যখন বৃষ্টি নামে
মধুমিতা(সপ্তক)
পাঁচমোড় থেকে চা বাগানের লাস্ট বাস চারটের সময়, এখন তিনটে বেজে গিয়েছে। অথচ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থার্ড পিরিয়ডের পর থেকে শুরু হয়েছে, আর থামার নাম গন্ধ নেই। বারান্দা ছেড়ে সবাই ক্লাসরুমে ভীড় করেছে। এতক্ষণ হইহই করে অন্তাক্ষরী চলছিল, এখন ইতস্ততঃ গল্পগুজব চলছে। অন্যদিন হলে মৌতান হয়তো শর্বরীদের বাড়িতে থেকে যেতে পারতো, কিন্তু আজ বাড়িতে ভাই একা; বাবা, মা দুজনেই ছোটকার বাড়িতে গিয়েছে। আজ বাড়ি ফিরতেই হবে। এস কে স্যারের ক্লাসটা করার জন্য আর সঙ্কল্পর থেকে ক্লাসনোটের খাতাটা ফেরত নেবার জন্যই আসা। কিন্তু সঙ্কল্পর তো খাতা ফেরত দেবার নামই নেই। সেই যে ফার্স্ট পিরিয়ডে একবার দেখা দিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। কখনো ঠিকঠাক ক্লাস করবে না, তারপর মৌতানের থেকে খাতা নিয়ে আটকে রাখবে, চাইতে চাইতে যখন মৌতানের মেজাজ গরম হবে তখন ফেরত দেবে।এরপর থেকে আর খাতা দেবে না সে।
অরিজিৎ বসে বসে অনেকগুলো নৌকো বানিয়ে ফেলেছে। মৌতানকে ডাক দিয়ে বলল, "কিরে, প্যাঁচার মত মুখ করে বসে কি ভাবছিস? চল, নৌকো ভাসাবি চল।" মৌতান দুটো নৌকো তুলে নিয়ে বারান্দা থেকে ভাসিয়ে দিল মাঠের জলে। দেখাদেখি অনেকেই ভাসালো। গন্তব্যহীন এলোমেলো ভেসে চলেছে এতগুলো কাগজের নৌকো। দারুন লাগছে দেখতে। অতসী গান ধরলো, " টাপুর টুপুর, বৃষ্টি নুপুর....."। পেছন থেকে সঙ্কল্পর গলা পাওয়া গেল, " আহা, অতসী থ্যাঙ্কু, এরকম একটা মেজাজ তৈরী করার জন্য।" গান শেষ হবার আগেই কোথা থেকে অনির্বান হইহই করতে করতে এলো, "শোন একটা মজার কথা, পি এম স্যার আর মল্লিকা ম্যাম একেবারে এক ছাতার তলায়, ওইভাবে গাড়িতে উঠতে গিয়ে পুরো আধভেজা।" সৌরিশ টিপ্পনী কাটল, "তাতে, তোমার এত পুলকের কারন কি চাঁদু, তাতে কি তোমার ঘরে চাঁদের আলোটা আজ একটু বেশী পড়বে?" সঙ্গে সঙ্গে হাসির ঢেউ উঠলো। সঙ্কল্প মৌতানের কানের কাছে গিয়ে বলল, " এখন যদি তুই ছাতা, বর্ষাতি ছাড়াই মাঠ পেরিয়ে ওই গেট অবধি গিয়ে আবার দৌড়ে আসতে পারিস, তাহলে আমি তোকে বিরিয়ানি খাওয়াবো।" মৌতান আর রাগ গোপন করতে পারলো না, "বাজে বকা বন্ধ করে আমার খাতা ফেরৎ দে আগে।" মিটি মিটি হেসে দুই কানে হাত দিল সঙ্কল্প, " সরি, খাতাটা আজ নিয়ে আসিনি রে, কাল ঠিক নিয়ে আসবো।" রাগে গা পিত্তি জ্বলে গেলো মৌতানের, "শোন, এবার তোর নামে ঠিক আমি প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেন করবো, বলবো, সামনে পরীক্ষা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে তুই আমার খাতা আটকে রেখেছিস। তখন বুঝবি।"
"বাব্বা!! পুরো হাজার ভোল্ট হয়ে গেছিস দেখছি!!!" সঙ্কল্প তখনো মিটি মিটি হেসেই চলেছে। আরো মাথা গরম হয়ে গেলো মৌতানের, "আসলে তুই হিংসে করিস আমাকে, চাস যে আমি কম নম্বর পাই আর হায়েস্ট মার্কস সবসময় তোর দখলেই থাকুক।"
"আরে বাবা, কুল ডাউন! কুল ডাউন! এই দ্যাখ নিয়ে এসেছি তোর খাতা, "ব্যাগের থেকে খাতা বের করল সঙ্কল্প। এক ঝটকায় খাতাটা নিয়ে ব্যাগে ঢোকালো মৌতান, "আর আমার থেকে যদি খাতা চেয়েছিস!!!" ওদিক থেকে শর্বরী ডাক দিল, বৃষ্টি ধরে এসেছে মৌতান, চল বেরিয়ে পড়ি।" সঙ্কল্প বাধা দিলো, "ক্যান্টিনে হিরুদা গরম গরম চপ ভাজছে; চল, খেয়ে তারপর যাবি।"
"আমি এখন সোজা বাড়ি যাবো," মৌতান আর দাঁড়ালো না। যেতে যেতে শুনলো রিতিকা বলছে, "আমায় খাওয়াবি রে সঙ্কল্প, প্লিজ!" সঙ্কল্পর গদগদ গলা পাওয়া গেলো, "ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, ইটস মাই প্লেজার, শিগগির চল।" একবার পেছনে তাকালো মৌতান, বাঃ!!! দিব্যি রিতিকার সাথে ক্যান্টিনের দিকে চলেছে, মৌতানকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলো না পর্যন্ত!!! রিতিকাসুন্দরীকে দেখে একেবারে গলে গিয়েছে। চাইতে আসুক এরপর খাতা! খাতা দেয়া তো দূর, কথা বলবে না পর্যন্ত। আর রিতিকাকে দ্যাখো!! মনে হয় জীবনে চপ খায়নি।
