`চেনা পথেই বারবার...`
সেবকের হাতছানি
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমি কাটাতে ভ্রমণপিপাসু মন নতুন নতুন পথের খোঁজে উৎসুক হয়ে বারেবারে ঘরছাড়া করে কত মানুষকে তার ইয়ত্তা নেই। চিকিৎসা, জীবিকা,পড়াশোনার কারণে চেনা গন্ডী ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় কতশত মাইল, স্পর্শ করতে হয় অজানা কত পথকে। এছাড়াও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর কোনো এক সুদূর প্রান্তে উত্তরসূরীদের স্থায়ী বসবাসের কারণে সমূলে উৎপাটিত হয় বাবা - মায়েদের নিজেদের পথের ঠিকানা।এক জীবনে কত পথকে যে আমরা প্রত্যক্ষ করি,মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে আঁচল ভরে তার সুমধুর স্মৃতির ফুলগুলিকে জড়িয়ে নিই আবার নতুন নতুন পথের দেখাশোনায় পুরোনো যা কিছু ধূসরতার ধূপছায়ায় হারিয়েও যায় হয়তো বা,কিছু চেনা পথ অচেনা হয় বিস্মৃতির অন্তরালে। তবুও মনের কোনো এক নিবিড় কোণে বিজয়ীর হাসি হাসে সেই সোনাঝরা টুকরো টুকরো মুহূর্তেরা যারা সাক্ষী থাকে সেইসব নতুন দেখার, নতুন আলাপের, নতুন পথ প্রণয়ের মায়াবী আলেখ্যের।বিনিসুতোর গ্রন্থিতে অমলিন থাকে পথ ও পথিকের সেই পথচাওয়া ও পথচলা।
অপ্রত্যাশিত কোনো দেখা,সে যদি মনোমুগ্ধকর হয় তবে ছক কষে ঘুরতে যাবার আনন্দের চাইতেও তা কয়েকগুণ বেশি আহ্লাদ জোগায় বলাই বাহুল্য। হতে পারে সে দেখা নেহাতই হাতের কাছেই কোথাও। অন্য জায়গায় যাবার পথে সে পথ দিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার পার হয়েও তাকে কাছ থেকে সেভাবে প্রত্যক্ষ করা হয়নি,হয়তো বা নির্ধারিত ভ্রমণের জায়গাগুলি নিয়ে ঘিরে থাকা রোমাঞ্চ,আগ্রহ এবং দ্রুত পৌঁছোনো বা ফেরার তাগিদে।
তেমনই এক পথকে স্পর্শ করলাম মাত্র কিছুদিন আগেই শিলিগুড়ি হয়ে বীরপাড়া যাবার সময় যা সকলেরই প্রায় কমবেশি পরিচিত একটি পথ, সেবক। গাঢ় সবুজ বনানীকে দুপাশে রেখে এগোতে এগোতে একসময় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ শুরু হতেই পাশে চলে এল তিস্তা তার সবটুকু রূপ লাবণ্য নিয়ে। এরপর পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া মনকাড়া সেই রেলপথ আর তারপর ব্রিটিশ আমলের সেই ঐতিহ্য করোনেশন সেতু সমস্তটুকু আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে।পাহাড়ঘেরা সে জনপদ যেন হাতছানি দিল যাত্রায় ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে একটু দাঁড়িয়ে যেতে।মন বলল, 'চলো আলাপ করি।'
আকাশ ছুঁয়ে পাহাড় চূড়োর মাথা দিয়ে যেন ধোঁয়া ধোঁয়া এক আবেশ। নজরকাড়া সে দৃশ্যে মোহিত হবেই মন।মেঘেরা দলে দলে সখ্য করে রোদেলা দিন আর ফুরফুরে বাতাসের সঙ্গে সন্ধি করে আকাশের বুক ছেড়ে অনেকটা নীচে তখন। নদীর টলমলে জলে আকাশের গাঢ় নীল, পাহাড়ের সবুজ,পাশ ঘেঁষে দিগন্তের ছায়াময়তা ও অদূরে রমনীয় পাহাড়ের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য্য। কোনো এক নামজাদা শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত এক ছবি যেন। পাকদন্ডী পথে অজস্র যানবাহনের চলাচল অনবরত জারি। সুন্দরকে দেখার চিরন্তন আকর্ষণে তবুও আমরা ও আমাদের মতো আরো কিছু মানুষ সেই পথেই তখন।অচানক গাড়ি এসে পড়লে ভরসা পাশঘেঁষা পাহাড়ের পিচ্ছিল পাদভূমি। সেতুটির একটি দিকের প্রবেশপথের দুদিকে দুটি নজরকাড়া বাঘের মূর্তি। পথের প্রান্তে অজস্র বাঁদর নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।আশমানী নীল আর পাহাড়িয়া সবুজের ঐক্যবদ্ধ ছন্দময়তার রূপে এবং তিস্তার ভরাট লাবণ্যে বর্ষার প্রকৃতি এখানে ভরা যৌবনা। সময় হাতে থাকলে শুধু অপরূপ পাহাড়ের সারি আর আশ্চর্য সুন্দর নীলাভ আকাশকে দেখেই কাটিয়ে দেওয়া যায় বহুক্ষণ।