভালো করেই জানে সুচেতনা প্রথম থেকেই একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। তাই রক্তিম মোটেই বিরক্তি প্রকাশ করে না ।রক্তিম সবটা ভালোভাবে বুঝে তার নিজের ঠোঁটের কোণে এক চাপা হাসি সামলে বলেছিল, আর যদি না যাই তাহলে?
সুচেতনা তখন বিরক্তির সঙ্গে বলেছিল, কাল তো তোমার অফিসে দোলের ছুটি ।তাহলে কেন যেতে পারবে না! চলো না মজা হবে। একটু দেখে আসতাম না হয়।
রক্তিম এবার ফ্যাল ফ্যাল করে হেসে উঠে বলেছিল, আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আগে সময়টা আসুক তারপর নিয়ে যাব এই কথা দিলাম । তাহলে এখন অফিসে যাই! চললাম।
সুচেতনা হেসে বলেছিল, আচ্ছা যাও। পাগল একটা।
আর পাঁচটা সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেরকমটা খুনসুটি নির্ভর কথাবার্তা হয় তেমনি সহজবোধ্য কথা দিয়েই দিনটা শুরু হয়েছিল রক্তিমা আর সুচেতনার। কিন্তু তারা কেউ জানতো না যে তাদের জন্য কি বিপদ লুকিয়ে আছে তাদের জীবনটাকে একেবারে বদলে দেওয়ার জন্য।
প্রত্যেক বছর দোল পূর্ণিমার দিন সুচেতনা বাড়িতে মা লক্ষ্মীর পূজা করে তাই এ বছরেও সে পুজো করবে বলে স্থির করেছিল।প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবকিছুই কাল রাতে রক্তিমকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছিল । সুচেতনা প্রথম থেকেই আলপনা দিতে যাকে বলে সিদ্ধ হস্ত। তাই এক হাতে আলপনা দিতে দিতে আর এক খাতে ফোনটা নিয়ে সুচেতনা অফিসে থাকা স্বামীকে ফোন লাগালো। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনতেই এপাশ থেকে সুচেতনা বলে উঠলো, শোনো একটা কথা ছিল।
রক্তিম বললো, হুম,বলো।
সুচেতনা বললো, ভাবছিলাম তোমাকে একটা হলুদ শাড়ি আনতে বলবো।
রক্তিম অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ এই অসময়ে হলুদ শাড়ি?
সুচেতনা একটু হেসে বললো, স্কুল ইউনিফর্ম এর মত বসন্ত উৎসবেরও ইউনিফর্ম আছে ।সেখানে হলুদ শাড়ি ,পাঞ্জাবি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।
রক্তিম বলল, তাই নাকি?
সুচেতনা বলল, হুম।
রক্তিম এবার বলল, আর যদি হলুদ শাড়ি না নিয়ে আসি চলবে!
সুচেতনা বলল,না চলবে না ,তোমাকে নিয়ে আসতেই হবে।
রক্তিম বলল, যদি ভুলে যাই তাহলে?
সুচেতনা বলল, বাড়িতে আসলে মনে করিয়ে আবার পাঠাবো কিনে আনবার জন্য।
রক্তিম বলল,আর যদি বাড়িতেই না আসি! কোনদিন আর না যাই!
সুচেতনা বললো, তাহলে আমি একাই যাবো বসন্ত উৎসবে হলুদ শাড়ি চাইনা আমার। রাখি। এই বলে সুচেতনা ফোনটা কেটে দিলো। তারপর এক মনে আলপনা করতে করতে গান করতে লাগলো "ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে...."
সেই ঘটনার পর আজ সম্পূর্ণ একটা দিন অর্থাৎ চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেছে। সুচেতনার ছেলেবেলা থেকেই অতি কঠিন রোগ আছে। যে মানুষকে সব থেকে বেশি কাছের বলে সে মনে করে তার কাছ থেকে কিছু চাইলে সে যদি না দিতে চায় তাহলে জোর করে কিভাবে তার কাছ থেকে সেই জিনিস আদায় করে নিতে হয় সে প্রক্রিয়া সুচেতনা ভালোভাবেই জানে। তাই সুচেতনা ওভাবে বলবার পর রক্তিম অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় কাছের বাজারের শাড়ির দোকানে। সেখান থেকে নিজে পছন্দ করে একখানা হলুদ ও লাল রঙের জামদানি শাড়ি কিনে নিয়ে আসে সুচেতনার জন্য। তারপর তার বাড়ির কাছে যে উড়ালপুলটা আছে সেখানে আসতেই তার ক্যাবটি খারাপ হয়ে যায় ।তাই সেখানেই ক্যাবের মালিককে তার ভারা মিটিয়ে বাকি অল্প পথটুকু রক্তিম পায়ে হেঁটেই আসছিল।কিন্তু বাড়ির কাছে আসতেই ঘটে গেল মহাবিপদ। সুচেতনা সবে মাত্র পুজো সেরে উঠেছে। অমনি দুম করে একটি শব্দ সুচেতনার কানকে যেন ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে নিচে দাঁড়াতেই যা পরিস্থিতি তার চোখে দৃশ্যের মতো ফুটে উঠলো তা তার পক্ষে মেনে নেওয়া ছিল অতি অলিক ব্যাপার। যে মানুষটির সাথে একটু আগেই সে কথা বলল সেই মানুষটাই এখন চিত হয়ে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে রাস্তার মাঝে, সমস্ত রাস্তা ভেসে যাচ্ছে তার লাল রক্তে।তারপর সুচেতনার কিছু মনে নেই ।যখন তার জ্ঞান ফিরলো সে দেখতে পেলে সকলে সবেমাত্র রক্তিমের মৃতদেহটা কাঁধে নিয়ে শ্মশানের দিকে নিয়ে গেল। কি হতে কি হয়ে গেল তার জীবনে!
দলে দলে মানুষ হলুদ সাজে সেজে সেই রাস্তা দিয়ে বসন্ত উৎসবে যাচ্ছে যে রাস্তায় রক্তিমকে কাল বিকেলে পিকআপ ভ্যান পিষে দিয়ে চলে গিয়েছিল। সেই শিমুল গাছটার ধারে যে জানালাটি আছে সুচেতনার বাড়িতে ঠিক সেইখানেই এসে বসেছিল সে। হঠাৎ এক রক্তিম শিমুল ফুল গাছ থেকে ঝরে এসে পড়ল সুচেতনার পরনে থাকা সাদা থানটির উপর। বসন্ত সবাইকে রাঙিয়ে দিতে আগ্ৰহী। তার কাছে ভেদাভেদ নেই।
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা
'আনন্দ বসন্ত সমাগমে....`
No comments:
Post a Comment