Thursday, July 2, 2020

কৃষ্ণভ্রমর
সোমা বোস

        জানালা দিয়ে আনমনে আড়চোখে তাকাতেই ভ্রমরের দৃষ্টিতে ধরা পরলো ঈশান কোণে ঈশানী… আকাশের ঈশান কোণে ঘনকৃষ্ণ মেঘের সঞ্চার। আনলক টু'য়ের তিনদিনের অফিসের পরেও আজকে তার ল্যাপটপে "ওয়ার্ক ফ্রম হোম" চলছে। কিন্তু তার মন সেই কাজ থেকে মনোনিবেশ সরিয়ে একছুটে সোজা দোতলার ব্যালকনি কাম অর্ধেক ছাদে তাকে বের করে আনলো। রিমঝিমকে বেশ কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাওয়া গেলো না। রুদ্রও আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছে। যাক, ওরা যখন আসার তখন আসবে। এদিকে এলোমেলো হাওয়ায় আসতেই তার কুঞ্চিত কেশরাশির দফারফা। ঘাড়ের পাশ দিয়ে, কপালের ওপর দিয়ে মুখের ওপরে চলে আসা চুলের গোছা অসহিষ্ণু হাতের আঙুলের সাহায্যে সামলাতে সামলাতে ভ্রমরের মনে হলো সামলানোরই বা কী দরকার! থাক না যে যেমন খুশী। এখন আর কিসের চুলের মায়া! তাছাড়া এখন তার কোঁকড়া চুল মাত্র ঘাড়-সমান লম্বা। অথচ  তাতেই এতো জট পাকিয়ে যায় রোজ! পাতলা চিরুনীগুলো তো টিঁকতেই পারে না, মট করে দাঁড়গুলো ভেঙে যায়। তাও তো চুলের গোছ আগের থেকে কতো কমে গেছে। অবশ্য তার অসহিষ্ণু হাতের অত্যাচার নিত্য সহ্য করে আর কতোদিনই বা টিঁকবে অসহায় চিরুনীগুলো! মনে পরে যায় ছোটবেলায় ঠাম্মার কথায় বাবা তাই মোটা দাঁড়ের চিরুনী এনে দিতো। খুব যত্ন করে ঠাম্মা তার মাথার তালুতে বেশ করে তেল ঠেসে দিয়ে তারপর গোটা চুলে তেল মাখিয়ে দিতো। তারপর আঙুল দিয়ে দিয়ে কেমন করে যেন আস্তে আস্তে চুলের সমস্ত জট ছাড়িয়ে নিতো। এরপর কাঠের মোটা চিরুনীটা দিয়ে আস্তে আস্তে মাথাটা আঁচড়ে দিতো যাতে একটুও টান লাগতো না তার। তারপর চুলটাকে দুটো ভাগ করে নিয়ে দুপাশে দুটো লম্বা বিনুনি করে মাথার ওপরে তুলে বেড়াবিনুনি বেঁধে দিতো। সেসব কবেকার কথা। ভ্রমর স্কুলেই ভর্তি হয়নি তখনো। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর রাতে তেল মাখলেও সকালে মাথায় শ্যাম্পু করে স্কুলে যাওয়া অভ্যেস হলো। এই ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে ঘনঘন ন্যাড়াও করা হতো তাকে। অবশ্য গরম থেকে রেহাই পেতেও ন্যাড়া হওয়া ছিলো এক উত্তম পন্থা। 