দুজনে পাঁচমোড়ে পৌঁছে শুনতে পেলো, লাস্ট বাস বেশ কিছুক্ষণ আগে চলে গিয়েছে। পাঁচমোড়েই শর্বরীদের বাড়ি, আগে অনেকবার থেকেছে মৌতান, আজও জোর করলো থেকে যাবার। কিন্তু মৌতান চারপাশে তাকিয়ে দেখল বাগানে যাবার অনেক যাত্রী অপেক্ষা করছে। শর্বরীকে বলল, "দ্যাখ, এরা সবাই নিশ্চয়ই যে যার বাড়িতে ফিরবে, অতএব আমিও ফিরতে পারবো। শর্বরী তাকিয়ে দেখলো, তারপর বললো, "এদের মধ্যে কোনো মেয়ে নেই কিন্তু, তাছাড়া সবাই দেখছি মুটেমজুর, তোর অচেনা, এরা যে কোনোরকম ভাবে ট্রাকে চেপে হোক, ভ্যানে করে হোক, চলে যেতে পারবে, তুই পারবি না মৌতান।" "আজ যদি আমার জায়গায় একটা ছেলে থাকতো, সে কি এত কিছু ভাবতো? আমিও ভাবতে চাই না। আজ আমি যেভাবেই হোক বাড়ি পৌঁছাবো।" জেদী শোনালো মৌতানের গলা। "অসুবিধে হলে ফোন করিস, "চলে গেলো শর্বরী অগত্যা।
বৃষ্টিটা থেমেছে, কিন্তু আকাশটা আরো কালো হয়ে থম মেরে আছে। বিকেল পাঁচটার দিকে একটি ট্রেকার এলো। হুড খোলা ট্রেকারে একটা ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। তার ভেতরে হাটফেরত সমস্ত লোকজন, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়ির ভেতর মুরগিও সদলবলে চলেছে, ট্রেকার আসতেই হুড়মুড় করে লোক ওঠা শুরু করলো। ড্রাইভার চ্যাঁচাচ্ছে, "লাস্ট গাড়ি, লাস্ট গাড়ি, ব্লু হিল চা বাগান।" কিন্তু এইরকম ভয়াবহভাবে গুঁতোগুঁতি করে যাওয়া মৌতানের অসাধ্য। সে অসহায় ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। এমনসময় ড্রাইভার সামনে এসে বলল, "মামণি, কোথায় যাবে?" অন্যসময় হলে মামণি ডাক শুনলে হয়তো ক্ষেপে যেতো, কিন্তু এখন বিপদের সময়, সে বললো, "ওই ব্লু হিলেই যাবো।" "তাহলে এদিকে এসো" বলে ড্রাইভারের পাশের সিটে জায়গা করে দিলো মৌতানকে। মৌতান দেখলো ড্রাইভার ছাড়াও আরো একজন রয়েছে। সে চুপচাপ উঠে বসলো।
বাড়িতে যখন পৌঁছালো, শরীর ভীষন ক্লান্ত। ভাই বেরিয়েছে। অনুমাসিকে চা করতে বলে সে ফ্রেশ হয়ে নিল। এখন শরীরটা অনেক হালকা লাগছে। চা খেতে খেতেই শর্বরীর ফোন এলো, "কিরে, পৌঁছেছিস?" মৌতান সংক্ষেপে জানালো সবটা। শর্বরী শুনে বললো, "তোর জেদেরই জয় হলো বল?"
-"আজ আমি দুটো জিনিস বুঝলাম। এক, যত আমরা পড়াশুনো করে শিক্ষিত হই, ততই আমাদের মধ্যে ক্লাস কনসাসনেস জাঁকিয়ে বসে। আর সেজন্যই ওই লোকগুলোর সঙ্গে একসাথে আসতে আমার অত অস্বস্তি হচ্ছিল। আর দুই, মেয়েদেরকে এখনও করুনার চোখেই দেখা হয়। আমি মেয়ে বলেই করুণা করে ড্রাইভার জায়গা করে দিয়েছিল। ছেলে হলে দিতো না।" মৌতানের আর কথা বলতে ভালো লাগছিলো না, সে ফোন রেখে দিলো।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে বই নিয়ে বসল। সঙ্কল্পর কাছে খাতাটা আটকে ছিলো বলে অনেক নোট তৈরী করা হয়নি। খাতাটা খুলতেই একটা চিরকুট পেলো। তাতে লেখা, "তোর খাতা একটু ইচ্ছে করেই আটকে রাখি, কেন জানিস? মনে হয়, তুই আমার সঙ্গেই আছিস, সারাক্ষণ তোর গন্ধ পাই। আর হ্যাঁ, খাতার পেছন দিকে দ্যাখ, ফিফথ পেপারের দুটো নোট তৈরী করে দিয়েছি।" লেখাটা পড়তে পড়তে যেন মনের সব মেঘ উড়ে যাচ্ছিলো, এক আশ্চর্য ভালোলাগা কখন এসে জুড়ে বসলো মনের ভেতর। সে ফোনটা নিয়ে মেসেজ করলো, "সরি সঙ্কল্প, আজ আমার এইরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি, পারলে ক্ষমা করিস।"
(মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা)
No comments:
Post a Comment