এমন দৃশ্যের কাছে এসে মৌনতা ভালো লাগে। হাতের কাছের প্রকৃতিও তো সেই শিক্ষাই দিয়ে যায়। প্রকৃতির নিজস্ব আওয়াজ গুলিকে পরখ করতে মন চায়।ছবি, ভিডিওতে ধরে রাখতে চাইলেও তো তা নিঃশব্দে করা যায়। কিন্তু কিছু দলবদ্ধ মানুষের উদ্দামতা,উন্মাদনা ও অবিরাম বলে চলায় খেই হারায় নিবিড় করে দেখা ও পাওয়ার মুহূর্তগুলি।পথের দুপ্রান্তে সামান্য ব্যবধানে দুটি ঝর্না দৃষ্টিসুখকে নিজেদের সেরাটুকু উপহার দেবে বলে যেন বদ্ধপরিকর। সেতুর নীচে ধাপকাটা নিম্নগামী পথ ও সবুজ জঙ্গলকে পাশে রেখে ও ওপরের নির্মল আকাশকে সাক্ষী রেখে নিজস্ব ভাষায় কথা বলে ও গান গেয়ে বয়ে চলেছে একটি ঝর্ণা নিজস্ব আবেগে।আর একটি যেন উত্তাল এক প্রবাহ। নিজের অস্তিত্বের ঘোষণা করছে সে চরাচরকে সচেতন করে। উৎসের সুদূর এক ঠিকানা থেকে বেগবতি এক অবিরাম ধারাপ্রপাত হয়ে নয়ন জুড়োনোর দায়ভার নিয়েছে সে যেন। পাহাড়ের রোমশ বুকজুড়ে আদর চুঁইয়ে সরব হয়েছে তার ভালোবাসার বান। উচ্ছল এক পাহাড়ি কন্যা যেন ঝর্ণার রূপ ধরে ধ্যানমগ্ন পাহাড়ের মৌনতায় কড়াঘাত করতে এসেছে, মান ভাঙাতে এসেছে তার। ঠিক কাছেই আর এক আনন্দ কুঠি। ঝর্নার অনতিদূরে সেতুর পিচ্ছিল নোনাধরা দেওয়াল ঘেঁষে পাঁকে পদ্মফুলের মতোই পাঁপড়ি মেলেছে অজস্র প্রজাপতি।দেখে অবাক হতে হয় তারা সবাই রঙে ও চেহারায় অবিকল একই দেখতে। পাখায় তাদের অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য। পাশের ওই প্রাণবন্ত বন্ধু ঝর্ণা প্রজাপতির দলকে প্রাণময়তার পাঠ দেয় নিরালা অবকাশে সুনিশ্চিত। রঙিন পাখায় পাখায় প্রজাপতিরা লেখে জীবনের জয়গান। মন্ত্রমুগ্ধ মন বলে, 'আবার দেখা হবে।' সেবকের পথ ছুঁয়ে যাবতীয় দেখাগুলি অপার আনন্দ হয়ে ঠাঁই নেয় মনের মণিকোঠায়।
অথচ প্রাপ্তির ঘরে এর কানাকড়িও জুটবে এমন কোনোভাবেই নির্ধারিত ছিল না সে দিনটির তালিকায়। আমার মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থতার কারণে তার আগে বেশ কিছুদিন ধরে সারাদিনের সমস্ত পথ মায়ের পথে গিয়েই মিশছিল শুধু উদ্বেগে,কর্তব্যে আর ফিরে দেখা স্মৃতির সাম্পানে। বহুদিন ধরে শয্যাশায়ী মাকে নিয়ে সবরকমের মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মন তো চরম সেই পথের দিকে চেয়ে কিছুতেই তাকে মেনে নিতে চায়না।খবর পেয়ে কান্নাকাটি করতে করতে অনেক দূরপথ পার হয়ে নিজের চাকরিস্থল থেকে ছুটে এসেছিল আমার মেয়ে। মা আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো আছেন দেখে শিলিগুড়িতে এক নিকট আত্মীয়ের শ্রাদ্ধের কাজে যোগদান করে মেয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী সেখান থেকেই ওর ঠাকুমাকে দেখতে বীরপাড়ার পথে রওনা দিয়েছিলাম আমরা। এর মাঝে প্রকৃতির এই মনকাড়া মাধুর্য্য অনেকটাই প্রলেপ হয়েছিল আগামীর পথচলার। সেদিনের সেই সেবককে দেখা অপ্রত্যাশিত ছিল বলেই হয়তো সেই পথ আরো বেশি করে মন ছুঁয়ে গিয়েছিল তার উজাড় করা সুন্দরের পসরা নিয়ে। মনের কষ্ট লাঘব হয়েছিল কিছুটা প্রকৃতির এই অনিন্দ্যসুন্দর নিরাময়ের আয়োজনে।
তবুও ছুঁয়ে আসা হলোনা সবটুকু। সেবকের অধীশ্বরী আরাধ্য দেবী মা সেবকেশ্বরীর কাছে পৌঁছোনো হলোনা। অধরা ইচ্ছেটুকুই হয়তো বা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে নিয়ে যাবে আবার কখনো সেবকের পথে।অন্য কোনো এক ঋতুতে অন্যভাবে প্রত্যক্ষ করা হবে সেই একই পথকে তার বৈচিত্র্যের আবেশ নিয়ে।অল্পে খুশি চাওয়া পাওয়ার পথে এভাবেই জুড়ে যাবে রং বেরঙের আলো আর খুশির পালকগুলি।
No comments:
Post a Comment