       আকাশের অপরূপ শোভা দেখতে বাধা পাওয়ার দরুণ চোখের ওপরে এসে পরা অবাধ্য চুলগুলোকে সরাতে সরাতে এই চুল নিয়েই আরও কতো কথা মনে পরতে থাকলো। আসলে নাকি এই কুঞ্চিত কেশরাশি, কৃষ্ণবর্ণা ভ্রমরের মুখের সাথে বেশ মানিয়েছিলো। আর তাতেই মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পরেছিলো রুদ্র। পরে এসব শুনে অত্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিলো ভ্রমর। প্রেমের বাজারে সাধারণত একঢাল অকুঞ্চিত কেশের অধিকারী গৌরবর্ণাদের জনপ্রিয়তাই সর্বাধিক। আসলে কবিমনের অধিকারী রুদ্রের প্রিয় ঋতু বর্ষা। তাই বর্ষার কালো মেঘের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তার পাত্রী নির্বাচন ছিলো। সুখে দিনাতিপাত ছিলো সেই দাম্পত্যের। অচিরেই তাদের প্রথম সন্তান... কন্যা রুদ্রাণী এসেছিলো তাদের মাঝে। সময়টা ছিলো আষাঢ়ের এক বজ্র-বিদ্যুৎসহ বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। প্রচুর বজ্রপাতে চারিদিকে যেন চমকে চমকে উঠছিলো সবকিছু। তারই মাঝে সময়ের অনেক আগে ভ্রমরের প্রসববেদনা শুরু হয় এবং অচিরেই তা তীব্র হয়। তড়িঘড়ি রুদ্র নিজে গাড়ী ড্রাইভ করে নিয়ে আসে নার্সিংহোমে। মেয়ের মুখ দেখে রুদ্র তখনই নামকরণ করে রুদ্রাণী। এ নিয়ে পরে ভ্রমর আপত্তি জানায়। ছেলের নাম রুদ্র হলে তবু ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ের নাম রুদ্রাণী হলে কেমন যেন বিনাশকারী মনে হবে না! মঙ্গল অমঙ্গল বলেও তো একটা কথা আছে! কিন্তু রুদ্রের এক কথা। তাদের মেয়ে নাকি বজ্রের মতো তেজস্বিনী হবে। এ যুগে ওরকম রমণীই প্রয়োজন। নারী হবে শক্তির আধার, ওরকম নরমসরম হলে চলবে না। কবি রুদ্রের মুখে একথাগুলো তখন ভুতের মুখে রামনামের মতোই শোনালো যেন! বিধাতা বোধকরি অলক্ষ্যে হেসেছিলেন সেদিন। মায়ের মতোই রুদ্রাণীর মাথায়ও একঢাল কালো কুঞ্চিত কেশরাশি দেখে স্বভাবতই রুদ্র আপ্লুত। 




         এতো জট পড়তো যে সহজে চুলে চিরুনী দিতে চাইতো না রুদ্রাণী। আসলে চুলে টান লাগতো যে, তাছাড়া ঠাম্মার মতো ভ্রমরের অতো ধৈর্য ছিলো না আস্তে আস্তে সেই জট ছাড়ানোর। অসহিষ্ণু হাতের চিরুনী চালানোতে স্বভাবতই ব্যাথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠে ছোট্ট রুদ্রাণী মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে যেতো অনেক দূরে। সেবারও ওরকম অনেক দূরে চলে যাওয়াতে তাকে খুঁজতে বেরোয় ভ্রমর। আচমকা আকাশ কালো করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে রাত্রির মতো। সাথে আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমক এবং ঘন ঘন তীক্ষ্ণ আওয়াজযুক্ত বাজ পরা। সকলে ভয় পেয়ে ঘরে ফিরতে থাকে। একটা বাজ তো মনে হলো যেন খুব কাছে কোথাও পরলো। অকস্মাৎ এক তীব্র আর্তকান্নার রোল এলো কানে, তারপর সব চুপ। এদিকে বৃষ্টির মধ্যে ছোট্ট রুদ্রাণীকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হতাশ ভ্রমর ক্লান্ত হয়ে বসে পরে একজায়গায়। আর ঠিক তারপরই রুদ্রাণীর নিথর দেহ কোলে করে নিয়ে আসে পাড়ার কয়েকজন। বাজ পরে পুরো শরীর কালো হয়ে গিয়েছিলো তার। তারপর আর কিছু মনে নেই ভ্রমরের। শুধু মনে আছে এরপরে নিজের লম্বা কেশরাশিতে এলোমেলো কাঁচি চালিয়ে কেটে ফেলেছিলো সে।                                                     




        চড় চড় চড়াৎ… পূর্ব পশ্চিম বরাবর আকাশের বুক চিরে এক তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেলো। তার সাথে তীক্ষ্ণ এক বুক কাঁপানো গুরুগম্ভীর আওয়াজ যেন তাকে শাসিয়ে উঠলো ঘরে ঢোকার জন্যে। ওই আবার, আবার! আবার সেই সবকিছু স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো কি ভয়ানক আওয়াজ! অন্যের কাছে এই আওয়াজ বড়ো ভয়ানক মনে হলেও এই তীক্ষ্ণ আওয়াজ যে তার বড়ো চেনা! মূহুর্তে ছোট্ট রুদ্রাণীর নিথর দেহটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না ভ্রমর। তাই এই আওয়াজের সাথে একাত্মবোধ করে সে ছুটে চলে যায় ছাদের একেবারে কিনারে, আহ্বান করে সেই আলোর ঝলকানি ও আওয়াজকে। "নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর। হে গম্ভীর, হে গম্ভীর"... এসো হে বজ্রসম প্রাণ আমার, এসে আমায় মিলিয়ে যাও। আমাতে সম্পৃক্ত হও। আমি তোমাকে আহ্বান করছি, এসো আমাকে আলিঙ্গন করো। আবার গগনভেদী চড় চড় চড়াৎ আওয়াজে কেঁপে উঠলো সমগ্র দিক। কোনও ঘর থেকে ভেসে এলো শিশুর আর্তকান্না। ঠিক এসময়েই আকাশ ভেঙে অঝোরধারায় ভারী বর্ষণ নেমে এলো। যেন সমস্ত আর্তনাদের আওয়াজকে ছাপিয়ে, বুকের মাঝের অব্যক্ত অনুভূতির যন্ত্রণায় এক স্নিগ্ধ, করুণ কোমলতার পরশ দিতে ধরায় নেমে এলো বর্ষা। তাপিত হৃদয়কে শান্ত শীতল, ও সমাহিত করাই যেন তার উদ্দেশ্য।  

           বৃষ্টি নামতেই বাজ পড়া থেমে গেলো এবং ভ্রমরের সমস্ত বাঁধ যেন মূহুর্তে ভেঙে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজে ছাদের কার্ণিশ শক্ত করে ধরে এক অসহায় বোবাকান্নায় ভেঙে পরলো সে। আরেকবার যেন বরাবরের মতো হারিয়ে গেলো তার রুদ্রাণী! "মা, ও মা… আর কেঁদো না মা তুমি। শান্ত হও, শান্ত হও" বলে এবারে মা'কে জাপটে ধরে আকুল হয় কন্যা রিমঝিম... ভ্রমর ও রুদ্রের দ্বিতীয় সন্তান। তার জন্ম পরের বছর আষাঢ়ে। এবার আর রুদ্রকে কন্যার নামকরণ করতে দেয়নি ভ্রমর। সে নিজেই তার নাম রেখেছিলো। এই রিমঝিম যেন তার নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের জীবনকে সত্যিই বর্ষণমুখর সঙ্গীতে ভরিয়ে দিয়েছে। তবু আজ এতো বছর পরেও আকাশভেদী তীব্র বজ্রপাত যেন আচমকা ভ্রমরের মধ্যে রুদ্রাণীকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র করে তুলেছিলো। এদিকে আষাঢ়ের প্রবল বৃষ্টি মাথায় করেই রুদ্র এসে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। মা ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভ্রমরের কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশে সযত্নে বিলি কাটতে কাটতে গেয়ে ওঠে... "এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে। দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ..."।           

(মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা)

No comments:

Post a Comment